STORYMIRROR

sunanda sanyal

Abstract Inspirational Others

3  

sunanda sanyal

Abstract Inspirational Others

প্রবীর, চির উন্নত শির

প্রবীর, চির উন্নত শির

6 mins
206

"এই তো সেদিন ছোট্ট সুমনা

গাইতো গান বাজিয়ে বীণা

আজ পেরিয়ে বাড়ির সীমানা

শ্বশুর বাড়ি তার নতুন ঠিকানা"

ছোটবেলায় বিয়ের কথা বললে মুখ ফুলিয়ে রাগ দেখাতো যে মেয়েটা, সেই মেয়ে প্রথম চাকরি প্রাপ্তির দুই বছর শেষে বিবাহ মনস্হির করে বয়ফ্রেন্ড অর্কপ্রভর সাথে বাড়ির সকলের পরিচয় করিয়ে দেয়। সুমনার পথচলতির এমন বহু সুখস্মৃতি ভেসে আসছে মানস মুখার্জীর চোখের সামনে। দৃশ্যমানতা অস্পষ্ট হয়ে এলে তিনি চোখ থেকে চশমাটা খুলে সাদা রুমাল দিয়ে চোখ এবং চশমাটা মুছছেন। কলকাতার রাস্তার বুক চিরে দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে একটি হলুদ ট্যাক্সি, অ্যাপ ক্যাবের অভ্যাস আয়ত্তে না আসায় ব্যাঙ্ক থেকে ফেরার সময় মানস মুখার্জী কলকাতার ঐতিহ্যমন্ডিত হলুদ ট্যাক্সি বেছে নিয়েছেন। ট্যাক্সি চালক লুকিং গ্লাসের মাধ্যমে লক্ষ্য করছিলেন মানস মুখার্জীর আবেগতাড়িত হয়ে যাওয়ার মূহুর্তগুলো।

মানস মুখার্জীর বাড়ি লাগোয়া মাঠে সুসজ্জিত বিয়ের মন্ডপের সামনে ট্যাক্সিটা এসে থামলো। ট্যাক্সি চালক দরজা খুলে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জামার বুক পকেট থেকে নীল রঙের খৈনির ডিবে থেকে বাঁ হাতের তালুতে ঢেলে ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞাসা করলেন, 

 - মেয়ের বিয়ে?


মানস মুখার্জী একটি ব্যাগসহ ট্যাক্সি থেকে নামতে নামতে মন্ডপের অসম্পূর্ণ গেটটি লক্ষ্য করলেন এবং প্যান্টের পকেট থেকে পার্স বের করে খানিক বিস্ময়ভরা চোখে বললেন,


- হ্যাঁ, আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে, আপনি বুঝলেন কি করে?


মানস মুখার্জীর হাত থেকে নেওয়া ভাড়া বাবদ টাকা গুনে নিয়ে চালক বললেন,


- "দেরি করে হলেও গতবছর আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আসার সময় মাঝে মাঝে আপনাকে লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখছিলাম আন্দাজ করলাম, এখন দেখছি মিলে গেছে।


মানস মুখার্জী পার্সটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে হাসি মুখে বললেন,


- আপনিও বাবা-আমিও বাবা। মেয়ের বিয়ের দিন সুখ ও দুঃখ মিশিয়ে সব বাবাদের মন ও মুখের অবস্হা হয়তো একই হয়। আপনার সাথে আলাপ করে ভালো লাগলো বুঝলাম এখনও শহরটা পুরো যান্ত্রিক হয়ে যায়নি।


ট্যাক্সির মধ্যে বসে ইঞ্জিন চালু করে চালক বললেন 

 - আপনার এই বড় কাজ সব ভালোয় ভালোয় হোক।


              পরস্পর পরস্পরকে হাসিমুখে বিদায় জানায়, চোখের নিমেষে ট্যাক্সি উধাও হয়, মানস মুখার্জী বাড়ির অভ্যন্তরে চলে যান।

স্নান শেষে মানস মুখার্জী পাঞ্জাবী পাজামা পড়ছেন হঠাৎ মন্ডপ থেকে ভেসে আসলো হাততালি এবং উলুধ্বনির শব্দ, দেওয়াল ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে, গায়ে হলুদের তত্ত্ব! আধঘন্টার মধ্যে রাজারহাট থেকে বেহালা! এই কথা চিন্তা করে কৌতুহলবশতঃ জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন সকালের ট্যাক্সিটা মন্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে বাকী আর কিছু দেখা যাচ্ছে না মন্ডপের জন্য। এক ছুটে যতটা দ্রুত সম্ভব তিনি মন্ডপে এসে উপস্হিত হলেন এবং দেখলেন সেই ট্যাক্সি চালক এবং তাঁর হাতে একটি ব্যাগ, বাড়ির সবাই গার্ড অফ অনার দেওয়ার মতো দাঁড়িয়ে, ছেলেরা হাততালি আর মেয়েরা উলুধ্বনি দিচ্ছে, পুরো ঘটনাটা ভিডিও করছে ভাইঝি ঈপ্সিতা। ব্যাগটা দেখে বজ্রপাতের মতো মানস মুখার্জীর মনে পড়ে যায়,নগদ অর্থ ও সোনার গয়নাতে পূর্ণ দুটি ব্যাগের মধ্যে এই ব্যাগটি তিনি ট্যাক্সি থেকে নামাতে ভুলে গেছিলেন। স্বস্তি ও আনন্দ মিশ্রিত অব্যক্ত অনুভূতির প্রভাবে মানস মুখার্জী আলিঙ্গন করলেন ট্যাক্সি চালককে। নিজের পোষাকে মোবিল তেলের কালো দাগ থাকায় আলিঙ্গনে বাধা দিয়েছিলেন ট্যাক্সি চালক কিন্তু সেই বাধা অস্বীকার করেছিলেন মানস মুখার্জী যার ফলে তাঁর পরণের সাদা পাঞ্জাবীতে কালো দাগ লেগে যায়। নতুন সাদা পাঞ্জাবীতে কালো দাগ লাগার পরে মহিলা মহলে গুঞ্জন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই গুঞ্জন থামিয়ে মানস মুখার্জী দীপ্ত কন্ঠে চিৎকার করলেন


- এই দাগ ভালো, এই দাগ ভালো।    

সুমনার নিজের কাকুর মেয়ে বোন ঈপ্সিতা পেশায় ইউটিউবার, মূলত তার উদ্যোগে ধীরে ধীরে বাড়ির সদস্যদের সাথে,বরপক্ষের যারা গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে এসেছিলেন তাদের সাথে পরিচিতি হলো ট্যাক্সি চালক প্রবীর বিশ্বাসের, তিনি এখন বেহালার মুখার্জী বাড়ির অনুষ্ঠানে মূল আকর্ষণ। ব্যাগ হস্তান্তর, আপ্যায়ন এবং সম্মান আদান প্রদান, প্রবীর বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত প্রতিটা মূহুর্ত স্হির চিত্র এবং চলমান চিত্রের মিশ্রণে লেন্সবন্দি করেছে ঈপ্সিতা। ট্যাক্সির সাথে এবং সুমনার বিয়ের কার্ডের সাথে প্রবীর বিশ্বাসের বেশ কয়েকটি সিনেম্যাটিক শটও লেন্সবন্দি করেছে ঈপ্সিতা। মধ্যাহ্নভোজন শেষে প্রবীর বিশ্বাস নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করতেই সমগ্র মুখার্জী পরিবার বিশেষত ঈপ্সিতা ও সুমনা তাঁকে সারাদিন থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানায়, ইউটিউব ভিডিওর থাম্বনেল শ্যুট এখনও তো বাকী। কন্যাসম দুজন এবং প্রত্যেকের আন্তরিক অনুরোধ উপেক্ষা করার ক্ষমতা প্রবীর বিশ্বাসের নেই অপরদিকে শয্যাশায়ী স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যপালন সেটা অত্যন্ত আবশ্যিক। ঈপ্সিতা ও সুমনার সাথে করমর্দন করে সন্ধ্যাবেলা ফিরে এসে নবদম্পতির সাথে ছবি তুলবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেন প্রবীর বিশ্বাস।

সময় যেন আজ বেশি দ্রুতবেগে ছুটছে, সূর্য অস্ত গেছে, বিয়ে বাড়ীর সবরকম প্রস্তুতি প্রায় সমাপ্ত, এখন শুধু চার হাত এক হওয়ার সেই শুভ লগ্নের অপেক্ষা। পাত্রসহ পাত্রপক্ষ এসে পৌঁছেছে, চলছে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে কথোপকথন, আলাপচারিতা সাথে সান্ধ্যকালীন স্ন্যাক্স এবং মকটেল। তবে প্রত্যেকজনের কথোপকথনে স্হান করে নিয়েছেন এই বিবাহের নায়ক ট্যাক্সিচালক প্রবীর বিশ্বাস, অধীর‌ আগ্রহে সকলেই অপেক্ষা করছেন তাঁর জন্য এটা স্পষ্ট। সময় এগিয়েছে, বিবাহের আচার অনুষ্ঠান একের পর এক নির্বিঘ্নে সুষ্ঠুভাবে মিটতে চলেছে তবু এখনও দেখা নেই প্রবীর বিশ্বাসের, ঈপ্সিতার মন খারাপ হয়েছিল কিন্তু সুমনার‌ কথা ভেবে প্রকাশ করেনি। 

সাড়ে বারোটা নাগাদ‌ যখন পাত্র ও পাত্রী পক্ষের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠরা খেতে বসছেন, তখন ভীষণভাবে আলোচনা হলো শুধুমাত্র প্রবীর বিশ্বাসকে নিয়েই, প্রত্যেকের কল্পনায় জন্ম নিচ্ছে তাঁর অনুপস্হিতির বিভিন্নরকম কারণ। ঈপ্সিতার আক্ষেপ সুমনা, অর্কপ্রভ ও প্রবীর বিশ্বাস এই তিনজনের একসাথে কোন ছবি লেন্সবন্দি হলো না, সেই কারণে ইউটিউব ভিডিওর থাম্বলেন ছবিটা সম্পাদনা করেই তৈরি করতে হবে। 

পরেরদিন সকালবেলা, আর মাত্র কয়েকটা মূহুর্ত শেষে বাপের বাড়ী ছেড়ে শ্বশুর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সুমনা। চিরাচরিত পারিবারিক নিয়মবিধি মেনে সবরকম প্রস্তুতি তখন তুঙ্গে, ক্ষণে ক্ষণে চলছে সুমনার মা ও বাবার মন খারাপের বর্হিপ্রকাশ। সবাইকে চমকে দিয়ে ঠিক এরকম সময়ে একটি পুলিশের গাড়ী মুখার্জী বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ী থেকে নেমে আসলেন দুজন উর্দিধারী পুলিশ। একজন মধ্যবয়সী আর একজন যে নব্য পুলিশ কর্মী তা সহজেই অনুমেয়,তাঁর হাতে রয়েছে একটি ব্যাগ। মধ্যবয়সী পুলিশকর্মী আত্মবিশ্বাসের সাথে বাড়ীর চর্তুদিক এবং বিবাহ মন্ডপের গেটে পাত্র-পাত্রীর নামে একবার চোখ বুলিয়ে সোজা বাড়ীর মূল দরজার সামনে চলে আসেন এবং নব্য পুলিশ তাঁকে অনুসরণ করেন।

মধ্যবয়সী পুলিশকর্মী এগিয়ে এসে বললেন,

নমস্কার! আমি সুমিত সমাদ্দার, এস আই, কলকাতা সাউথ ইষ্ট ট্র্যাফিক গার্ড, ম্যুভিং সিকিউরিটি সেল, আর আমার সাথে এসেছে জুনিয়র অফিসার তুহিন দাশগুপ্ত। আপনারা প্রবীর বিশ্বাস এই নামের কোন ট্যাক্সি চালককে চেনেন?


মানস মুখার্জী নিজের পরিচয় জানানোর পরে গতকালের সমগ্র ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করেন এবং প্রমাণ স্বরূপ ঈপ্সিতাকে ডেকে নিয়ে তার ক্যামেরা বন্দী ছবিগুলো দেখান।

সব দেখে শুনে এস আই সুমিত সমাদ্দার বললেন,


- আপনাদের বাড়িতে শুভ কাজ চলছে এর মধ্যে এই সংবাদটা জানানো ঠিক হচ্ছে কি না জানিনা তবু আমাদের ডিউটি তো করতেই হবে। প্রবীর বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত গতকাল রাতে। কিভাবে মৃত্যু হয়েছে জানতে ইনভেস্টিগেশন চলছে। ট্যাক্সিটা নিউ আলিপুর- তারাতলা ক্রসিং এ তারাতলা ব্রিজের নীচে পাওয়া গেছে, উনি ট্যাক্সির মধ্যেই ছিলেন, আর ট্যাক্সিতে ছিল এই বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করা বিয়ের কার্ড এবং একটি উপহার খামে দুটি পাঁচশো টাকার নোট।


উপহারের খামটা মানস মুখার্জীর হাতে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান দুজন পুলিশ। বাড়ির কন্যা বিদায়ের মন খারাপের অনুভূতিটাকেই অনেকটা বাড়িয়ে দিয়ে গেলো মুখার্জী পরিবারের একদিনের নায়ক ট্যাক্সিচালক প্রবীর বিশ্বাসের মৃত্যুসংবাদ।

একদিকে কন্যাসন্তানের শ্বশুর বাড়িতে গমন অপরদিকে ট্যাক্সিচালকের মৃত্যুসংবাদ, মন খারাপের পরিমাণ কিছুটা লাঘব করতে আজ প্রায় দুইদিন পরে মানস মুখার্জী ফেসবুকে অন হলেন। ফেসবুক ওয়াচের ভিডিও স্ক্রল করতে করতে আচমকা দেখলেন লালবাজার ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্টের "দুঃখিত, অপরাধীদের কড়া শাস্তি হবে" শিরোনাম দিয়ে আপলোড করা একটি সিসিটিভি ফুটেজ, ওই ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দুইজন গ্রীণ পুলিশ এবং একজন ট্র্যাফিক সার্জেন্ট প্রথমে হাত দিয়ে পরে বুট জুতো দিয়ে আঘাত করছে একজন বয়স্ক মানুষকে - হ্যাঁ, এই তো প্রবীর বিশ্বাস।

সিসিটিভি ফুটেজের আলো আঁধারে উজ্জ্বল হয়ে থাকলো প্রবীর এবং ইউটিউবের ভিডিওতে চির উজ্জ্বল বিশ্বাস।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract