গেরুয়া রোদ্দুর
গেরুয়া রোদ্দুর
হঠাৎই ঘটলো ব্যাপারটা-মানে এই টাকা পেয়ে যাওয়াটা আরকি। বিশ্বনাথবাবু এতটা আশাই করতে পারেননি। জীবনে লটারির টিকিট কেটেছেন বহুবার ,কিন্তু একলাখ দুলাখ তো দূরের কথা, পাঁচটা টাকা পর্যন্ত কখনো পাননি ।তাই একেবারে পঞ্চাশ লাখ টাকা পেয়ে গিয়ে বিশ্বনাথবাবুর তো হার্টফেল করার অবস্থা। কিন্তু টাকাটা নিজের নয়, একথা তিনি ভাবতেই পারছেন না,মেনে নেওয়া তো দূরের কথা।
ব্যাপারটা খুলেই বলি ।আসলে দিন পনেরো আগে পাড়ার পঞ্চার কাছ থেকে তার বাল্যবন্ধু শ্যামল একটা টিকিট কেটেছিলেন।শ্যামলের কোনদিনই ওইসব লটারি ফটারির ব্যাপারে কোন আস্থা ছিল না, খেটেখাওয়া মানুষ। কিন্তু পঞ্চাও তো তারই সামনে বড় হয়েছে।মা বাপ মরা ছেলেটা খেতে না পেয়ে, অভাবের তাড়নায় লটারির দোকানটা খুলেছে। সেই এসে তাকে গছিয়ে গেছে,আর তিনিও যথারীতি ভুলে যেতেন টিকিটের কথা। ভুলো মনের জন্যই টিকিটটা তাই বিশ্বনাথবাবুকে দিয়ে দিয়েছিলেন।দেবার সময় হেসে বাল্যবন্ধুকে বলেছিলেন " টাকাটা উঠলে তুই'ই নিয়ে নিস"। তার পরেই শ্যামলবাবু চলে গেছেন বড় মেয়ের বাড়ি কদিন ঘুরে আসতে।এদিকে আবার পঞ্চাও তার দোকানে এলাহি ব্যাপার স্যাপার করে বসেছে-ওর দোকান থেকে নাকি সেকেন্ড প্রাইজ উঠেছে-পঞ্চাশ লাখ টাকার।
গতকালই বিশ্বনাথবাবু টিকিটটা মিলিয়েছিলেন পঞ্চার দোকান থেকেই ।ঘোড়েল পঞ্চাটা আবার জিজ্ঞেস করছিল টাকা ফাকা উঠেছে কিনা ।সেকেন্ড প্রাইজটা যে তারই ভাগ্যে উঠেছে, মানে শ্যামলবাবুর আরকি, সে কথাটা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন।
টাকা উঠেছে দেখেই বিশ্বনাথ বাবু মনে মনে ঠিক করলেন ওই টাকাটা আর শ্যামলবাবুকে দেবেন না। শ্যামল নিজেইতো বলেছিল। ভাবলেন শ্যামলের টাকার অভাব কি? আর তাছাড়া এতদিন পর ফিরে এসে ওর আর অত মনেও থাকবে না। আর থাকলেও নিদেনপক্ষে ঐ নম্বরটা ?সে মনে রাখা দুঃসাধ্য ।অতএব "ওঠেনি" বলে চালিয়ে দিলেই হয়।আর তিনি নিজে যে মাঝেমাঝেই লটারির টিকিট কাটেন,একথা সবাই জানে।সুতরাং দুয়ে দুয়ে চার মিলে যেতে আর অসুবিধা কোথায়? কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবলেন ,পরের টাকায় সুখভোগ?এ তো চুরি। না, না ,এত নীচ কাজ বিশ্বনাথবাবু করতে পারবেন না ।তাছাড়া পঞ্চা যেভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে, মালা দিয়ে, ফেস্টুন টাঙিয়ে তার দোকান থেকে দ্বিতীয় প্রাইজ ওঠার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তাতে শ্যামলের মনেও প্রশ্ন উঠতে পারে। তিনি টাকাটা ফিরিয়েই দেবেন। খুশি হয়ে শ্যামল যদি উপহার স্বরূপ কিছু দিয়ে দেয় তো ভালো, না হলে যাকগে। দিলেই বা আর কত দেবে? বিশ ত্রিশ হাজার ?দূর!পঞ্চাশ লাখ থেকে ত্রিশ হাজার?শ্যামলটা একটা অমানুষ ।সেই ছোটবেলা থেকেই ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব ,তাও আবার গলায় গলায় ।স্কুল পালানো, মাস্টারমশাইয়ের চেয়ারের তলায় বেড়ালছানা রেখে দেওয়া ,দেওয়ালে নানা কুকথার কুকীর্তি করে রাখা, এমনকি ক্লাশ নাইনে দুজনেই একসঙ্গে ফেল করা পর্যন্ত।তারপর চাকরির সূত্রে একটু আলাদা হওয়া। এখনতো দুজনেই রিটায়ার্ড, পেনসনভোগী। সেই একই জায়গায় এখনও থাকেন দুজনে।এখনও দুজনে খুব মিল ।
শ্যামলবাবুর দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে।নাতি নাতনিও হয়েছে।বিশ্বনাথবাবুর এক ছেলে বিদেশে চাকরি করে। বিশেষ খবরাখবর নেয় না ,আসেও না ।বোধ হয় ওখানেই বিয়ে থা করে সংসার পেতেছে ।বিশ্বনাথবাবুর ছোটছেলে ব্যবসা করে। ওর বিয়ের জোগাড়যন্তর চলছে।মোট কথা বিশ্বনাথবাবুর এখন টাকার খুব দরকার। গলায় গলায় ভাব দুজনের-তাই বিশ্বনাথবাবু ভাবছিলেন, শ্যামল নিশ্চয়ই তাকে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে দেবে এবং সেটাই উচিত। আবার এটাও মনে হল শ্যামলের মনটা বড় ভাল,হয়ত অর্ধেকই দিয়ে দেবে ।অন্ততঃ তিনি যে টিকিটটা মিলিয়ে আত্মসাৎ না করে, টাকাটা ফিরিয়ে দিচ্ছেন এর জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ কি আর থাকবেনা? আর শ্যামলই বা কি করবে অত টাকা নিয়ে?শ্যামলের তো ঝাড়া হাত পা। তার নিজের ছোটছেলের বিয়ে দিতে হবে ।আর বড় ছেলে যদি ফিরে আসে তাহলে ঘর কোথায়? ছোট ছেলের ব্যবসার উন্নতিতেও অনেক টাকা দরকার। পরক্ষণেই লজ্জিত হয়ে পড়েন। ছি ,ছি,ও যে পরের টাকা,আমি কেন তার ওপর লোভ করব ?তাছাড়া সত্যি বলতে কি আমাদের দুজনের অবস্থার তেমন কিছু ফারাক নেই।
কিন্তু অত টাকা চট্ করে ছেড়ে দেব বললেই ছেড়ে দেওয়া যায় না ।এভাবে তিনি কয়েকদিন বেশ চিন্তা-ভাবনা করলেন। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা কথা মাথায় এলো , টাকাটা যদি তিনি আত্মসাৎ করে কাজে লাগান ,তবে একটা জিনিস চিরকালই খচখচ্ করে বিঁধবে যে"পরের ধনে পোদ্দারি"। তাহলে আর লাভ কি?এভাবে দোষী হয়ে চিরজীবন বেঁচে থাকার চেয়ে, ব্যাপারটা বলে ফেলাই ভাল। মনটাতো হালকা হবে ।এই ভেবে তিনি শ্যামলবাবুর বাড়ী রওনা হলেন ।সেখানে গিয়ে সব একই রকম দেখলেও ওর অবস্থা আগের থেকে আরও বেশি স্বচ্ছল বলেই মনে হলো। একটু যেন দেমাকও হয়েছে। হবেনা? বড় জামাইয়ের ব্যবসার উঠলে ওঠা টাকা এ সংসারেও গড়িয়ে আসে যে। কথাটা পাড়তে গিয়েও,শ্যামল কোথায় ফ্ল্যাট কেনার প্ল্যান করছে ,সেই আলোচনাতেই সেটা চাপা পড়ে গেল।তাড়াহুড়ো করে চা-বিস্কুট না খেয়েই উঠে পড়লেন।মনে পড়ল নিজের কথা, নিজের কথা ভাবলেই তার মনটা বড় আনমনা হয়ে যায়। সেই চরম দুর্দিনের কথা মনে পড়তেই নিজেকে বড় একা মনে হল ।আজ জীবনের সুখের পাশবালিশকে কিছুতেই হড়কে যেতে দেওয়া যায় না।
মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে বেড়াতে গিয়ে কিভাবে তিনি একদা ডিসেন্ট্রির কবলে পড়েছিলেন ,একে একে সব মনে পড়তে লাগলো। মৃত্যুর মুখ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনা ছিল দুঃসাধ্য। চারিদিকে উৎকণ্ঠা,দাঙ্গা চলছে। তখন ছিল না খাদ্য ,ওষুধপত্র কিছুই। কেবল ছিল একটি কিশোরী ।তার থেকেই সেবার তিনি মায়ের যত্ন পেয়েছিলেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে, রাত জেগে, সে তার সেবা করেছিল ।তিন মাইল দূরের ডাক্তারকে হাতে-পায়ে ধরে ডেকে এনে ক'দিন অন্তর তাকে দেখিয়েছিল। যথাসর্বস্ব বেচে ,ওষুধ-পথ্য দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তুলেছিল। সব গল্পের মতো মনে হয়। ফিরে আসার সময় 'পোস্টমাস্টার'এর কথা মনে পড়েছিল ।তারপর সময়ের আবর্তনে মেয়েটার কথা একরকম মনেই ছিল না। অনেকদিন বাদে একদিন অফিসের কাজে তাকে মুর্শিদাবাদ যেতে হয়েছিল ।সে প্রায় দশ বারো বছর পর। এসে মেয়েটিকে আর খুঁজে পাননি তিনি। বিয়ের পর প্রচলিত দুর্বোধ্য এক কারণে মেয়েটি পায়ের তলার টুলটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। নিজের ছবি তুলে রাখার বড় ইচ্ছে ছিল মেয়েটির।সে কথা অনেকবারই সে বলেছিল। তাই এবার সঙ্গে করে ক্যামেরাটা নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একটা নেগেটিভও খরচ করতে হয়নি।বিশ্বনাথবাবু আঙুলদুটো চোখের কোনে দুবার বুলিয়ে নিলেন ।
নিজের দাদার কথা মনে পড়ল। দাদা নেশা করতেন। বৃদ্ধ বাবা-মার সব দায়িত্ব বিশ্বনাথবাবুকেই নিতে হয়েছিল অনেক ছোটবেলা থেকেই।তখন তিনি সবে গ্র্যজুয়েশন করেছেন,চাকরি পাননি,সামান্য টিউশনি করেন। শুধুমাত্র ভিক্ষাটা করতে হয়নি।দিনের পর দিন শুধু খাবারটুকু জোগাড় করার জন্য কি ভীষণ লড়াই।বাবা অসুখে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন,মার সদা কান্না ভেজা মুখটা,বৌদির বিষ খাওয়া,ভাইপোটার করুণ চাহনি, ওঃ।
এখন কেউ নেই, ক্যান্সার দাদাকে কেড়ে নিয়েছে। ছেলেটা তার সামনেই বড় হয়েছে ।এখন সে দাদার অফিসেই চাকরি করে। বিশ্বনাথ বাবুর অনেক কথাই মনে পড়ছিল ।তিনি অনেক কিছু যেমন পাননি ,তেমনি অনেক কিছু পেয়েছেনও।এই যেমন শ্যামলের বন্ধুত্ত্ব।জীবনে পাওয়ার ভাগটাই বেশী। এইতো জীবন,নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হল। আরামকেদারায় শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলেন স্থিরচোখে। পিছনে পাখাটার বাঁটকুলে ছায়াটাই তাকে আকৃষ্ট করছিল।ছায়াটা যেন পাখাটার নয়,একটা আলাদা এবং বৃহত্তর অস্তিত্ত্ব। তিনি ঠিক করলেন টাকাটা আর দেবেন না। এখন পঞ্চাশ লাখ টাকা তার।ভাবলেন একটা ছক কেটে কি করা উচিত ,কি না উচিত সব লিখে রাখবেন ।সব ঠিক করে অবশেষে শান্তি হল।
ভাবলেন একবার রাস্তা থেকে ঘুরে আসি। তার মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠেছিল ।রাস্তায় দেখা হয়ে গেল সত্যর সঙ্গে। গোবেচারা ভালোমানুষ সত্য ।অনেকদিন চাকরির জন্য হয়রান হয়ে অবশেষে একরকম ঘটিবাটি পর্যন্ত বেচে দিয়ে কপাল ঠুকে নেমে পড়েছে নিত্যনতুন ব্যাবসার নেশায় ।বিশ্বনাথবাবু আবার চলতে শুরু করলেন ।হঠাৎ খেয়াল হলো ছাতাটা মাথার ওপর থেকে সরে গেছে, ছাতাটা আবার যথাস্থানে এলো। জীবনে বহু সংঘাত, বহু কষ্টের পর তিনি দাঁড়াতে পেরেছেন ।হঠাৎ আজ তার সামনে বিরাট বড়লোক হবার হাতছানি ।তিনি কি করবেন ?একটা বুড়ো ভিখিরি হাত পাততেই পথচলতি আর পাঁচটা মানুষের মতোই কপালে হাতটা ঠেকিয়েই চলে যাচ্ছিলেন। ধাক্কা লেগে বৃদ্ধের লাঠিটা পড়ে গিয়েছিল ।পড়োপড়ো বৃদ্ধকে ধরে, আবার লাঠিটা হাতে তুলে দিয়ে এগিয়ে এলেন। অনেকটা এসে আবার কি যেন মনে হতে, পেছন ফিরে ভিখিরিটাকে খুঁজতে লাগলেন,কিন্তু আর দেখতে পেলেন না। সূর্যটা যখন মেঘের আড়ালে। পাশে দাঁড়ানো গরুর ল্যাজটা দু'বার তার কনুই ছুঁয়ে গেল ,আদর করে ল্যাজ বোলানোর ব্যাপারটা যেন চেনা চেনা মনে হল।
বিশ্বনাথবাবু আর ভাবলেন না। এতদিন তো খালি নিজের জন্যই করে এসেছেন, আর না। পথে-ঘাটে অর্ধমৃত, অনাহারী মানুষ গুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সবার মুখ এসে ধরা পরল স্মৃতির মণিকোঠায় সমুজ্জ্বল সেই কিশোরীটির মধ্যে ।তিনি তার দোলাচলে দুলতে থাকা মন,শেষবার ঠিক করে ফেললেন ।
বেশ কয়েক মাস পরের কথা। এই কদিনে বয়সের ভার যেন বেশী করেই পড়েছে বিশ্বনাথবাবুর চোখে মুখে।লটারির টাকাটা কালই গিয়ে নিয়ে এসেছেন। কাটছাঁট করে প্রায় তিরিশ লাখ ।আজ ভোরে উঠেই ট্যাক্সি ভাড়া করে গিয়ে নামলেন সোজা রামকৃষ্ণ মিশন বেলুড় অফিসে ।গেরুয়ার দীপ্তিতে হৃদয় ভরিয়ে, পুরো টাকাটাই তুলে দিলেন সন্ন্যাসী মহারাজের হাতে। একজন বললেন "একটা ছবি তুলব দাদা ,এত বড় একটা---" বিশ্বনাথ বাবু আর দাঁড়ালেন না। তার বুকটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। তাড়া খাওয়া একদল কাক উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে ।মনে হল তার কোন কষ্ট নেই ,তিনি যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছুটছেন। বয়স যে কমে সেই প্রথম বুঝলেন ।কাছে-দূরে চারপাশে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগলেন ।তবু বিশ্বনাথবাবু পেলেন না সেই চেনা কিশোরী মেয়েটিকে ,যে হয়তো তখন অজানা গোধূলির সোনালী রোদ্দুরে বিরাট একটা দীঘির সামনে, হোগলা বনে দাঁড়িয়ে ,ঘরে না ফেরা হাঁসের বাচ্চা খুঁজে বেড়াচ্ছিল-আয় আয়,চই চই চই-----।