নিহত গোলাপ
নিহত গোলাপ
বছরের প্রথম দিন,ইংরাজী নববর্ষ,রাতভোর চারিদিকে ছিল বর্ষবরণ উৎসব,ঘরে ঘরে টিভির সামনে মানুষজনের ভিড়,গানবাজনা হুল্লোড়ের সঙ্গে কয়েকঘন্টা কাটলে,শুরু হল কাউন্টডাউন ৫৯,৫৮,৫৭.....৩০,২৯,২৮.....১০,৯,৮...৩,২,১। বাজল ১২টা,ফুটল বাজি,টিভিতে,বাইরে,সঙ্গে হৈহৈ চিৎকার,বাজল সিটি,আনন্দের অভিব্যক্তি। জানল না কেউ পল্লীর একটা বাড়িতে কি ঘটে গেল সেই আনন্দের রাতে। জানল সবাই অনেক পরে,যখন সারারাত ডাক্তারদের সব চেষ্টাকে বিফল করে দিয়ে বাড়ি ফিরল সুনুর নিথর দেহ।
বাড়ীটার সামনে তাই বছরের প্রথম দিনে ভিড়ে ভিড়,লোকে লোকারণ্য। সবার মুখ থমথমে। আর হবে না-ই বা কেন,ছেলেটির মিষ্টি স্বভাবের জন্য সে যে সবার প্রিয়,এমন ফুলের মত সুন্দর তরতাজা একটি ছেলে,আর এইতো টুকু বয়স,সবাই হায় হায় করছে।
মায়ের বড় প্রিয় ১৬ বছরের সুনু,তিন দিদিরও খুব প্রিয় তাদের একমাত্র ভাই,দেখতে যেমন রাজপুত্রের মত,টকটকে ফর্সা,তেমনি মিষ্টি স্বভাব। ঘোরে ফেরে,মা মা করে। মায়ের মেয়েদের থেকে ছেলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব একটু বেশিই ছিল,তাতে অবশ্য দিদিরা রাগ করত না,তারাও যে ভাইকে খুব ভালবাসত। সেবারের মাধ্যমিকের ছাত্র সুনু,টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে,ফাইনালের জন্য প্রস্তুতি চলছিল জোরকদমে। সেদিন ৩১শে ডিসেম্বর,বাড়ীতে পৌষমাসের লক্ষ্মীপুজো ছিল। ঠাকুরকে পায়েস ভোগ দিয়ে পুজো হয়ে গেলে,খাওয়াদাওয়া সেরে ম্যাটিনি শো-য়ে পাশের বাড়ীর কাকীমার সাথে সুনুর মা গেলেন ফিল্ম দেখতে। ছেলে আবদার করল,"মা,আমার জন্য নৌকো পাউরুটি নিয়ে আসবে"। তাই ফেরার সময় ছেলের জন্য এল নৌকো পাউরুটি। সন্ধ্যেয় প্রাইভেট টিউটর পড়াতে আসার আগে মা তাকে নৌকো পাউরুটি আর ঠাকুরের ভোগের পায়েস খেতে দিলেন।
টিউটরের কাছে পড়ার মাঝে সে টয়লেট যেতে চায়। টয়লেটে যেতে তিনটে সিঁড়ি উঠতে হয়। তিনটে সিঁড়ি ওঠার পর সুনু ওপর থেকে নীচে পড়ে যায়,সবাই ছুটে আসে,ও বলে,"কিছু হয়নি আমার"। মা ভাবেন কাঁচা পাউরুটি আর পায়েস খেয়ে পেটে গ্যাস হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে তাই একটু কার্মোজাইম খাইয়ে দেন,আর ভাল করে দেখেন কোথাও কেটে ছড়ে গেছে কিনা। না,সেসব কিছু হয়নি দেখে নিশ্চিন্ত হন মা,রান্নাঘরে গিয়ে রাতের রান্নার আয়োজন করতে থাকেন। পড়ে যাবার আধঘন্টা পরে সে বমি করে ফেলে ঘরের মধ্যেই আর এতে সে খুব লজ্জা পেয়ে যায়। মা আবারও ভাবেন গ্যাস থেকেই বমি হল। সবাই তাকে শুতে বললে সে বলে,"আরে আমি ঠিক আছি,কিছু হয় নি আমার"। এরপর আস্তে আস্তে সে ঝিমিয়ে যেতে থাকে। রাত প্রায় ১১টা নাগাদ ওর মুখ থেকে যখন গ্যাঁজলা বেরোয় তখন ডাক্তারের কথা সবার মনে হয়। বাড়ীর নিচেই একজন ডাক্তারের চেম্বার,যেখানে সন্ধ্যে থেকে ডাক্তারবাবু ছিলেন,রাত ১০টা নাগাদ চেম্বার বন্ধ কর
ে চলে যান। প্রাইভেট টিউটর ওখানেই ছিলেন,এমন অবস্থায় ছেড়ে চলে যেতে পারেননি,তিনি তখন ছোটেন ডাক্তার ডাকতে। কিছুদূরে ডাক্তারবাবুর বাড়ী গিয়ে সব বললে,তিনি আক্ষেপ করেন সন্ধ্যে থেকে ওখানেই ছিলেন,আর এত পরে? তিনি নিজের মনেই বলে ওঠেন,"ইন্টারনাল হেমারেজ",আর বলেন,"যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যান"।
এরপর তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলেও অত রাতে,তার ওপর বছরের শেষ দিনে,গাড়ি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। শেষমেশ একটা গাড়ি পাওয়া গেলে নেতিয়ে পড়া সুনুকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে বর্ষবরণ উৎসবের জের চলছে তখনও,বাজি ফুটছে তীব্র আওয়াজ করে,যতটা আনন্দ সঞ্চয় করে নেওয়া যায়। হাসপাতালে পৌঁছালে এমার্জেন্সীতে ডাক্তার ওকে পরীক্ষা করেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। বিলাপের মত নিজের মাথায় চাপড় মেরে বলতে থাকেন,"It's too late,too late.একটা ফুটন্ত গোলাপকে ছিঁড়ে নিয়ে এলেন?আমায় কিছু করার একটু সুযোগ দিলেন না?" বস্তুত হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই সুনুর মৃত্যু হয়। তবু একটা মিরাকল কিছুর আশায় ডাক্তার চেষ্টা চালান কিছু সময়। সব আশায় জল ঢেলে,ডাক্তারের সব চেষ্টাকে বৃথা করে দেয় সুনু।
ফুলের মত ছেলেটাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলে মানুষের ভিড়ে বাড়ি ভেঙে পড়ে। সুনুকে দেখে মনে হয় এক পবিত্র বালক শান্তির ঘুমে ডুব দিয়েছে। মা পড়িমরি করে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন,"কি হয়েছে আমার সুনুর,কিচ্ছু হয়নি,ও তো ঘুমোচ্ছে। তোমরা এখানে ভিড় করেছ কেন?ওকে শান্তিতে ঘুমোতে দাও,ওর ঘুম ভেঙে যাবে"। মায়ের এই করুণ উক্তিতে প্রতিটি মানুষের চোখে জল আসে,মাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেখান থেকে সুনুকে দাহ করতে নিয়ে যাবার আগে।
সেদিন থেকেই মা অপ্রকৃতিস্থ,বিশ্বাস করেন তার সুনু ঘুমিয়ে আছে। নিজের মনেই ঘরে ঘরে ঘোরেন আর খুঁজে বেড়ান তার সুনু কোন ঘরে ঘুমাচ্ছে। সুনু,সুনু করে ডাক দেন দিনান্তে কতবার,খাওয়া নেই,চোখে ঘুম নেই। সন্তানহারা মায়ের এই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় সকলে কষ্ট পায়। সুনুর দিদিরা স্থির করে মাকে কঠিন সত্যটা বোঝানো দরকার,তাতে মা কষ্ট পেলেও এই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় মাকে তারা দেখতে পারছে না আর। অবশেষে বারবার তাঁকে কাছে বসিয়ে কেঁদেকেটে তারা বোঝাবার চেষ্টা করে সুনু আর নেই,কোনোদিনও ফিরবে না,সে মারা গেছে,স্বর্গে গেছে। মা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। কদিন বারবার বলতে বলতে একদিন তিনি চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। তারপর দেওয়াল থেকে সুনুর ছবিটা খুলে ঠাকুরের আসনে রেখে এলেন।
এরপর মা একদম আর সুনুর নাম মুখে আনতেন না,অসম্ভব রকম চুপচাপ হয়ে গেলেন আর সুনু যা যা খেতে ভালোবাসত সব ত্যাগ করলেন। সংসারে থেকেও তিনি বিবাগী হয়েই রইলেন।