Sangita Duary

Horror Fantasy Thriller

3  

Sangita Duary

Horror Fantasy Thriller

মৃত্যুর পরে

মৃত্যুর পরে

7 mins
266



 ধীরে ধীরে একটা দরজা খুলে যাচ্ছে। কালো পুরু শ্যাওলা ধরা দরজা, ভিতরটা নিকষ অন্ধকার, কিন্তু সেই অন্ধকারেও সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। দেখতে পাচ্ছে অগুনতি অবয়ব, প্রত্যেকেই ফ্যাকাশে সাদা। দুইচোখের গর্তে কালো অন্ধকারের মধ্যেও হৃদয়বিদীর্ণ করা দৃষ্টি। টিঙ্কুর মনে হলো প্রায় সবাইকেই সে চেনে। কিন্তু এ সে কোথায় এসে পৌঁছেছে!!

সে তো...

একটা ঘটনা চলচিত্রের মতো ভেসে উঠলো তার সামনে...


বুকের ভেতরের দলা পাকা কান্না বেরিয়ে আসতে চায়ছে, কষ্ট হচ্ছে, বুকটা ফেটে না যায়!


টিঙ্কু সিলিংয়ের দিকে তাকালো, একটা এস ঝুলছে সিলিং ফুঁড়ে।


একটু দূরে একছড়া নাইলনের দড়ি পরে রয়েছে, টিঙ্কুর চোখ দড়ির দিকে স্থির। হঠাৎ করে বড়দির মুখটা ভেসে উঠলো।


হাসপাতালের বেডে শুয়ে, শরীরের নব্বইশতাংশ পুড়ে গেছে, ডাক্তার বললো ,যা খেতে চায় খাওয়ান, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। বড়দি টিঙ্কুকে একলিটারের ম্যাংগোজুস আনতে বললো সঙ্গে একগোছা রজনীগন্ধা। বড়দি রজনীগন্ধা খুব ভালোবাসত।


ফুল আর জুস দিয়ে উঠতে যেতেই বড়দি হাত টেনে ধরেছিল, "আমায় ছেড়ে যাসনা ভাই, কাছে এসে বোস!"


আজ টিঙ্কু পরিষ্কার শুনলো বড়দি তাকে ডাকছে, "আয় না ভাই আমার কাছে!"


টিঙ্কু দৌড়ে দড়ি আনলো, থাক থাক ইঁট সাজালো, বড়দির ডাক আরও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে টিঙ্কু। দড়ির ফাঁসটা গলায় লাগাতে মার মুখটা মুখটা ভেসে উঠলো, এবার মা নিশ্চিন্তে ঘুমাবে, তার জন্য মার যে অনেক জ্বালা। দিদির কাছ থেকে তার এই অপদার্থ ছেলের অপকর্ম শুনতে হবেনা রোজরোজ।


সুতপারও রাস্তায় আর কোনো বাধা থাকবেনা। পায়ের বুড়োআঙ্গুল দিয়ে সব চেয়ে ওপরের ইঁটটা ফেলে দিলো টিঙ্কু, ওই তো বড়দি দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে, টিঙ্কু দৌড়ে যেতে চায়ছে, পারছেনা, এবার প্রবল এক ঝাঁকুনি.... তারপর......!

সিলিং থেকে টিঙ্কুর দেহটা ঝুলছে। ঘাড়টা মোটকে একপাশে হয়ে আছে। জিভ বেরিয়ে বীভৎসরকম ঝুলে পড়েছে। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে! উফ! টিঙ্কুর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। সে কি তবে মরে গেছে?

ঘরের আশেপাশে কেউ কোত্থাও নেই।

অদৃশ্য টিঙ্কু রাস্তায় আসে। অনেক গাড়ি চলে যাচ্ছে। ঐতো মইদুল, সেও হুশ করে বেরিয়ে গেল।

ডাকলেও শুনলো না, শুনতে পেল না।

প্রায় পাঁচঘন্টা টিঙ্কুর ঝুলন্ত দেহ একা, শীতল হাওয়ায় দুলতে থাকলো।

লাশ মর্গে গেল। ওরা অমানুষিকভাবে এদিক ওদিক কাটলো। কিন্তু ঠিকভাবে সেলাই করলো না।

পায়ের আঙুলে ঝুলিয়ে দিলো একটা নম্বর।



অনেক সই সাবুদ, ঝামেলা ঝক্কির পর, টিঙ্কুর লাশ মর্গ থেকে ঘরে ফিরলো। উঠোনের মাঝখানে শোয়ানো হলো। ভীড় যেন উপচে পড়ছে। সব্বাই বুক চাপড়ে কাঁদছে। মা থেকে থেকেই জ্ঞান হারাচ্ছে। তার এত দাম ছিল এবাড়িতে? আগে তো বোঝেনি।

বুঝলে হয়তো এই কান্ড সে করতো না।

একটা হাহাকার টিঙ্কুর বুকটা তোলপাড় করে দিচ্ছে।

কিন্তু উপায় নেই, তার যে আর ফেরার রাস্তা নেই।


লাশটা শ্মশানে নিয়ে চললো ওরা।

কে পোড়াবে? অষ্ট ডোম? ছেলেবেলায় যাকে যমের মতো ভয় পেত টিঙ্কু? যার ভয় দেখিয়ে মা ঘুম পাড়াতো টিঙ্কুকে? 

টিঙ্কুর খুব ইচ্ছে করলো, একবার অষ্ট ডোমের বাড়ি যেতে, দেখতে, যেরকম বীভৎসতা ওর কাজের মধ্যে থাকে, সেরকম বীভৎসতা নিয়েই কি ও সংসার করে?

----------------------------


শরীরটা সকাল থেকেই কেমন ম্যাজম্যাজ করছে যেন। কাল রাতেও ঘুমটা ভালো হয়নি। আজকাল রাতে চোখ বুজলেই কি সব স্বপ্ন দেখে যেন অষ্ট। বিশ্রী। আর আশ্চর্য্য! সেই স্বপ্নগুলো ঠিক ঘটনাক্রমে মিলেও যায় দিন কয়েকের মধ্যে।

প্রথম প্রথম ব্যাপারটাকে ঠিক আমল দেয়নি অষ্ট। ভেবেছে, ডোমের জীবন, শ্মশানই কর্মস্থল, কত মড়া ছুঁতে হয়, ভয় কি করেনা? করে তো, ভয় দূর করতে সুরা ছাড়া গতি নেই, আর ওইসব ছাই ভস্ম খেয়ে খেয়ে মনের ভয়টা রাতে স্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে। 

বউ কতবার বারণ করেছে," বয়স হচ্ছে, ওইসব কাজ ছেড়ে চাষবাসে মন দাও, জাতে ডোম হলেও, চাষেই তো লক্ষ্মী আসে"।

অষ্টও যে এমনটা ভাবেনা তা নয়, তবে পাড়া গাঁয়ের লোক এসে ধরলে সে না করতে পারেনা। 

শোনা যাচ্ছে শহরের মতো তাদের গাঁয়েও ইলেকট্রিক চুল্লি বসবে, কিন্তু যতদিন না হচ্ছে, গ্রামের মানুষের মড়া পোড়াতে এই অষ্ট ডোম ই ভরসা।

এইতো গেল হপ্তায় অষ্ট স্বপ্ন দেখলো তাদের পাশের বাড়ির খেন্তিটা জলে ডুবে গেছে।

 সকালেই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখেছিল পুকুর পাড়ে খেলতে , অষ্ট কোলে তুলে ঘরের ভিতর রাখতে গিয়ে বেশ রগড়ে দিয়েছিল খেন্তির মাকে, "ওইটুকু মেয়েকে পুকুরপাড়ে ছেড়ে দিয়েছো, যদি জলে পড়ে যেত?"

স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভাঙতেই অষ্ট নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, সকালে মেয়েটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাটাই রাতে স্বপ্ন হয়ে ফিরেছে।

ঠিক দুদিন পর পাশের পাড়ার ক্যাবলার ঠাকুমাটা জলে ডুবে মরলো। খবরটা শুনে অষ্ট ভয় পেয়েছিল, তারপর ভাবলো, বর্ষা বাদলার রাত ,বুড়ি নিশ্চয় ঘুমের ঘোরে ঘর থেকে বেরিয়ে চোর তাড়াতে গিয়েছিল আর পা পিছলে পুকুরে, অতো রাতে কেই বা টেনে তুলতো? সকালেই ফোলা বডি ভেসে উঠেছে।

এর আগেও অষ্ট স্বপ্নে দেখেছিল, তার বউটা উঠোনের মধ্যিখানে সাদা চাদর মুড়ে চিৎ হয়ে খাটিয়ায় শুয়ে,ঠোঁটের পাশ দিয়ে কষ গড়িয়ে পড়ছে। ঘুম ভাঙতেই বউকে জড়িয়ে ধরেছিল অষ্ট। নিজেকে ছাড়িয়ে বউ বলেছিল, "মরণ, মাঝরাতে আদিখ্যেতা! বিছানায় শুয়েই তো নাক ডাকো, সারা দিন খেটেখুটে এই মাঝরাতে আমি অমন সোহাগ চাইনে বাপু, ঘুমোও তো!"

অষ্ট ঘুমিয়েছিল, তবে ভোররাতে। বউএর মৃত্যুটা হঠাৎ তার স্বপ্নে এলো কেন?

দিন সাতেক পর শ্মশানে একটা বডি এসেছিল, ঠিক যেমন সেদিন সে স্বপ্নে দেখেছিল তেমনি সাদা চাদরে মোড়া, ঠোঁটের পাশ দিয়ে কষ গড়িয়ে পড়েছে।

অষ্ট মড়ার বাড়ির লোকেদের থেকে দুবোতল দেশী চেয়ে নেয়, গলায় ঢেলে দেয়, ব্যাস, ভয় ফুরুৎ!

কাল রাতেও একটি স্বপ্ন দেখছে অষ্ট, অষ্টর ছেলেটা...!


তিনসপ্তাহ কেটে গেছে, এখনও কোনো মড়া পোড়াতে ডাক পড়েনি অষ্টর। যাক! শেষ স্বপ্নটা তাহলে এমনিই ছিল। অষ্ট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আলুসিদ্ধতে দুখানা তেলে ভাজা শুকনো লঙ্কা লাল করে মেখে একখানা বড়ো পেঁয়াজ আর একগামলা মুড়ি খেয়ে অষ্ট কোদাল নিয়ে মাঠে যায়। নদীর জল ঢুকতে শুরু করেছে জমিতে, আল না বাঁধলে ধানের চারাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। 

পাশের জমিতে গোপাল খুড়ো ঘূণি বসিয়েছে। নদীর জলের সাথে অনেক ছোট মাছ জমিতে ঢুকে পড়ে তাদের ধরারই এই ব্যবস্থা। নিজের জমিতে আল কেটে অষ্ট চারপাশটা দেখে নেয়। আশেপাশে আপাতত কেউ নেই, ঘূণি থেকে কয়েকটা মাছ নিয়ে নিজের লুঙ্গির কছোড়ে লুকিয়ে নিলে কেউ টের পাবেনা। বউএর হাতের ওই যে কালো সর্ষে আর শুকনো লঙ্কা বাটা দিয়ে রগরগে চুনোমাছের ঝাল, আহঃ! অষ্ট খেয়েদেয়ে লম্বা একটা ভাতঘুম দেবে।

ঘূণির কাছে এসে দেখলো, মাছ নয়, একটা সাপ আটকে পড়েছে, জলঢোঁড়া, পালানোর চেষ্টা করছে বটে, পারছেনা। এই সাপ কামড়ালেও ক্ষতি নেই, বিষ নেই একদম। জলে ঘুরে মাছ খেয়ে বেড়ায় এই সাপ। অষ্ট একটা লাঠি নিয়ে সাপ টার মাথা থেঁতলে দেয়। ঘূণির জল লাল হয়ে ওঠে, প্রাণহীন সাপটার মড়া চোখদুটো তার দিকেই তাকিয়ে।


বাড়ি ফিরতেই বউ বললো, "সামুই দের বাড়ি থেকে লোক এসেছিল, ওদের ছেলেটা গলায় দড়ি দিয়েছে। তোমাকে শ্মশানে যেতে বলেছে।"

 অষ্টর বুকটা ধড়াস করে ওঠে।


আর অদৃশ্য হয়েও টিঙ্কুর মনটা এক তৃপ্তির আনন্দে হেসে ওঠে। তার মরার খবর অষ্ট ডোমকে ভয় পাইয়েছে!

এবার...



খাট থেকে বডিটা চিতায় তোলার সময় মনটা হুহু করে উঠলো অষ্টর। আহা! কীই বয়স ছেলেটার, বাইশ, তেইশ, এরই মধ্যে মায়ের কোল ছাড়তে হলো? কী এমন কষ্ট মনে লুকিয়ে রেখেছিলি বাপ, যে দড়িটাকেই বেছে নিলি?

পাটকাঠির আগুনের আঁচ পেয়ে ডান হাতটা নড়ে উঠলো হঠাৎ। মাথাটাও চিতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। অষ্ট চুলের মুঠি ধরে তুলতে যেতেই ঘিলু সমেত গরম রক্ত ছিটিয়ে পড়লো অষ্টর মুখে। পোস্টমর্টেমের পর মাথাটা ভালো করে সেলাইও করেনি হাসপাতালের ডোমেরা? মানুষ মরে গেলে তার দাম বাড়ির লোকেদের কাছে অনেক হলেও, আদতে সেতো নেহাতই একটা লাশ, আইনিভাবে!

অষ্টর সারা শরীর জ্বলছে, ছুট্টে গিয়ে শ্মশানের পুকুরে ঝাঁপ দেয়।


চিতার কালো ধোঁয়ার মধ্যে মিশে থেকে টিঙ্কু দেখছে সব। সে বুঝতে পারছে, আরও একটা চিতা জ্বলবে এই ভক্তাপাড়ার শ্মশানে।

পৈশাচিক আনন্দে টিঙ্কুর বুকটা ফুলে ওঠে।


ওদিকে অষ্ট দেখলো, শুকনো মোটা নিমকাঠের চিতা কিছুতেই জ্বলেনা। এক অতিপ্রাকৃতিক ভয়ের দৃশ্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে যেন।

অষ্ট ভয় পাচ্ছে। আরো একবোতল দেশী ঢালে গলায়। এবার মাথাটা চাঙ্গা হচ্ছে।

 চোখ বুজে বিড়বিড় মন্ত্র আউড়ে জলপোড়া দেয় অষ্ট। চিতা জ্বললেও মড়া উঠে বসে পড়ে। মোটা বাঁশ দিয়ে হাত পা ভেঙে অষ্ট চিতা সাজায় আবার।

একটা তেইশ বছরের ছোকরা পুড়তে টানা ছঘন্টা সময় নিলো! 


সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেছে।

অষ্টও বাড়ি ফিরেছে, ফিরেই আবার বোতল খুলেছে। ষোলো বছর মড়া পোড়াচ্ছে সে, একবোতল দিশি টানলেই তার দুচোখে যম ভর করে। আগুনের আঁচ পেয়ে লাশ বেঁকে যাওয়া, উঠে বসে পড়া, বাঁশের আঘাতে লাশের হাত পা ভেঙে চিতা জ্বালিয়ে দেওয়া, এসব তো নতুন কিছু না, একটু আগেও যার প্রাণ ছিল, এখন সে জ্বলছে, এমতাবস্থায় অদ্ভুত কিছু ঘটবেনা, এটাই তো অস্বাভাবিক। অষ্ট এগুলোতেই অভ্যস্ত, তবু কেন বুকের বাঁ পাশটায় ভয় উকি দিচ্ছে আজ?

রাতে দেখা স্বপ্নটা মনে পড়ছে বারবার।

কেউ যেন তার পাশে পাশে ঘুরছে। কে ঘুরছে?

আর একটা দৃশ্যও হঠাৎ মনে উঁকি দিলো... থেঁতলানো মাথার একটা মড়া চাহনি...

 কলজেটা বেয়াড়ারকম ধুকপুক করছে কেন?

বাঁ-গালটা এখনো জ্বালা করছে! এখনও রক্ত লেগে রয়েছে নাকি! অষ্ট আবার পুকুরে ঝাঁপ দেয়। 


এই তো শীতল হচ্ছে তার মুখ, জ্বালা জুড়িয়ে যাচ্ছে। অষ্ট সাঁতরে জলের ওপরে উঠতে চাইলো, ঠিক সেই মাঠে আটকে পড়া সাপটার মত।

 কিন্তু কে যেন তার চুলের মুঠি ধরে টানছে অতলে। অষ্ট প্রাণপনে ওপরে ওঠার চেষ্টা করে। পারছেনা। অদৃশ্য টানে সে তলিয়ে যাচ্ছে জলের গভীরে, চিৎকার করার চেষ্টা করে, কিন্তু জলের ভিতর কেই বা শুনবে তার আর্তনাদ?


অষ্ট হঠাৎ টের পেলো জলের মধ্যেও কেমন যেন মড়া পোড়ার গন্ধ!

আর একটা বীভৎস মুখ, জিভ বেরিয়ে রয়েছে, চিতার আগুনের আঁচ পেয়ে গলে গলে পড়ছে রক্ত, মাংস, পৈশাচিক হাসছে সামুইদের ছেলেটা। কী নাম করে যেন ওর বাড়ির লোক মরাকান্না কাঁদছিলো? টিঙ্কু!!







Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror