Aparna Chaudhuri

Children Stories Horror Classics

4.3  

Aparna Chaudhuri

Children Stories Horror Classics

বিনুর পেন

বিনুর পেন

5 mins
606


বাব্লু মানে অরিত্র ছেলেটা খুবই শান্তশিষ্ট। কারুর সাতে পাঁচে থাকে না। একেবারেই গোবেচারা। কিন্তু তাতেও ওর দুর্ভোগের অন্ত নেই। ক্লাসের সব দুষ্টু ছেলেরা ওকেই বেছে নেয় যত বাজে কাজগুলো করার জন্য। আর ও যদি না করে তাহলে ওর আর রক্ষা নেই।

এই তো সেদিন ক্লাস সেভেন আর এইটের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছিল। কিন্তু দুই দলের ক্যাপ্তেন অরুণদা আর কিশোরদা বাব্লুকে ধরে নিয়ে গেল।

“ এই শোন এই গাছের নীচে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবি আর যেই বল ওই মাঠের পাশের নালায় গিয়ে পড়বে তুলে আনবি বুঝলি।“

বাব্লু ওদের কথামত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। জানে যদি ওদের কথা না শোনে তাহলে রাম গাঁট্টা খাবে দুই ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে।

ব্যাপারটা কিন্তু এরকম হবার কথা ছিল না। বাব্লু যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলটা ওর ঠাকুরদাদার বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ছিলেন জেলার ফার্স্ট বয়। পরে ব্যারিস্টারি করে অনেক অর্থ রোজগার করেছিলেন। বাব্লুরা এখন যে বিশাল বাড়িটায় থাকে সেটাও উনিই বানিয়ে ছিলেন। বাব্লুর বাবা ঠাকুরদা সবাই ওই স্কুলের ট্রাস্টি । সে হিসেবে দেখতে গেলে সবার বাব্লুকে সমীহ করেই চলা উচিৎ। বাব্লুর ভাই টাব্লুকে সবাই সমীহ করেই চলে । যদিও টাব্লু বয়সে বাব্লুর চেয়ে দু বছরের ছোট। বাব্লু পড়ে ক্লাস সিক্সে আর টাব্লু ফোরে।

বাব্লু অনেক পড়ে কিন্তু কিছুই মাথায় রাখতে পারেনা। ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ অবধি পাশফেল নাই বলে ওর ক্লাসে উঠতে কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ক্লাসের টিচাররা ওর বাবাকে ডেকে নিজেদের চিন্তা ব্যক্ত করতে ছাড়েন না, “ কি বলবো রায়বাবু , অরিত্র যে আপনার ছেলে মনে হয় না। ক্লাস ফাইভ অবধি তো চলে গেল কিন্তু সিক্স থেকে কি হবে? ওকে একটু বোঝান।“


তা বোঝাতেন বাবা, বাড়ী এসেই। হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে। মা এসে বাঁচাতেন বাব্লুকে।

ক্লাস সিক্সের হাফ ইয়ারলির রেজাল্ট বেরোল। যথারীতি টাব্লু ক্লাসে ভালো নম্বর পেয়েছে আর বাব্লু অঙ্ক আর ইংরাজিতে ফেল করেছে। আর বাকি বিষয় গুলোতেও নম্বর একেবারে তলানিতে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাড়ী এসে বাবার সঙ্গে দেখা করে গেলেন। জানিয়ে গেলেন বাব্লু নির্ঘাত রায়বাড়ির নাম ডোবাবে।


ফলে বাব্লুর ভাগ্যে সেদিন মারাত্মক উত্তম-মধ্যম জুটল। সেদিন মা গিয়েছিলেন মাসির বাড়ী বেড়াতে, তাই বাঁচাবারও কেউ ছিল না। মারার পর বাবা বাব্লুকে বড় দাদুর ঘরে আটকে রেখে দিলেন। কানাই ঠাকুরকে বলে দেওয়া হল যাতে বাব্লুকে খেতে না দেয়।

এই বড় দাদুর ঘর হল বাব্লুর ঠাকুরদাদার বাবার ঘর। উনি এই ঘরেই মারা গিয়েছিলেন। তারপর থেকে ঘরটায় আর কেউ বিশেষ ঢোকে না। ঘরে ওনার ব্যবহার করা আসবাব পত্র সব যেমন ছিল তেমনি রাখা আছে। ঘরের দেয়ালে ওনার একটা বিশাল তৈলচিত্র।

বাবা বাব্লুকে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিলেন। বাব্লু ঘরে ঢুকে দরজাটার পাশে গুটিসুটি মেরে মাটিতেই বসে পড়ল। ভয়ে তখন ওর চোখের জল শুকিয়ে গেছে। ঘরটা থেকে কেমন একটা ভ্যাপসা ভ্যাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে। কারণ বহুদিন ধরে এ ঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ। ওপরের স্কাইলাইট থেকে একটা হাল্কা আলো এসে পড়ছে উল্টো দিকের দেয়ালে। সেই আলোতেই একটা হাল্কা আলো-আঁধারী সৃষ্টি হয়েছে সারা ঘরে।

বাব্লুর চোখ পড়লো বড় দাদুর ছবির ওপর। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। কিন্তু বারবার চোখটা ওইদিকে চলেযেতে লাগলো। হঠাৎ ওর মনে হল বড়দাদুর চোখটা একটু নড়ে উঠলো। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে ও চোখ বুজল। খানিকক্ষণবাদে চোখ খুলল। প্রথমে ভেবেছিল ওদিকে আর চাইবে না। কিন্তু কৌতূহল বড় খারাপ জিনিষ। খানিকক্ষণ বাদে ও ঠিক ওদিকে চাইল। আর দেখলো বড় দাদুর ছবির হাতটা উঠে ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।


প্রথমে তো ভয়ে ওর হাতপা অবশ হয়ে গেছিল কিন্তু খানিকক্ষণ বাদে ওর মনে একটু সাহস এলো। ও গুটিগুটি পায়ে ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ছবিটা ফিসফিস করে বলে উঠলো ,” বাব্লু আমি তোমাকে একটা জিনিষ দেব যাতে তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। “

ওনার কথা শেষ হতেই ছবির তলা থেকে একটা হলুদ-কালো রঙের ফাউন্টেন পেন গড়িয়ে পড়লো।

“তুমি এই পেনটা রাখো। মন দিয়ে পড়াশোনা কর আর পরীক্ষায় এটা দিয়ে লেখ তাহলে তোমার নম্বর কখনই কম আসবে না।“

বাব্লু তাড়াতাড়ি পেনটা তুলে নিয়ে নিজের পকেটে রেখেদিল।

বাব্লু কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই । সন্ধ্যাবেলায় মা এসে দরজা খুলতে ওর ঘুম ভাঙল। মা ওকে বাইরে নিয়ে গিয়ে স্নান করতে পাঠালেন। কারণ ওর সারা গায়ে ওই বন্ধ ঘরের ধুলো।


জামা খুলতে গিয়ে বাব্লু দেখলো ওর পকেটে রয়েছে সেই পেনটা। ও তাড়াতাড়ি ওটাকে নিজের পেন্সিল বক্সের মধ্যে লুকিয়ে রাখল।

এর একমাস বাদে শুরু হল বাব্লুদের সেকেন্ড ইউনিট টেস্ট। এই পরীক্ষাতেই দেখা যাবেই ওই পেনের গুণ।

পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে সবাই অবাক! ক্লাসে প্রথম হয়েছে বাব্লু। 

স্বভাবতই স্কুলে ওর সম্মান বেড়ে গেল। আজকাল আর কেউ বাব্লুকে আগের মত বিরক্ত করে না।


তারপর থেকে সব পরীক্ষাতেই বাব্লুর ফল দেখবার মত। কিন্তু বেশীদিন এই পেনের খবর গোপন রইল না। একদিন ঘরে ঢুকে বাব্লু দেখে টাব্লু ওর পেনসিল বক্স থেকে কিছু একটা বার করছে। দেখেই ও ছুটে এলো, “ আমার পেন্সিল বক্সে কেন হাত দিয়েছিস?”

“ একটা রাবার চাই তাই...... দাদা এই মান্ধাতার আমলের পেনটা কোথা থেকে পেলি তুই?”

“ওটা আমার লাকি পেন। খবরদার হাত দিবি না।” বলে চেঁচিয়ে উঠলো বাব্লু।

কিন্তু ছোটদের যেটা করতে মানা করা হয় সেটাই তারা বেশীকরে করে। টাব্লুও সেই পেনটা হাতে নিয়ে মারল দৌড়,” দাঁড়া দেখাচ্ছি এটা মাকে।“


পিছনে তাড়া করলো বাব্লু। ছুটতে ছুটতে পা আটকে টাব্লু গেলো পড়ে আর ওর হাত থেকে পেনটা ছিটকে পড়ে দু টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল।

বাব্লু একেবারে ভেঙ্গে পড়লো। আর তিনদিন বাদে ওর বার্ষিক পরীক্ষা শুরু। ওর মনে ভালো রেজাল্ট করার আর কোনও আশাই রইল না।


পরীক্ষার আগের দিন ও ভীষণ ভয়ে ভয়ে ঘুমোতে গেল। রাতে ভালো করে ঘুম হল না। ভোরের দিকে ও স্বপ্নে দেখলো ওর একটা চেয়ারে বসে আছেন ওদের বাড়ীর বারান্দায়। ওকে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। ও কাছে যেতেই উনি হেসে বলে উঠলেন,” ওরে বোকা অত ভয় পাচ্ছিস কেন? পেনটা ভেঙ্গে গেছে তো কি হয়েছে? তুই পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে পড়াশোনা করে তৈরি হয়েছিস তো? তাহলে যে পেন দিয়েই লিখিস না কেন ফল ভালো হবে। ভাবে মাথা, লেখে হাত। পেন তো একটা যন্ত্র মাত্র তার কি ক্ষমতা তোকে ভালো রেজাল্ট করায়!”


ঘুমটা ভাঙে গেল অরিত্রর। মন থেকে ভয় অনেক তা কমে গেছে। অন্য একটা পেন নিয়ে ও পরীক্ষা দিতে গেল।

ফল বেরোতে দেখা গেল অরিত্র আবার ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। রেজাল্টটা হাতে নিয়ে অরিত্র ওর বড়দাদুর ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রণাম করার জন্য মাথাটা ছবির ফ্রেমে ঠেকাতেই, কে যেন ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো,” ভয়কে জয় কর, আর পরিশ্রম কর, সাফল্য আসবেই।“


Rate this content
Log in