Debmalya Mukherjee

Children Stories Romance Classics

4.3  

Debmalya Mukherjee

Children Stories Romance Classics

যে সয় সে রয়

যে সয় সে রয়

24 mins
2K


রাজ্যের মহারাজ অচিন্ত্য সিংহ সিংহাসনে বসতে না বসতেই চারিদিকে ফিসফিস শব্দ শুরু হয়ে গেল। প্রজারা, সভাসদরা, মন্ত্রীরা এমনকী প্রধান সেনাপতি পর্যন্ত রাজার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে আর এ ওর কানে, ও এর কানে কি যেন বলাবলি করে চলেছে। এরকম আগে কখনো ঘটেনি। রাজা খুব কৌতুহলী হয়ে পড়লেন। প্রধান মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন - ‘সমস্যাটা কি? কী নিয়ে এতো গোপন আলোচনা চলছে?’ - ‘পাকা চুল মহারাজ’। - ‘কার মাথায় পাকা চুল? তাকে এক্ষুনি সভায় এনে হাজির করো। আমি থাকতে আমার দেশের লোক দুঃশ্চিন্তা করবে এ তো মেনে নেওয়া যায় না।’ নিশ্চিন্ত রাজ্যে আবার কিছুতেই দুঃশ্চিন্তা লুকিয়ে রাখা যায় না। সামান্য কিছু একটা কারনে কেউ দুঃশ্চিন্তা করলেই তার মাথার চুল সাদা হয়ে যায়। প্রধান মন্ত্রী একটু ইতস্তত করে বলল - ‘আপনার মাথায় পাকা চুল মহারাজ’। - ‘আমার মাথায়?’ রাজা আকাশ থেকে পড়লেন। ‘কই আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।’ - ‘রাজআয়না নিয়ে এলেই দেখতে পাবেন মহারাজ। লোক পাঠাবো আনতে?’ - ‘আচ্ছা পাঠাও।’ রাজার বুকে দুরু দুরু কাঁপুনি শুরু হল। খবরটা উনি কাউকে জানাতে চাননি। কিন্তু এখন তো না জানিয়ে আর উপায় রইল না। মন্ত্রীর আদেশে ততক্ষনে দশ জন লোক মিলে বয়ে নিয়ে এসেছে রাজআয়না। সে এক দেখার মতো আয়না বটে। যেমন বিশাল তেমন অদ্ভূত কায়দায় তৈরী।


সামনে দাঁড়িয়ে সোজা তাকালেই শরীরের সব দিক দেখা যায়। পায়ের পাতার নীচ থেকে মাথার তালু, হাতের নখ থেকে পায়ের গোড়ালি কিচ্ছু বাদ নেই। সেই আয়নায় মাথার প্রতিটি চুল নিখুঁত করে পর্যবেক্ষন করলেন রাজা। পাকা চুলের সংখ্যা গুনতে গুনতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। দেখা গেল মাথায় মোট একানব্বইটা চুল পুরো পেকেছে, উনপঞ্চাশটা চুল অর্ধেক পাকা আর তেত্রিশটা চুলের গোড়ায় সবে একটু পাক ধরেছে। রাজা বাধ্য হয়ে স্বীকার করলেন- ‘হ্যাঁ বেশ অনেকগুলোই চুল পেকেছে বটে।’ অর্থাৎ দুঃশ্চিন্তাটা বেশ বড় ধরনের তাতে কোন সন্দেহ নেই। সভাসদরা সবাই মিলে রাজাকে চেপে ধরল - ‘মহারাজ, আমরা থাকতে আপনার এতো দুঃশ্চিন্তার কারনটা কী?’ রাজা আমতা আমতা করে শেষে বলেই ফেললেন - ‘রাজকন্যা নন্দিনী ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না।’ সেনাপতি বললেন – ‘সে কি !’ মন্ত্রী বললেন – ‘সে কি !’ সব সভাসদরা এক সাথে বলে উঠলো – ‘সে কি !’ ‘সে কি’ ‘সে কি’ রবে গম গম করে উঠলো রাজসভা। সেনাপতি মাথা চুলকায়। মন্ত্রী মাথা চুলকায়। সভাসদরা সবাই জোরে জোরে মাথা চুলকে চলে। এমন কঠিন সমস্যায় সভাসদরা আগে কখনো পড়েন নি। রাজকন্যা সাঁতার কাটতে পারে, ঘোড়ায় চড়তে পারে, পাহাড়ে উঠতে পারে, শক্ত শক্ত অংক কষতে পারে, মোটা মোটা বই পড়তে পারে, কিন্তু ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। এ ও কী সম্ভব?


কিন্তু অনেক মাথা চুলকেও কেউ কোন উপায় ভেবে পেল না। ধীরে ধীরে সবার মন দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেল। প্রথমে প্রধান মন্ত্রীর মাথার চুলে কিছুটা পাক ধরল। তারপর সেনাপতির মাথার কয়েকগাছি চুল পেকে গেল। ক্রমশঃ সব সভাসদের চুল কিছুটা করে সাদা হয়ে গেল। দুঃসংবাদ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল দেশে। কিছুদিনের মধ্যে দেশবাসীর সবার মাথার এক গাছি করে চুল গেল পেকে। দেশবাসীর সাদা কালো মাথাগুলোর দিকে তাকিয়ে রাজার মন আরো খারাপ হয়ে গেল। শেষে সারা রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল - রাজকন্যাকে যে ভাজা মাছ উলটে খাওয়া শেখাতে পারবে তাকে ভুরি ভুরি পুরস্কার দেওয়া হবে। এই খবর যথাসময়ে রাজকন্যা নন্দিনীর কানেও এসে পৌঁছল। কিন্তু সে স্বভাববশতঃ তাতে উতলা হওয়ার কোন কারন খুঁজে পেল না। তাই খবরটা এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বার করে দিলো।


২. একদিন দুপুরে রোজদিনকার মতোই রাজকন্যা মনের আনন্দে মধ্যাহ্ন ভোজ সারল। সোনার থালায় ভাত আর সঙ্গে সোনার বাটিতে সাজানো ছিল সাতাশ রকমের মাছ আর চৌষট্টি রকমের তরকারী। খাওয়া দাওয়া সেরে রাজকন্যা হেলতে দুলতে এসে তার নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকেছে। এখন সে সোনার পালঙ্কে লাল মখমলের বিছানায় শুয়ে মনের সুখে দিবাস্বপ্ন দেখবে। কিন্তু পালঙ্কে শুতে না শুতেই হঠাৎ অদ্ভূত এক শব্দ করে রাজবাড়ির সব ঘড়ি এক সঙ্গে থেমে গেল। ঘড়িগুলোর কোন দোষ নেই। এমনিতে তারা খুব নিয়ম মেনে চলে। সারাদিন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁটাগুলো ‘টিক’ ‘টিক’ আওয়াজ করতে করতে ছুটে চলে। কিন্তু সময়টাই এমন খামখেয়ালি। সারা দিনরাত তার নদীর স্রোতের মতো একনাগাড়ে বয়ে যেতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে সে থমকে দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নেয়। ঘড়ির কাঁটাগুলোও তখন চলতে চলতে চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কারো কোন সময়ের হিসাব থাকে না তখন। তাই সবার সব কাজ থেকে ছুটি হয়ে যায়। এই সময়টাকে বলে পড়েপাওয়া সময়। সবাই তখন স্বাধীন। কারো ওপর কারো আদেশ চলে না, কোনো জোর খাটে না। সবাই নিজের ইচ্ছে খুশি মতো আনন্দে সময় কাটায়। তারপর আবার সময় যেই বইতে শুরু করে, ঘড়িও চলতে শুরু করে, সবাই যে যার রুটিনে ফিরে যায়। অন্যদিন এইরকম পড়েপাওয়া সময়ে রাজকন্যা ছাদে ঘুড়ি ওড়ায় বা বিড়ালদেরকে দাবা খেলা শেখায় বা গাছে উঠে আম-জাম পাড়ে বা পিঁপড়েদের জন্যে পাতার ঘর বানিয়ে দেয়। কিন্তু আজ সে সব কিছুই করতে ইচ্ছে করল না তার। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে শুধু আকাশকুসুম ভেবে যাচ্ছে। কত রকমের ভাবনারা যে মাথায় ভীড় করে আসছে তার ঠিক নেই। সময়ের খামখেয়ালিপনার কথাই বেশী করে মনে হচ্ছে এখন।


ছোটবেলা থেকেই শুনেছে যে এই পড়েপাওয়া সময়ে নাকি কোন সন্দেহ করা উচিত না। কিন্তু সন্দেহ করলে কী হতে পারে তা কেউ জানে না। অবশ্য লোকে বলে বলেই সব কথা যে সত্যি হবে এমনও তো নয়। হয়তো এসব শুধুই কথার কথা। যেমন সবাই বলে ‘শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়’। কিন্তু এ কথা কি আর সত্যি নাকি? একদিনও যদি রাজকন্যাকে এই নরম বিছানা ছেড়ে অন্য কোথাও ঘুমোতে বলা হয় তো রাজকন্যার কী আর ঘুম আসবে? জেগে জেগেই কাটিয়ে দিতে হবে সারারাত। অথবা একদিনও যদি সোনার থালায় ভাত আর সোনার বাটিতে করে নানারকম মাছ আর তরকারী না দেওয়া হয় তাহলে কী সে ভাত খেতে পারবে? কিছুতেই পারবে না। মুখেই রুচবে না। না খেয়েই থাকতে হবে। যেই না ভাবা অমনি হঠাৎ রাজকন্যা দেখল হলুদ রং-এর আলোতে ঘর ভরে গেছে। আর সেই আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক পরী। সোনার মত তার গায়ের রঙ। আকাশের মতো নীল তার জামা। কালো মেঘের মতো তার চুল। হাতে তার জাদু লাঠি। লাঠিতে চাঁদ তারা ঝিকমিক করছে। এসেই বললো - ‘পড়েপাওয়া সময় আনন্দে না কাটিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছ। এখন যাও নিজের সন্দেহ নিজেই নিরসন কর।’


৩. রাজকন্যা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই উধাও হয়ে গেল পরী। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল অদ্ভূত কোন এক দেশে এসে পড়েছে সে। কোথাও কিছু নেই। মধ্য গগনে সূর্য। রোদের কী ভয়ানক তেজ আর গরম আঁচ। মাঠ ফুটি ফাটা হয়ে আছে। ধু ধু করছে চারিদিক। মাঝে একটা দুটো লম্বা লম্বা গাছ। তার ছায়াগুলো নীচে মাটিতে পৌঁছনোর আগেই যেন মিলিয়ে গেছে। একটু ছায়ায় বসে যে দু’দন্ড জিরিয়ে নেবে তাও সম্ভব নয়। এমনিতে খুব সাহসী হলেও সামান্য একটু গা ছম ছম করল রাজকন্যার। এমন একা একা আগে তো কোথাও যায়নি। হঠাৎ-ই একেবারে নতুন একটা দেশে। কেউ কোথাও নেই। তারপরেই তার চোখ পড়ল নিজের বেঁটে খাটো ছায়াটার দিকে। কেমন যেন ওর পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ বন্ধু বন্ধু হাবভাব। নিজেকে আর একা মনে হল না। এই তো ছায়াকন্যা সঙ্গে আছে তার। মনে জোর এলো। ভাবল দেখাই যাক না এই দেশটা কেমন। এই দেশেও নিশ্চয় একটা রাজা আছেন।


তাঁকে গিয়ে যদি নিজের পরিচয় দেওয়া যায়, তাহলে তিনি নিশ্চয় রাজকন্যার বাড়ি ফিরে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করবেন। এখন শুধু রাজপ্রাসাদটা খুঁজে বার করতে পারলেই হল। হাঁটতে আরম্ভ করল রাজকন্যা। আস্তে আস্তে প্রকৃতি বদলাতে থাকে। গাছের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাজকন্যা হাঁটে আর পাশে পাশে ছায়াকন্যাও হাঁটে। দু বন্ধুতে হেঁটে চলে। ছায়াকন্যার সঙ্গে একা একাই অনেক গল্প করে রাজকন্যা। সূর্য পশ্চিম দিকে একটু একটু করে হেলে পড়ে। ছায়াকন্যাও লম্বায় একটু একটু করে বাড়তে থাকে। হঠাৎ রাজকন্যা দেখে রাস্তার ধারে একটা ছোট কাঁটা গাছ লাল লাল ফলে ভরে আছে। ফল থেকে টুপটাপ রস গড়িয়ে পড়ছে। তার গায়ে বড় বড় হুলওয়ালা পোকাতে ছেয়ে গেছে। গাছটার ফল খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে। গাছের গায়েও বড় বড় গর্ত করে ফেলেছে। গাছটা প্রায় মরে যায় যায় অবস্থা। ওর দেখে খুব মায়া হল। ও সব পোকা একটা একটা করে ধরে ধরে মেরে ফেলল। তারপর গাছটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল - আমি সব পোকা মেরে দিয়েছি। আর তোমার কষ্ট হবে না। গাছটা বলল - তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। তাই আমার উপহার হিসেবে এই গাছের একটা ফুল নিয়ে যাও সঙ্গে। এই ফুলের ঘায়ে যে কেউ মূর্ছা যেতে পারে। আবার মূর্ছা যাওয়া লোকের জ্ঞানও ফিরে আসতে পারে। কিন্তু শুধু তোমার হাতে থাকলেই এই মূর্ছাফুল কাজ করবে।


রাজকন্যা গাছ থেকে একটা ছোট্ট সাদা ফুল তুলে নিয়ে সযত্নে তার জামার পকেটে রেখে দিল। তারপর গাছকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর গিয়ে শোনে পাখিরা খুব কিচির মিচির করছে। কি হল কি হল। দেখে একটা বিশাল সাপ এক পাখির বাসায় ডিম খেতে উঠেছে। রাজকন্যা সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে মূর্ছাফুল বার করে ঠেকিয়ে দিলো সাপের গায়ে। সাপটা চোখের নিমেষে অজ্ঞান হয়ে গাছ থেকে পড়ে গেল। তখন পাখিরা জ্ঞ্যানহীন সাপটাকে অনেক দূরের এক জঙ্গলে ফেলে এলো। ডিম বাঁচানোর জন্যে পাখিরা ওকে উপহার দিল একটা অপূর্ব সুন্দর পাখির পালক। একদিকে তার রামধনু রঙ আর অন্যদিকে আকাশের মতো নীল। বলল - এই মুশকিল আসান পালক সব সময় তোমার কাছে রেখ। তুমি যেমন আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করলে তেমন এই পালকও তোমায় সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।


রাজকন্যা পালক নিয়ে, পাখিদের ধন্যবাদ দিয়ে আবার চলতে শুরু করে। বিকেল প্রায় শেষ হতে চলেছে। ছায়াকন্যা লম্বা হতে হতে এতটা লম্বা হয়ে গেছে যে তার মাথাটাই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না এখন। অনেক দূরে দূরে কিছু ছোট বড় পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পায়ের নীচে সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ। আবহাওয়া এখন অনেকটা মনোরম। কিন্তু রাজপ্রাসাদ তো দূরের কথা। কোন বাড়ি বা মানুষের কোন চিহ্নও নজরে পড়ছে না। রাজকন্যা আর বিশাল লম্বা ছায়াকন্যা হেঁটে চলেছে তো চলেছেই। তারপর একসময় টুপ করে সূর্য ডুবে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল ছায়াকন্যা। রাজকন্যার তখন খুব একা লাগল। হাঁটতে একটুও ইচ্ছে করল না। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে শুয়ে পড়ল মাটিতে ঘাসের ওপর। ৪. না জানি কতক্ষন ঘুমিয়ে রইল সে। যখন ঘুম ভাঙ্গলো দেখলো ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। তারা ভরা আকাশ। আকাশে থালার মতো একটা বিশাল গোল চাঁদ। জ্যোৎস্নার মধ্যে মাঠের নরম ঘাসে শুয়ে থাকতে কী ভালোই না লাগছিল। রাজকন্যা অবাক হয়ে ভাবল যে সে রাজকন্যা হয়ে সোনার পালঙ্ক আর মখমলের বিছানা ছেড়ে এই মাটিতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল? শরীরে তাহলে সত্যিই সব সয়ে যায়।


একদম ঠিক কথা বলে লোকে। শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। শুধু যদি খিদে আর তেষ্টাটা না থাকত তাহলে আরো খানিকক্ষন আরামে ঘুমাতে পারত সে। একটু জল না খেলে শরীর আর বইছে না। কিন্তু এত রাত্রে কোথায় জল খুঁজবে। তেষ্টাতে গলাটা এত শুকিয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে এইবার বোধহয় মরেই যাবে। ঠিক তখনই ওর পকেট থেকে সেই মুশকিল আসান পালকটা বেরিয়ে রামধনু রঙের আলোর অক্ষরে হাওয়াতে লিখে দিল – ‘যে সয় সে রয়।’ বেশ কয়েকবার নিজের মনে কথাগুলো বলতেই কথাটার মানে বুঝতে পারল রাজকন্যা। পালক বলতে চাইছে এখন সে কষ্ট সহ্য করতে পারলে তবেই প্রানে বেঁচে থাকবে। তাছাড়া অন্য কোন উপায়ও নেই। শরীরকে বলল – ‘শরীর মহাশয়, একটু কষ্ট সহ্য করো। চল, জলের সন্ধানে আবার হাঁটতে শুরু করি।’ শুরু করল হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখে ছোট্ট একটা বোতল তার পাশে পাশে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। রাজকন্যা খুব অবাক হয়ে গেল। নিচু হয়ে বসে বোতলটা হাতে নিয়ে দেখল ভেতরে একটা ছায়া ছায়া মত কিছু। তার চোখ দুটো জোনাকীর মতো জ্বলছে আর নিভছে। চিঁ চিঁ করে কি সব কথাও বলছে সে। ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। কানের কাছে বোতলটা নিয়ে আসতেই শুনতে পেল তার কথা - দয়া করে, আমায় বোতল থেকে মুক্ত করে দাও। তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো। - কিন্তু তুমি কে? বোতলের ভেতর তোমায় কে ঢোকালো? - আমি সব বলব। তুমি আগে আমায় বার করো। রাজকন্যা তাড়াতাড়ি বোতলের ছিপিটা খুলে দিলো। ছায়ামূর্তি বোতল থেকে বেরিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল - তিন দিন ধরে আমি বোতল বন্দী হয়ে আছি। বোতলের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে বসে থাকতে থাকতে আমার গায়েহাতে ব্যাথা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস তোমার দেখা পেলাম। তুমি যে আমার কতো উপকার করলে তা বলার নয়। এখন থেকে তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো। - তুমি কে? তোমার নাম কি? - আমার নাম ফিসফিস। আমি একটা মেছোভূত।


আগে ছিলাম মাছধরা জেলে। মছলী দ্বীপে থাকতাম। এক দুষ্টু ডাইনী আমাদের দ্বীপটা দখল করে নিয়ে আমাদের সবাইকে মন্ত্রবলে মেছোভূত বানিয়ে দিয়েছে। - এখন তাহলে থাকো কোথায়? - সেই ডাইনী আমাদের একটা রাজপ্রাসাদে থাকতে দিয়েছে। - কিন্তু তোমায় বোতলে ঢোকালো কে? - আমাদের সর্দার নিশপিশ। আমি কাজে ফাঁকি দিয়ে একটু জ্যোৎস্নাতে ভিজছিলাম। তাতে রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে আমাকে বোতল-বন্দী করে ছুঁড়ে একেবারে রাজ্যের বাইরে বার করে দিলো। বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল ফিসফিস। রাজকন্যা আবার এই কান্না ব্যাপারটা একেবারে সহ্য করতে পারে না। বলল - কেঁদো না। তুমি আমার সব কথা শুনে চললে আমি নিশপিশকে সরিয়ে তোমায় দলের সর্দার করে দেব। কিন্তু আগে আমায় তোমাদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে চল। তেষ্টায় প্রান গেল আমার। ফিসফিস ওকে কাঁধে চাপিয়ে চোখের নিমেষে চলে এল রাজপ্রাসাদে। শ্বেত পাথরের বিশাল প্রাসাদ। চাঁদের আলোয় চকচক করছে। চারিদিকে উঁচু প্রাচীর। সামনে বিশাল গেট। কোথাও কোন আলো জ্বলছে না। শুকনো পাতা পড়ে বিশ্রী নোংরা হয়ে আছে।


সামনে একটা জলে ভরা বিশাল সরোবর। সেখানে পেট ভরে জল খেয়ে রাজকন্যা শরীরে প্রান ফিরে এল। তারপর ফিসফিসকে বলল - চলো রাজপ্রাসাদের ভেতরে যাই। খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে। জলদি আমায় কিছু খেতে দাও। শুনেই খুব ভয় পেয়ে গেল ফিসফিস - আমি যাব না ভেতরে। আমায় দেখতে পেলে সর্দার খুব রেগে যাবে। বরং তুমি একটা মাছ খাও। চোখের নিমেষে সরোবর থেকে একটা মাছ ধরে এনে দিল। কিন্তু রাজকন্যা কাঁচামাছ দেখেই আঁতকে উঠলো – ইস, এমন কাঁচা মাছ কী করে খাব? - আমরা তো রোজ এই খাই। - আমি কী তোমার মত মেছোভূত নাকি? তখন ফিসফিস রাজপ্রাসাদের কলাবাগান থেকেই অনেকগুলো কলা পেড়ে এনে দিল। রাজকন্যার কলা খেতে একেবারেই ভাল লাগে না। কলা আবার খাবার মত একটা ফল হল। কিন্তু এত খিদে পেয়েছিল কী আর করে। শরীরকে বলল – ‘ওহে শরীর মহাশয়, সওয়াতে যখন হবেই তখন একটু সয়ে নিন। আর কোন খাবার জুটছে না এখন। কলা-ই খান পেটভরে।’ বলেই সব কটা কলা গপাগপ খেয়ে নিল। খেতে খেতে ভাবল কলাটা আসলে অতটা খারাপ খাবার নয় যতটা সে আগে ভাবত।


৫. ফল খেয়ে জল খেয়ে রাজকন্যার পেট ভরল, মন শান্ত হল। তারপর সরোবরের ধারে মেছোভূত আর রাজকন্যা গল্প করতে বসল। রাজকন্যা বলল - এই রাজ্যের নাম কি? - আগে ছিল আনন্দ রাজ্য। আমরা এসে রাজ্যের নাম পালটে করে দিয়েছি ভূতানন্দ রাজ্য। - আচ্ছা। কিন্তু সেই আনন্দ রাজ্যের রাজা, রানি লোকজন সব কোথায় গেল। - ডাইনীর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। তাই ডাইনী সবাইকে মন্ত্রবলে গাছ করে দিয়েছে। এখানে যত গাছপালা দেখছ তার অনেকেই আগে এই রাজ্যের লোক ছিল। শুধু রাজপুত্রকে ডাইনীটা মেরে ফেলেনি। ঐ যে চিলেকোঠার ঘর দেখছ ওখানেই ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে রাজপুত্রকে। ডাইনী রোজ নিজে এসে দেখে যায়। বলে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো ঘরটা। রাজকন্যা দেখল হাল্কা নীল একটা আলো জ্বলছে। এতক্ষন খেয়াল হয়নি। রাজপ্রাসাদে রাজা রানী না থাক কিন্তু একটা রাজপুত্র আছে শুনেই রাজকন্যার মনে খুব আনন্দ হল। কিন্তু এই ডাইনীটা খুব গোলমেলে। - ডাইনী রাজপুত্রকে বাঁচিয়ে রাখলেন কেন? - তার যে রাজপুত্রকে খুব পছন্দ। সামনের পূর্নিমাতে রাজপুত্রকে বিয়ে করবে বলেছে। - আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারবে রাজপুত্রের ঘরে। - না, আমি কিছুতেই রাজপ্রাসাদে যাবো না। সর্দার দেখতে পেলে আমাকে জল-শাস্তি দেবে। - জল-শাস্তিটা আবার কি? - বোতলে পুরে জলে ফেলে দেবে। তখন কোন মাছ এসে আমায় গপ করে খেয়ে নেবে। আর আমি কোনদিন মুক্তি পাব না। বলেই আবার কাঁদতে লাগল ফিসফিস।


তার কান্না দেখে রাজকন্যার মাথাটা বেজায় গরম হয়ে গেল। - কথায় কথায় কাঁদো কেন? আমি রাজকন্যা হয়ে নিজের দেশ ছেড়ে এমন একটা ভূতের দেশে বসে আছি। কই তাতেও তো আমি কাঁদছি না। শীগ্রি কান্না থামাও। না হলে আমিই তোমায় বোতলে পুরে জলে ফেলে দেব। তাও মেছো ভূত কান্না থামায় না দেখে রাজকন্যা আর রাগ সামলাতে পারলো না। মূর্ছাফুল বার করে ফিসফিসের গায়ে ঠেকিয়ে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ফিসফিস অজ্ঞান হয়ে গেল। তখন তাকে বোতলের ভেতর পুরে ছিপি আটকে দিল। তারপর বোতলটাকে ছুঁড়ে পুকুরে ফেলে দিতে যাবে, এমন সময় মুশকিল আসান পালক রাজকন্যার পকেট থেকে বেরিয়ে এসে হাওয়ায় রামধনু রঙের আলো দিয়ে লিখে দিলো – ‘ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ।’ তখন রাজকন্যার হুঁশ ফিরলো। মনে মনে ভাবল – ক্রোধ মানে এই রাগ ব্যাপারটা সত্যি-ই খুব খারাপ জিনিষ। নাঃ, এতোটা রাগ করা তার একেবারেই উচিত হয়নি। ফিসফিস তো আর মানুষ নয়। একটু না হয় কান্নাকাটি করলই। কিন্তু এখন ও-ই তো রাজকন্যার একমাত্র বন্ধু। একমাত্র কথা বলার সঙ্গী। তা ছাড়া ঐ-ই তো ওর প্রান বাঁচালো। না হলে জল তেষ্টায় ও মরেই যেত আজ। বোতল বন্দী ফিসফিসকে পকেটে পুরে রাখল। পরে যখন দরকার হবে তখন জ্ঞান ফেরালেই চলবে। রাজপুত্রের কাছে যাওয়ার জন্যে রাজপ্রাসাদের গেট দিয়ে ঢুকতে গেল রাজকন্যা। দেখল ভীষন হৈ চৈ চলছে ভেতরে। রাজপ্রাসাদ ভরা অসংখ্য ভূত। কারো মূলোর মতো সাদা সাদা দাঁত, কারো কুলোর মতো চওড়া চওড়া কান, কারো লুচির মতো ফুলো ফুলো গাল, কারো চুলের মতো সরু সুরু হাত। নানা ভূত নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ মাছ খাচ্ছে, কেউ মাছ কাটছে, কেউ মাছ দিয়ে খেলছে। একদিকে অনেক মাছ জড়ো করা। মেছোবাজার বসে গেছে যেন। তারমধ্যে গোটা কুড়ি ভূত রাজপ্রাসাদের চিলেকোঠায় চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচছে আর আর নাকী সুরে গান গেয়ে চলেছে। চাঁদ উঁঠেছে ফুঁল ফুঁটেছে চিঁলেকোঠায় কেঁ ভূঁত নাঁচছে, প্রেঁত নাঁচছে রাঁজপুত্রের বেঁ।

বুঝতে পারল মেছোভূতেদের কাজ কর্ম ফূর্তি আহ্লাদ সব শেষ হওয়ার আগে কিছুতেই এই ভূতপুরীতে ঢোকা যাবে না। একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসে সে অপেক্ষা করতে লাগলো।


৬. ভূতেদের মাছকান্ড দেখতে দেখতে কখন ঝোপের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল রাজকন্যা। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন বেশ রোদ উঠে গেছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। ফুর ফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। কোথাও কোন ভূত নজরে পড়ল না। কোথাও অন্যরকম আওয়াজ পর্যন্ত নেই। রাজপ্রাসাদের সব ঘর ঘুরে ঘুরে দেখল। শুন শান। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু রাশি রাশি সরষে ছড়িয়ে পেড়ে আছে রাজপ্রাসাদময়। তাহলে কী স্বপ্ন দেখেছিল নাকি? কিন্তু এতো স্পষ্ট মনে আছে ভূতগুলোকে। ভূতগুলো নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে আছে। এমনও হতে পারে, সারা রাত জেগে এখন ঘুমাচ্ছে। তখনই ফিসফিসের কথা মনে পড়ল। বোতলটা পকেট থেকে বার করে দেখল। আরে কোথায় ফিসফিস? কিচ্ছু নেই বোতলের ভেতর। মনটা খচখচ করতে থাকল। অমনি মুশকিল আসান পালক পকেট থেকে বেরিয়ে লিখে দিল – ‘সরষের মধ্যে ভূত।’ সরষের মধ্যে ভূত? অবাক কান্ড। তাই জন্যেই রাজপ্রাসাদময় এতো সরষে ছড়ানো?


বোতলটা পরীক্ষা করে দেখল যে বোতলের তলাতেও একটা সরষে দানা পড়ে আছে বটে। তাহলে ঠিকই ফিসফিস বোতলবন্দী হয়ে আছে। দিনের বেলা বলে কি ভূতেরা সরষে হয়ে গেছে? নাকি সেই ডাইনীটা মন্ত্র বলে এরকম করে দিয়েছে ওদের। আহা বেচারা ফিসফিস। জেলে থেকে মেছোভূত হয়েছিল, আবার মেছোভূত থেকে সরষে হয়ে গেল। এখন দরকার পড়লেও ফিসফিসের জ্ঞান ফেরানো যাবে না, কোন কাজেও লাগানো যাবে না ওকে। একটাই মাত্র বন্ধু ছিল সঙ্গে তাকেও হারালো। তবে মুশকিল আসান পালক তো সঙ্গে আছে। সে যে খুব ভালো আর উপকারী বন্ধু তা বুঝতে আর বাকী নেই রাজকন্যার। রাজকন্যা মন খারাপ না করে সোজা গেল চিলেকোঠায় রাজপুত্রের ঘরে। সোনার পালঙ্কে শুয়ে রাজপুত্র ঘুমাচ্ছে। যেমন সুন্দর তার চেহারা তেমন সুন্দর তার পোষাক পরিচ্ছদ। রাজপুত্রকে দেখেই ভালোবেসে ফেলল রাজকন্যা। ভাবল বিয়ে যদি করতে হয় তো এই রাজপুত্রকেই বিয়ে করবে সে।


কিন্তু তার আগে ডাইনী বুড়িটার একটা ব্যবস্থা না করতে পারলে হবে না। অনেক ঠেলাঠেলি, ডাকাডাকি করেও রাজপুত্রের ঘুম ভাঙ্গাতে পারল না। তখনই মনে পড়ল মূর্ছাফুলের কথা। ফুলটা পকেট থেকে বার করে রাজপুত্রের গায়ে ঠেকাতেই রাজপুত্র চোখ মেলে উঠে বসল। রাজকন্যাকে দেখে তো রাজপুত্র খুব অবাক হয়ে গেছে। এমন অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে সে আগে কোনদিন দেখেনি। ভাবল ডাইনী বুঝি রূপ বদল করে এসেছে। কিন্তু দিনের বেলা ডাইনী তো কোনদিন আসে না। রাজকন্যা তার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজের পরিচয় দিলো। বলল তার রাজ্যের কথা। কি ভাবে এখানে এসেছে সব জানালো তাকে। রাজপুত্র তখন খুব খুশী হয়ে ওকেও নিজের সব কথা বলল। বলল তার নাম অনন্ত কুমার। বলল কেমন ভীষন যুদ্ধ হয়েছিল ডাইনীর সঙ্গে। এখনও রোজ রাত্রে সুন্দরী মেয়ে সেজে সেই ডাইনী আসে। গল্প করে রাজপুত্রের সঙ্গে। খেতে দেয়। তারপর মন্ত্র বলে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। বলেছে সামনের পূর্নিমার দিন রাজপুত্রকে বিয়ে করবে। তাই রাজপুত্র খুব চিন্তায় আছে। বলল - চলো এক্ষুনি আমরা দুজনে পালিয়ে যাই অনেক দূরের কোন দেশে। তাহলে ডাইনী আমাদের আর ধরতে পারবে না। রাজকন্যা বলল - আমরা পালিয়ে গেলে তোমাকে হয়তো বাঁচানো যাবে। কিন্তু তোমার মা, বাবা রাজ্যের লোকজন যাদের ডাইনী মন্ত্রবলে গাছ করে দিয়েছে তারা কেউ মুক্তি পাবে না। তার থেকে বরং আমরা চেষ্টা করে দেখি কি করে ডাইনীটাকে মেরে ফেলা যায়। এখনো বেশ কিছুদিন সময় আছে। যদি পূর্নিমার আগে ডাইনীটা না মরে তাহলে আমরা এই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাব। রাজপুত্র রাজী হয়। তারপর দুজনে আলোচনা করে কী করে ঐ ডাইনীকে মেরে ফেলা যায়। রাজপুত্র জানায় ডাইনী খুব শক্তিশালী। তারওপর অনেক মন্ত্র জানে। ওর দলে অনেক ভূত, রাক্ষস, খোক্কস আছে। যেভাবে ও এই রাজ্যকে দখল করেছে তাতে ওকে গায়ের জোরে যুদ্ধ করে হারানো যাবে না। তখনই মুশকিল আসান পালক লিখে দিল – ‘বুদ্ধি যার বল তার।’ আর সেটা দেখেই রাজপুত্রের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বলল - ডাইনী যখন গল্প করবে তখন কথায় কথায় যতটা পারি তার গোপন খবর জেনে নেব। কোথায় তার দেশ? সে অমর কিনা? যদি না হয় তাহলে কী করে মারা যায় ডাইনী কে? তার দূর্বলতা কী? সব কিছু। - তাহলে খুব ভালো হবে। তোমাকে একটু অভিনয় করতে হবে। আজ রাত্রেই চেষ্টা করো জানতে। আমিও এই খাটের তলায় লুকিয়ে বসে থাকব। একবার কাছ থেকে ডাইনীকে দেখতে চাই। যদি কিছু জানা যায়। রাজপুত্রের সঙ্গে অনেক গল্প করে তাকে মূর্ছাফুল দিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে রাজকন্যা চলে এলো নীচে। খুব খিদে পেয়েছিল তার। সারা রাজপ্রাসাদ ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজলো। কিন্তু কিছুই পেলনা। যা ছিল সব ভূতেরা খেয়ে শেষ করে ফেলেছে বোধহয়। একটা ঘরে দেখল মোহর ভরা রাজকোষে খোলা পড়ে রয়েছে। কিন্তু মোহরে তার কী কাজ। তারপর এলো রান্নাঘরে। সেখানে দেখল বেশ কয়েকটা মাছ রাখা আছে। ভূতেরা নিশ্চয় এত মাছ খেয়ে শেষ করতে পারেনি। কড়ায় অনেকটা তেল ঢেলে সে মাছ ভাজতে বসল। কিন্তু আগে তো সে কোন দিন রান্না করেনি। তাই মাছ ভাজাতে গিয়ে খুব মুশকিলে পড়ল। অনেকক্ষন মাছ ভাজার পরেও মাছের রঙ ভাজা ভাজা হল না। নিজের মনেই বলল - মাছ ঠিক ভাজা হচ্ছে না কেন? সঙ্গে সঙ্গে পালকটা ওর পকেট থেকে বেরিয়ে আলোর অক্ষরে লিখে দিলো - ‘উলটে দেখো পালটে গেছে।’ উল্টানো কাকে বলে সেটাই তো জানে না রাজকন্যা। তাই জিজ্ঞাসা করে - উল্টোবো কি করে? তখন পালক নিজে উলটে একবার নীল থেকে রামধনু রঙ হল, আবার রামধনু থেকে নীল। তক্ষুনি ব্যাপারটা জলের মতো পরিস্কার বুঝতে পারল রাজকন্যা। - ও এই সামান্য ব্যাপার। হাসি মুখে খুন্তি দিয়ে মাছের নীচের পিঠটা উপরে করে মাছটা উলটে দিলো। আর দিতেই দেখে সত্যিই তো পালটে গেছে। এখন বেশ মাছটা ভাজা ভাজা হয়েছে মনে হচ্ছে। খুশি মনে বেশ অনেকগুলো মাছ ভেজে থালায় নিয়ে খেতে বসল রাজকন্যা।


আগের স্বভাব মতো মাছের একদিকটা খেয়েই সরিয়ে রাখছিল থালায়। কিন্তু মুশকিল আসান পালক আজ ওকে ছাড়বে না। লিখে দিলো – ‘উলটে দেখো পালটে গেছে।’ রাজকন্যা সঙ্গে সঙ্গে মাছটা উলটে দিল। দেখল আরে সত্যি-ই তো পালটে গেছে। উলটোদিকটা দেখে মনে হচ্ছে মাছটা পুরোটাই গোটা আছে। সে ভাল করে উলটো দিকটাও খেয়ে নিল। তখনই মনে পড়ল মহারাজার কথা। সে ভাজা মাছ উলটে খেতে পারে না বলে কতো দুঃশ্চিন্তা ছিল। যখন এই খবর জানতে পারবে তখন কত খুশিই না হবেন। যাইহোক এখন সেসব ভেবে লাভ নেই। খাওয়া সেরে হাত মুখ ধুয়ে রাজকন্যা রাজপ্রাসাদের পালঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ৭. নানা রকম কথাবার্তার আওয়াজে হঠাৎ ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আর ঘরের মধ্যে গোটা পঞ্চাশ ভূত বকবক করছে। ওকে বিছানায় উঠে বসতে দেখেই একজন বলল - তুমি কে? এখানে কি করে এলে? আর একজন বলছে - এটা ভূতের দেশ জানো না। এখানে কোন মানুষের ঢোকা বারন। ডাইনী জানতে পারলে তোমার রক্ত চুষে খেয়ে নিয়ে তোমাকে মেরে ফেলবে। আর একজন পেছন থেকে বলে উঠলো - একে এখানে আটকে রাখ। আমি এক্ষুনি গিয়ে সর্দারকে খবর দিচ্ছি। তখন রাজকন্যা বলল – তোমরা আগে মাছধরা জেলে ছিলে তো? ডাইনী তোমাদের এরকম ভূত করে রেখেছে। আমি এসেছি তোমাদের মুক্তি দিতে। তোমরা যদি আমার কথা মত কদিন কাজ করো তাহলে আমি এই ডাইনীকে মেরে ফেলে তোমাদের মুক্তি দেব। সবাই মুক্তি পাওয়ার কথায় আনন্দে নেচে উঠলো। কিন্তু ততক্ষনে সর্দার আরো কিছু ভূতকে নিয়ে এসে হাজির। এসেই আদেশ দিল - ওকে বেঁধে রাখো দড়ি দিয়ে। ডাইনী এলেই ওকে নিয়ে যাবে তার কাছে। যা ব্যবস্থা করার ডাইনীই করবে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক ভূত এসে ওকে আক্রমন করল চারিদিক থেকে। রাজকন্যা কী করবে ভাবতে না ভাবতে সেই মুশকিল আসান পালক শুরু করে দিল ওর খেলা। সব ভূতের গায়ে এমন সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করল যে সবাই কাতুকুতুর চোটে অস্থির। হাসছে, কাঁদছে, লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে। পালক তাও থামছে না। শেষে সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, সবাই রাজকন্যার পক্ষে। সবাই রাজকন্যাকে সাহায্য করবে। এপাশে সবাই রাজকন্যার পক্ষে চলে যাওয়ার সর্দার গেল খেপে। বলল - ঠিক আছে। রাজকন্যাকে বাঁধার জন্যে আমি একাই একশ। বলে যেই না কাছে এগিয়ে এসে সর্দার রাজকন্যার হাতটা ধরেছে অমনি রাজকন্যা তার গায়ে মূর্ছাফুল ঠেকিয়ে দিল। আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে সর্দার নিশপিশ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রাজকন্যা তখন বোতল থেকে ফিসফিসকে বার করে ওর জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়ে সবাই কে বলল - আজ থেকে ফিসফিস তোমাদের নতুন সর্দার। সবাই ওর কথা শুনে চলবে। ফিসফিসের তো আনন্দের আর সীমা নেই। ‘ধিন তা না না’ করে নাচতে শুরু করে দিল। আর সেই বোতলের মধ্যে নিশপিশকে পুরে রাজকন্যা বোতলটা তুলে দিল নতুন ভূতের সর্দার ফিসফিসের হাতে। - দেখি তোমার হাতের জোর কেমন। কত দূরে তুমি একে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারো। ফিসফিস গায়ের জোরে কে-জানে-কোন-রাজ্যে ছুঁড়ে ফেল দিল বোতলটা।


৮. রাজকন্যা ভূতেদের সঙ্গে একটা জরুরী মিটিং সেরে নিল। রাজকন্যা ও ফিসফিসের সব কথা শুনে চলবে বলে কথা দিল সব ভূত। তারপর রাজকন্যা চিলেকোঠার ঘরে রাজপুত্রের খাটের তলায় লুকিয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকল ডাইনী বুড়ির জন্যে। রাত একটু বাড়তেই হঠাৎ বিকট আওয়াজ করে কেউ যেন উড়ে এসে নামল। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো রাজপ্রাসাদটা। রাজকন্যা দেখল এক ভয়ানক দেখতে ডাইনী জানলা দিয়ে ঢুকে এলো ভেতরে। এসে একটা বিশ্রী কালো রঙের আলখাল্লা খুলে বাইরে রাখল। তারপর রূপ বদলে করে হয়ে গেল এক পরমাসুন্দরী মেয়ে। সে রাজপুত্রের ঘুম ভাঙ্গালো। রাজপুত্রের সঙ্গে অনেক গল্প করল। খেতেও দিলো। ভালো ভালো খাবারের গন্ধে জিভে জল চলে এলো রাজকন্যার। সেই রাজপ্রাসাদ থেকে চলে আসার পর থেকে তার এই সব খাওয়া জোটেনি। জীবনটাই পালটে গেছে এখন। শরীর মহাশয়-এর ঢের শিক্ষা হয়েছে। গল্প করতে করতে রাজপুত্র একসময় বলল – তুমি রোজ আসো আর রোজ চলে যাও। তোমার সঙ্গে ভালো করে গল্প করা হয়না কোনদিন। আজ তুমি এখানেই থাকো। ডাইনী বলল - থাকতে কি আর আমারই ইচ্ছে করে না? কিন্তু অনেক কাজ। এই তো আর মাত্র কদিন। সামনের পূর্নিমাতেই তো আমরা বিয়ে করব। তারপরে তোমাকে নিয়ে চলে যাব আমার রাজ্যে। তখন অনেক গল্প হবে। রাজপুত্র ভেতরে ভেতরে একটু ভয়ে কেঁপে উঠলো। কিন্তু প্রকাশ করল না। বলল - এত কাজের লোক থাকতে তোমার আবার এত কাজ কী শুনি? - খুব বড় দায়িত্ব আমার উপর। সে তুমি বুঝবে না। - বুঝবো না কেমন? বলে দেখ দিকি। আর কদিন পরে তোমাকে বিয়ে করলে তো আমাকেই তোমার সব দায়িত্ব নিতে হবে। না বুঝলে চলবে কেন? - তা ঠিকই বলেছ। তোমাকে বলাই যায়। আসলে একটা কই মাছের প্রান রক্ষার দায়িত্ব আছে আমার ওপর। তাকে সারাদিন পাহারা দিতে হয়। - একটা সামান্য কই মাছ তুমি সারাদিন পাহারা দাও? সে দেশে তো তোমার কত চাকর বাকর দাস দাসী। কাউকে একটা পাহারায় বসিয়ে রাখলেই তো পারো। - না, আর কাউকে আমার বিশ্বাস হয় না। এ তো আর যে সে কই মাছ নয়। এই কই মাছের পেটের মধ্যে এক সোনার কৌটে আমার প্রানভ্রমর রাখা আছে। - তাহলে তো খুব জরুরী ব্যাপার। কিন্তু তুমি যে রোজ রাত্রে এখানে আসো তখন যদি কেউ সেই মাছ ধরে নেয় তাহলে কী হবে। তুমি মরে গেলে আমার তো আর কেউ থাকবে না। - দূর! মাছ ধরা কি এত সহজ নাকি। এত গভীর রাত্রে সাতটা সমুদ্র পেরিয়ে কে যাবে সেখানে? তারপর তিন তিনটে দূর্গম পাহাড় টপকে তবে সেই সরোবরে পৌঁছতে হবে। সরোবরে তাকে ধরাও কি আর সোজা কথা। সরোবরের জল যেমন কালো, কই মাছের রঙ ও তেমন কালো মিশমিশে। - যাক শুনে নিশ্চিন্ত লাগছে। এতো কান্ড করে কই মাছ ধরা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। - একেবারেই চিন্তা কোরো না। তাছাড়া সেই কই মাছের পেট থেকে কৌট বার করলেও তো আমার প্রানভ্রমরের নাগাল পাবে না। সেই বাক্স খুলতে চাই এক সোনার চাবি। সে চাবি সবসময় আমার কাছে আমার আলখাল্লার পকেটে থাকে। - এটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছ তুমি। তারপর ডাইনী অনেক গল্প করে রাজপুত্রকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর সেই বিচ্ছিরি কালো আলখাল্লা গায়ে দিয়ে ডাইনী রূপ ধারন করে উড়ে চলে গেল চিলেকোঠার জানলা দিয়ে।


৯. পরদিন সন্ধ্যেবেলা রাজকন্যা সব কথা জানল ভূতেদের। ঠিক হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই ডাইনী বুড়ির দেশে যেতে হবে। ভূতেরা বলল তাদের কয়েকজনকে যদি রাজকন্যা সঙ্গে নিয়ে যায় তাহলেই তারা ঠিক কই মাছ ধরে ফেলতে পারবে। সেই কথামত গোটা পঁচিশ সাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ভূত বেছে নিল রাজকন্যা। ফিসফিসকে বলল - তুমি এখানেই থাকবে। রাজপ্রাসাদের সবকিছু দেখা শোনার ভার তোমার ওপর। ডাইনী এসে যেন বুঝতে না পারে যে ভূতের সংখ্যা কমে গেছে। আর একটা খুব দায়িত্বপূর্ন কাজও তোমাকে করতে হবে। পরদিন রাত্রে যখন ডাইনী এসে তার আলখাল্লাটা খুলে রাজপুত্রের ঘরে ঢুকবে তখন তার আলখাল্লার পকেট থেকে সোনার চাবিটা বার করে নিয়ে সেখানে একটা লোহার চাবি ঢুকিয়ে দিতে হবে। খুব সাবধানে। খবরদার ডাইনী যেন টের না পায়। ফিসফিস বলল – সে আমি সব করে দেবো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হল কি ভাবে যাবে অতদূর দেশে? সাতটা সমুদ্র আর তিনটে পাহাড় পেরোনো তো সহজ কথা নয়। এ দেশে পক্ষীরাজ ঘোড়াও নেই যে তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। - কেন? মেছোভূতেরা পারবে না উড়িয়ে নিয়ে যেতে? - কিছুদূর পারবে। কিন্তু ভূতেরা একটানা বেশি দূর যেতে পারে না। অত দূরে যেতে যেতে রাত শেষ হয়ে গেলেই তো আবার সব ভূতেরা সরষে হয়ে যাবে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। - খুব মুশকিলের ব্যাপার হল। আর তখনই মুশকিল আসান পালক বেরিয়ে এলো তার পকেট থেকে। তার গা থেকে রামধনু রঙের অদ্ভূত এক আলো বেরোতে শুরু করল। আর দেখতে না দেখতে সে একটা ভীষন সুন্দর রামধনু রঙের পাখিতে পরিনত হল। বলল - আমি পক্ষীরানি মায়া। আমার পিঠে চেপে বসো। আমি পৌঁছে দেবো সেই ডাইনী রাজ্যে। রাজকন্যার তো খুশির শেষ নেই। চেপে বসল পক্ষীরানির পিঠে। সব ভূতরাও চেপে বসল। নীল সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল, নানা অচেনা দেশের ওপর দিয়ে রামধনুর মতো ওরা ভেসে যেতে থাকল। ভাসতে ভাসতে ঠিক রাত শেষ হওয়ার একটু আগে পৌঁছে গেল ডাইনীর দেশে। তখনও সেখানে সবাই ঘুমিয়ে। ওরা সেই পাহাড়ে ঘেরা কালো সরোবরের পাশে এক গুহায় গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকল। দিন হতে না হতেই ভূতেরা হয়ে গেল সরষে আর পক্ষীরানিও ফিরে এলো তার পালক মূর্তিতে। আবার সন্ধ্যে হতেই ভূতেরা ফিরে পেল নিজেদের শরীর। ডাইনী যেই উড়ে গেল আনন্দ রাজ্যের রাজপুত্রের কাছে অমনি ভূতেরা নেমে পড়ল সরোবরের কালো জলে কই মাছ ধরতে। বেশীক্ষন লাগল না তারা কই মাছ ধরে এনে দিল রাজকন্যার হাতে। সঙ্গে সঙ্গে কই মাছকে ফুলের ঘায়ে অজ্ঞান করে দিল রাজকন্যা। তারপর পক্ষীরানির পিঠে চেপে ফিরে চলল রাজপ্রাসাদে। রাজপ্রাসাদ থেকে একটু দূরে একটা অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে নামল তারা। যাতে ডাইনীর কোন সন্দেহ না হয়। তারপর পালক নিয়ে ভূতের পিঠে চেপে রাজকন্যা পৌঁছে গেল রাজপ্রাসাদে। চুপিচুপি ঢুকলো রান্নাঘরে। ডাইনী তখনও রাজপুত্রের ঘরেই গল্প করছে। ফিসফিসকে ডেকে পাঠালো রাজকন্যা। ফিসফিস আগে থেকেই সোনার চাবি উদ্ধার করে রেখেছিল। রাজকন্যা একটুও সময় নষ্ট করল না। কই মাছের পেট বঁটি দিয়ে এক কোপে কেটে বার করল সোনার বাক্স। সেটা সোনার চাবি দিয়ে খুলে ফেলতেই বেরিয়ে পড়ল ডাইনীর প্রানভ্রমর। বিশ্রী কালো রং-এর ভোমরাকে বঁটি দিয়ে দু’টুকরো করে ফেলল রাজকন্যা। আর সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্র দেখলো তার সামনে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটি এক ভয়ানক দেখতে ডাইনীতে পরিনত হয়ে যাচ্ছে। তার গোটা গা যন্ত্রনায় কালো হয়ে যাচ্ছে। আর ভয়ংকর আর্তনাদ করতে করতে সেই ডাইনী চিলেকোঠার জানলা দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেলো আকাশে। আর দেখতে না দেখতে সব ভূত আর রাজকন্যাদের চোখের সামনেই ডাইনীর বিশ্রী বিশাল শরীরটা আছড়ে পড়ল মাটিতে। সবাই রাজকন্যার জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো।


১০. সবাই ডাইনীর শরীরটাকে ঘিরে দাঁড়ালো। রাজকন্যা শুনতে পেল একটা মিষ্টি বাজনা বাজছে কোথাও। চোখে পড়ল ডাইনীর গলায় একটা সোনার হারে একটা ছোট লকেট ঝুলছে। বুঝতে পারল সেই লকেটেই জলতরঙ্গের মত মিঠে বাজনাটা বাজছে। রাজকন্যা তাড়াতাড় গিয়ে লকেটটা খুলে নেয়। তার একটা ছোট্ট বোতাম টিপতেই সেটা বাক্সের মতো খুলে যায়। আর তার ভেতরে জ্বলে ওঠে একটা সবুজ আলো। সেই আলো বাক্স থেকে বেরিয়ে সারা রাজপ্রাসাদ আলোয় ভরিয়ে তোলে। নিমেষের মধ্যে মেছোভূতেরা সবাই আবার মাছধরা জেলে হয়ে যায়। সেই আলো তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা রাজ্য জুড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আওয়াজে ভরে যায় গোটা রাজ্য। রাজপ্রাসাদ ভরে ওঠে রাজা রানি মন্ত্রী সেনাপতি সভাসদ আর সব হারিয়ে যাওয়া মানুষে। রাজ্য ভরে ওঠে জনগনে। রাজপ্রাসাদ আবার ঝকঝকে চকচকে হয়ে যায়। ঝাড়বাতিতে আর সব বাতিদানে আলো জ্বলে ওঠে। ফোয়ারাগুলো চালু হয়ে যায়। হাতি শালে হাতি ঘোড়া শালে ঘোড়া ভরে যায়। সরোবরে টলটলে জল। সেখানে পদ্ম ফুটে ওঠে। রাজহাঁসেরা চরে বেড়ায়। আনন্দ আর ধরে না রাজপুরীতে। রাজপুত্র, রাজা আর রানী সবাই একে অপরকে দেখে খুশিতে আনন্দে ভেসে যায়। সবাই এসে রাজকন্যাকে তাদের প্রান রক্ষার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানায়। ফিসফিস সহ সব মাছধরা জেলেদের তাদের সাহসিকতার জন্যে পুরস্কৃত করা হয়। আনন্দ রাজ্যের রাজা দূত মারফত নিশ্চিন্ত রাজ্যে খবর পাঠান। মহারাজ অচিন্ত্য সিংহ রাজকন্যা নন্দিনীর খবর পেয়ে খুব খুশী হন। রাজকন্যা ভাজা মাছ উলটে খেতে শিখে গেছে এবং একটা রাজ্যের সবাইকে উদ্ধার করেছে শুনে তাঁর আহ্লাদে আর গর্বে বুক ফুলে ওঠে। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যময়। আর রাজ্যের সব লোকের মাথার চুল আবার আগের মতো কালো হয়ে যায়। দুই রাজ্যে শুরু হয়ে যায় আনন্দ উৎসব। মহা ধুমধাম করে রাজকন্যা আর রাজপুত্রের বিয়ে হয়। রাজপুত্র অনন্ত কুমার আর রাজকন্যা নন্দিনী সুখে শান্তিতে ও আনন্দে বসবাস করতে থাকে।


Rate this content
Log in