sunanda sanyal

Children Stories Classics Inspirational

4.9  

sunanda sanyal

Children Stories Classics Inspirational

Goal...জয়, পরাজয়, গৌরব

Goal...জয়, পরাজয়, গৌরব

9 mins
2.2K


প্রথম দৃশ্য


ঘড়িতে সময় দুপুর ৩টা। কাঁকুলিয়া রোড, কলকাতা। রাস্তার মোড়ে দুধের ডিপোর পাশে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের পোষাক পরিহিত একটি চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রুট এস ১০৪ গোলপার্ক বি বা দী বাগ মিনিবাস থেকে একজন তিরিশ উর্ধ্ব ব্যক্তি নামার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে অপেক্ষারত ছেলেটি ধীরে ধীরে ওই ব্যক্তির দিকে এগিয়ে গেলো।


- স্যার, আমি আপনাকে একটি অনুরোধ করতে চাই।


- বলো অনীক। তোমার অনুরোধ কি সেটা শুনি।


- স্যার, ফুটবল আমার খুব পছন্দের খেলা। আপনি নিশ্চুই জানেন যে দুই সপ্তাহ পড়ে এই মরশুমের আন্তঃ স্কুল জেসুয়েট কাপের ফাইনাল খেলা হবে আমাদের স্কুল মাঠে। সেন্ট জেভিয়ার্স বনাম ডনবক্স লিলুয়া। ডনবক্স লিলুয়া ফুটবলের সেরা দল। এদেরকে পরাজিত করা আমাদের কাছে কাল্পনিক ঘটনার মতো বিষয়। এই খেলায় আমি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের অধিনায়ক এবং আক্রমণভাগের প্রধান খেলোয়াড়। কাল্পনিক বিষয়কে বাস্তব করার জন্য আমার আর একটু বেশি অনুশীলন প্রয়োজন।


- আচ্ছা বেশ! আমি তোমায় কি ভাবে সাহায্য করবো বলো?


- স্যার, আপনি আমায় স্কুল ছুটির পরে যে সময়ে পড়াতে আসেন যদি ওই সময়ে না এসে এক ঘন্টা পরে আসেন তাহলে খুব উপকার হয়। আপনারও একটু বিশ্রাম হবে, আমারও অনুশীলন হবে।


- আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তাই হোক।


- আর একটা অনুরোধ স্যার।


- বলো অনীক।


- এই পরিকল্পনার কথা যেন শুধুমাত্র আপনার আর আমার মধ্যেই গোপন থাকে। আমার বাবার কানে এই কথা গেলে আমায় ফুটবল খেলা বিসর্জন দিতে হবে।


- তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে খেলো অনীক। তবে তোমার কাছেও আমার একটা অনুরোধ থাকবে।


- বলুন স্যার।


- সামনেই বোর্ডের পরীক্ষা। তোমার ফলাফলে উন্নতি করানোর জন্য তোমার বাবা আমায় গৃহ শিক্ষক পদে নিযুক্ত করেছেন। তোমার পরীক্ষার ফলাফলে উন্নতির সঙ্গে আমার সম্মান বিষয়টা নিবিড়ভাবে যুক্ত। তাই পড়াশোনাও তুমি ফুটবলের মতো মনোযোগ সহকারে করবে এটা আমি আশা করবো।


- নিশ্চুই স্যার।


দ্বিতীয় দৃশ্য


কাঁকুলিয়া রোডের ১/২ রাধাপ্রভাস কুঞ্জের বড় অট্টালিকা। অট্টালিকার দ্বিতীয় তলে পড়াশোনার ঘর। পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে অনীক। আর সামনের চেয়ারে নিরাশ হয়ে বসে আছে অনীকের স্যার।


- অনীক, বাবা অনীক! ওঠো! ওঠো! তোমার বাবা কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে একটু তো আমাদের পড়াশোনা হোক।


অনীক ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে।


- স্কুল তারপর ফিরে এসে ফুটবল অনুশীলন মিলিত ধকলে তোমার ঘুম আসাটাই স্বাভাবিক। সবই হচ্ছে, আমার একঘন্টা বিশ্রাম, তোমার ফুটবল অনুশীলন, শুধু পড়াশোনা হচ্ছে না। তোমার বাবাকে আমি মুখ দেখাতে পারবো কি না সন্দেহ বাড়ছে।


- স্যার, চলুন একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করা যাক। ভালো সময় ঘুম থেকে তুলে দিয়েছেন বাবার বাড়িতে আসার সময় হয়ে গেছে।


কিছু সময় পরে একজন পঞ্চাশ বছর ছুঁইছুঁই সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তি পড়ার ঘরের দরজার সামনে এসে উপস্হিত হলো।


- স্যার, ছেলে কেমন পড়াশোনা করছে? সামনে পরীক্ষা। আমি তো চিন্তিত। ব্যবসার কাজের জন্য সময় দিতে পারি না একদম। আপনি আমার একমাত্র ভরসা। বাড়ির একমাত্র ছেলে মা, পিসিদের অপরিমিত আদরে বাঁদর হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ওর প্রতি আমি একমাত্র খুব কঠোর। জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে আমি ওকে তেজ্য পুত্র করতে দু বার ভাববো না।


- না, না, এভাবে বলবেন না অভীকবাবু। অনীক ভালো ছেলে। আমি আশাবাদী ও একদিন আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে।


- যাক! নিশ্চিন্ত হলাম। আমি আসি। আপনারা continue করুন।


তৃতীয় দৃশ্য


সেন্ট জেভিয়ার্স ফুটবল মাঠ, আন্তঃ স্কুল জেসুয়েট কাপের ফাইনাল, ডনবক্স লিলুয়া বনাম সেন্ট জেভিয়ার্স। ডনবক্স লিলুয়া‌‌ মাঝমাঠে দখল নিয়ে একের পর এক‌ আক্রমণ করে বিপক্ষ দলের রক্ষণভাগ, মাঝমাঠকে থিতু হওয়ার কোন সুযোগ দেয় না, সেন্ট জেভিয়ার্সের বিরুদ্ধেও এই একই কৌশলে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট জেভিয়ার্সের গোলরক্ষক বিক্রমের অসাধারণ তিনটে গোল বাঁচানোর জন্য প্রথমার্ধ্ব শেষে খেলার ফলাফল শূণ্য-শূণ্য।


- অনীক, কতক্ষণ আর ধরে রাখা যাবে? আমরা তো ওদের ডি বক্সের মধ্যেও ঢুকতে পারছি না।


- ওদের ধরে রাখা নয়, ম্যাচটা আমরাই জিতবো, এই বিশ্বাসটা আমাদের ধরে রাখতে হবে, মুরশেদ। লোথার ম্যাথিউজের মতো মাথা থান্ডা পা গরম রাখতে হবে আমাদের।


দ্বিতীয়ার্ধ্বেও ছবি বিশেষ কিছু পরিবর্তন হলো না। মূহুর্মূহু আক্রমণ তবে এবার দেখে মনে হচ্ছে জেভিয়ার্সের রক্ষণটা প্রথমার্ধ্বের থেকে আরও মজবুত। খেলা শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগে জেভিয়ার্সের মুরশেদ ডনবক্সের মাঝমাঠের একজন খেলোয়াড়ের থেকে বল ছিনিয়ে এগোতেই দেখলো সামনের অনেকটা মাঠ অসুরক্ষিত, রক্ষণভাগে কোন খেলোয়াড় নেই। বল নিজ পায়ে নিয়ন্ত্রণে রেখে দুরন্ত গতিতে দৌড়াতে শুরু করলো মুরশেদ। সমান্তরালে মুরশেদের ডানদিক থেকে দৌড় শুরু করলো অনীক।

     মুরশেদ ডনবক্স লিলুয়ার ডি বক্সে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ডনবক্সের গোলরক্ষক গোল ছেড়ে বেরিয়ে এসে মুরশেদের শট নেওয়ার পরিধি ছোট করার জন্য সচেষ্ট হয়। মুরশেদ ডান পায়ের আলতো ছোঁয়া দিয়ে‌ বলটা পাস করে দেয় অনীকের পায়ে। দৌড়ানো অবস্হাতেই গতিশীল বলে ডান পা ব্যবহার করে দলের জন্য গোল এনে দিলো অনীক। এক মূহুর্তের জন্য সবাই স্তব্ধ। ডনবক্স লিলুয়ার বিরুদ্ধে জেভিয়ার্স গোল করেছে! সত্যি! স্তব্ধতা ভাঙলো রেফারির বাজানো খেলা ভাঙবার বাঁশির শব্দ। তারপর শুরু হলো গোল ও খেলা জেতার উদযাপন।

          ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেলো অনীক। অনীককে মাঠেই জড়িয়ে ধরলেন সেন্ট জেভিয়ার্সের শিক্ষক তথা অনীকের গৃহ শিক্ষক।

 

- তোমরা খুব ভালো খেলেছো। মুরশেদের দৌড় দেখে মনে হয়েছিল বাজ্জিও ওয়ান ম্যান শো হবে। কিন্তু তুমি ক্যানিজিয়া হলে আর মুরশেদ‌ মারাদোনা। আমাদের‌ প্রথম পরিকল্পনা তো মহা সার্থক হলো। এবার শুধু পড়াশোনা।


অনীকের মুখে জয় করবার হাসি।


চতুর্থ দৃশ্য


জেসুয়েট কাপ ফাইনাল খেলার পরের দিন, রবিবার, সকাল। রাধাপ্রভাস কুঞ্জের একতলার খাবার টেবিলে অনীক আর তার বাবা গরম গরম ফুলকো লুচি আর আলুর সাদা তরকারি খেতে ব্যস্ত। হঠাৎ বাড়িতে একজন চল্লিশ বছর উর্ধ্ব, শাড়ি পড়ার এবং চুল বাঁধার কৌশল দেখে সহজেই আধুনিকা বলে অনুমেয় মহিলার প্রবেশ ঘটে। মহিলার হাতে একটি সংবাদপত্র।


- দাদা, বৌদি! এসব কি হচ্ছে? এইভাবে ছিনিমিনি খেলছো অনীকের জীবন নিয়ে! ফুটবল খেলে ও কি করবে?


- কি সব বলছিস বোনটি? অনীক ফুটবল খেলছে!


- এই দেখো, কাগজে নাম বেরিয়েছে। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের হয়ে জয়সূচক গোলটি করেছেন দলের অধিনায়ক অনীক।


- সে কি ! মুরশেদের দৌড় আর বল পাস করার কথাটা লেখেনি কাগজে! কি মারাত্মক হাল ক্রীড়া সাংবিদকতার!


- ওসব বাদ দে গর্দভ। কি বুঝিস সাংবাদিকতার! তুই ফুটবল খেলিস? ছিঃ!ছিঃ! পড়াশোনা বাদ দিয়ে বল নিয়ে মাঠে দৌড়াস। হায় ভগবান! কই পঙ্কজ স্যার তো কিছু বলেননি আমায়। পঙ্কজ স্যারকে তো বুদ্ধিমান মনে হতো, সে যে বিশ্বাসঘাতকতা করবে বুঝতে পারিনি।


- বাবা, তোমার যা বলার আমাকে বলবে কিন্তু স্যারের সম্পর্কে কোনরকম কটূক্তি বরদাস্ত করবো না। তোমাদের মতো অভিভাবকদের জন্য অনেক পড়ুয়ারা শিক্ষকদের সম্মান করতে ভুলে গেছে। স্যারকে কোন অপমান নয়। হ্যাঁ, আমি ফুটবল খেলি, খুব ভালো খেলি। তোমরা এমনভাবে বলছো যেন খুব অপরাধ করে ফেলেছি। বাবা, তুমি টোরেস, আবিদ, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, মাজিদ বাসকারদের ভুলে গেছো?


- ফুটবল খেলে যখন ভবিষ্যতের বারোটা বাজবে তখন কোন স্যার, কোচ, ফুটবলার তোমার মুখে ভাত তুলে ধরবে না। আসতে হবে আমার কাছেই। আর টোরেস, আবিদরা ব্যতিক্রম। মাথায় রাখবি Exception proves the rule. আমি তোমার গৃহশিক্ষক পরিবর্তন করবো। পঙ্কজ স্যার আর নয়। পরীক্ষার আর বেশিদিন নেই। আশা করবো ফুটবল ভুলে তুমি পড়াশোনায় মনোযোগ দেবে।


- হ্যাঁ, ফুটবল খেলা বন্ধ কর অনীক। আমি তোর পিসি, ভাইপোর কোনদিন ক্ষতি চাইবো না। দেখ তো কেমন কালো হয়ে যাচ্ছিস, জন্মের সময় সবাই বলেছিলো পুরো সাহেবের বাচ্চা। কত ফর্সা ছিলি, এখন রোদ, জল কাদায় বল নিয়ে খেলে কালো হয়ে গেছিস। বৌদি তুমি তো একটু দেখবে না কি! দাদা কি এখন ব্যবসার কাজ ফেলে অনীকের নজর রাখবে!


- অযথা চিন্তা করো না গো। তোমার ভাইপোর যথেষ্ট খেয়াল রাখা হয়। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি নাম পরিবর্তন করেছে গ্লো অ্যান্ড লাভলি, জানো নিশ্চুই।



পঞ্চম দৃশ্য, আট মাস পরে...


ঘড়িতে সময় দুপুর ৩টা। কাঁকুলিয়া রোড, কলকাতা। রাস্তার মোড়ে দুধের ডিপোর পাশে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে মার্কসশিট হাতে অপেক্ষা করছিলো অনীক। বাস থেকে পঙ্কজ স্যার নামতেই অনীক‌ এক ছুটে স্যারের কাছে পৌঁছে গেলো। স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো অনীক।


- স্যার, আমাদের দ্বিতীয় পরিকল্পনাও সফল হয়েছে। এইট্টি এইট পারসেন্ট। আমার চরম শুভাকাঙ্খীরাও হয়ত এই নম্বর আশা করে না।


- আমি জানতাম, তুমি ভালো ফলাফল করবে। তবে এটা আর আমাদের পরিকল্পনা ছিলো না, তোমার নিজস্ব চেষ্টায় পরিশ্রমে অর্জন করেছো। এইভাবে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে এগিয়ে চলো অনীক।


- স্যার, আমার জন্য আপনাকে অপমান সহ্য করতে হয়েছে। আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। বাবা কিছু বোঝার চেষ্টা করে না। বাবার ইচ্ছা নয় আমি ফুটবল খেলি।আমার লক্ষ্য পথে খলনায়ক বাবা।


- না, অনীক। এইভাবে কখনও অভিভাবকদের সম্বন্ধে বলবে না। বাবা হলে তখন বুঝবে কত দায়িত্ব মাথায় নিয়ে জীবনে চলতে হয়। অভিভাবকরা সন্তানের ক্ষতি কখনই কামনা করে না। আর আমি একদমই অপমানিত বোধ করিনি। আমি তোমার বাবার স্হানে থাকলে হয়ত এরকমই করতাম। হ্যাঁ, মনে একটু খারাপ লাগা ছিলো সেই খারাপ লাগাটা আজ তোমার ফলাফল দেখে মুছে গেলো। ও হ্যাঁ, ভালো কথা। আজ তোমার জন্য আর একটা ভালো খবর আছে।


- সত্যি! কি স্যার?


- সংবাদপত্রে খবরটা দেখেছো কি না জানিনা! টাটা সংস্হা জার্মানির স্টুটগার্ট এফ সির জুনিয়র দলকে ভারতে নিয়ে এসে পাঁচটা ম্যাচ খেলানোর আয়োজন করেছে। প্রথম খেলা স্টুটগার্ট এফ সি বনাম বেঙ্গল গভর্ণরস ইলেভেন। জেসুয়েট কাপ ফাইনালে অংশগ্রহণকারী দুই দলের থেকে বাছাই করা এগারো জন খেলোয়াড় নিয়ে তৈরি হবে বেঙ্গল গভর্ণরস ইলেভেন। বিক্রম, মুরশেদ‌ আর অনীক তোমরা তিনজন সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে নির্বাচিত হয়েছো। অনুশীলন আরও কঠোর করো। প্রস্তুত হও।


- আচ্ছা স্যার।


- এতো ম্রিয়মান কেন? জেসুয়েট কাপের ফাইনালের আগে যে তেজ দেখেছিলাম সেই তেজ ফিরিয়ে আনো।


- না স্যার! ম্রিয়মান নই। ভালো খেলবো কথা দিলাম।


ষষ্ঠ দৃশ্য


শৈলেন মান্না স্টেডিয়াম, কলকাতা, নিউ টাউন। স্টুটগার্ট এফ সি বনাম বেঙ্গল গভর্ণরস ইলেভেন। জার্মানির স্টুটগার্ট এফ সি ক্লাবের জুনিয়র দলের খেলোয়াড়দের দেখে মনে হচ্ছে গোলরক্ষক বাদ দিয়ে বাকী দশজন খেলোয়াড় যেন মানুষ নয় রোবট। যেমন গতি তেমন বল নিয়ন্ত্রণ তেমন শক্তিশালী ফুটবল খেলা প্রদর্শন। প্রথমার্ধ্বের প্রথম তিরিশ মিনিটেই তিনটে গোল করে ফেলেছে স্টুটগার্ট, ওদের আক্রমণ দেখে মনে হচ্ছে যে কোন মূহুর্তে গোল হতে পারে। গোল সংখ্যা অনায়াসেই পাঁচ হতে পারতো গোলরক্ষক বিক্রমের দক্ষতার জন্য হয়নি। প্রথমার্ধ্বের শেষে খেলার ফলাফল যখন স্টুটগার্ট ৩, বেঙ্গল গভর্ণরস ইলেভেন ০ তখন বেঙ্গল গভর্ণরস ইলেভেনের খেলোয়াড়দের জিভ বেরিয়ে গেছে। সেন্ট জেভিয়ার্স এবং ডনবক্স লিলুয়া ফুটবল দলের দুইজন কোচ মিলিতভাবে খেলোয়াড়দের ভোকাল টনিক দিতে শুরু করলো। ভোকাল টনিকের শেষে অনীক তার কিট্ ব্যাগ থেকে লোথার ম্যাথিউজের ছবিটা বের করে দেখলো।


- কি রে অনীক! এদিকে স্টুটগার্ট আমাদের নিংড়ে নিচ্ছে আর তুই লোথার ম্যাথিউজের ছবি দেখছিস!


- মুরশেদ ভাই, মাথা ঠান্ডা, পা গরম। একটা গোলও যদি করতে পারি!


      দ্বিতীয়ার্ধ্বের খেলা শুরু হলো। যথারীতি প্রথমার্ধ্বের শুরু থেকেই গতি, পেশী এবং বল নিয়ন্ত্রণের চরম প্রদর্শনমূলক খেলা দেখায় স্টুটগার্ট। এবং সাত মিনিটের মাথায় স্টুটগার্ট চতুর্থ গোল করে ফেলে। মুরশেদ মাথা গরম করে একটা হলুদ কার্ড দেখে ফেলে, অনীক ও বাকি খেলোয়াড়রা মুরশেদকে সংযত থাকার বার্তা দেয়।

           দ্বিতীয়ার্ধের সাতাশ মিনিটের মাথায়, মুরশেদ সামান্য পিছন থেকে এবং অনীক সামনে থেকে দুই জনে নিজেদের মধ্যে বল দেওয়া নেওয়া করে স্টুটগার্টের রক্ষণভাগের সামনে পর্যন্ত এগিয়ে যায়। খেলায় বেঙ্গল গভর্ণরস ইলেভেনের এটাই প্রথম গঠনমূলক পদক্ষেপ। সামনে স্টুটগার্টের রক্ষণভাগের তিনজন খেলোয়াড় এবং শেষে গোলরক্ষক দাঁড়িয়ে আছে। রক্ষণভাগের তিনজনকে পেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আচমকা অনীক পায়ের হিল দিয়ে বলটাকে পিছনের দিকে পাস করে এমন একটা জায়গায় বলটাকে রাখলো যে রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের পাঁচিলটা ভেঙে গেলো।


- মুরশেদ, ইনস্টেপ, মাথা ঠান্ডা গরম শট্।


পিছন থেকে মুরশেদ কিছুটা গতি বাড়িয়ে ছুটে এসে ইনস্টেপে সজোরে শট্ মারলো, গতির কাছে পরাজিত হয়ে স্টুটগার্টের গোলরক্ষক দর্শকের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হলো। বল জালে জড়িয়ে গেলো। গোল! স্টেডিয়ামে দর্শকদের চিৎকার শুনে মনে হলো এই একটা গোলেই বিপক্ষের চারটে গোল শোধ হয়ে গেলো। না, দ্বিতীয়ার্ধ্বে আর গোল হয়নি। খেলার শেষে ফলাফল স্টুটগার্ট এফ সি ৩ বেঙ্গল গভর্ণরস ইলেভেন ১।


সপ্তম দৃশ্য


স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে যাওয়ার টানেলের সিঁড়ির সামনে ডনবক্স লিলুয়া এবং সেন্ট জেভিয়ার্স দুই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক এবং অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে ছিলো। মুরশেদকে প্রায় সবাই জড়িয়ে বাহবা দিচ্ছিলো। অনীক পিছনে একা দাঁড়িয়ে জল পান করছিলো।


- Well played my son. Well played.


- বাবা! তুমি!


অনেকটা বিস্ময় এবং তারও বেশি আবেগতাড়িত হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো অনীক। দুই হাত প্রসারিত করে অনীকের বাবাও ছেলেকে কাছে টেনে নিলো। অনীকের চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। ঝাপসা চোখেই সে স্পষ্ট দেখলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে পঙ্কজ স্যার তাঁর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উর্ধ্বপানে করে Thumbs up চিহ্ন দেখাচ্ছে।


- আজ খেলায় জিততে পারিনি, গোল করতে পারিনি ঠিকই কিন্তু আজ ফুটবল মাঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছি, আমার বাবা আমায় বলেছে well played my son, এর থেকে বড় জয় আর গোল কি বা হতে পারে!


বাবাকে আলিঙ্গনরত অবস্হায় কথাগুলো মনে মনে ভাবছিলো অনীক।


- তোমার পঙ্কজ স্যারের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। উনি আমায়‌ ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে আজ মাঠে নিয়ে এসেছেন। আগামীকাল সংবাদপত্রে মুরশেদের নাম লেখা হবে কারণ আজ মুরশেদ গোলদাতা ক্যানিজিয়া, আর আমার ছেলে অনীক মারাদোনা।


অনীক বাঁ হাত দিয়ে বাবাকে আলিঙ্গন থাকা অবস্হায় ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আঙুলটা উর্ধ্বপানে তুলে পঙ্কজ স্যারের দিকে thumbs up চিহ্ন দেখালো। অনীকের চোখ ঝাপসা মুখে অপরাজিত হাসি।


গোল .... জয়, পরাজয় এবং গৌরব

               বল দখল তো গোল দখল।




Rate this content
Log in