STORYMIRROR

SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Thriller

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Thriller

নৈশ অ্যাডভেঞ্চার

নৈশ অ্যাডভেঞ্চার

6 mins
207


আজ থেকে বছর দশেক আগেকার কথা। সদ্য বিয়ে করেছি, গিন্নির তখনও গ্রাজুয়েশন চলছে। দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার জন্য তার কলেজে ছুটি চলছিল তখন। তাই, ঠিক করলাম এই সুযোগে তাকে আমার কর্মস্থলে নিয়ে গিয়ে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।


ওহো, বলা হয়নি তো - তখন আমি ওড়িশার ঢেঙ্কানাল জেলার সুবিস্তীর্ণ বনভূমির মধ্যস্থ একটি গ্রামে নির্মীয়মান তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত ছিলাম। ঢেঙ্কানাল এবং অঙ্গুল জেলার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আছে গভীর বন। 


সেই বনের বুক চিরে চলে গেছে চওড়া পিচ রাস্তা, সম্ভবত ৭৭ নং রাজ্য মহাসড়ক। ঐ বনভূমিটির বিস্তার রাজ্যের বিপুলাংশ জুড়ে। মহানদীর গতিপথের অনেকটাই এই বনভূমির ভিতর দিয়ে, সাতকোশিয়া ড্যামও এই বনভূমির মধ্যেই আসে। সাতকোশিয়া ড্যামের কথা এই কারণে বলা, যাঁরা ওড়িশা সম্পর্কে খুব বেশি খবর রাখেন না তাঁরাও এই ড্যামের কথা অন্তত জানেনই।


ভারতবর্ষে যে সমস্ত দর্শনীয় জায়গা রয়েছে তার মধ্যে এ'টি অবশ্যই অন্যতম। অসাধারণ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সঙ্গে রয়েছে হাতি, বাঘ, ঘড়িয়াল, কুমির ইত্যাদির দুর্লভ দর্শনের সু্যোগও। যাই হোক সে প্রসঙ্গে পরে আসবো, আসলে যেটা বলার জন্য এত গৌরচন্দ্রিকা সেটা হচ্ছে, ওই মহাসড়কে এখনও মাঝেসাঝেই এসে হাজির হয় বুনো হাতির দল আর তখন যে একটু বিপত্তি হয় সে কথা তো বলাই বাহুল্য।


আমার কর্মস্থল ওই মহাসড়ক থেকে অনেকটা দূরে হলেও, হাতির দল যে সেখানে পৌঁছতে পারবে না এমন নয়। তবে সচরাচর তাদের এই পথে আসতে দেখা যায় না। অন্তত আমার তো সেই সৌভাগ্য হয়নি তখনও পর্যন্ত। এই ঘটনার সময় আবার ক'দিন ধরে শুনছিলাম যে, কোথা থেকে একটা চিতা বাঘও নাকি এসে হাজির হয়েছে ঐ বনে।


যাই হোক, হাওড়া থেকে রাত্রের ট্রেনে স্বামী-স্ত্রীতে ফিরছি ওড়িশা। বেশ অনেকটা রাতেই নামলাম ভুবনেশ্বরে, বাইরেই গাড়ি দাঁড়িয়েছিল অপেক্ষায়, দু'জনে রওনা দিলাম আমার কর্মস্থলের দিকে। গাড়ির ড্রাইভার মোহন খুব ভালো ছেলে, ওখানে আমার গাড়ি তখন মূলত ওই চালাতো। 


মোহন বয়সে আমার থেকে সামান্য বড় ছিল, কিন্তু আমার থেকেও যেন বেশি তরুণ মনে হতো তাকে দেখে। আদিবাসী ছেলে, কর্মসূত্রে শারীরিক পরিশ্রম করা ছাড়াও সে তখন মাঠে খেলাধুলাও করতো নিয়মিত। ওই বনটাকেও খুব ভালো চিনতো সে, আর সেই জন্যই রাত বিরেতে বেরোতে হলে আমি ওর উপরেই ভরসা করতাম বেশি।


রাত তখন তৃতীয় প্রহর হবে বোধ হয়, মোহন আমার হুড খোলা গাড়ি চালাচ্ছে আর গুনগুন করে সুর ভাঁজছে। আকাশের পূর্ণ চাঁদের আলো মাঝে মাঝেই গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছে রাস্তায়, আর আমাদের হুড খোলা গাড়িতেও - সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। 


সারারাত ট্রেন জার্নির ধকলটা আমার অভ্যেস হয়ে গেলেও, গিন্নির তখনও সেটা হজম হয়নি। গাড়িতে আমার কাঁধে মাথাটা রেখে, পাশের সিটে কাত হয়ে শুয়ে, সে বাকি পথটুকু চোখ বুজে সেই ধকল কাটাবার চেষ্টা করছিলো। সেটা উপলব্ধি করে আমিও কিছু বললাম না, নাহলে এমন নৈশ সৌন্দর্য কি কেউ কখনো মিস করে?


সেই আলো আঁধারের অপরূপ সৌন্দর্য দু'চোখ ভরে দেখতে দেখতে যাচ্ছি, হঠাৎ মোহন ব্রেক কষে থামিয়ে দিল গাড়িটা। আমি তাকে বলতেই যাচ্ছিলাম যে - কি হলো, কিন্তু মুখ খোলার আগেই সামনে তাকিয়ে দেখি, এক গজরাজ তাঁর দলবল নিয়ে অতি ধীর গতিতে সেই রাস্তা পার হচ্ছেন। ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়েছিল গিন্নিরও। সে চোখ মেলতেই তাকে সামনের দিকে সেই হাতির পালের প্রতি তাকাতে ইশারা করলাম।


এমন সময়, পিছনে গর্জন শুনে দু'জনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি - রাস্তায় আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে এক নধরকান্তি চিতা বাঘ! বোধ হয় কোন হস্তিশাবক তাকে বিরক্ত করেছে অথবা তার উল্টোটা হয়ে থাকবে হয়তো। ঘটনা যাই ঘটুক, হাতির দল যে তাকে এখন কোনভাবেই ছাড়বে না, অভিজ্ঞতা থেকে এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম।


মোহন বললো - স্যার, এই হাতির পাল এখন ঐ চিতা বাঘের সাথে পাঙ্গা নেবে। মাঝখানে পড়ে গেছি আমরা, গাড়িটার যে তারা কি অবস্থা করবে জানিনা, আপাতত আমরা যদি গাড়ি থেকে নেমে না পালাই, তবে নিশ্চিত গাড়ি বা আমাদের কেউই তাহলে আর বেঁচে বাড়ি ফিরবো না।


বললাম - সেটা তো ঠিকই বলেছো, কিন্তু আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলেও কি বাঁচবো? এই যে হাতির দল কিংবা ওই চিতাবাঘ, এদের কেউ যদি দেখতে পায় আমাদের, তাহলে তারাও কি ছেড়ে দেবে? এবার বুঝলাম, এইজন্যই এখানে হুড খোলা গাড়ি ব্যবহার করতে মানা করে সবাই!


মোহন বললো - আপাতত আমরা রাস্তার ধারের একটা গাছের উপরে উঠে গিয়ে বসি চলুন, কিন্তু ম্যাডাম গাছে উঠবেন কি করে? সেক্ষেত্রে তো আপনাদের... বলতে বলতেই দেখি, আমাদের গাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছে গেছে হাতির পাল! দেখে তো আমরা গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিলাম বনের ভিতর।


মোহনের চিন্তা তার নিজের ওপরেই ছেড়ে, আমরা নবদম্পতি তখন প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছি বনের ভিতর দিয়ে। জোছনা ভরা সেই রাতের সৌন্দর্য আর তার আকর্ষণ তখন মন থেকে সম্পূর্ণ বিদায় নিয়েছে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছি, শেষ পর্যন্ত এসে হাজির হলাম এক নদীর ধারে। না, মহানদী নয়, সেটা ছিল সম্ভবত ব্রাহ্মণী। কিন্তু তার দুকূল ছাপানো জল আর বিস্তার দেখে, তখন বোঝার উপায় ছিল না যে সে মহানদী নয়, তার উপনদী ব্রাহ্মণী।


হঠাৎ, মাটিতে পড়ে থাকা একটা ভেজা কিন্তু খুব কঠিন নয় এমন গাছের ডালে পা জড়িয়ে গেলো দুজনেরই। আছাড় খেয়ে পড়লাম মাটির উপর। বুঝতে তখন বাকি নেই যে, ওটা আর যাই হোক কোন মতেই কোন গাছের ডাল তো নয়ই। কারণ, আমাদের পায়ের আঘাতের পর, সেই গাছের ডালটাও দেখি নিজে নিজেই যেন সেখান থেকে বেশ খানিকটা সরে গেল!


ভালো করে সেদিকে চেয়ে দেখি - একটা বিশাল আকারের ঘড়িয়াল! ওরে বাবা, কুমীর হলে তবু তার শ্লথ গতির জন্য পালাবার একটা উপায় হতো, কিন্তু এ তো তুলনামূলক লম্বা পা-ওয়ালা ঘড়িয়াল, এরা ভীষণ জোরে দৌড়ায়! যদি এখন আমাদের দিকে ধেয়ে আসে সে, তাহলে আমাদের বাঁচা খুবই মুশকিল।


ভাগ্য সহায়, সে বেচারা ঘড়িয়াল আমাদের দু'জনের ধাবমান চারটে পায়ের আঘাত পেয়ে হয়তো, কোনো বড় সড় জন্তুর আক্রমণ ভেবেছে বা অন্য কোন কারণ হবে, যা'তে ভয় পেয়ে সে জলে নেমে গেল। কিন্তু সে নেমে গেলেও, তার জ্ঞাতি ভাইরা কেউ ডাঙ্গায় আরো আছে কিনা, আর তাদের সাথে আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎও ঐ এরকমই ফল দেবে কিনা, সে বিষয়ে আমরা তখন যথেষ্টই সন্দিহান।


অগত্যা ওই স্থান ত্যাগ করে বরং, পুনরায় সেই মহাসড়কের দিকেই ফিরে যাওয়া ঠিক হবে ভেবে, আবার পিছন দিকে ছুটতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই, দৌড়াতে গিয়ে গিন্নির মাথায় স্যাঁতসেঁতে পাটের বস্তা জড়ানো একটা গাছের ডালের ধাক্কা লাগলো! কিন্তু এই গভীর বনে কেন গাছের উপর ভেজা বস্তা টাঙিয়ে রাখবে কেউ? কথাটা মনে হতেই চোখ তুলে ওপর দিকে চেয়ে দেখি - গাছের ডালে জড়িয়ে আছে একটা দশাসই চেহারার ময়াল!


সেই রাতে, শুধু এনার দর্শনটুকুই পেতে বাকি ছিল তখনও। যাক গে, আমাদের চওড়া কপাল সাথ দিল এক্ষেত্রেও। সে মহাশয় বোধ হয় তার কিছুক্ষণ আগেই তাঁর মধ্যরাত্রের ভোজন পর্ব সেরে নিদ্রা গিয়েছিলেন। আমার গিন্নির কপালের ছোঁয়ায় তাঁর সেই নিদ্রাভঙ্গ হওয়ায় খানিক ফোঁসফুঁসিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে, তিনি ডালের কিছুটা উপর দিকে চলে গেলেন সম্ভবত।


আমরা আর বিন্দুমাত্র কাল বিলম্ব না করে, যে গতিতে মহাসড়ক থেকে এই নদীর ধার পর্যন্ত এসেছিলাম, সেই গতিতেই ফিরে যাওয়ার পথ ধরলাম। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর যখন ফিরে এলাম সেই রাস্তার ধারে, তখনও দেখি সেখানে সেই চিতাবাঘ আর হস্তিশাবকের সংগ্রাম চলছে। হাতির দল চারিদিক থেকে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, আর মহাসড়কের ওপর সেই মল্লভূমিতে কসরত করছে তারা দু'জন!


মোহনকে দেখি, গাছের উপর একটা ডালে বসে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে। আমরা আড়াল থেকে তাকে আস্তে করে আওয়াজ দিলাম, নিচে নেমে আসার জন্য। সে ইশারায় জানালো যে, যদি সে এখন গাছ থেকে নামার চেষ্টা করে তাহলে গাছের ডালপালা নড়ার আওয়াজে, হাতির দল তাদের তাড়া করতে পারে। তাহলে আর নিস্তার নেই, প্রাণে বাঁচবো না আমরা কেউই।


ইশারা করে তাকে বললাম যে, চলো গাড়ি নিয়ে দ্রুতগতিতে এখান থেকে চলে যাই। কিন্তু সে কিছুতেই নামবে না গাছ থেকে, তাই হাত বাড়িয়ে তার পা টা ধরে দিলাম বেশ জোরে একটা হ্যাঁচকা টান, আর সে হুড়মুড়িয়ে নেমে এলো নিচে। 


ওদিকে এমন সময় কানে এলো, গিন্নি বলছে - ওঃ মাগো, মরে গেলাম গো। এইভাবে কেউ পা ধরে টেনে নামায়? ভাগ্যিস নিচে ব্যাগটা বের করে রেখেছিলাম, নয়তো কোমরটাই ভাঙতো আজ আমার, মা গো খুব লেগেছে গো। আরে ওঠো না, ওঃ পা ধরে টেনে নামালো, তারপরেও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে!


চমকে উঠে চোখ কচলে দেখি, ট্রেনটা ভুবনেশ্বর ঢুকছে। আমার ক্যুপের বাকি দু'জন এবং অন্যান্য যাত্রীরা সবাই নামার জন্য আগেই গেটের কাছে গিয়ে ভিড় করেছে। আমি মোহনের ঠ্যাং মনে করে, আসলে আপার বার্থে অপেক্ষমান আমারই গিন্নির ঠ্যাং ধরে সজোরে টান দেওয়ায়, তিনি ছিটকে এসে পড়েছেন নিচের মেঝেতে রাখা আমাদেরই ব্যাগের উপর!


এর পরের ঘটনা ঠিক প্রকাশ্যে বলার মতো না। তবে এটুকু জানাই, আমাদের সেই বাস্তব সফরের গাড়িটা মোটেই হুড খোলা ছিল না। ড্রাইভারের নামটা অবশ্য মোহনই ছিল। আর সেই বনভূমিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেদিন সূর্যোদয় হয়ে গিয়েছিল। আরও বাকি কিছু তিক্ত স্মৃতি সেদিন অর্জিত হয়েছিল আমার, কিন্তু সেটা কোয়ার্টারের ঘরে আমরা প্রবেশ করার পর। সেই ইতিহাসটুকু গোপন থাকাই ভালো।



ଏହି ବିଷୟବସ୍ତୁକୁ ମୂଲ୍ୟାଙ୍କନ କରନ୍ତୁ
ଲଗ୍ ଇନ୍

Similar bengali story from Comedy