মুখপুড়ি
মুখপুড়ি
।।মুখপুড়ি।।
এতো বছর অপেক্ষার পর মালতি বুঝতে পারলাম এখন আমি তাঁকে ভালোবাসি। ওর মুখ পুড়ে গেছে বলেই ওর সৌন্দর্যটা আর নেই। কিন্তু এক কালে যার রূপের ছটা দেখতে স্নানের ঘাটে স্কুলের গেটে প্রেমিক ছোকরাদের ভিড় হয়ে থাকতো। আজ তার দিকে তাকাতে ভয় লাগে। কিন্তু আমি তবু নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত আর দুই দিন পর আমরা বিয়ে করে আমাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করবো বলে ঠিক করেছি। এমন পদ্মা মাসি হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জানালো" মুখপুড়ির ভাগ্যটাই পোড়া , বিয়ে আয়োজন বন্ধ কর তোমরা"
কলকাতা শহরের কাছাকাছি এক প্রত্যন্ত গ্রামের শিবানী পুর। ভুবন কাকা ছিলেন এক প্রকার ঘর জামাই।এক দরিদ্র কৃষক বলতে পারেন তাকে ।ভাগ চাষ, জন খেটে, খেজুর গাছ কেটে তার গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড় তৈরি করে সংসার চালাতো। ছেলে সন্তানের লোভে পাঁচটা মেয়ের সন্তান জন্মের পর, একটি ছোট্ট পুত্র সন্তান জন্ম পর সে খান্ত হয়েছিল। কিন্তু বিশাল পরিবার চালতে গিয়ে সে শত পরিশ্রম করেও গরীর রেয়ে গেলো।
স্বল্প আয়ের সংসারে আগে দুই কন্যার বিবাহ দিতে একপ্রকার সর্বস্বান্ত হয়ে বসেন ভুবন কাকা। যতটুকু জমি ছিল, সেটা বন্ধক দিয়ে, সুবীর মহাজনের কাছ টাকা ধার নিয়ে উমার বিয়ে দেয় সে। একেদিকে উমার বাড়ি থেকে বারবার পাওনা সামগ্রীর জন্য ভুবন বাবুকে বিতিপব্যস্ত করে তোলে। হঠাৎ একদিন খবর আসে উমার শশুর বাড়ি থেকে রান্না করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা গেছে। আর তার মেয়ে উমাকে বাঁচাতে গিয়ে মালতির মুখ পুড়েছে ।মালতি সেই সময় উমার বাড়ি উপস্থিত ছিলো, তাই এটা দূর্ঘটনা নয়, জেনেও ভুবন কাকুর মত গরিব মানুষ সত্যতা প্রমাণ করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারি নি।
অন্যদিকে মহাজন সুবীর পাওনা টাকার জন্য ভুবনের বাড়ি হানা দেন। আসলে সুবীর তো মালতি বিয়ে করতে চাইতো কিন্তু মালতির মুখ পুড়ায় তার সব আশায় জল পরে যায়।ভুবন বাবু টাকা মেটাতে না পারায় তার দলিল দস্তাবেজ জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে যায় সে। ভুবন বাবু এই অপমান সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ভুবন কাকার এই অকাল মৃত্যু ওনার স্ত্রী সরলা কাকী মেনে নিতে পা
রেলো না।উনার সাথে সরলা দেবী ও প্রান হারান। সবাই বললো সরলা দেবী সতী নারী তাই স্বামীর সাথে চলে গেল। আসলে সরলা কাকী কিটনাশক খেয়ে ছিলো।সুধীর ফেসে যেতো। যাইহোক মালতীর বোন রমাকে বিয়ে করে ও বিষয়টি ধামাচাপা দিলো।
হঠাৎ উনাদের একমাত্র পুত্র সন্তান অসীম স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে তার বাবা মা অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে, ডাকলেও সাড়া দেয় না, বুঝতে পারে তার বাবা মা আর জীবিত নেই। অথচ পাড়ার লোকেরা তার বাবা মায়ের খুনীর সাথেই তার দিদির বিয়ে দিচ্ছে। তখন সে একটু অন্যরকম হয়ে গেলো।কি যেন ভাবতে ভাবতে থাকলো সব সময়।ছেলেটি বাড়ি ত্যাগ করে এক অন্ধকারে তলিয়ে যায়। গ্রামের মানুষ আর কোনদিন তার খোঁজ পায় না,
হঠাৎ এতো বছর পর গ্রামের এক পথ দুর্ঘটনায় এক অজ্ঞাত পরিচয় যুবক সন্যাসীর মৃত্যু হয়েছে। এই সন্যাসী মালতির খোঁজ খবর নিচ্ছিলো।অনেকেই দাবি তাই ছেলেটি ওই ভুবন চাষীর হারিয়ে যাওয়া ছেলে। কিন্তু তারা সঠিক চিহ্নিত করতে পারছিল না। ভুবন বাবুর ছোট মেয়ে মালতি সনাক্ত করতে সেই মৃত যুবকটি আরে ভাই। এরপর মালতি ও মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। গ্রামের মানুষরা পাগলা গারদে নিয়ে চললো তাকে।
মালতি সত্যি মুখপুড়ি। ও যখন রূপবতী ছিলো তখন ওর চরিত্র খারাপ বলে আমার সাথে ওর বিয়েতে রাজী হয় নি আমার বাড়ি লোকজন। আজ মুখ পুড়িয়ে চরিত্র হীন কলঙ্ক মুক্ত হয়েও নতুন জীবন শুরু করতে পারলো না সে।
আমি যখন বিছানায় মুখ গুজে কাঁদছি। দেখি মায়ের গুরু ভাই নিত্যানন্দ মামা স্বংয় হাজির হয়েছে আমার ঘরে। নিজেকে সামলে প্রনাম করলাম উনাকে। উনি বললেন " কেঁদে না কেঁদে না , গোসাই। সব প্রভুর খেলা। ওর পূর্ব জন্মের কর্ম ফল, এবাড়িতে তোমার সাথে মেয়ে বিয়ে দেবার জন্য এখনো রাজী চৌধুরী বাবু। মালতি মুখপুরি পূর্ব জন্মের কর্ম ফল ওকে ভোগাচ্ছে।"
মা বললো " না না আমি এই লগ্নে বিয়ে দেবো চৌধুরী বাবুর মেয়ে সুচিত্রার সাথে। মলতির চিকিৎসার দায়িত্ব চৌধুরী দা তো নিয়েছে। আমি কোন কথা শুনবো না। কাঁদিস না বাবা।" বলে মা জরিয়ে ধরলো আমাকে। মায়ের নিঃশ্বাস গরম বুঝতে পারলাম না। এটা স্বস্তি নিঃশ্বাস না দীর্ঘ শ্বাস।
@মানব মন্ডল