Dola Bhattacharyya

Tragedy Others

4  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Others

মুখরিত ক্যাম্পাস

মুখরিত ক্যাম্পাস

7 mins
187


আই এস সি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হল মৌমিতা। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকতে যেতেই চরম বিস্ময়কর এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল ওকে । কদিন আগে কলেজে যখন ভর্তি হতে এসেছিল তখনও একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল মেয়েটা। ফর্মটা ফিল আপ করে যে টিচারের কাছে জমা দিতে গেল, তিনি প্রথমেই ওর বয়স নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। আসলে স্কার্ট টপ পরা অষ্টাদশী মেয়েটাকে দেখে ওনার নিতান্তই বালখিল্য বলে মনে হয়েছিল। সমস্যা হল ওর উচ্চতা নিয়ে। রোগা ছিপছিপে ছোট্টখাট্ট চেহারার মৌ কে দেখলে ক্লাস এইট কি নাইনের ছাত্রী বলেই মনে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই উনি ভুল করেছিলেন। 

প্রথম দিন কলেজের গেটের সামনে ছেড়ে দিয়ে গেলেন বাবা। নিজের ক্লাসরুমের দরজায় গিয়ে যখন দাঁড়াল মৌ, স্যার তখন সদ্য ক্লাসে ঢুকেছেন। ওকে দেখেই বলে উঠলেন, "এখানে কি চাই তোমার?কোন স্কুলে পড়?" 

মৌ তখন ঘামতে শুরু করেছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তখন স্টুডেন্টদের মধ্যে থেকেই একজন বলে উঠল, "স্যার, ও আমাদের সঙ্গেই সিভিল ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে।" স্যারের মুখে তখন হাসি ফুটে উঠেছে, "ও মাই সুইট বেবি। কাম, এ্যন্ড টেক ইওর সিট্। হোল ক্লাস হেসে উঠেছে তখন। স্যারের ধমক খেয়ে আবার সব চুপচাপ। মৌ তখন ভাবছে, এখানে সবাই এত দৈত্যাকৃতি কেন! স্কুলের বন্ধুরা কেউ তো এত বড়সড় ছিল না! সত্যি! এখানে প্রতিটি ছেলেমেয়েরই বেশ লম্বাচওড়া চেহারা। এদের মাঝে মৌকে একটু বেমানানই লাগছে। তবে মৌকে ঠিক বেঁটে বলা চলে না। ওর গড়নটাই ওইরকম ।ভীষণ সুন্দর দেখতে একটা বার্বি ডল যেন। 

 স্যার বেরিয়ে যেতে সব গুলতানি শুরু হয়েছে। সিভিল ডিপার্টমেন্টে মোট সতেরো জন স্টুডেন্টের মধ্যে তিনজন মাত্র মেয়ে। ছেলেগুলো হইচই লাগিয়েছে। এর মধ্যেই সবার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মেয়ে তিনটে একা চুপচাপ বসে আছে। একটু অস্বস্তি বোধ করছে ওরা। হঠাৎ একটি ছেলে এগিয়ে এল ওদের দিকে, "হেই গাইজ। তোমরা কি আমাদের সাথে জয়েন করবে! নাকি ওরকম একা একাই থাকবে! ভেবে দ্যাখো। তিনটেতে মিলে যদি একা থাকবে মনে করো, তাহলে ভুল করবে। পরে কিন্তু হেব্বি প্রবলেমে পড়ে যাবে। তখন আমাদের দোষ দিতে এসো না যেন" । তিন কন্যা উঠে দাঁড়ালো । চোখে চোখে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে উঠলো তাদের। তিনজনেই ছোট থেকে কো এড স্কুলেই পড়েছে। তাই বন্ধুত্ব স্বীকার করতে কোনো অসুবিধা নেই। হইহই করে উঠল সকলে। "তাহলে মেলাও হাত। উই আর অল সিভিলিয়ানস।"শুরু হল জীবনের

এক সোনালী অধ্যায়। 

মৌকে ওর বন্ধুরা আদর করে নাম দিয়েছে লিটল মৌ । টিচার্স ডে র অনুষ্ঠানে ওর নাচ দেখে মুগ্ধ সকলে। এর ফলে বেশ কিছু অন্ধ ভক্তও তৈরী হয়ে গেল ওর । এগুলো বেশ উপভোগ করে মৌ। বাড়ি ফিরে গল্পের ঝুলি উজার করে দেয় মায়ের কাছে। মন দিয়ে সব কিছু শোনে সুমনা। মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ওর। 

দিনের পরে কেটে যায় দিন। পড়াশোনার সাথে হাসি, মজা, খুনসুটি, টুকরো মান অভিমান নিয়ে কেটে যাচ্ছে কলেজ জীবন। এবারে শীতকালে কলেজের ফেস্ট, আ্যকোয়ামেরিনায় অনুষ্ঠিত হবে। সুমনা ভীষণ চিন্তিত। জলের মধ্যে ঝাঁপাঝাপি করলে মেয়েটার ঠান্ডা লেগে যাবে। ভীষণ ঠান্ডার ধাত ওর। কিন্তু মেয়ে তো যাবেই। ছেড়েও দিতে হল ওকে। ফেস্টে ও নাচবে কথা দিয়েছে। নিজে হাতে ওকে সাজিয়ে দিল সুমনা। সারাদিন নিজে কাঁটা হয়ে রইল। মেয়েটা বোধহয় জ্বর গায়ে ফিরবে। 

"কোন সকালে গেছে। সন্ধ্যা ছটা বাজল ।মা যে চিন্তা করবে সে কথাটাই মাথায় নেই ওর" । গজগজ করতে করতে মৌ কে ফোন করে সুমনা। মায়ের ফোন পেয়ে কলকল করে উঠল সে, "ওমা। আজ খুব মজা হয়েছে।" 

"হ্যাঁ ।সেতো বুঝতেই পারছি। নাচ হয়েছে তোমার?" 

"হ্যাঁ ।হয়ে গেছে"। 

"তাহলে এবার বাড়ি ফিরতে হবে তো"। 

"না না। দেরি হবে। এই মাত্র রাজ বর্মন এল। একটু বাদেই স্টেজে উঠবে আমি এখন রাখছি।" 

হাল ছেড়ে দেয় সুমনা। রাত্রি আটটা নাগাদ আবার ফোন করে, 

" কি হল মৌ! কখন ফিরবে "? 

" ওঃ মা! এখন মিকা সিং উঠেছে স্টেজে। কি অসাধারণ গাইছে জানো! আমরা সবাই নাচছি ওর গানের সাথে।"

"আমি কিছু শুনতে চাই না মৌ। তুমি এখনই ওখান থেকে বেরিয়ে আসবে। রাত হয়ে যাচ্ছে। এরপর লঞ্চ ঘাট ফাঁকা হয়ে যাবে। এপাড়ে এসে অটো পাওয়াও মুশকিল হবে। রাতের বাস বা অটো তোমার জন্য একদম শেফ নয়। এখনই বেরিয়ে এসো।"রাগের চোটে ফোনটা কেটে দিল মৌ। সুমনা ভাবে, মেয়েটা রেগে গেল। কিছুতেই বুঝতে চায়না যে দিনকাল একদম ভালো নয়। হায়নার দল ঘুরছে চারিদিকে। একটু সুযোগ পেলেই ছিঁড়ে খাবে। একটু সাবধান হলে ক্ষতি কি! 

সেই সকাল বেলায় বেরিয়ে রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাড়ি ফিরল মৌ। কি রাগ, কি রাগ। মিকা সিংএর গান কেন শুনতে দেওয়া হয় নি। অনেক কষ্টে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তবে শান্ত হল মেয়ে। তারপর বসল মায়ের কাছে গল্পের ঝুলি নিয়ে। 

সুমনা জিজ্ঞেস করে মেয়েকে, "কিরে, জলে নেমেছিলি নাকি"? 

"না না। আমি একটুখানি নেমেছিলাম ।তারপর উঠে পড়েছি ।ওমা! জানো, সৌনক আর রনধীর বিয়ারের ক্যান নিয়ে এসেছিল।" 

"সেকী রে! ওরা এসব খায়!" 

"হ্যাঁ ।খায় তো। ওরা হোস্টেলে থাকে। রোজ না হলেও, মাঝেমধ্যে রাতের দিকে বোতল খুলে বসে।পরদিন লাল লাল করমচার মত চোখ নিয়ে কলেজে আসে। " 

" টিচার রা কিছু বলেন না? "

" কেন বলবে? ওরা তো কলেজের মধ্যে কিছু করছে না।"

" বাবা মা জানতে পারলে কি হবে?সে ভয়টাও ওদের নেই নাকী!"সুমনা অসন্তুষ্ট। 

মৌ বলে," আরে, বাবা মা জানলেই বা কি! রনধীর বলে. 'আমার বাবা পাবলিক ফিগার।সে তো সন্ধ্যা হলেই বোতল খুলে বসে। তাহলে আমি খেলে দোষ কিসের! এরকম লোকের ছেলেরা একটু আধটু খেয়েই থাকে' । আর সৌনক কে তো রনধীরই তৈরী করে দিয়েছে। সৌনকও খুব বড়লোকের ছেলে। তবে ওরা কিন্তু দুজনেই পড়াশোনায় খুব ভালো। যাইহোক, শোনো না, আজকে সবাই একটু একটু খেয়েছে"। খুব রেগে যায় সুমনা। বলে," সেকী! তুইও খেয়েছিস নাকি! আমি এইজন্যই যেতে দিতে চাইনি তোকে"। 

"আরে শোনো না। আমার একটু চেখে দেখার ইচ্ছে ছিল। তার আগেই অর্নব আর যশ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল।" কিরে, তোরা এখানেই বোতল খুলে বসে পড়েছিস! জাহান্নামে যা তোরা। কিন্তু লিটল মৌ কে নষ্ট করছিস কেন!" ওরা আমাকে টানতে টানতে ওখান থেকে নিয়ে গেল। "

হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সুমনা। বলে," অনেক গল্প হয়েছে। এবার খাবি চল"। 

সেকেন্ড সেমিস্টার যেদিন শেষ হল, পরীক্ষা দিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল ওরা। প্রথমে গেল ইমামবাড়া ।সেখান থেকে নৌকো করে ব্যান্ডেল চার্চ। পশ্চিমে সুর্য অস্ত যাচ্ছে তখন। আকাশের অলিন্দ থেকে রঙিন আলো চুঁইয়ে নেমেছে গঙ্গার জলে। রঙিন হয়ে উঠেছে গঙ্গার জল। কি মিষ্টি সুরে মাউথ অরগ্যান বাজাচ্ছিল অর্নব ।একটা মধুর মূর্ছনায় আচ্ছন্ন হয়ে চুপ করে বসেছিল ছেলেমেয়েগুলো। স্বপ্নের মতো কেটে গেল ফার্স্ট ইয়ার। সেকেন্ড ইয়ারে বেশ কিছু ল্যাটারাল ঢুকল। 

সিভিলের স্টুডেন্ট সংখ্যা সতেরো থেকে চল্লিশ হয়ে গেল। প্রথম থেকেই ল্যাটারাল গুলোর ওপর এদের রাগ। কারণ ক্লাসে যা পড়ানো হচ্ছে, ল্যাটারাল গুলো খুব তাড়াতাড়ি ধরে নিচ্ছে। আসলে ডিপ্লোমা পাস করে এসেছে তো। ওদের থেকে ল্যাটারাল গুলো বেশি জানে, বয়সেও বড় ওদের থেকে। রাগ করে তাই কারোকে কাকু, কারোকে বা পাঁচ বাচ্চার বাবা, এরকম সব নামও দেওয়া হয়েছে। একদিন ল্যাটারালের একটা ছেলেকে ওরা সবাই ছেঁকে ধরে। উদ্দেশ্য একটু Ragging করা ।"এ্যাই! দাঁড়া তো"। রনধীরের ডাকে থমকে দাঁড়ায় ছেলে টা। "তোর নাম কি রে?" 

"রণ ।রঞ্জিত ।" 

ধমক লাগায় রণধীর, "আরে! ভুঁইফোঁড় নাকি! বাপের টাইটেল টা কে বলবে?" 

লম্বা চওড়া ছেলেটা হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে বলে, "আরে বাঃ! Ragging হচ্ছে নাকি!" ও হেসে উঠতে রণধীরও ভড়কে যায়। ছেলেটা রণধীরের গাল টিপে দিয়ে বলে, "ওসব পাট আমরা অনেক আগেই চুকিয়ে এসেছি চাঁদ।" ওদের ভ্যাবলার মতো মুখগুলো দেখে হাসতে হাসতে চলে যায় রঞ্জিত । তুহিন হঠাৎ বলে ওঠে, "যাঃ শালা! আমরা গেলাম ওকে চাটতে ।উল্টে ও আমাদের চেটে দিয়ে চলে গেল! কলেজের মধ্যেই একটা জল টলটলে ঝিল রয়েছে। সেই ঝিলের ধারে এসে মুখ ঝুলিয়ে বসল সকলে। রঞ্জিত আজ ওদের খুব জব্দ করেছে। 

কখন যেন ল্যাটারালের ছেলেমেয়েরা ওদের সাথে এক হয়ে মিশে গেল। সেই বিদ্বেষ, হিংসা কেটে গিয়ে সবাই সবার বন্ধু হয়ে উঠল। কলেজ ছুটি হলে সবাই মিলে একসঙ্গে হয়তো চন্দননগর স্ট্যান্ড বা অন্য কোথাও বসে আড্ডা দেওয়া চলে। ইদানিং কেউ কেউ কপোত কপোতীর মতো জুটি বেঁধে ফেলেছে। মৌকে অনেক দিন ধরে জ্বালাচ্ছিল তুহিন। সেদিন কলেজের ঝিলের ধারে হঠাৎ মৌ এর হাত টা ধরে ফেলে তুহিন। অবাক হয়ে তাকায় মৌ। তুহিন বলে, "তুই কি কিছুই বুঝিস না মৌ!" মিষ্টি হেসে মৌ বলে, "কি বোঝাতে চাইছিস বলতো?" 

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে তুহিন। কিন্তু খুলে বলতে পারে না। মৌ বুঝতে পারে, কি বলতে চাইছে তুহিন। কিন্তু সাড়া দিতে চায় না। ওযে ভীষণ স্বাধীনচেতা ।এইটুকু চেনায় কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না ও। 

   সেকেন্ড ইয়ার শেষ হবার আগেই দেখা দিল বিশ্ব জোড়া মহামারী। তার কবলে পড়ে থমকে গেল ওদের কলেজ জীবন। ভীষণ মনমরা হয়ে পড়ল ওরা।

কিছুদিন পর থেকে শুরু হল অনলাইন ক্লাস। আবার হইচই, দুষ্টুমি। একে অপরকে ক্লাস থেকে বার করে দিচ্ছে। কখনো বা স্যার কেই বার করে দিচ্ছে। কেউ দোকান চলে গেল ক্লাস করতে করতে। কেউ আবার দুপুরে ভাতঘুম দিতে দিতেই ক্লাস করে নিচ্ছে। পরীক্ষা গুলোও হয়ে যাচ্ছে অনলাইনে। আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছে ছেলেমেয়েগুলো। তার মধ্যেও ভীষণ একটা অতৃপ্তি দানা বেঁধেছে সবার মনে। কারো সাথে দেখা করার উপায় নেই। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সোনা রঙের সেই দিনগুলো। জীবনের কতগুলো দিন ওদের নষ্ট হয়ে গেল। 

 থার্ড ইয়ার শেষ হতে চলেছে । মহামারীর প্রকোপও কমে এসেছে অনেক। লকডাউন এখন নামে মাত্র। দোকান বাজার সব কিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। দুটো বছর নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফোর্থ ইয়ারটাও যদি এভাবেই কাটে, তবে আফসোসের আর শেষ থাকবে না। তারপর কে কোথায় ছিটকে যাবে, কে জানে! ওরা তবু আশায় আছে। আবার খুলবে কলেজ। ফোর্থ ইয়ারে নিশ্চয়ই দেখা হবে সবার সাথে । ওরা সবাই এখন মন দিয়ে ক্যাম্পাসিং এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy