না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত - মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ ঘোঁচাতে চাইছিলো অন্ধকার। আমি গেছি এক বন্ধুসুলভ দাদার বিয়েতে, তার সহযাত্রী হয়ে।
একা নই, বরকে সাথ দেবার জন্য আমরা তিন মূর্তি হাজির - ধনঞ্জয়দা, প্রবীরদা এবং আমি। ওনারা দুজন বরের ক্লাস মেট ছিলেন। আমিই সবার মধ্যে ছোট ছিলাম বয়সে।
ওহো, দাদার নামটাই তো বলিনি - বুদ্ধদেব। তিনি তখন সদ্য বিডিও অফিসে কম্পিউটার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছেন। ধনঞ্জয়দার বিরাট পারিবারিক কারবার, ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।
প্রবীরদা তখন সরকারী চাকরি নিয়ে, কোন দপ্তরে যোগ দেওয়া ভালো হবে - শুধু সেটা ঠিক করার অপেক্ষায় ছিলেন। আমি তখন সদ্য মাস ছয়েক হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছি - ভীষণ ভাবেই নীরস বিষয় আমার, পদার্থবিজ্ঞান।
যা হয় আর কি, ওরে বাবা ফিজিক্সের টীচার! ওর থেকে দূরে থাকাই ভালো - এমনটাই ভাব লক্ষ্য করতাম সাধারণত আসপাশের লোকজনের মধ্যে। তাই সচরাচর কাউকে বলতামই না - কোন সাবজেক্টের টীচার আমি।
মাঝে সাঝে বাধ্য হলে অবশ্য বলতেও হতো, তবে সেইসব ক্ষেত্রে ধরা পড়ার ভয় না থাকলে, বলতাম - বাংলার শিক্ষক। অথবা, একান্তই সিওর শট খেলার হলে বলতাম - সংস্কৃত।
ঐ দুই বিষয়েরই প্রতি আমার নিজের একটা আবেগ, একটা টান আছে। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা উতরানোর জন্য, এই দুই বিষয় পরবর্তী কালে আমায় প্রচুর সাহায্যও করেছে।
তাই, নিরাপদ আশ্রয়ের দরকার হলে, আমি আমার মাতৃভাষা আর এদেশের প্রাচীনতম ভাষারই স্মরণ নিতাম। যাক গে, তো মোদ্দা কথা হলো - আত্মরক্ষার্থে সংস্কৃত ভাষার আশ্রয় নিয়েই, গেলাম সেদিন ফেঁসে।
বিবাহ দেবেন যে পুরোহিত তাঁর সহকারী আসে নি, অসুস্থ হয়ে পরায়। ওদিকে সংস্কৃতে লেখা শ্লোক পাঠ করে, তাঁকে সাহায্য করবে এমন কেউ না থাকলেও অসুবিধা।
অন্যদিকে, বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের বিবাহরীতি ও পদ্ধতি নিয়ে বিভেদের কারণে, সন্ধ্যেতেই দুই পক্ষের পুরোহিতদের মধ্যে এক পশলা ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে।
এখন, চাইলেও ঐ পুরোহিত মশাই - তাঁর বীপরীত পক্ষের পুরোহিতের কাছে, সাহায্য প্রার্থনা করতে পারছেন না। সে এক মহা মুশকিলে পড়লেন তিনি। এরই মধ্যে, আসরে এসে কোথা থেকে অবতীর্ণ হলেন - কনের এক মাসিমা।
তিনি, কি কারণে জানি শুনে ফেলেছিলেন যে, আমি সংস্কৃতের শিক্ষক না হয়েও, নিজেকে সেই পরিচয় দিয়েছি। মোট কথা, আমি যে বরাসনে দাদার পাশে বসে গুল দিচ্ছিলাম, সেটা তিনি অবগত ছিলেন।
তো, তিনি এগিয়ে এসে পুরোহিত মশাইকে বললেন - আপনার একজন সংস্কৃত জানা পণ্ডিত ব্যক্তি হলেই হবে তো? এখানেই তো একজন সংস্কৃতের শিক্ষকই আছেন। দাঁড়ান তাকে বলে দেখি, যদি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।
আমি তো প্রমাদ গণলাম। পরিস্কার বুঝলাম - ঘুঘু আজ ফাঁদে পড়তে চলেছে। এমন সময় দেখি, আমার গা ঘেঁষে ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে এক কিশোরী আমায় বলছে - শোনো, এদিকে এসো। বলে ইশারা করে কনের বসার ঘরের দিকে চলে গেলো।
আমি ভাবলাম, এ আবার কি ফন্দি আঁটছে এরা কে জানে! যাক গে, এখান থেকে আপাতত সরে পড়লেই বাঁচি। নয়তো, সংস্কৃত হরফে ঐ শ্লোক পড়তে হলে তো, ব্যস আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে আমার।
তাই কন্যাটির পিছু পিছু গেলাম। কিশোরীটি বুদ্ধদেবদার একটি হবু শ্যালিকা। বোধ হয় ক্লাস এইট নাইনে পড়তো তখন। ভীষণ চঞ্চলা এবং বুদ্ধিদীপ্ত মুখাবয়ব। সে বললো - জামাইবাবু বলছিলেন, তুমি নাকি খুব ভালো ছেলে?
এ আবার কি রকম কথা? আমি পরলাম আর এক মহা ফ্যাসাদে! এখন কি তবে নিজের ভালোত্বের শংসাপত্রও নিজেকেই প্রত্যয়িত করে দিতে হবে?
আমি আড় চোখে বুদ্ধদেবদার দিকে তাকালাম, দেখি - সে ভদ্রলোক আমাদের রঙ্গই দেখছে, আর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। ভাবছে বোধ হয় - ভাই, তোমায় এবার ভায়রাভাই বানাবো।
আমি অবস্থা বেগতিক দেখে, একটু সতর্কভাবে কন্যাটির আগ্রাসনকে রুখে দিতে বললাম - তা তোমার জামাইবাবু যখন বলেই ফেলেছেন, তখন তোমার মানতে আপত্তি কিসের?
সে বেশ লজ্জায় পরে গেলো কথাটা শুনে। বললো - তা' না, বলছিলাম, তুমি ভালো ছেলে যখন, তো শুধু শুধু গুল দিতে গেলে কেন? ঐ যিনি তোমায় খুঁজছেন, সংস্কৃত পড়ানোর জন্য, উনি কে জানেন?
বললাম - দাদার মাসশ্বাশুরি। সে বললো - হ্যাঁ, আমার মা! আমি তো শুনে চমকে উঠলাম। যাহ, এ আবার কি গেঁড়ো! শুধু তখন ভাবছি - তাহলে কি, টকের ভয়ে পালিয়ে এসে তেঁতুলতলায় বাস?
আমতা আমতা করে বললাম - বরাসনে দাদার কাছে যাঁরা আসছেন, বসছেন, কথা বলছেন তাঁদের মাঝে, নিজের একটু মানানসই জায়গা বানানোর জন্য, ফিজিক্সের জায়গায় সংস্কৃত বলেছিলাম।
সে বললো - সংস্কৃত তো শুধু সেভেন আর এইটে পড়ানো হয়। কোন কোন স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকেও পড়ায়। তাই সংস্কৃতের টীচার পাওয়া যে খুব দুর্লভ এটা তো জানা উচিত ছিলো তোমার।
আমি তো মনে মনে ভাবছি - সর্বনাশ, হয় এর মা, নয় বাবা, কেউ তো একজন পুলিশ কিংবা উকিল হবেনই। জেরার যা স্টাইল দেখছি, তাতে তো মনে হয় - আমার ঢোল শুধু ফাঁসিয়েই নয়, বোধ করি গলায় ঝুলিয়েই বাড়ি পাঠাবে।
তাই প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বললাম - ওহো, তবে তো তোমায় থ্যাঙ্কস দিতে হয়, আমায় উদ্ধার করার জন্য। সে হেসে বললো - উত্তরটা কিন্তু দিলে না! তা ছাড়া কি করে বুঝলে, তোমায় উদ্ধার করছি না গাড্ডায় ফেলছি?
এইরে......
চলবে।
