Indrani Bhattacharyya

Children Stories Drama Fantasy

4.0  

Indrani Bhattacharyya

Children Stories Drama Fantasy

একটি বর্ষার দিন

একটি বর্ষার দিন

6 mins
4.5K



শুরু হয়ে গেছে কদমতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা।আজ প্রথম দিন। আজকের বিষয় বাংলা। পরীক্ষার হলে সবাই খুব মন দিয়ে লিখছে। অনেকটা সময় কেটে গেছে। আর মাত্র তিরিশ মিনিট মত হাতে আছে। সেকেন্ড বেঞ্চে ডানদিকের কোনায় ঘাড় গোঁজ করে পেন্সিল চালাচ্ছে কার্তিক।মোটামুটি সব প্রশ্নের উত্তর লিখে ফেলেছে। হাত দিয়েছে শেষ প্রশ্নে। লিখতে হবে একটি রচনা।বিষয় - একটি বর্ষার দিন। রচনার বিষয়টা দেখে তার মনটা বেশ ভালো হয়ে গেলো। হবে নাই বা কেনো? কার্তিকের প্রিয় ঋতু তো বর্ষা। আনন্দের সাথে পেন্সিলটা চেপে ধরে আবার লিখতে শুরু করলো।


টাপুর টুপুর বৃষ্টি ঝরে সারা দিন, সারা রা.... । হঠাৎই বাক্যটা শেষ হবার আগেই পেন্সিলটা যেন আপন খেয়ালে মার্জিন ধরে খানিক সুরুৎ করে এগিয়ে গিয়ে খাতার ওপর দিয়ে কার্তিকের আঙ্গুলে সওয়ার হয়ে ছুটতে শুরু করলো। তারপর কার্তিককে চমকে দিয়ে শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে খাতা জুড়ে ঝরে পড়তে লাগলো ঝুপঝাপ টুপটাপ একের পর এক সোঁদা মাটির গন্ধমাখা শব্দ। আর দেখতে দেখতে সেগুলো বিনি সুতোর মালায় গাঁথা একেক খানা বাক্য হয়ে ধরা দিল পরীক্ষার খাতায়।

'সারা রা.... ত । ভোররাত থেকে চরাচর একাকার করে আকাশ ভেঙ্গে সেই যে শুরু হয়েছে বৃষ্টি, তা যেন আর থামার কোনো নামই নেই। আকাশে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধে ব্যস্ত দামাল মেঘের দল। বিদ্যুতের তীক্ষ্ণ ফলায় মুহুর্মুহু ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে কখনো হাতির শুঁড়ের মত বিশালাকৃতি বুনো মেঘ, কখনো সিংহের কেশরের মত ফাঁপানো রাশভারী মেঘ, কখনো ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গাল ফোলানো অভিমানী মেঘ, কখনো বা মায়ের চুলের মত লম্বা সুন্দরী কাজল কালো মেঘ। নদীর জল গরম তেলে সদ্য ছাড়া পাঁপরের মত কখন যেন দেখতে দেখতে ফুলে উঠেছে। একের পর এক তালগাছের মত লম্বা লম্বা ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। মাঠ ঘাটগুলো যেনো একেকটা নাম না জানা নদী।


জানলা খুলে আদুর গায়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কার্তিক খেয়ালই করেনি কখন যেনো ঘরে ঢুকে আসা জলের ছাঁটে সে ভিজিয়ে ফেলেছে নিজেকে। পাশে মুখ থুবড়ে জলে ভিজে নেতিয়ে পড়ে রয়েছে অঙ্ক বই আর খাতা। এক মুহূর্তের জন্য খাতা বইয়ের এইরকম করুন দশা দেখে কার্তিকের ভারী আনন্দ হলো। মনে হল আপাতত সিড়ি ভাঙ্গা অঙ্কের হাত থেকে কয়েক দিনের এক্কেবারে জন্য নিশ্চিন্ত। সত্যিই তো! বই খাতা না থাকলে অঙ্ক কষবে কোথায়! কিন্তু পরের মুহূর্তে মায়ের চেহারাটা মনে পরতেই শুকিয়ে গেলো মুখ চোখ। পা টিপেটিপে রান্নাঘরে ঘর সামলাতে ব্যস্ত মাকে একবারটি দেখে এলো চুপিচুপি। তারপর চটপট গা হাত পা মুছে জামা বদলিয়ে জানলাটা বন্ধ করলো আগে। এরপর ভাঁড়ার ঘরে গিয়ে সন্তর্পনে ভেজা বইটাকে মুড়ে গুঁজে দিলো দরজার পাশে রাখা উনুনের নিচে, যাতে উনুন ধরানো হলে ওপরের কয়লার গরম আঁচে ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে যায় বইয়ের পাতাগুলো। মনে মনে ঠিক করলো বই শুকিয়ে গেলে রাতের বেলা সুযোগ বুঝে একসময় গিয়ে সেটা লুকিয়ে বের করে নিলেই চলবে। বৃষ্টি না থামা অব্দি স্কুলে যাবার বালাই নেই। তাই অঙ্ক বইয়ের খোঁজ এখন আর কেউ করবে না।শুধু দাদাকে নিয়েই চিন্তা। সে তো কাল সকালে আবার অঙ্ক পরীক্ষা নেবে বলেছে। তার আগেই শুকিয়ে ফেলতে হবে বই খাতা।


দুপুরের দিকে বৃষ্টি একটু ধরলে মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কার্তিক খেলতে গেলো বাড়ির সামনে কদমতলার মাঠে। সেখানে কাঁদায় জলে মাখামাখি হয়ে ভুত সেজে অনেকক্ষন ধরে চলল ফুটবল খেলা। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ চোখে পরলো মাঠের পাশে নদীর মত বয়ে চলা নালার স্রোতে আপন গতিতে ভেসে চলেছে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা কাগজের ভেলা।সেগুলো দেখে দারুন মজা লাগলো কার্তিকের। ছুট্টে গিয়ে ধরল দু চারটে। তারপর হাতে তুলে নিয়ে দেখতে গিয়ে কপালে উঠলো চোখ। এগুলো যে ভোরবেলা ভিজে যাওয়া অঙ্ক বইয়ের পাতা। বইয়ের পাতায় তার হাতের লেখা জলে ধুয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেলেও পড়া যাচ্ছে এখনও। কিন্তু এগুলো এখানে এলো কি করে? ভাবতে ভাবতে কেমন যেন কান্না পেয়ে গেলো কার্তিকের। বন্ধুদের কাউকে কিছু না বলে ছুট্টে চলে গেলো বাড়ি।


কার্তিক বাড়ি ঢুকেই মাকে হেঁকে ডেকে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো - "মা, উনুনটা কোথায়? " মা বিরক্ত হয়ে বললো- 'কেনো রে?তুই আবার উনুন দিয়ে কি করবি? যা পরিষ্কার হয়ে নেয়ে আয়।'

পুকুরপাড়, মাঠঘাট আজ সব এক হয়ে গেছে। অন্যদিন এইসময় পুকুরে নাইতে যায় সে। আজ সেই সুযোগ না থাকায় কার্তিক বাবু কলতলায় নাইতে নাইতে ভাবতে লাগলো- 'ইশ, যদি নৌকোগুলো একটু বড়ো হতো, আমি উঠে ঠিক পালাতাম আজ। দাদা অঙ্ক বইয়ের কথা জানতে পারলে কাল কপালে দুঃখ আছে। বছরের মাঝখানে বই হারিয়েছি বললে বকা খেতে হবে খুব'।


বইয়ের শোকে এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কার্তিক উঠোনে যেই না উঠতে যাবে ,অমনি দেখলো মাঠের পারে দেখা কাগজের ভেলাটা ।সেটা বেশ বড়সড় একটা নৌকো হয়ে ভাসছে বৃষ্টি জমা জলে।সেই সঙ্গে নৌকোর ওপর ছাতা নিয়ে দুটো অদ্ভুত দেখতে লোক কেমন গোল গোল হাত নেড়ে ডাকছে কার্তিককে। কার্তিক চমকে উঠে কাছে যেতেই একটা লোক বলে উঠলো - ' তোমার মনের কথা জানতে পেরে আমরা নিজেরাই কেমন চলে এলাম দেখো। এবার উঠে পরো দেখি চটপট'। আরেকজন কার্তিক কিছু বলার আগেই নৌকোয় একরকম বগলদাবা করে তুলে নিলো কার্তিককে। তারপর সটান তুলে দিল পাল। নৌকো হুড়হুড় করে ঝড়ের বেগে স্রোতের টানে এগিয়ে যেতে লাগলো মাঠ ঘাট ছাড়িয়ে।


কার্তিক প্রাথমিক ধাক্কাটা একটু সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ পর লোক দুটোকে ভালো করে চেয়ে দেখলো । লম্বায় দুজনেই বেশ খাটো আর অদ্ভুত ভাবে দুজনের পুরো শরীরটাই তৈরি নানা রকম সাদা কালো সংখ্যা দিয়ে। দুজনের মধ্যে যে একটু মাথায় লম্বা সে এগিয়ে এসে নিজে থেকেই আলাপ করে বললে - ' আমি হলাম গিয়ে গসাগু আর এ হলো আমার ভাই ,লসাগু। আমরা জানি তুমি খুব ভয় পাও আমাদের।' বলেই ফিকফিক করে হাসতে লাগলো দুজনে।হাসির দমকে দুলে দুলে উঠতে লাগলো তাদের গোলগাল শরীর দুটো। দেখে খুব রাগ হলো কার্তিকের। এই তো বারো নম্বর সাইজের ফুটবলের মত চেহারা। তাদের নাকি ভয় পাবে এই কার্তিক শর্মা। বুক চিতিয়ে বললো- 'তোমাদের ভয় পেতে আমার বয়েই গেছে'। গসাগু বললো হেসে - 'তাই বুঝি! তাই যদি হবে, তাহলে রোজ রোজ অঙ্ক খাতায় আমাদের দেখলে তোমার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে যায় কেনো? আমাদের বুঝি দুঃখ হয় না তাতে? মোটেই আমরা এত খারাপ নই '। কার্তিক চোখ পাকিয়ে বললো - 'খারাপই তো ! বিদঘুটে রকমের খারাপ আর বিচ্ছিরি রকমের খটমটে'। লসাগু তখন রিনরিনে গলায় বলল - 'না গো ভাই। আসলে তোমাদের শেখা আর শেখানোতেই যত রাজ্যের গন্ডগোল। তুমি শুধু শেখ পরীক্ষায় পাস করবে বলে। তোমাদের স্যারেরাও বলেন - না শিখলে ফেল করবি। তাহলে বুঝতে পারছো, দুয়ের ক্ষেত্রেই কমন ফ্যাক্টর হলো গিয়ে ভয়। এই ভয়কে একবার অঙ্কের নিয়মে বিয়োগ করে, যোগ করে নাও আগ্রহ আর উৎসাহ, দেখবে অঙ্কের থেকে মজার জিনিস এই দুনিয়ায় আর কিচ্ছুটি নেই।' গসাগু সুর মিলিয়ে বললো- 'এই যে কার্তিক বাবু, তুমি কিছুক্ষন আগে আমাদের মনে মনে ফুটবল ভাবছিলে না? আমরা আসলে কিন্তু সত্যিই তাই।ঠিক একেকটা ফুটবলের মত। তুমি মাঠে যেমন করে ফুটবল খেলো ,বুদ্ধি করে সবাইকে কাটিয়ে গোল দাও, তেমন করেই অঙ্ক কষার ক্ষেত্রেও ধাপে ধাপে বুদ্ধি খরচ করে গোল দিতে হয়।আর গোল করতে পারলে এই ক্ষেত্রেও কিন্তু একই রকম আনন্দ হয়। পার্থক্য শুধু একটাই। ফুটবলটা খেলতে হয় কদমতলার মাঠে আর অঙ্কটা কাগজের খাতায়।' 

এবারে কার্তিক বেশ লজ্জা পেলো । তারা দুজনেই যে তার মনের কথাটা জানতে পেরে গেছে। মাথা চুলকিয়ে বললো- 'কথাটা ঠিকই বলেছ মনে হচ্ছে। সত্যিই তো! এভাবে ভাবলে অঙ্ককে ভয় পেতে ইচ্ছেই করছে না আর '। গসাগু আবার বলল- 'ভাই ,শুধু অঙ্ক কেনো সব কিছুই পড়ো মনের আনন্দে , জানার আগ্রহে আর খেলার ছলে'। কথাগুলো শুনে বুকে ভারি বল পেলো কার্তিক'।


এমন সময় হঠাৎ দুর থেকে শুনতে পেলো কোথায় যেনো ঘণ্টা বাজছে। ঘোর কাটতেই চমকে উঠলো কার্তিক। তাকিয়ে দেখলো বিধু স্যার বলছেন- 'পরীক্ষা শেষ হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। এরপর ফাইনাল বেল পড়বে'। কার্তিক হাত চালিয়ে তাড়াতাড়ি রচনাটা শেষ করলো।


তোমরা ভাবছো কার্তিক বুঝি রচনাটা মোটেই ভালো লেখেনি। তা কিন্তু নয়। কার্তিক খাতা জমা দেবার আগে পুরো লেখাটা একবার পড়ে বুঝেছিল কার্তিকের অঙ্ক বইয়ের দুর্দশার কথা, কাগজের নৌকো, হঠাৎ করে বড়ো হয়ে যাবার ব্যপারগুলো মোটেই লেখা হয় নি রচনায়। সেগুলো শুধু কার্তিক মনে মনে দেখেছিলো। কার্তিকের পেন্সিলটা মোটেই তেমন দুষ্টু নয়।


বাকি পাঁচ মিনিটে রচনাটা কার্তিক শেষ করলো নিজের মত করে এইভাবে।


'পুকুরপাড় থেকে স্নান সেরে খেতে বসলো কার্তিক। আজ যে মেনুতে খিচুড়ি আর ফুলেশ্বরী নদীর ইলিশ মাছ ভাজা। বর্ষার দিনে খাবার পাতে এমন অমৃত পেলে আর কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে। রাতেও বৃষ্টির দস্যিপনা বজায় ছিল একই ভাবে। সঙ্গে পুকুরপাড় থেকে ভেসে আসছিলো একটানা কোলাব্যাঙের গণসঙ্গীত । দাদা সন্ধ্যে বেলায় মোমবাতির আলোয় শোনাল গা ছমছমে বাংলো বাড়ির ভূতের গল্প। তারপর চটপট রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই , একটা রোদ ঝলমলে দিনের অপেক্ষায়'।

পরীক্ষা দিয়ে খুব খুশি হয়েছিলো কার্তিক। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে পড়তে বসেছিল সেদিন। পরের দিন যে অঙ্ক পরীক্ষা। আর ভয় নেই। এবার থেকে বাকি সব পরীক্ষাই নির্ভয়ে মনের আনন্দে দেবে সে।



Rate this content
Log in