সোনারপুর গ্রামে ঢোকার বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই আকাশটা কেমন যেন থমথমে লাগছিল। গন্তব্যের কাছাকাছি আসতেই আবহাওয়ার অবনতি ঘটতে আরম্ভ করল। আমি বাসের উইন্ডো সিট্ দখল করে বাইরে প্রকৃতির ক্রুদ্ধ রূপের দিকে অপলক চেয়ে ছিলাম। গাঢ় কালো মেঘরাশি তার বৃহৎ সৈন্যবাহিনী নিয়ে ধেয়ে আসছিল আকাশের পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে। তাদের সম্মিলিত আর্তনাদ আর চাপা গর্জনে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। সড়কের দু'ধার জুড়ে শুধুই ধানক্ষেত। সেই ক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ফসলের শিষগুলি মত্ত বাতাসের পরশ পেয়ে উত্তাল নৃত্যে মেতে উঠেছিল। মুহুর্মুহু বজ্রপাতের শব্দ আর তার তীব্র ঝলকানিতে চতুর্দিক ক্ষণিকের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল দিবালোকের মতো। এই চরম দুর্যোগের মধ্যে আমাদের বাস ছুটে চলেছে সোনারপুরের উদ্দেশ্যে।
সোনারপুর বাস স্ট্যান্ডে ঢুকতেই বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। অতি কষ্টে স্যুটকেসটা দিয়ে মাথা আড়াল করে ছুটলাম কোনও নিরাপদ আস্তানার খোঁজে। একটা বড় গাছের তলায় আশ্রয় নিয়ে, পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কল করলাম আমার জ্যাঠতুতো দাদার ফোনে।
"হ্যালো, দাদাভাই?"
"হ্যাঁ রে দেবু, এখন কোথায় পৌঁছলি বল।"
"আরে আমি তো বাস স্ট্যান্ডেই দাঁড়িয়ে আছি গো। তোমার তো আমায় নিতে আসার কথা ছিল, তুমি এলে না?"
"উফ্! আমি তো আধঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেছি রে আহাম্মক। এখন হারু দা'র দোকানে বসে আছি। দৌড়ে চলে আয়।"
"তুমি মাঝেমধ্যে এমন সব কথা বলো না!" একটু রেগেই বললাম, "আমি কি আগে কখনও সোনারপুরে এসেছি যে তোমার ওই হারু দা'র দোকান চিনব?"
"হাহাহা!" দাদাভাই সশব্দে হেসে উঠলেন, "কাউকে জিজ্ঞেস করে নে না। এখানে হারু দা'র চপ-মুড়ির দোকান অনেক ফেমাস, বুঝলি? সবাই এক ডাকে চেনে।"
একে-ওকে জিজ্ঞেস করে হারু দা'র দোকান খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হল না। দাদাভাই ছুটে এসে আমাকে বুকে চেপে ধরল।
"কী রে দেবু, আসতে কোনও কষ্ট হয়নি তো?"
"না না দাদাভাই," আমি ঢিপ করে একখানা প্রণাম সেরে ফেললাম, "শুধু এই বৃষ্টির জন্য...."
"ও কিছু না। আয় আয়....এত দূর থেকে বাস জার্নি করে এলি, একটু বসবি চল।"
আমরা হারু দা'র দোকানের ভিতরে একটি বেঞ্চ দখল করে বেশ জমিয়ে বসলাম। ধবধবে সাদা ফতুয়া আর লুঙ্গি পরিহিত এই ভদ্রলোকটিই সম্ভবতঃ সেই স্বনামধন্য হারু দা। মুখে একটা পান আর ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি নিয়ে বেগুনি ভেজে চলেছেন। দাদাভাই কে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন-
"আপনার কী লাগবে ছোট ঠাকুর? আর আপনার সাথে এই ছেলেটি কে গো? আপনার ভাই বুঝি?"
"ঠিকই ধরেছ। এ হল দেবাঞ্জন, আমার খুড়তুতো ভাই। কলকাতায় থাকে; এই বছরই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। তুমি এক কাজ করো, গরম-গরম বেগুনি আর দু'ভাঁড় চা এদিকে দাও দেখি।"
আমার জ্যাঠামশাই রামকমল ভট্টাচার্য্য হলেন সোনারপুর গ্রামের ডাকসাইটে পুরোহিত। শুধু সোনারপুরই নয়, আশেপাশের দু-তিনটে গ্রাম জুড়েই তাঁর যজমানী চলে। গ্রামের লোকেরা তাঁকে সম্মান করে 'কমল ঠাকুর' বলে ডাকে। তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান হল নীলাঞ্জন ভট্টাচার্য্য অর্থাৎ আমার এই দাদাভাই। যদিও তিনি কোনও দিনই নিজের পিতার পদচিহ্ন অনুসরণ করে পৌরহিত্য করার প্রতি নিজের বিশেষ আগ্রহ দেখাননি, তবুও গ্রামের মানুষেরা আদর করে দাদাভাই কে 'ছোট ঠাকুর' বলেই সম্বোধন করত। আমার বাবা পেশায় ডাক্তার। ডাক্তারি পড়া শেষ করে তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। কিন্তু জ্যাঠামশাই কখনওই তাঁর জন্মভিটে ছেড়ে অন্যত্র যেতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি নিজের স্ত্রী আর পুত্র কে নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন এই পাণ্ডববর্জিত সোনারপুরেই। আমাকে অনেকদিন ধরে দাদাভাই এইখানে কিছুদিন ঘুরে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। কিন্তু স্কুলের হাঙ্গামা, পড়াশোনার চাপ আর কোচিংয়ের ঝঞ্ঝাট কাটিয়ে এতদিন আসতে পারিনি। তাই এইচ.এস. পরীক্ষা দেওয়ার পর যেই অল্প অবসর সময়টুকু পেয়েছি, তাতেই মালপত্র গুছিয়ে দৌড় দিয়েছি সোনারপুরের উদ্দেশ্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ধূমায়িত বেগুনি আর চা হাজির। এই ঝুপঝুপ বৃষ্টির মধ্যে এমন অমৃততুল্য জলযোগ যে কতটা উপাদেয়, তা বলাই বাহুল্য।
"তবে?" ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে দাদাভাই বলল, "এতদিন পর এদিকপানে আসার খেয়াল হল?"
"আর কী বলব, পড়াশোনার যা চাপ!"
"থাম তুই!" দাদাভাইয়ের গলায় অভিমানের সুর, "লেখাপড়া আমরাও করেছি বাপু, কিন্তু এ কেমনধারা বিদ্যার বহর শুনি? সতেরো বছরের ধেঁড়ে বাঁদর হয়ে গিয়েছিস, স্কুলে একটু ম্যানেজ করতে পারতিস না? কাকুমণি কত ব্যস্ত মানুষ, অথচ তিনি ছোট মা কে নিয়ে বছরে অন্তত একবার করে আসতেন। আর তুই...."
"আসলে বোঝোই তো, স্কুল ছাড়াও কোচিং ক্লাসের বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আমায়। সব মিলিয়ে আর কি...."
"থাক, আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। এতদিন পর তোর চাঁদ বদনখানা দেখতে পেয়েছি, এই বা কম কী!"
যদিও আসল কথা হল এই, ছোটবেলায় এত রকমারি ঘোরার জায়গা থাকতে আমার মনে এই অজ পাড়াগাঁয়ে আসার কোনও ইচ্ছেই জাগত না। তাই ছুটি পেলেই বাবা মা কে নিয়ে শিমলা-মুসৌরী চরে বেড়াতাম। তারপর বড় হলাম। বুদ্ধি পরিপক্ব হল। তখন বুঝতে শিখলাম যে একটা গাছ, সে যতই উচ্চতা লাভ করুক না কেন....কিন্তু তার শিকড় আলগা থাকলে সে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বেই। বিগত কয়েক বছর ধরেই আমার গ্রাম, আমার আপনজনদের জন্য আমার প্রাণটা হুহু করত। মাঝে-মাঝেই এই সরল মানুষগুলোর জন্য হৃদয়ে এক তীব্র বেদনা অনুভব করতাম। এরাই তো আমার সবকিছু, আর সেখানে আমিই এত বছর ধরে এই মানুষগুলো কে অবহেলা করেছি? ধিক্কার!
কথা ঘোরানোর মতলবে বললাম-
"আচ্ছা দাদাভাই, তোমাদের এই সোনারপুরে ঘুরে দেখার মতো কী-কী জায়গা আছে?"
দাদাভাই কিছু বলার আগেই হারু দা ফোড়ন কাটল।
"দেখার জায়গা তো অনেক আছে গো, কিন্তু এখন যেহেতু শাওন মাস লেগে গেছে, তাই এখনকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল বিপদভঞ্জন মহাকালের সিদ্ধপীঠ মন্দিরের শাওন মেলা। বিরাট মেলা গো, পুরো শাওন মাস জুড়েই চলবে। আমাদের বিপদভঞ্জন মহাকাল খুব জাগ্রত ঠাকুর। আমি বলি কি....তুমি একবার ওখানে দর্শন করে এসো।"
কথাটা আমার খুব মনে ধরল। ঠাকুরের কাছে পুজো দেওয়া তো হবেই, তার সাথে মেলা দেখাও হবে। একেই হয়তো বলে বিকেলে ভোরের ফুল ফোটা....যেই আনন্দগুলো আমার ছেলেবেলার প্রাপ্য ছিল, সেই সব আনন্দগুলোই আমি পেতে চলেছি এই বুড়ো বয়সে! দাদাভাই আমার মনের পুলক আঁচ করে হেসে বললেন-
"আচ্ছা বেশ বেশ। তুই এত দূর থেকে এলি, তাই আজ বিশ্রাম নে। কাল সকালে স্নান-টান করে, কাচা জামাকাপড় পরে আমার সাথে বের হবি। খুব মজা করব দু'ভাই মিলে। পুজো তো দেবই। খুব জাগ্রত ঠাকুর, দেখবি....ওখানে মানত করলে তোর সব মনস্কামনা পূর্ণ হবে।"
টানা সাত ঘণ্টার ক্লান্তিকর বাস যাত্রার পর শরীর আর মন উভয়ই পরিশ্রান্ত। তার উপর আবার নৈশভোজে বড় মায়ের হাতে রাঁধা পরম সুস্বাদু সব নিরামিষ পদ খেয়ে আমার পেট আস্ত একটা জয়ঢাকে পরিণত হয়েছে! আলু ফুলকপির ডালনা দিয়ে ঘি-ভাত, তারপর শেষ পাতে বাড়ির পোষা গরুর দুধ দিয়ে পাতা এক বাটি দই আর ছানার মিষ্টি। আহা....অমৃত! রাতে বড় মায়ের ঘরেই আমাদের তিনজনের জন্য ঢালাও বিছানা পাতা হল। জ্যাঠামশাই পার্শ্ববর্তী পলাশডাঙা গ্রামে গিয়েছেন কোনও পুজোর কাজে, ফিরবেন সেই কাকভোরে। বড় মা তো আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছে, আমি আর দাদাভাইও গল্প করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
পরের দিন সকালে একটু দেরি করেই আমাদের ঘুম ভাঙল। স্নানের পাট চুকিয়ে দুজনে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম।
"চল দেবু," দাদাভাই তাড়া দিল, "প্রথমে ঠাকুরের কাছে পুজো দেব, তারপর মেলা ঘুরব।"
আজ আকাশ একদম পরিষ্কার। শ্রাবণের ঝলমলে সোনাঝরা নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে আমরা দুজনে লম্বা-লম্বা পা ফেলে হেঁটে চলেছি আলপথ ধরে। এই রাস্তাটা হল মন্দিরে পৌঁছানোর শর্টকাট।
"বিপদভঞ্জন মহাকালের মন্দির চণ্ডেশ্বর নদীর তীরে অবস্থিত, বুঝলি? এখন তো শাওন মাস সবে শুরু হল। এর আগে আষাঢ় মাসে যা বর্ষা হয়েছে এই অঞ্চলে....নদীর বিরাট কলেবর দেখলে তুই ভিরমি খাবি! আর মন্দিরের ঠিক সামনেই আছে লক্ষিন্দরের ঘাট।"
"লক্ষিন্দরের ঘাট?"
"হ্যাঁ, আমাদের এই গ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাট। সড়ক পরিবহন তো ঠিক মতো শুরু হয়েছে বিগত পাঁচ-ছয় বছর আগে। তার আগে মালপত্র কেনাবেচা থেকে আরম্ভ করে ব্যবসার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালানোর একমাত্র উপায় ছিল এই জলপথ। আর সাধন ছিল বড়-বড় সব নৌকা। আজকের দিনেও এই লক্ষিন্দরের ঘাট হল সোনারপুরের মুখ্য বাণিজ্যিক কেন্দ্র। প্রতি সপ্তাহে বুধবার আর শনিবার এইখানে বিরাট বড় হাট বসে।"
গল্প করতে-করতে আমরা খুব তাড়াতাড়ি আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। নাহ্! হারু দা ভুল কিছু বলেনি। শাওন মেলায় সত্যিই লোকে লোকারণ্য। সুবিস্তৃত মেলা প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে বিপদভঞ্জন মহাকালের প্রাচীন সিদ্ধপীঠ। মন্দিরের গগনচুম্বী চূড়া বহুদূর থেকে চোখে পড়ে। মন্দিরের পাশেই অঘোর শিবতলা মহাশ্মশান। আর আমাদের ঠিক সামনে শান্ত গম্ভীর ভাবে বয়ে চলেছে দু'কূল প্লাবিনী চণ্ডেশ্বর। তার গাঢ় কালো জলে অজস্র ছোট-বড় নৌকার আনাগোনা। ঘাটের বাঁধানো পাথরের সিঁড়িগুলো প্রায় সবই চণ্ডেশ্বর একে-একে আত্মসাৎ করেছে। শুধু উপরের দু-একটা ধাপ দেখা যাচ্ছে জল ছুঁইছুঁই অবস্থায়।
"চল দেবু," দাদাভাই ব্যস্ত ভাবে বললেন, "আগে দর্শনটা সেরে নিই। আজ তো আবার শনিবারের হাট বসবে, তাই মন্দিরে মানুষের ঢল খুব বেশি।"
ভক্তদের লম্বা লাইন পেরিয়ে দর্শন করে বেরিয়ে আসতে-আসতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। কিন্তু পুজোটা খুব ভাল ভাবে দেওয়া হল। ঠাকুরমশাই প্রসাদ দিলেন....গলায় পরালেন মন্ত্রপূত মাদুলি। মন্দির থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন আমার ঘড়ির কাঁটা প্রায় আড়াইটা পার।
"কী রে? এর মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়লি নাকি? ওঠ ওঠ, মেলা ঘুরে দেখতে হবে তো! আমায় আবার সন্ধ্যা ছ'টায় একটা টিউশন পড়াতে যেতে হবে।"
"আরে না না, ক্লান্ত হতে যাব কেন? চলো।"
বিরাট মেলা চত্বর। বাচ্চাদের জন্য নাগরদোলা, খাওয়ার স্টল, খেলনার দোকান....আরও কত কী! টুকটাক কেনাকাটা করলাম। বাবার জন্য একটা শাল কিনলাম; জ্যাঠা মশাইয়ের জন্য নিলাম এক সেট ধুতি-পাঞ্জাবি। হালকা খাওয়া-দাওয়া করে আমরা দুজনে ঘাটের বাঁধানো সিঁড়িতে এসে বসলাম। যা ধকল গেল আজ সারাদিন!
শান্ত চণ্ডেশ্বরের কালো জল ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে মৃদু আঘাত করছে ঘাটের সিঁড়িতে। পড়ন্ত বেলার সূর্য্য তার শেষ রশ্মিটুকু দিয়ে নদীর বক্ষে গলিত সিঁদুর আর স্বর্ণাভ ছটা মিশিয়ে এক অপরূপ আলপনা এঁকে দিয়েছে। বহুদূরে চোখে পড়ছিল তিন-চারটে ছোট ডিঙি নৌকা। একদল পাখি ঠিক আমাদের মাথার উপর দিয়ে ডানা ঝটাপটি করতে-করতে বাসার উদ্দেশ্যে উড়ে গেল। আকাশে-বাতাসে, সর্বত্র জুড়ে যেন ভাসছে এক অজানা ঘর ছাড়ানোর সুর। পাশেই একটা গাছের ছায়ায় বসে একজন বাউল আপনমনে গান ধরেছে:-
"মন চলো নিজ নিকেতনে,
সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে,
ভ্রম কেন অকারণে?"
"দেবু," দাদাভাই হাতঘড়ির দিকে চাইলেন, "পাঁচটা বাজতে চলল। এইবার ওঠা যাক।"
"আমি এখন যাব না।"
"যাবি না মানে? ছ'টায় আমার টিউশন আছে, তুই জানিস তো।"
"তোমার কাজ থাকলে তুমি বেরিয়ে পড়ো দাদাভাই, আমি আরও কিছুক্ষণ এইখানে বসতে চাই।"
"কিন্তু তুই ঘাটে একা-একা বসে করবি কী? সন্ধ্যা তো নেমেই এল প্রায়।"
"দেখব দেখব, যা এতদিন দেখিনি, তা আজ দেখব। এই শান্ত নদীর গভীরতা কে ছুঁয়ে দেখব। গ্রামের এই নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধতা কে অনুভব করে দেখব। শহরে থেকে যা কিছু দেখিনি, সেই সব দৃশ্য আমি আজ দেখব।"
"বুঝেছি বুঝেছি, ভিতরকার কবিখানা জেগে উঠেছে! আচ্ছা, তোর কথা যদি মেনেও নিই, তবুও তুই বল....রাতের অন্ধকারে একলা পথঘাট চিনে আসতে পারবি? না না, তার চেয়ে তুই বরং আমার সাথেই চল।"
"তুমি চিন্তা কোরো না। সাথে মোবাইল আছে তো, কোনও অসুবিধা হলে আমি কল করে নেব নাহয়। তুমি নিশ্চিন্তে পড়াতে যাও।"
"আচ্ছা বেশ," দাদাভাই নিমরাজি হলেন, "কিন্তু কোনও ঝামেলা হলে অবিলম্বে ফোন করবি। আর যেমন করেই হোক, রাত ন'টার আগে বাড়ি ফিরে আসবি। যদিও এইখানে তেমন চুরি-ছিনতাইয়ের ভয় নেই, তবু গ্রামাঞ্চল বলে কথা। বেশি রাত না করাই ভাল।"
দাদাভাই কে আশ্বস্ত করে আমি পড়াতে পাঠিয়ে দিলাম। আসল কথা হল, এই মুহূর্তে আমার কিছুক্ষণের একাকীত্ব দরকার ছিল। যেখানে প্রকৃতির সাথে আমার অভিসারের সাক্ষী থাকবে শুধুই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, আর কেউ না। দাদাভাইও না। ধীরে-ধীরে ঘাট খালি হতে শুরু করেছে। মেলা প্রাঙ্গণ, ঘাটের সিঁড়ি....সবই জনহীন হতে আরম্ভ করল আঁধার নামার সাথে সাথে। নদীর বুকে ভাসমান নৌকাগুলিও ক্রমশঃ বিদায় নিল এক-এক করে। এখন এই ঘাটে পড়ে রইলাম কেবল আমি, আর আমাকে সঙ্গ দিতে থেকে গেল সাঁঝবেলার বিষাদময় নীরবতা। শুধু মন্দিরের ভিতর থেকে সন্ধ্যা আরতির কাঁসর-ঘণ্টার ধ্বনি হাওয়ায় ভেসে আসছে। যত্রতত্র গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকি মিটমিট করছিল। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। আনমনে একটা ঢেলা ছুঁড়ে মারলাম নদীর জলে। 'ছপ' করে একটা শব্দ, জলের বুকে ক্ষণিকের চঞ্চলতা....তারপর আবার চারিদিকে নেমে এল নিশ্ছিদ্র শূন্যতা।
"বাবু, ও বাবু! নাও লাগবে নাকি?"
ঘোরের মধ্যে ছিলাম বোধহয়, প্রথম বারে শুনতে পাইনি। বার দুয়েক ডাকার পর ফিরে তাকালাম। একজন প্রৌঢ় মাঝি। কালো পেশিবহুল চেহারা, পরনে খাটো ধুতি আর ফতুয়া। মুখে আলগা হাসি।
"নাও লাগবে বাবু?"
"না।"
"কম করে দিব কত্তা, হাজার হোক আপনি ছোট ঠাকুরের আত্মীয়।"
"অ্যাঁ! তুমি কী করে জানলে?"
আমার হতভম্ব ভাব দেখে লোকটা দন্ত বিকশিত করে খানিকক্ষণ হ্যা-হ্যা করে হাসল।
"আজ্ঞে আমি জেলেপাড়ার তিলক। ছোট ঠাকুর আমায় চেনেন। আপনি ওনার সাথে অনেকক্ষণ ধরে ওই ঘাটের সিঁড়িতে বসে কথা বলছিলেন তো, তাই ভাবলুম আর কি...."
"অ, বুঝেছি। তার মানে অনেকক্ষণ ধরেই নজরদারি চালানো হচ্ছে, তাই না? অবশ্য তুমি ঠিকই ধরেছ হে তিলক, আমি তোমাদের ছোট ঠাকুরের খুড়তুতো ভাই।"
আবার একগাল হাসল তিলক মাঝি।
"আসেন কত্তা আসেন, নৌকায় ওঠেন। লক্ষিন্দরের ঘাটে এলেন আর নাও চড়লেন না, সে কি হয়?"
"বললাম তো লাগবে না।"
"আসেন না বাবু," মাঝি তখনও ঘ্যানঘ্যান করে চলেছে, "একদম কম ভাড়ায় ঘুরিয়ে আনব।"
গরীব মাঝির মিনতি শুনে মনটা কিছুটা খারাপই হল। আজ হয়তো সারাদিন তেমন উপার্জন হয়নি। দিনের শেষে আমার কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়ে যদি ওর ঘরের উনুন জ্বলে, তাহলে মন্দ কী? এরা আত্মসম্মানী মানুষ, নেহাৎ পেটের দায়ে এত হাতে-পায়ে ধরতে হচ্ছে। জঠর জ্বালা যে কী জিনিস, তা এরা হাড়ে-হাড়ে বোঝে। হাতঘড়ি বলছে সোয়া ছ'টা, তার মানে এখনও হাতে ঝাড়া দুই-আড়াই ঘণ্টা সময় বাকি। একটু নৌকা বিহার করলে ক্ষতি কী?
"আচ্ছা বেশ," একটু ভেবে বললাম, "কিন্তু রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত। তারপর আমায় বাড়ি ফিরতে হবে।"
আমি উঠে পড়তেই নৌকা ছেড়ে দিল তিলক মাঝি। প্রসাদের ডালিটা রেখে ছইয়ের ভিতরে বেশ গুছিয়ে বসলাম। সেইখানে শুধু একটা কালিমাখা লণ্ঠন টিমটিম করে জ্বলছে। এ ছাড়া কোথাও বিশেষ কোনও আলো চোখে পড়ল না। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে, বাতাস হয়ে উঠেছে মন্থর। তার সঙ্গে ঠাণ্ডাও বোধ করছি খুব। একেই নদীর জোলো হাওয়া গায়ে লাগছে, তার সাথেই তাল মিলিয়ে কমছে শ্রাবণ রাতের পারদ। ইশ্! এই সময়ে শহরে কী বিশ্রী গরম....কিন্তু গ্রামে দেখছি এখনই হাওয়ায় বেশ একটা শীত-শীত ভাব এসে গিয়েছে। তিলক গলুইতে বসে দাঁড় টানছিল। সেই ছন্দবদ্ধ 'ছপ-ছপ-ছপাক' শব্দে কেমন যেন এক ঘোর লেগে আসে। বাইরে চাঁদের আলো নদীর কালো জলে একখানি রূপালী চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। আকাশও আজ একেবারে পরিষ্কার মেঘবিহীন। চারিদিক শান্ত, নিস্তব্ধ। ছইয়ের ভিতর থেকে দেখলাম, যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই জল আর জল। বিগত আষাঢ় মাসে প্রকৃতির দানের প্রাচুর্যে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠা নদীর হৃদয়ে আমাদের ছোট্ট নৌকাটি এক অবোধ শিশুর ন্যায় আপন মনে ভেসে চলেছে। আকাশভরা তারার মেলা এই গভীর তিমিরেও চণ্ডেশ্বরের জলে হাজার-হাজার সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। নদীর দু'কূল জুড়ে শুধুই চোখে পড়ছিল অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর কালো গুঁড়ি। বাতাসে সর্বত্র একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে ছিল....কোনও নাম না জানা অভাগিনী ফুলই হয়তো বোকার মতো তার সুগন্ধের বিপুল ভাণ্ডার উজাড় করে দিচ্ছে। সেই অপূর্ব সৌরভে আমার নিঃশ্বাস ক্রমেই ভারী হয়ে উঠল।
বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তিলক জিজ্ঞাসা করল-
"কী বাবু? কেমন লাগছে?"
"হুম, জীবনে প্রথমবার এমন হল। নির্জন রাতে নৌকা বিহার....বেশ তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করছি।"
"সে আর বলতে বাবু?" অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠল তিলক, "আপনার জীবনে আরও কত কিছু যে প্রথম বার ঘটবে আজ রাতে, তার কি কোনও ইয়ত্তা আছে?"
"মানে?" একটু অবাক হলাম, "কী হবে আমার জীবনে?"
"না, তেমন কিছু না। মানে বলছিলাম যে আজ তো শনিবার, তার উপর আবার...."
"তার উপর কী?"
"সেকি বাবু?" মাঝির গলায় ব্যঙ্গের সুর, "আপনি এইটুকুও খবর রাখেন না? আজ যে গ্রহণ লাগবে!"
"তাতে আমার কী?" রাগান্বিত গলায় বললাম, "চন্দ্রগ্রহণ তো লেগেই থাকে। এর সাথে আমার জীবনে নতুন ঘটনা ঘটার কী সম্পর্ক?"
"বুঝবেন বাবু, সময় এলে সবই বুঝবেন," তিলক আবার সেই অদ্ভুত কায়দায় হেসে উঠল, "আজ গ্রহণ লাগার সাথেই আরম্ভ হবে মহানিশীথ কাল। একটু সবুর করুন, গ্রহণ তো এই লাগল বলে!"
"কী আবোল-তাবোল বকছ হে? মদ-টদ গিলেছ নাকি?"
আমার এই ধমকের কোনও উত্তরই দিল না তিলক মাঝি। নিথর হয়ে বসে রইল। শুধু ওর দুটো হাত যান্ত্রিক ভাবে দাঁড় টেনে চলেছে। অন্ধকারে হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে, যেন ওর গোটা শরীরটা পাথর কেটে খোদাই করা একটা মূর্তি। কেবলমাত্র সেই নিশ্চল মূর্তির হাত দুটোই সজীব।
অত্যন্ত বিরক্তির সাথে আবার ছইয়ের ভিতরে এসে বসলাম। কী বলতে চাইছে তিলক? গ্রহণের সাথে আমার কীসের যোগাযোগ? আচ্ছা, চন্দ্রগ্রহণ মানে তো ল্যুনার এক্লিপ্স। এইটা তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত একটি ঘটনা মাত্র। পৃথিবী যখন চাঁদ আর সূর্য্যের মাঝামাঝি চলে আসে, এবং সেই কারণে যখন পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে, তখনই হয় চন্দ্রগ্রহণ। এ তো সম্পূর্ণ ভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক একটা ব্যাপার। তবে...? নির্ঘাত লোকটার মাথায় বেশ ভাল রকমের ছিট আছে, নইলে এমন অসঙ্গত কথা কেউ বলে? সে যাই হোক, এক গাঁইয়া অশিক্ষিত মাঝি কী না কী বলল, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নৌকা বিহারের আনন্দটা মাটি করার আদৌ কোনও মানে নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে বেশ আরাম করে হেলান দিয়ে বসলাম। কানে আসছে শুধুই সেই ছপ-ছপ শব্দ........
কতক্ষণ ওইভাবে বুঁদ হয়ে বসে ছিলাম জানিনা। নৌকার দুলুনিতে হয়তো চোখটা অল্প লেগে এসেছিল। লক্ষ্য করে দেখলাম, কালিমাখা মিটমিটে লণ্ঠনটা এখন একদমই নিভু-নিভু হয়ে এসেছে। আগুনের শিখাটা থেকে-থেকে প্রচণ্ড ভাবে কেঁপে উঠছে। সেই অল্প আলো-আঁধারিতে অতি কষ্টে ঘড়িটা দেখলাম। রাত সোয়া আটটা। না, এইবার মাঝিকে নৌকা ঘুরিয়ে নিতে বলি। কিন্তু এক মিনিট....নৌকাটা এত স্থির আর শান্ত হয়ে আছে কীভাবে? দুলছে না কেন? আর বাইরে বৈঠা চালানোর শব্দও তো পাচ্ছি না। তাহলে কি তিলক দাঁড় টানা বন্ধ করে দিয়েছে? স্তিমিতপ্রায় লণ্ঠনের শিখাটা বার দুয়েক কেঁপেই নিভে গেল। আর তার সাথেই ছইয়ের ভিতরটা ডুবে গেল গহীন অন্ধকারের সমুদ্রে।
উঠে বাইরে এলাম। যা অনুমান করেছিলাম, ঠিক তাই। তিলক বৈঠা চালানো থামিয়ে দিয়েছে। ও এখন গলুইয়ের উপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে পিছন ফিরে। ওর বলিষ্ঠ শরীরটা যেন এক অজানা উত্তেজনায় কেঁপে-কেঁপে উঠছে। আর ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে আকাশের দিকে। তিলকের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম, কিছুক্ষণ আগেকার ঝলমলে চাঁদ এখন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। মরা জ্যোৎস্নার হলুদ আলোতে চারিদিক কেমন যেন মায়াবী লাগছে। কিছুই ভাল করে ঠাহর করা যাচ্ছে না। চাঁদের একটা দিকে লেগে রয়েছে এক গভীর রক্তিম আভা। তিলক সেই দিকেই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মানে কি গ্রহণকাল আরম্ভ হয়ে গিয়েছে?
তিলকের নাম ধরে ডাকতে গিয়ে দেখি, গলা দিয়ে কোনও স্বরই বেরোচ্ছে না। সারা সন্ধ্যা নদীর বাতাস খেয়ে গলাটা বোধহয় ধরে গেছে। আমাকে চমকে দিয়ে তিলক নিজেই কথা বলে উঠল-
"দেখছেন কত্তা? সময় তো শুরু হয়ে গেল।"
"কীসের সময়?"
"মহানিশীথ কাল। আজ এই মহানিশীথ কালেই আরও একটা নরহত্যা করলে আমার সাধনা পূর্ণ হবে। পরপর সাতটা গ্রহণে সাতটা তাজা প্রাণ নিতে পারলেই এই মহাসাধনা পূর্ণ হয়। ছ'টা হত্যা করেছি, আজ হবে সপ্তম খুন। আজ রাতেই সাধনা সফল হবে আমার, আর তারপর....শয়তানের দয়ায় আমি পাব এক নতুন দেহ। কত কাল আর অন্যের দেহে পরজীবী হয়ে আশ্রয় নেব? হাহাহা!"
"মানে?" ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল, "সাধনা...নরহত্যা...নতুন দেহ? কী সব বলছ তুমি? তিলক, অ্যাই তিলক!"
তিলক মাঝির ঠোঁটের কোণে আবার ফুটে উঠল সেই রক্ত জল করা কুটিল হাসি।
"এই শরীরটাই শুধু তিলক মাঝির। কিন্তু আত্মাটা আমার। আমি উৎপল, মণ্ডলদের ছোট ছেলে।"
গোটা শরীরটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল আমার। হায় ভগবান! তার মানে অন্যের শরীরে ভর করে রয়েছে এক অতৃপ্ত আত্মা? পৈতৃক গ্রামে ঘুরতে এসে আমি এ কোন রক্তপিপাসু পিশাচের পাল্লায় পড়লাম? মাথা কাজ করছিল না। ক্রমেই পিশাচটার কণ্ঠস্বরে ভয়াল পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করেছে। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে ঘৃণার আগুন। ঘন-ঘন গরম নিঃশ্বাস পড়ছে তার, পুরুষালি বুক ওঠানামা করছে প্রচণ্ড ক্রোধে। পেশিগুলো ফুলে উঠছে অদম্য নারকীয় উচ্ছ্বাসে। চিবুক বেয়ে নেমে আসছে ঘর্মাক্ত ধারা। এক পা-এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল শয়তানটা। তাল মিলিয়ে বাড়ছে সেই নিষ্ঠুর অট্টহাসি।
মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেলে সে একটা শেষ চেষ্টা অবশ্যই করে। সে রুখে দাঁড়ায়, কারণ তা করা ছাড়া তার কাছে প্রাণে বাঁচার অন্য কোনও উপায় থাকেনা। আমিও মরিয়া হয়ে উঠলাম। পিছু হটতে লাগলাম একটু-একটু করে। হাতের নাগালে নিভে যাওয়া লণ্ঠনটা পেয়ে গেলাম। বিদ্যুৎগতি'তে সেইটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারলাম শয়তানটার দিকে। কপালে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে টাল খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল উৎপল। কিন্তু চোখের পলকে সে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। কপালের গভীর ক্ষত থেকে গড়িয়ে পড়ছে কালচে রক্ত। পিশাচের মুখে ফুটে উঠেছে চরম নির্দয়তার প্রতিচ্ছবি।
"শোন রে তবে মূর্খ!" যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সেই পৈশাচিক কণ্ঠস্বর, "আমাদের মরণ নেই। আমাদের ধ্বংস করা যায় না। আত্মাদের কোনও আদি-অন্ত নেই। বহুদিন অপেক্ষা করেছি নিজের একটা শরীর পাওয়ার জন্য। আজ আমার অপেক্ষার অবসান হবে।"
"কিন্তু আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি?" আমি চিৎকার করে উঠলাম, "তুমি কেন নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এক নির্দোষের প্রাণ নিতে চাও?"
"নির্দোষ?" রাগে হিসহিস করে উঠল উৎপলের প্রেতাত্মা, "আমিও তো নির্দোষ ছিলাম, তাহলে কেন আজ থেকে দশ বছর আগে বিনা দোষেই আমাকে মরতে হল? গ্রহণ লেগেছে আজ। এইবার দেখবি কেমন তোদের গ্রামেও গ্রহণ লাগে। মড়ক লাগবে প্রতিটা ঘরে-ঘরে, প্রতিটা বাড়ি থেকে শুধুই ভেসে আসবে মড়াকান্না আর বিলাপ। কালরাত্রি নামবে গোটা তল্লাট জুড়ে। দেখবি কীভাবে তোদের চোখের সামনেই তোদের এই গ্রামটাকে একটা জীবন্ত শ্মশানে পরিণত করি। হাহাহা...!"
পায়ে-পায়ে পিছু হটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়লাম। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আর বুঝতে বাকি রইল না, এটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। শেষবারের মতো দাদাভাইয়ের স্নেহময় মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। পিশাচটা এসে আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়েছে। ওর তপ্ত নিঃশ্বাস আমি অনুভব করতে পারছি। মুখে খেলা করছে নৃশংসতা। দুটি শক্তিশালী বাহু এগিয়ে এল আমার দিকে। আমাকে মরণপাশে চেপে ধরল লৌহকঠিন দুই হাত........
"আআহহহ্....!!!"
এক গগনভেদী জান্তব হুঙ্কার ছেড়ে দূরে ছিটকে পড়েছে উৎপল। মেঝেতে পড়ে কাতরাতে লাগল প্রচণ্ড কষ্টে, তার সাথেই গোঙাতে-গোঙাতে চিৎকার করতে লাগল-
"আহ্! জ্বলে গেল....হাত দুটো আমার জ্বলে গেল!"
কোনওমতে টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। শক্তিশালী দুরাত্মার এমনধারা করুণ অবস্থার কারণটা আঁচ করতে বিশেষ অসুবিধা হল না। আমার টুঁটি টিপতে গিয়ে উৎপলের হাতে ছুঁয়ে গেছিল আমার গলায় পরানো বিপদভঞ্জন মহাকালের মন্ত্রপূত মাদুলি। তাতেই দুষ্টের এহেন শোচনীয় অবস্থা হয়েছে। মনে বল পেয়ে তাড়াতাড়ি প্রসাদের ডালিটা হাতে তুলে নিলাম। ওইটা বাড়িয়ে ধরে এগোতে শুরু করলাম উৎপলের দিকে। সাথে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করতে লাগলাম মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র:-
||ওঁ ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্দ্ধনম্,
উর্বারুকমিব বন্ধনাৎ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ||
এইবার উৎপল নিজেই এক পা-এক পা করে পিছু হটতে আরম্ভ করেছে। সেই সঙ্গে বুকের রক্ত জল করা গর্জনে দিয়ে চলেছে হুঁশিয়ারি-
"খবরদার! আর এক পাও এগোতে যাস না। নয়তো তোর কপালে অশেষ দুঃখ নাচছে।"
যেন নরকের গভীরতম গহ্বর থেকে উঠে আসছে এই বাণী। কিন্তু আমার সাথে স্বয়ং ঈশ্বর আছেন, আমার ভয় কীসের? দৃঢ় পায়ে পিশাচটা কে পিছনে ঠেলতে-ঠেলতে একেবারে নৌকার শেষ প্রান্তে এনে ফেলেছি। কাছেই ভাঙা লণ্ঠনটা পড়ে ছিল। ওটা দিয়ে ঘুরিয়ে ওর মুখে মারতেই উৎপল টাল সামলাতে পারল না....সোজা গিয়ে পড়ল নদীর জলে। একটা বিরাট 'ঝপাং' করে শব্দ, তারপর আবার সব আগের মতোই নিস্তব্ধ। প্রকৃতি আবার পূর্বের মতো নির্বিকার হয়ে গেল। আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম নৌকার মেঝেতে।
যখন আস্তে-আস্তে আবার চোখ খুলে তাকালাম, তখন সকাল হয়ে গেছে। নবোদিত সূর্য্যের নির্মল আলোকে চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে। মৃদু হাওয়ায় অল্প-অল্প দুলছে গাছের চূড়াগুলি। পাখির কূজনে আকাশ-বাতাস মুখরিত। কাল রাতের বিভীষিকার কোনও চিহ্নই ছিল না এই প্রাণবন্ত প্রভাতে। আমি এতক্ষণ ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিলাম চণ্ডেশ্বরের বালুকাময় তীরে। শুধু আমার প্রসাদের ডালিটা সযত্নে আমার হাতের কাছেই রাখা ছিল। কোথায় সেই নৌকা? কোথায় সেই ভাঙা লণ্ঠন? সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কোনও স্মৃতিই আর নেই। গায়ে খুব ব্যথা অনুভব করছি। সারারাত নদীতীরে পড়ে ছিলাম, তাই হয়তো এতক্ষণ ধরে হিম খেয়ে গা ভারী হয়ে উঠেছে। আমাকে ঘিরে বেশ একটা জটলা তৈরি হয়েছিল। আমি চোখ খুলতেই কিছু ছেলে "চোখ মেলেছে, চোখ মেলেছে!" বলে তুমুল চিৎকার জুড়ে দিল। ভীড়ের মধ্যে থেকে দাদাভাই আর জ্যাঠামশাই বেরিয়ে এলেন। তারপর কীভাবে ওই শরীর নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলাম, তা শুধু ভগবানই জানেন।
বাড়িতে ফেরার পর আমার ধূম জ্বর উঠে গিয়েছিল। প্রায় দু-তিন দিন আমি জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে ভুল বকেছিলাম। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর আমি পুরো ঘটনাটা খুলে বলেছিলাম বাড়ির সকলকে। সবকিছু শুনে জ্যাঠামশাই নিজেই সর্বপ্রথম মুখ খুললেন। তিনি যা শোনালেন, তার সারমর্ম হল এই:-
আজ থেকে প্রায় দশ-এগারো বছর আগেকার কথা। মণ্ডলরা এই গ্রামের বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার ছিল। তাদের ছোট ছেলে উৎপল ছিল তুখোড় মেধাসম্পন্ন। শহরে গিয়ে অনেক দূর পড়াশোনা করেছিল। তবে তাদের এই সুখী সংসারে কাল হয়ে নামল উৎপলের বাবার আকস্মিক মৃত্যু। হঠাৎ করেই পরিবার চালানোর পুরো দায়ভার এসে পড়ল ছোট ছেলে উৎপলের উপর, কারণ ওর দাদারা কেউ তেমন ভাবে পড়ালেখা শেখেনি। এখন বললেই তো আর ভাল চাকরি জোটানো যায়না। কিন্তু তখন পরিবারের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। অগত্যা, বুকে পাথর চাপা দিয়ে উৎপল একটা শাড়ির দোকানে হেল্পার হয়ে যোগ দিল। মাসের শেষে যা হাজার দুয়েক টাকা হাতে পেত, তা দিয়েই অতিকষ্টে চলত তাদের বড় পরিবারের পেট। নিয়তির প্যাঁচে পড়ে উৎপল কাজটা করছিল ঠিকই, কিন্তু এত পড়াশোনা শিখেও শেষে একটা শাড়ির দোকানে কর্মচারী হয়ে পড়ে থাকতে ওর সম্মানে লাগত। এ নিয়ে অনেক হীনমন্যতায় ভুগত উৎপল। সে পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। কিন্তু একদিন হঠাৎ ওই শাড়ির দোকানের মালিক অধীর বাবুর সাথে কোনও পার্টির খুব তুমুল ঝগড়া লাগে। কথা কাটাকাটি হতে-হতে গালিগালাজ, তারপর হাতাহাতি। শেষে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে অধীর বাবু তার লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিভলভার দিয়ে গুলি চালিয়ে একজন কে খুন করে ফেলেন। ক্ষণিকের হঠকারিতায় করে ফেলা এই অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি আঁচ করতে পেরে তিনি খুনের পুরো দায় চাপিয়ে দেন তার দোকানের কর্মচারী উৎপলের উপর। কোর্টে কেস ওঠে। তবে প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী অধীর সান্যালের সামনে কি আর অনটনে জর্জরিত উৎপলরা টিকতে পারে? যা হওয়ার ছিল তাই হল। অর্থ বেকসুর খালাস হল, অভাব দোষী সাব্যস্ত হল। মাত্র চব্বিশ বছরের কচি বয়সে উৎপল কে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়েছিল, তাও আবার বিনা দোষে।
কিন্তু তখন প্রশ্ন উঠল, এই তিলক মাঝি লোকটা কে? দাদাভাই কে জিজ্ঞাসা করতেই সে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, তিলক কে সে বিলক্ষণ চেনে। আমার জোরাজুরিতে দাদাভাই তিলকের বাড়িতে খোঁজ নেওয়ার জন্য লোক পাঠায়। সেইখান থেকে জানা গেল যে তিলক মাঝি বিগত এক সপ্তাহ ধরে নিরুদ্দেশ।
তারপর আর বেশি কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি আমার গ্রামে থাকাকালীন। আরও সাত-আট দিন সোনারপুরে থেকে আমি আবার কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলাম। আসল চমকটা পেলাম শহরে ফেরার দিন পাঁচেক পর। দাদাভাই ফোন করেছিল। কিছুক্ষণ এটা-ওটা বলার পর সে আসল ঘটনাটা জানাল। বলল, তিলক মাঝির লাশ পাওয়া গেছে চণ্ডেশ্বরের জলে। তবে ওর মৃত্যুটা জলে ডুবে হয়নি....কারণ মৃতদেহের গলায় পাঁচটা আঙুলের দাগ সুস্পষ্ট। অর্থাৎ কেউ গলা টিপে ওকে হত্যা করে লাশটা নদীর জলে ফেলে দিয়েছিল। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এটাও পরিষ্কার লেখা আছে, তিলক মাঝির মৃত্যু ঘটেছে আমার সাথে ওর সাক্ষাৎ হওয়ার তিন থেকে পাঁচ দিন আগে। সুতরাং আমার সাথে তিলকের মুখোমুখি দেখা হওয়ার কোনও কথাই নেই, অন্তত বিজ্ঞান তাই মনে করে।
কথাগুলো শুনে আমি বড়ই ধাঁধায় পড়ে গেলাম। যদি তিলকের মৃত্যু আমার সাথে ওর সাক্ষাৎকারের আগেই ঘটে থাকে, তাহলে সেই রাতে আমি কাকে দেখলাম? তার মানে কি উৎপলের অতৃপ্ত আত্মাই তিলক মাঝিকে কোনওভাবে মেরে ফেলেছিল? তারপর ওর প্রাণহীন দেহের ভিতরে আশ্রয় নিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিল তিলকেরই রক্তমাংসের হাত দিয়ে? এইসব প্রশ্নের কোনও সম্যক উত্তর বা ব্যাখ্যা আমি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। কিন্তু সেই রাতে আমার সঙ্গে বিপদভঞ্জন মহাকালের আশীর্বাদ না থাকলে কী যে অনর্থ ঘটে যেত, তা ভাবলে আজও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
**** সমাপ্ত ****