আগামীর ডাক
আগামীর ডাক


বাসে উঠে জানলার ধারের সীটটা ফাঁকা আছে দেখেই, মনটা খুশি হয়ে গেল সায়ন্তনীর। কপাল ভাল, মনে মনে বলল ও, আজকের গোটা দিনটাই যেন এমনি ভালভাবে কাটে। ইন্টারভিউটার ওপর ওর অনেক কিছু নির্ভর করছে। একটা ম্যাসিভ স্যালারি জাম্প, আর সেই সঙ্গে স্ট্যাটাসও। ছোট্ট অনামী অফিসটার, ততোধিক ছোট একটা কিউবিকলে আটকে থেকে, আর ঘেমো বসের বকবকানি শুনতে শুনতে মাথা ধরে যায় রোজ, আর ভাল লাগছে না। ও এবার একটু উড়তে চায়।
সিটে গুছিয়ে বসে, সবে ব্যাগটাকে কোলের ওপর রেখেছে, অমনি পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল, "মা "। "কে?", ঘাড় ঘুরিয়েও ও কাউকে দেখতে পেল না। পেছনে এক বয়স্কা মহিলা জানলার বাইরে উদাস ভাবে চেয়ে রয়েছেন, আর তার পাশের ভদ্রলোক চশমার আড়ালে অল্প ঢুলছেন। গলাটা একটা বাচ্চা ছেলের, কিন্তু কোথায় কে? মনের ভুল ভেবে ব্যাগ থেকে পার্শটা বের করে, বাস ভাড়ার টাকাটা বার করতে গেল সায়ন্তনী। হঠাৎ ওর কানে কানে সেই গলাটা আবারও বলে উঠল, "মা ,শু-শুনতে পাচ্ছ না? আমি।" আবার ঘুরে ফিরে সবদিক দেখেও, কাউকে দেখতে পেল না সায়ন্তনী। অবাক কান্ড! এ তো আশেপাশের কারো কাজ নয়, তাছাড়া কথাটা কানের কাছে এসে কেউ যেন ফিসফিস করে বলছে। এবার ও একটু ভয়ও পেল। হঠাৎই সেই বাচ্চার গলাটা ওর কানে কানে বলতে লাগল, " মা, নে-নেবে যাও বা-বাস থেকে। নেবে যাও।" ছেলেটা একটু তোতলা, আর কথাগুলো কানের ভেতর থেকে উচ্চারিত হয়ে যেন মাথার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। দিন দুপুরে ভুতুড়ে কান্ড। উসখুস করে সায়ন্তনী। পাশে সবে বসা এক গোমড়া ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হয়ে তাকান। তবে কি কথাগুলো ও একাই শুনছে? না কি ওর মনের ভুল? অথচ এত স্পষ্ট কথা! নাছোড়বান্দা গলাটা এবার অনুনয় করে বলে, "মা শি-শিগগির নেমে যাও পরের স্ট-স্ট-স্টপে। বা-বাস থেকে নেমে যাও মা।" কে ওকে 'মা' বলছে! বিয়েই হয়নি সায়ন্তনীর। সবে তো মাস কমিউনিকেশনটা পাশ করে, এই বছরই চাকরীতে ঢুকেছে। এসব ভাবতে ভাবতে, অস্বস্তিতে বাস থেকে তড়িঘড়ি নেমেই পড়ে ও। পরের স্টপেই। টেনশনে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না, কন্ডাক্টরকে বাস ভাড়া দিয়ে পয়সা ফেরত নিতেও সেদিন ভুলে যায়।
বাস থেকে নামতেই গলাটা ফের কানে কানে বলে ওঠে, "এবার ওই বাঁ-বাঁদিকের রাস্তাটায় ঢু-ঢুকে পড় মা।" মন্ত্রমুগ্ধের মতো হুকুম তামিল করে চলে সায়ন্তনী। রাস্তাটায় ঢুকে ও ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে আর পরবর্তী নির্দেশের জন্য কান খাড়া করে অপেক্ষা ক'রে থাকে। ব্যাপারটা ভুতুড়ে হলেও, ও কেমন যেন একটা আকর্ষণও বোধ করে বাচ্চাটার প্রতি। একটু চলার পর আবার গলাটা বলে "এ-এবার ঐ সামনের বা-বাড়িতে ঢুকে পড়,আর সো-সোজা চলে যাও তি-তি-তিনতলায়।" তাই করে সায়ন্তনী।
কিন্তু এ কোথায় এসে পড়ল? এ তো একটা নামকরা নার্সিংহোম, তারই তিনতলায় এমআরআই এর ফ্লোরে চলে এসেছে ও। বাচ্চাটা আবার বলে, "মা, তো-তোমার ব্রে-ব্রেন স্ক্যান করিয়ে নিতে হবে, এ-এখনই করিয়ে নাও।" সায়ন্তনী সব অক্ষর অক্ষরে মেনে চলে, ও যেন কারও হাতের পুতুল। অবাক বিস্ময়ে ও দেখে, রিসেপশনিস্ট ঠিক তখন ওরই নাম ডাকছে, আর তার পরেই টেকনিশিয়ানরা ওকে ঢুকিয়ে দেয় এমআরআই রুমে। সায়ন্তনী দেখে, সেখানে সবরকম ফরমালিটি আগে থেকেই করা রয়েছে। সায়ন্তনী তখনও ভাবছিল, যা ঘটছে তা কি সত্যি? না স্বপ্ন? কিন্তু অবিশ্বাসই বা করে কি করে? গলাটা ওর কানে ভরসা যোগায়, বলে ভয় না পেতে, 'মা', 'মা' করে ডেকে মন জয় করে নেয়। সায়ন্তনীও কেমন যেন এক বাৎসল্যের ভাবনায় ডুবে যায়, বাচ্চাটার সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে। শুধু যদি একটি বার দেখতে পাওয়া যেত! বাচ্চাটা বলে, সায়ন্তনীর নাকি একটা ছোট টিউমার হয়েছে ব্রেনে, এক্ষুনি অপারেশন করাতে হবে।
একটু বাদে সায়ন্তনীকে চেম্বারে ডেকে, এমআরআই রিপোর্টটা দেখতে দেখতে, চিন্তিতমুখে ডক্টর ব্যানার্জি বলেন, "খুব ঠিক সময় চলে এসেছেন ম্যাডাম। তবে ভয়ের কিছু নেই, একটা ছোট্ট মেটাস্ট্যাটিক টিউমার আছে, এখনই ওটা অপারেট করতে হবে। আর একটুও দেরী করা যাবে না। বাড়ির লোককে নিয়ে আসেননি কেন? এক্ষুনি আসতে বলুন।" সায়ন্তনী অবাক হয়ে দেখে অপারেশনের সব ফরমালিটি রেডি, এমনকি প্যাকেজের টাকাও আগে থাকতেই মেটানো হয়ে গেছে ।
বাবা মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে, সব দেখে ভীষণ অবাক হয়ে যান। ইন্টারভিউ দিতে বেরিয়ে, কেউ ব্রেন টিউমার অপারেশন করাতে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে যায় নাকি? ওরা বারবার সায়ন্তনীকে জিজ্ঞেস করেন, ওদের কাউকে কিছু না জানিয়ে ও কি করে এই ডিসিশনটা একা একা নিল? এতগুলো টাকাই বা কিভাবে মেটাল? কোন জবাব দিতে পারেনা সায়ন্তনী, ও তখন ঘোরের মধ্যে। ডক্টরও ওদের উত্তেজিত হতে বারণ করেন। সায়ন্থনী কিছুতেই সেই তোতলা ছেলেটার কথা কাউকে বলতে পারে না। ভুতুড়ে গলার কথা কেউ বিশ্বাসই করবে না। ওর নিজের কাছেই এখনো কোন কিছুই স্পষ্ট নয় ।
ক'দিন পরেই একেবারে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে সায়ন্তনী। নার্সিংহোমটি সেরা আর ব্রেন সার্জন ডঃ ব্যানার্জিও খুবই নামকরা। মাত্র ক'দিনের জন্য আছেন এদেশে, তারপরই আবার বিদেশে চলে যাবেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সায়ন্তনী আর ওর বাবা-মা। কিন্তু সায়ন্তনীর মনটা খারাপ, সেই দিনের পর থেকে গলাটা বেবাক হাওয়া হয়ে গেছে । আর কোন নির্দেশ উপদেশ বা অনুরোধ আসে না সেই অজানা বাচ্চাটার কাছ থেকে। 'মা' ডাকটাও আর শুনতে পায় না সায়ন্তনী। বড় ভালবাসা, বড় টান ছিল ডাকটার মধ্যে ।
বছর দশেক পরের কথা। একটা ভাল এডিটোরিয়াল হাউসের উঁচু পোস্টে এখন কাজ করে সায়ন্তনী। বিয়েও করেছে বেশ কয়েক বছর। কৌশিক বড় একটা কোম্পানির জয়েন্ট ডাইরেক্টর। ওদের একমাত্র ছেলে সৌভিক। সৌভিক একটু তোতলা।