নিষ্ঠুর
নিষ্ঠুর


প্রতিবছর আজকের দিনটি আসলেই আনন্দর কথা মনে পড়ে। সেদিন শুনলাম অ্যামাজনের জঙ্গলে দাবানল। অসংখ্য পশু পাখি গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, ধোঁয়ায় অনেক জায়গা ঢেকে গেছে। আমাদের দেশে দিল্লিতে পৌষ মাসে ধোঁয়ায় অন্ধকারে ডুবে থাকে মাসের পর মাস। দেশের প্রতিটি শহরে বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আর তার ফলে জানা-অজানা বহু মরণব্যাধি বাসা বাঁধতে আমাদের শরীরে। এই দূষণের ফলে কেউ অসুস্থ নয়,এখন থেকে যদি আমরা সচেতন না হই তবে হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবী থেকে অনেক মানুষ হারিয়ে যাবে। যেমন দূষণে বলি হতে হলো আমার বন্ধু আনন্দকে। বছর চব্বিশের যুবক সে সংসারে মা আছেন, বাবা গত হয়েছেন। কষ্টের সংসার। জরাজীর্ণ দূষণ ভরা বস্তিতে থাকতো কোনরকমে মা ও ছেলে।
কোথাও কাজ পাচ্ছিল না, অবশেষে পাড়ায় একজন প্রভাবশালী কে ধরে চটকলে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ পেল।ছেলেটি ভীষণ ভালো ছিল, আমার ভালো বন্ধু,রোজ সন্ধে হলে আমরা রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে শেষের দিকে একটি নির্দিষ্ট বেঞ্চে বসে গল্প করতাম, দুজনে বসে চা খেতাম আর বিড়ি খেতাম। প্রায়ই কথা হতো, ওর মায়ের শরীর ভীষণ খারাপ, টাকার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারছে না। ঠিকা শ্রমিক এর যে মজুরি তাতে মাস চলা বড় কঠিন তার মধ্যে মায়ের অসুখ। মাঝে মাঝে ও আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিতো আবার ঠিক সময়ে মাস মায়না পেলেই দিয়েও দিত। এভাবেই চলতো ওদের সংসার।
একদিন আনন্দ বলল,ওর মা নাকি ভীষণ অসুস্থ তাকে এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। হাতে টাকা নেই, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আমি ওকে সাহস দিলাম, চিন্তা করিস না তুই চল মাসিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। একটা রিক্সা করে মাসিমাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তারবাবুরা মাসিমাকে ভর্তি করিয়ে নিলেন। পরে বুকের এক্সরে, কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করতে দিলেন। ভিভো রক্তপরীক্ষা আর এক্স-রে রিপোর্টে মাসীমার যক্ষা ধরা পড়েছে। আনন্দ ভিষন ঘাবড়ে গেল। আমি ওকে সাহস দিলাম, বললাম, এখন যক্ষা রোগ সাধারণ রোগের মত, ভালো চিকিৎসা আছে। ভাবিসনা মাসিমা ঠিক হয়ে যাবে।
বেশ কিছুদিন ধরে মাসিমা হাসপাতালে থাকলেন। কিন্তু তার শরীরে কোন উন্নতি হলো না। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে বললেন, যক্ষা কমলেও ওনার দুটো কিডনি বিকল হয়ে গেছে। ভালো চিকিৎসার জন্য বাইরে নিয়ে যেতে হবে। আমি আর আনন্দ ভিষন ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, ডাক্তারবাবু, আমরা ভীষণ গরিব, বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। ডাক্তারবাবু আমাদের বললেন,আমাদের যা করার তা তো করছি তবে রোগীর যা অবস্থা তাতে খুব ভরসা পাচ্ছি না। একথা শুনে আনন্দ খুবই ভেঙে পড়ল। আমি ওকে বারবার সান্ত্বনা দিলাম। কি আর করা যাবে দেখা যাক। ডাক্তারবাবু তো চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোন সান্তনাই কাজে এলো না। পাঁচ দিন পরে মাসিমা মারা গেলেন। আনন্দ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কী করবে বুঝে উঠতে পারছেনা।আমি আর পাড়ার কজন বন্ধুদের দেখে মাসিমার মৃতদেহের সৎকার করলাম। মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি করার পর কদিন ও বাড়িতে ঘরে থাকলো কাজে যায় না। কেমন যেন হয়ে গেল।আমি ওকে বুঝিয়ে আবার কাজে পাঠালাম কিন্তু কিছুদিন কাজ করার পর কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেল।
স্থায়ী শ্রমিকদের সাথে মালিকের ঝামেলা হওয়াতে। ও আবার বেকার হয়ে। পাগলের মত রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, উস্কোখুস্কো চুল, দেখে মনে হয় কতদিন যেন ঘুমায়নি, মনে হয় ওর উপরে ভীষণ অত্যাচার হয়েছে। মূর্তি আমি ছাড়া ওর কাছের বলতে কেউ ছিলনা। শুনেছি শহরের কোথায় ওর কাকার বাড়ি আছে, কোনদিন কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। মামাতো এক ভাই আছে নদীয়ার কোন এক গ্রামে। তার সাথে ও কোন যোগাযোগ। আমি ছাড়াও কে শান্তনা দেওয়ার আর ওর কথা শোনার কেউ নেই।
কাজ চলে যাওয়াতে ও ভিষণ মুষরে পড়েছিল। ও প্রায়ই অভুক্ত, অর্ধাহারে দিন কাটাতো। নতুন কোন কাজের খোঁজে আমরা বিভিন্ন লোকজনদের সাথে কথা বললাম। অবশেষে একটি প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ পেল। আবার ভালোভাবেই চলছিল ওর সংসার। একদিন আমি ওকে বললাম মাসিমা তো নেই, তোকে দেখবে কে, তুই এবার বিয়ে কর। ও রাজি হয়নি। যে সামান্য টাকা পাই তা দিয়ে চলার মতো ব্যবস্থা হবে না। বিয়ে করলে খরচা বাড়বে, দায়িত্ব বাড়বে। আর এ অবস্থায় আমাকে কে দেবে মেয়ে? বরং যেমন আছি তেমনি ভালো, নতুন করে ঝামেলা বাড়াতে চাইনা।
এভাবে কিছুদিন চলার পর ও আমাকে বলল,- তাপস দা, প্লাস্টিকের কারখানায় ভীষণ দূষণ। ওখানে কাজ করা যাবে না। আমি বললাম, সেকিরে? সবে কাজটি পেলি এর মধ্যেই তুই কাজটি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছিস? ও বলল প্লাস্টিক গলাতে যে ধোঁয়া আর গন্ধ বের হয় মুখ বন্ধ হয়ে যায়, শ্বাস নিতে ভারী কষ্ট হয়। আমি বললাম, দূষণ তো সব কারখানাতেই আছে। শুধু কলকারখানাই কেন দেশের সব শহরগুলিতে বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণের প্রতিযোগিতা চলছে। এ সমস্যা শুধু তোর আমার নয় সারা বিশ্ববাসীর। দেখছিস না, দিনের বেলাতেও আকাশ অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দিনের পর দিন সূর্যের তেজ বেড়ে যাচ্ছে।শুনেছি কুমেরু সুমেরু মহাদেশ এ উষ্ণায়নের ফলে প্রচন্ড বরফ গলে যাচ্ছে। আর এভাবে বরফ গলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সাগর কিনারে অনেক দেশ ডুবে যাবে। ও বলল, শুনেছি কিন্তু আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তাই ভাবছি আমাদের বস্তির কয়েকজন ছেলে ঠিকা কাজের জন্য দিল্লি যাচ্ছে। আমি ভাবছি ওদের সাথে আমিও যাব। আমি বললাম, দেখ যা ভাল বুঝিস কর। আমি আর কথা বাড়ালাম না। কয়েকদিন পর শুনলাম ওর বস্তির কয়জন বন্ধুর সাথে দিল্লিতে চলে গেছে।
অনেকদিন ওর সাথে কথা হয়নি। একদিন হঠাৎ ওর ফোন এলো,-ও বলল, ভাই তাপস কলকাতাতে আমার জন্য একটা কাজ দেখিস, আমি এখানে থাকতে পারছিনা। এখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করছি কজন মিলে একসঙ্গে মেসে থাকি। কিন্তু শরীরটা ভীষণ খারাপ হয়েছে। কদিন থেকে জ্বর, ডাক্তার দেখিয়েছি, কিন্তু ভালো হচ্ছে না।এছাড়া এখন পৌষ মাসে সারা দিল্লি শহর ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে আছে, ভীষন শ্বাসকষ্ট।
আমি বুঝতে পারলাম ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কলকাতায় এসে ও কি কাজ করবে? তবুও ওকে আসতে বললাম, ওর শরীর খারাপের কথা শুনে আমার ভীষণ খারাপ লাগলো। কদিন পরে আনন্দ এল। ওর বস্তির বাড়িতেই একা থাকে কিন্তু একদিন ও আমাকে ফোন করে বলল, চলে আয় তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়, আমার শরীর ভীষণ খারাপ। আমি তাড়াতাড়ি করে ওর বাড়িতে গেলাম, দেখি, ওর গায়ে ভীষণ জ্বর, শরীর ভেঙে গেছে, মুখের কালো দাগের। আমি ভাবলাম, ওর বড় কোন অসুখ হয়েছে। আমি ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেখানে ডাক্তারবাবু দেখে বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। তখনই ওকে কলকাতার এক বড় হাসপাতালে ভর্তি করালাম। ডাক্তারবাবুরা ওর বুকের এক্সরে, রক্ত পরীক্ষা করে বলল, রোগীর অবস্থা ভালো নয়। আরেকটি পরীক্ষা করব দুদিন সময় লাগবে। দুদিন পর ওর পরীক্ষা করে ডাক্তার বাবু বললেন, ওর বুকে ক্যান্সার হয়েছে। ফুসফুস সংক্রামিত, রোগীর অবস্থা ভীষণ খারাপ, আপনারা ওকে বাড়ি নিয়ে যান। আমি বললাম ওর নিজের লোক বলতে কেউ নেই তাছাড়া ওকে কে দেখবে। বরং হাসপাতালেই থাক আপনারা চিকিৎসা করুন।
তারপর কদিন পরে একদিন সকালে ওকে দেখতে গেলাম ওর বেডের কাছে দাঁড়িয়ে দেখি, ও চোখ দুটি মেলে চারিদিকে যেন কিছু খুঁজছে। আমি ওকে ডাকলাম, ও কোন সাড়া দিল না। শুধু আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। ওর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আমি ওর দৃষ্টির কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আমিও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। মনের অজ্ঞাতেই বললাম, হায় ভগবান, দূষণে যে এমন কত আনন্দ সবার চোখের আড়ালে নিরবে চলে যাচ্ছে, কে তার খোঁজ রাখে।