মুক্তি
মুক্তি
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করছিল ঋকিয়া। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বললেই ভালো হয়। বিশাল উঁচু উঁচু গম্বুজের মত খিলান উঠে গেছে দোতলার ছাদ পার করে। বড় বড় গরাদ দেওয়া জানালার আধ পোড়া কপাটের পেছনে না জানি কতোই না বিস্ময় লুকিয়ে আছে! বড় সিংহ দরজার সামনে মাকড়শার ঝুলের চাদর আর চারপাশের আধ পোড়া দেওয়ালের আগাছা, কার্নিশে বট অশ্বত্থ'র চারা বলছে এ প্রাসাদ বহু যুগের সাক্ষী। সিঁড়ির ফাটলে সরীসৃপের আস্তানা, পা দিতে ভয় লাগে। তবুও বাড়িটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছা করে ঋকিয়ার। বাগানে আগাছার জঙ্গলের ফাঁকে ভাঙ্গা ফোয়ারা দু একটা গ্ৰীক মর্মর মূর্তি মনে করায় একদা সৌখিন কোনো বড় জমিদার বা বাবুর প্রাসাদ ছিল এই ভগ্ন অট্টালিকা।
-''কি দেখছিস তুই অমন করে ? কতক্ষণ ধরে সবাই তোকে খুঁজছে জানিস?'' আরুহির ডাকে সম্বিত ফিরলেও বাড়িটার থেকে চোখ সরাতে পারে না ঋকিয়া।
-''এখানে এসে তোর কি হয়েছে রে? থেকে থেকেই বার বার এই বাড়িটা দেখছিস ঘুরে ফিরে। '' সঞ্চারী বলে ওঠে।
আরুহি সঞ্চারী আর ঋকিয়া কলেজে সবাই ওদের এক ডাকে চেনে। 'আসর' বলে ডাকে ওদের সবাই। তিন জন ঘুরতে এসেছে সঞ্চারীর দেশের বাড়ি মেটেলিতে।মেটেলি বাজারের পেছনে চা বাগানের রাস্তায় এই বিশাল ভগ্ন প্রায় বাড়িটা চোখে পড়েছিল ঋকিয়ার। সবুজ চা বাগানের গায়ে পরিত্যক্ত বাড়িটা আধপোড়া, ধ্বংসস্তূপের ভেতর আগাছা আর সরীসৃপের বাসস্থান। সঞ্চারী বলে,
- ''এই বাগানের প্রাক্তন মালিক ছিল এক ইংরেজ সাহেব। তার বাড়ি ছিল। আগুনে পুড়ে গেছিল বাড়িটা শুনেছি।দাদু জানে পুরোটা।''
রাতে খাওয়ার পর সঞ্চারীর মামা বাড়ির ছাদে আড্ডা বসেছিল। ছাদ থেকে একটু দূরের চা বাগানের ঢালে কুয়াশায় ঢাকা ঐ বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল। ঋকিয়াকে অদ্ভুত ভাবে টানছিল বাড়িটা। আরুহি আর সঞ্চারী বড় দাদুকে চেপে ধরেছিল ঐ বাড়ির গল্পটা শোনানোর জন্য।
ঋকিয়াকেই দেখছিলেন অবনী মোহন, মেয়েটাকে খুব চেনা লাগছিল ওনার। হয়তো নাতনীর সাথে ফটো দেখেছেন আগে কখনো। ওদের আব্দারে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অবনী মোহন, সঞ্চারীর বড় দাদু। বলেন,
-''আমার তখন সবে জ্ঞান হয়েছে, পনেরো বছর বয়স, ঐ বাড়িকে দাউদাউ করে জ্বলতে দেখেছিলাম। পরে ধীরে ধীরে জেনেছিলাম ঐ ইংরেজ সাহেবের গল্প। এই মেটেলীর যা প্রতিপত্তি তা শুরু হয়েছিল এই সব চা বাগানকে ঘিরে। এক সময় ট্রেন চলত পাহাড়ের বুক চিরে। আজ সে সব অতীত।
এই প্রাসাদোপম অট্টালিকায় থাকত রবার্ট ফিলিপ যে এই বাগানের মালিক ছিল। দেশ স্বাধীন হলেও সাহেব নিজের দেশে ফেরেনি। ব্যবসা করছিল এখানে। সাহেব ছিল বড্ড রাশভারী আর রাগী। ওনার পরিবার এ দেশে ছিল না। তিনজন ঠাকুর চাকর নিয়েই এত বড় বাড়িতে থাকত সাহেব। লালমুখো সাহেব রাগী হলেও বাচ্চাদের ভালো বাসত। চকলেট দিত দেখতে পেলে।
এই অঞ্চলে প্রচুর নেপালি ও তিব্বতি কুলি চা বাগানে কাজ করত। মেয়েরা পাতা তুলত। ও ধারের কুলি বস্তিতে মাঝে মধ্যেই বাচ্চা হারিয়ে যাচ্ছিল। এই নিয়ে এলাকা গরম ছিল। বন্য প্রাণীতে টেনে নেয়নি। দিনে দুপুরে হারিয়ে যাচ্ছিল শিশুরা। কয়েকটা বাচ্চার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেছিল চা বাগানের নালায়। বাচ্চাদের বয়স সব পাঁচ থেকে দশ বারোর ভেতর। দু একটি দেহর গায়ে হিংস্র পশুর আঁচড় থাকলেও এ যে মানুষের কাজ বোঝাই যাচ্ছিল।
কুলি বস্তির শেষ প্রান্তে কুর্তি নদীর ধারে টিলার উপর থাকত এক তিব্বতি মহিলা পেমা। ও নিজের ঘরে কি সব পূজা করত, তুকতাক তন্ত্র মন্ত্র জানত। লোকের অসুখ বিসুখ সারাত। অনেকেই বলত ও অপদেবতার উপাসক, লোকে ওকে ভয় পেত। তবু বিপদে পড়লে ছুটে যেত ওর কাছে। ওর এক পালিত মেয়ে ছিল মায়া। মেয়েটি নেপালিদের মত ফরসা কিন্তু চোখ বড় বড়, নাক টিকালো, এক মাথা চুল। মেয়েটাকে ও নাকি কুড়িয়ে পেয়েছিল নদীর ধারে। বাচ্চা অপহরণের পর কিছু লোক ওর কাছে গেছিল, ও অনেক কিছুই বলতে পারত ছক কেটে। সে বার ছক কেটে ও বলেছিল এক বিদেশী এর পেছনে রয়েছে। বাচ্চাদের ও তুলে নেয়। বিদেশী দু চারটে পরিবার এদিকে ছিল সে সময়।
কিন্তু হঠাৎ ফিলিপের লোকেরা রটিয়ে দিল ঐ পেমাই বাচ্চাদের অপহরণ করে, ও তন্ত্র সাধনা করে। তাই বাচ্চাদের ধরে ওদের দেহের উপর অত্যাচার করে মেরে ফেলে পেমা। বাচ্চাদের দেহ ওর বাড়ির পিছনের নালায় পেতেই বস্তির লোকেরা ক্ষেপে উঠেছিল। ফিলিপ সবাইকে বলে মায়াকেও ও চুরি করে এনেছে কোথাও থেকে। এর পর এক অমাবস্যায় বাচ্চা চুরি হতেই সবাই মিলে পেমার বাড়ি হামলা করে, ওরা মা মেয়ে পালিয়ে যায় কোনোভাবে। কিন্তু বাচ্চাদের কোথাও পাওয়া যায় না। ওদের বাড়িটা জ্বালিয়ে দেয় কুলিরা। দু দিন পর মায়ার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া যায় নালার ধারে। ফিলিপ বলে পেমা ওকে মেরেছে ওভাবে। এ সব ওর তন্ত্র সাধনার অঙ্গ। সবাই পেমার খোঁজে ঘুরতে থাকে আশেপাশের বস্তিতে।
এর পরের দিন মাঝ রাতে সবাই দেখে ফিলিপের বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলছে। ঠাকুর চাকর সবাই পুড়ে মরেছিল সেদিন, ফিলিপ নিজেও পালাতে পারে নি। পরদিন দ
ুটো পোড়া লাশ পাওয়া গেছিল, একজনের গলায় রূপার ক্রস ও আংটি দেখে ফিলিপকে সনাক্ত করা গেলেও অন্যটি কার জানা যায় নি। তবে অনেকেই বলে ওটা পেমার লাশ। আগুন কি করে লাগল জানা যায়নি!
এই ঘটনার পর আর বাচ্চা চুরি হয়নি কখনো। বাগান বিক্রি হয়ে যায়। এক গুজরাটি ভদ্রলোক কিনেছিল। কিন্তু বাংলো সারিয়ে থাকতে পারেনি। লেবাররা কাজ করতে গেলেই ভয় পেতো। বাচ্চাদের কান্না শোনা যায় ওখানে, মহিলার চিৎকার পোড়া গন্ধ এমন অনেক কিছুই শোনা যায়। বাংলোটা ওরা বেঁচে দেয় এক মারোয়াড়ী ব্যবসায়ীকে। সে হোটেল বানাবে ভেবেছিল। কিন্তু লোকটা হঠাৎ মারা যায়। এরপর যার হাতে যায় এ অট্টালিকা সে ও কিছুতেই রিপেয়ার করাতে পারেনি। কেউ ঐ বাড়িতে ঢুকতে চায় না। এক অপদেবতা ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে। হয়তো পেমার অভিশাপে ঐ অট্টালিকার আজ এই অবস্থা। ''
গল্প শেষ হতেই আরুহি বলে -''কিন্তু পেমা না ফিলিপ কে দোষী বোঝা গেল না!!''
-'' এখনো সবাই পেমাকেই দোষ দেয়, বলে ধরা পরার ভয়ে আর রাগে ও ফিলিপকে পুড়িয়ে মেরেছিল।'' সঞ্চারীর ছোট মামা বলে ওঠে।
-''ঋকিয়া কোথায় ?'' আচমকা সঞ্চারীর কথায় সবাই ওর দিকে তাকায়। ছাদের শেষ প্রান্তে সিঁড়ির পাশে বসেছিল ঋকিয়া আর সঞ্চারী। ঋকিয়াকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এ ওর দিকে তাকাচ্ছে।
বড়মামা বলে -''নিচে জল খেতে বা টয়লেটে গেছে হয়তো!!''
মুহূর্তের মধ্যে সারা বাড়ি খুঁজে ও ওকে পাওয়া যায় না। কাজের লোক রমাপদ বলে ওকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে।
-''ও আবার ঐ বাড়িতেই গেছে। আমাদের এখনি যেতে হবে ওখানে।'' আরুহি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে।
সঞ্চারীর দুই মামা, দাদু মামার ছেলে রাজকে নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে। সাথে দুটো বড় টর্চ আর মোবাইলের আলো। পাড়ার দু একজন ওদের সাথে যোগ দেয় সব শুনে।
বাড়িটার সামনে গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ায়, চাঁদের আলোয় আধ পোড়া বাড়িটা আরো বীভৎস লাগছে, সিংহ দরজা খোলা, সঞ্চারী চিৎকার করে ডাকে -''ঋকিয়া..আ..আ..আ ''
প্রতিধ্বনি ফিরে আসে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে। একটা রাত জাগা পাখী বিকট চিৎকার করে উড়ে যায়। ওরা ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতর। একটা হিম শীতল অনুভূতি নেমে আসে আরুহির শিরদাঁড়া বেঁয়ে।
দোতলার সিঁড়িতে বসে ছিল ঋকিয়া, কিন্তু এ কোন ঋকিয়া? ওর জ্বলন্ত চোখ, চুলগুলো উসকোখুসকো। ওদের দেখে চিৎকার করে ওঠে -'' কেউ এগোবে না আর এক পা ও। ''
ওর হাতে শক্ত করে ধরা একটা কিছু।
আরুহি বলে -''কি হয়েছে তোর ঋকিয়া? চলে আয়। এই বাড়িটা অভিশপ্ত।''
-'' তোরা চলে যা, আমি আমার দেবতাকে নিতে এসেছি।'' ও বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে রেখেছে একটা কিছু।
-''চলে এসো মা, আমাদের বাড়ি এসে তোমার কিছু ক্ষতি হলে আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবো না।'' অবনী মোহন বাবু বলেন।
সঞ্চারীর দুই মামা আর দাদা সিঁড়ির দিকে এগোতেই ছিটকে পড়ে কিছুর ধাক্কায়।
ঋকিয়া বলে -''তোদের সবার উপকার করেছিলাম আমি। অথচ তোরা ঐ বিদেশীর কথা বিশ্বাস করে আমার ঘরে আগুন দিয়েছিলিস। ও আমাদের আটকে রেখেছিল। আমার মেয়েটাকেও ছাড়ে নি। ও ছিল এক জীবন্ত শয়তান। একটা পেডোফিল, বাচ্চাদের উপর যৌন অত্যাচার করে আনন্দ পেত। ওরা মরে গেলে নতুন শিকার ধরত আবার। এই বাড়ির মাটির নিচের ঘরে এখনো দুটো শিশুর কঙ্কাল পাওয়া যাবে। ওদের মুক্তি দে। আর আমার দেবতার এই মূর্তি ভাসিয়ে দেব আমি নদীতে।''
-''তাই হবে, আমরা সব কথা শুনবো। তুমি ফিরে এসো।'' অবনী মোহন বলে ওঠেন কম্পিত কণ্ঠে।
ঋকিয়া উঠে দাঁড়ায়, দৌড়ে বাড়ির পিছনের চা বাগানের ভেতর দিয়ে ছুটে যায় নদীর দিকে। পেছন পেছন গিয়ে ওরা দেখে ও নদীতে কিছু ভাসিয়ে দিল।
ওর জ্ঞানহীন দেহটা উদ্ধার করে যখন ওরা বাড়ি ফিরল ভোর হয়ে এসেছে, প্রচুর লোক জমে গেছিল ওদের বাড়ির সামনে। সব শুনে ওরা ঐ বাড়ির ভেতর ঢুকে খুঁজে বার করে সেই পাতাল ঘর। আর উদ্ধার করে দুটো শিশুর কঙ্কাল। বাড়িতে ঢুকতে আর বাধা পায় না কেউ।
ঋকিয়ার জ্ঞান ফিরলেও ও কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো কিছুই মনে ছিল না। সঞ্চারী ও আরুহি ভেবে পাচ্ছিল না এত বছর পর পেমার আত্মা ঋকিয়াকেই কেন বেছে নিলো। তবে আর কোনো প্রশ্ন করেনি ওরা ওকে।
ফেরার দিন অবনীমোহনকে ওরা জিজ্ঞেস করেছিল সে কথা।
উনি আস্তে আস্তে বলেন,
-''আসলে ঋকিয়ার সাথে মায়ার চেহারার এক অদ্ভুত মিল ছিল। মায়ার মুখটা আমার মনে আছে এখনো। প্রথম দিন ঋকিয়াকে দেখে খুব চেনা চেনা লেগেছিল। ওর কপালের বা দিকের লাল জড়ুল টা.... ওটা যে মায়ারও ছিল।''
-''আমার মা নির্দোষ ছিল। ঐ শয়তানটা আমাকেও শেষ করেছিল। মা দেবতাকে জাগিয়ে ওকে শেষ করে দিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই আমাকে টেনে এনেছিল হয়তো। আমাদের দেবতা রয়ে গিয়েছিল ওখানে। আর ঐ শিশুরাও মুক্তি চাইছিল।''
ঋকিয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দূরের সেই বাড়িটার দিকে। কুয়াশা কেটে সকালের রোদ এসে পড়েছে পোড়ো বাড়িটার গায়ে।
(সমাপ্ত)