Sanchari Bhattacharya

Fantasy

2  

Sanchari Bhattacharya

Fantasy

মায়াবিনী

মায়াবিনী

9 mins
790


   ||প্রথম পর্ব||


ছুটিতে বেড়াতে যেতে কার না ইচ্ছে করে | অফিসের একঘেয়ে জীবনের হাত থেকে বাঁচতে চাওয়াটা কোন অন্যায় নয় |পরেশ ঠিক করল কিছুদিনের ছুটি নিয়ে কাছাকাছি কোন পার্বত্য এলাকা থেকে ঘুরে আসবে |পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য তাকে বরাবরই টানে |


পুরুলিয়া থেকে কিছুটা দূরে একটি গ্রাম আছে |গ্রামের নাম মারওয়া |জায়গাটা বেশ পুরোনো হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খনি |পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম মারওয়ার নাম অনেকেই শোনেনি |সে নামিদামি জায়গায় থাকার চেয়ে অজানা, অচেনা কোন জায়গায় একা বসে প্রকৃতির শোভা দেখতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ অনুভব করত |বেশ কয়েকদিনের লম্বা ছুটি নিয়ে সে চলে এলো মারওয়াতে |


আপাতত একা থাকাটাই জীবনের লক্ষ্য |কথায় বলে, 'শেষ ভালো যার, সব ভালো তার'|জীবনের প্রতিটি কাজকেই সে খুব নিখুঁতভাবে উপভোগ করত |সব কাজের শেষটা ভালো হোক, এটাই তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল |


মনে মনে এবারেও ঠিক করল, এই গ্রামে ঘুরতে এসে এমন কিছু স্মৃতি সে নিয়ে যাবে, যা সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে |গ্রামের নামে অনেকেই অনেক কথা বলেছিলো তাকে |কিন্তু অলৌকিক কিছুতে তার বিশ্বাস কোনদিনই খুব একটা বেশী নয় |


এই অঞ্চলে নাকি ডাইনীর বাস আছে |গ্রামের আনাচে কানাচে তেমনটাই শোনা যায় |জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট এই গ্রামের অলিন্দে লুকিয়ে আছে কিছু অপ্রত্যাশিত ইতিহাস, যা অনেকেরই অজানা |পরেশের উদ্দেশ্য ছিল সেই অজানাকে দেখার, অচেনাকে চেনার |


         ||দ্বিতীয় পর্ব||


জীবনের দৈনন্দিন টানাপোড়েন ইতিমধ্যেই তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছিলো |একা বাঁচার প্রত্যাশা সে একদিনে করতে শেখেনি |জীবনের প্রপঞ্চময় দিকটার হদিস সে পেয়েছে |সুন্দরের অভাব না থাকলেও বহু হতাশার ভিড়ে তার আনন্দগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলো |তবুও এই একা বাঁচার অভিযানকে সে জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলো |জীবনের খারাপ দিকটা দেখতে সে আজও ভয় পায়না |


ভালো মন্দ যাইই ঘটুক না কেন, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত যে এই জীবনের গতি অব্যাহত থাকবে, সেই সত্যের মুখোমুখি অনেক কাল আগেই সে হয়ে গেছিলো |নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেই যে হতাশার ছায়া থেকে নিজেকে সবসময় সরিয়ে রাখা যায়না, সে শিক্ষা ততদিনে তার বেশ ভালোই হয়েছিল |তবুও জীবনের গতিপ্রকৃতির সাথে ছন্দ মিলিয়ে চলতে পারাটাও তার কাছে নেশার মতন ছিল |


এসব ভাবতে ভাবতেই গ্রামের কোমলতা তাকে কাছে টেনে নিলো |চোখের সামনে ছোট ছোট পাহাড় আর সবুজের হাতছানি মুগ্ধ করল তাকে |গ্রামে থাকার ব্যাবস্থা সে করেনি |ভেবেছিলো এখানে এসে কারুর কাছে আশ্রয় চাইবে |এমন অদ্ভূত ঘোরার বাতিক যাদের থাকে তাঁদের বোধহয় এমনটাই হয় |


গ্রামের চারপাশটা বেশ শান্ত | সন্ধের আগেই সে পৌঁছে গেল| আশেপাশে নিবিড় ঘন ছায়া ঘেরা পরিবেশ| গাছগাছালিতে ঢাকা| গোটা পরিবেশটাকে সবুজ বেষ্টন করে রেখেছে| এত সুন্দর প্রাকৃতিক শোভা এর আগে পরেশের চোখে পড়েনি|পাহাড়ের কোলে সূর্যের এবার ঢাকা পড়ার মুহুর্ত |ধীরে ধীরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পশ্চিমে ডুবে যেতে শুরু করল সূর্য |প্রকৃতির কোলে ধীর গতিতে তখন অন্ধকার নেমে আসছে |


          

          ||তৃতীয় পর্ব||


ঠান্ডাটা ক্রমশঃ বাড়ছে |গ্রামটা অদ্ভূতরকম শান্ত |নিরবচ্ছিন্ন ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে |পাশেই ছোট কোন নদী আছে|নদীর জলের ছলছল শব্দ ভেসে আসছে পরেশের কানে | হঠাৎ তার চোখটা গেলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছায়ার দিকে |মনে হলো কেউ যেন লাল রঙের একটি শাড়ি পড়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে |অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে আসছে কোন মায়াবিনী? 


মেয়েটির পায়ের নূপুরের শব্দ নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে তার কানে প্রবেশ করতে লাগলো |মায়াবিনী মেয়েটি এগিয়ে আসছে তার দিকে |তার মুখটা ঢাকা |মেয়েটি সুন্দরী হলেও তার মুখটা দেখার উপায় নেই |মেয়েটি এক পা এক পা করে যখন এগিয়ে আসছে তার দিকে তখন চারিদিকের পরিবেশটা আরো বেশী থমথমে হয়ে যাচ্ছিলো |পরেশের সারা শরীরে একটা অদ্ভূত অস্বস্তি হচ্ছিলো |এই অচেনা জায়গায় কাউকেই সে চেনেনা |নিবিড় ঘন কুয়াশাকে ভেদ করে কে এগিয়ে আসছে তার দিকে? 


মহিলা আরো কাছে এগিয়ে আসতে সে দেখলো তার পোশাক রুচিশীল |চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে |গ্রামের বাসিন্দা হলেও মেয়েটির মধ্যে গ্রাম্য চালচলনের প্রভাব এতটুকু ছিলোনা |মেয়েটির দৃষ্টি পরেশকে সম্মোহিত করছিল |নিজেকে তার এতো কাছে পেয়ে, তার সংস্পর্শে এসে, এবং তাকে এই ঘটনাবিহীন সন্ধ্যার অপ্রকাশিত রহস্যের প্রতীক ভেবে এক অদ্ভূত বিষণ্নতা পরেশকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো |তবে সেই মায়াবিনীর দৃষ্টিকে এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিলোনা তার পক্ষে |


"আমার নাম নীলা|আপনি কি এই গ্রামে প্রথমবার এসেছেন?"


মেয়েটিকে দেখে পরেশ কোন কথাই বলতে পারলোনা |ভালো করে লক্ষ্য করে পরেশ দেখলো মেয়েটি নীরবে হাসছে |মেয়েটিকে দেখে এতক্ষন তার মনে হচ্ছিলো সে কোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে |কিন্তু এখন মেয়েটির এরূপ আচরণের মধ্যে দিয়ে তার মনে হলো মেয়েটি পতিতা|মেয়েটি হয়ত কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে তার কাছে |গ্রামে গঞ্জে এরূপ কান্ড নতুন নয় |শহুরে লোককে দেখে হয়ত মেয়েটি তার মন বদলে ফেলেছে |পরেশ কিছুটা পিছনে সরে এলো|


তবে মেয়েটির হাসির মধ্যে কোন ভালোবাসার ইঙ্গিত নেই |তাহলে সবটাই কি পরেশের মনের ভুল !মেয়েটি মুখের থেকে পর্দাটা সরালো |মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী |পরেশ মেয়েটিকে দেখে বাকরুদ্ধ |মেয়েটির মুখের আলতো মৃদু হাসি ওর কথা বলার শক্তিকে কিছুটা ফিরিয়ে দিলো |মেয়েটি বলল, "আপনার আশ্রয় চাই|এই অচেনা জায়গায় আপনাকে আশ্রয় দেবার মতন নিশ্চয়ই কেউ নেই? "


"মানে? "-পরেশের মুখে চোখে তখন একটা অস্বস্তির ছাপ |


"না আমার মনে হলো আপনি আগন্তুক |কি উদ্দেশ্যে এসেছেন জানতে পারি?"


"তেমন কিছুই না, ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম আরকি এই দিকটায় |তবে পরিবেশটা বড্ড অতিপ্রাকৃতিক"|


পরেশের চোখে পড়লো মেয়েটির মুখের অপ্রকাশিত ভঙ্গি |মেয়েটি যেন নজর সরাতেই চাইছে না ওর দিক থেকে |কি তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি |অবরুদ্ধ অথচ তৃষ্ণার্ত |মেয়েটি পরেশকে থামিয়ে দিয়েই বলে উঠলো, "আমি ভাবলাম আমার সাথে যেতে আপনার বোধহয় কোন আপত্তি হবেনা |জায়গাটাও তেমন ভালো নয় |নিশ্চয়ই শুনেছেন জায়গাটার একটা বদনাম আছে |তাই বলছিলাম যদি আমার সাথে আসেন আরকি?"


"না, মানে, কোথায় যাবো?"- কিছুটা স্বলজ্জ ভঙ্গিতে কথাটা বলে উঠলো পরেশ |


"কাছেই আমার বাড়ি, গ্রামের শেষ প্রান্তে, পাহাড়ের পাদদেশে |আপত্তি না থাকলে একসাথে যেতেই পারি আমরা !"


কিছুর একটা অদ্ভূত আকর্ষণ পেয়ে বসেছিল পরেশকে |উন্মাদনার মুহূর্ত গুলিকে হাত দিয়ে সরিয়ে অচেনা আবেগ গুলিকে প্রকাশিত হতে দিতে চাইছিলো সে |তবুও কোন এক অচেনা ভয় থেকে বার বার পিছিয়ে আসতেও বাধ্য হচ্ছিলো সে |তবুও বলল, "ঠিক আছে, আপনার যখন কোন আপত্তি নেই আমাকে অথিতি রূপে বরণ করে নিতে, আমারো কোন আপত্তি নেই এই আতিথেয়তা গ্রহণ করতে"|


মেয়েটি আবার হাসল |


          ||চতুর্থ পর্ব||


রাস্তা ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেলো ওরা |গ্রামের সীমানা থেকে একটু দূরেই পাহাড়ের ঢালে একটি বাড়ি |ঐতিহাসিক সত্ত্বা নিয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে |বাড়িটির দেওয়াল ভগ্ন |তবুও এক নিশ্ছিদ্র উন্মত্ততা আছে গোটা পরিবেশটা জুড়ে |বাড়িটার আশেপাশে কারুর আবাসস্থল নেই |অবাঞ্চিত হয়ে পড়ে থাকা একটি বাড়ি |এর অলিন্দে না জানি কতই ইতিহাস ধামা চাপা হয়ে পড়ে আছে|


"কিহলো ভিতরে আসুন"|- মেয়েটির দীপ্তময় কণ্ঠ |নীলা বলে ডাকাটা হয়ত সমীচীন হবেনা তাকে |মেয়েটির সুন্দর ত্বকের স্বছ বিবর্ণতা, ধূসর উজ্জ্বল চোখ, ঘন কালো ভুরু এবং স্বপ্রভ ঘন কালো চুলের অন্তরঙ্গতায় জন্ম নিয়েছে এক আশ্চর্য্য বিবর্ণ দ্যুতি |গোটা মুখমন্ডল সিক্ত সেই দ্যুতির কোমল অপরিচিত স্পর্শে |


বাড়িটিতে মেয়েটি একাই থাকেন |পরেশকে হাত ধরে মেয়েটি ঘরে নিয়ে গেলো |পরেশ অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখতে লাগলো |


"নীলা দেবী, আপনি কি করছেন?"

কথাটা শোনামাত্রই নীলা ওর হাতটি ছেড়ে দিলো |তির্যক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে|নীলার সেই দৃষ্টির গভীরতা পরেশকে একনিমিষে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো |কোন কথা বলতে পারলনা সে |নীলার থেকে দূরত্বটা বজায় রাখাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে পরেশের |


          ||পঞ্চম পর্ব||


বাড়ির ভিতরটা উষ্ণ |অদ্ভূত একটা পরিবেশ |ঘরের বাইরে হিমেল হাওয়ার রেশ অথচ ঘরের মধ্যে এই ঈষদ উষ্ণতা, সবকিছুই যেন একটা অস্বাভাবিক পরিবেশের হাতছানি দিয়ে যাচ্ছিলো |ক্ষনে ক্ষণেই পরেশ মেয়েটিকে দেখতে লাগলো |


বাড়ির ভিতরটা ও বড়োই অদ্ভূত |বিভিন্ন রকমের প্রাচীন আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো গোটা বাড়িটি |বাড়িটি আয়তনে খুব একটা ছোট নয় |তবে বাড়ির ভিতরের পরিবেশের সাথে বাইরের প্রকৃতির কোন সামঞ্জস্যতা ছিলোনা |বাড়ির মধ্যে আলো আসার কোন স্থান বা চিহ্ন নেই |


দরজা জানলা সবই বন্ধই থাকে |বাইরের হাওয়া বাতাসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে যে আজ বহু শতাব্দী আগে তা বোঝার অপেক্ষা রাখেনা |বাড়িটা থমথমে |কোন দ্বিতীয় লোক নেই |পরেশের নজর এড়ালো না বিষয়গুলো |এক নজরে সে যতটুকু দেখবার সুযোগ পেয়েছে তাতে সর্বত্রই এই বৈচিত্রময় পরিবেশের হাতছানিই ধরা পড়েছে |তার পাশাপাশি ধরা পড়েছে এই অজ্ঞাত পরিচয় মেয়েটির সন্দিগ্ধ আচরণ |


এসব দেখতে দেখতেই মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলার অভিপ্রায় নিয়ে পরেশ উল্টোদিকে তাকাতেই দেখলো পাশে কেউ নেই |অন্ধকারের বিভীষিকা কোথায় গ্রাস করল তাকে? কোথায় গায়েব হয়ে গেলো জলজ্যান্ত মেয়েটি ? 


পরেশের নজর এদিকে ওদিকে ঘুরতে লাগলো কিন্তু তার দেখা মিলল না |হঠাৎ সামনে এসে জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো নীলা |


"নীলাদেবী, আপনি কোথায় ছিলেন? আপনি এভাবে গায়েব হয়ে গেলেন কিভাবে?"


"আপনি বাড়ির চারিদিকটা খুব মন দিয়ে দেখছিলেন |আমি ভাবলাম আপনার জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করি |"


নীলাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছিলো পরেশ |প্রতিটি আচরণেই মধ্যেই একটি অস্বাভাবিকত্ব |জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলো নীলা |নীলার চাউনি, চোখ ও ঠোঁটের সূক্ষ্ম নড়াচড়ায় এমন এক অন্তরঙ্গতার ইঙ্গিত, যার অর্থ অনেক |পরেশ বুঝলো তাকে সতর্ক হতে হবে |ওর মনে হলো নীলা দেবীকে ধন্যবাদ দেওয়াটাই ঠিক হবে |এতে এতক্ষনের সঞ্চিত ঋণের হাত থেকেও মুক্তি পেতে পারবে সে |


কিন্তু কথাটা বলতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল পরেশ |পরেশের কথার উত্তর দেবার আগেই সে দেখলো নীলার বিষাদভরা দৃষ্টি |সেই দৃষ্টির ইঙ্গিত আলাদা |যেন কোনরকম অস্বস্তিকে প্রশ্রয় না দিতে অনুনয় করে বলছেন তিনি |নীলা জানে, এই অনুরোধ অস্বাভাবিক |তবুও বাইরের পরিবেশ আর তার একাকিত্বই যে তাকে ক্ষনিকের জন্য হলেও পরেশের জন্য দুর্বল করে দিয়েছে, তা তার চাউনিতে স্পষ্ট |


জীবনে কাউকে প্রথমবার এতো কাছ থেকে অনুভব করতে পারছে পরেশ |একি নিতান্তই কোন সুযোগ নাকি জীবনের ফেলে আশা অতীতের নিরবচ্ছিন্ন উদ্বেগ !আশাব্যঞ্জক কোন আশ্বাস নাকি শুধুই অন্তরের তৃষ্ণা? ঝলসে ওঠা হৃদয় দুটিকে কাছে নিয়ে আসার প্রয়াস মাত্র |হঠাৎ বাইরে গর্জে ওঠা মেঘের শব্দ |আরো কিছুটা কাছে এগিয়ে আসল নীলা |নিখুঁত সাক্ষাতের সম্ভাবনা - এই সন্ধিক্ষণকে সহজে ধ্বংস করতে পারেনা পরেশ |তার উচ্ছাস নিয়ন্ত্রণের সীমা অতিক্রম করল |নীলার আর তার মাঝের দূরত্বটা ক্রমশঃ হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে |নীলাকে তার প্রতিটি মুহূর্তে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে |


নীলা বলল, "চলুন, আপনার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছি |শুধু জল খেয়ে সারারাত থাকবেন নাকি? "


খাবার টেবিলে বসতেই কিছু মেয়েকে তার চোখের সামনে সুস্বাদু সমস্ত খাবার এনে রাখতে দেখলো পরেশ |এতক্ষন তাঁদের কোথাও দেখতে পাওয়া যায়নি |সুস্বাদু সব খাদ্যসামগ্রী, মাছ,মাংস, ফল, সরবত|একেবারে এলাহী আয়োজন |এতো কিছু কোথা থেকে আসলো! সবটাই কেমন যেন ধোঁয়াশা |মেয়েগুলো খাবার রেখে চলে গেলো|কারুর মুখেই কোন সাড়া শব্দ নেই |সবাই চুপচাপ কাজ করে প্রস্থান করল |পরেশের পক্ষে পরিস্থিতিটা বোঝা ক্রমশঃ কঠিন হতে লাগলো |


          ||ষষ্ঠ পর্ব||


পরেশের মনে তখন অজস্র প্রশ্ন |গ্রামটা এতো নিস্তব্ধ |আর কেউ কেন এগিয়ে আসল না অভ্যর্থনা করার জন্য |একমাত্র এই অজ্ঞাতপরিচয় মহিলাটি কেন এলেন !এরকম অজস্র প্রশ্ন ভিড় করতে থাকলো ওর মনে |মহিলাটির চোখের নিস্পলক চাউনি ওকে বারংবার আবেগতাড়িত করে দিচ্ছিলো |সময় আর পরিস্থিতি দুটিই যেন নীলার অনুকূলে |পরেশ শুধুই দর্শক মাত্র |বলবার অনেক কিছু থাকলেও নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসি ছাড়া আর কোন 

অভিব্যক্তিই প্রকাশ পেলোনা |


"তোমার সাথে দেখা হওয়াটা বড় অদ্ভূত সময়ে হলো পরেশ |বলতে পারো বহুদিনের আকাঙ্খিত সন্ধ্যা আজ উপহারস্বরূপ পেলাম আমি"|


কথাগুলির মধ্যে সন্দেহের গন্ধ লুকিয়ে থাকলেও, দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোন অসামঞ্জস্যতা ছিলোনা |পরেশের খাওয়া শেষ হওয়ার জন্যই যেন মেয়েটি এতক্ষন অপেক্ষা করছিল |সারা বাড়িতে তখন শুধু নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে |পারিপার্শ্বিক পরিবেশেও কোন বাহ্যিক কোলাহল নেই |মৃতপ্রায় নিস্তব্ধতা |অনাকাঙ্খিত প্রত্যাশার ভিড়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে তারা |তবে এইটুকু সময়ের আলাপে কখন যে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছে তা প্রায় দুজনেরই অজানা |


পরেশের হাত ধরে নীলা তাকে নিয়ে চলল সিঁড়ি দিয়ে উপরে |ওর নরম হাতের স্পর্শ পরেশের মনে অপরাধবোধ সৃষ্টি করতে চাইছিলো |কি গভীর নীরবতা ঘিরে রেখেছে ওদের দুজনকে | পরেশের হৃৎপিণ্ডের শব্দ ভয়ঙ্করভাবে শুনতে পেলো সে নিজেও |ঘরের দেওয়ালে হয়ত প্রতিধ্বনিত হবে সেই শব্দ |কঠিন ইঁটের পাঁচিল ভেদ করে সেই শব্দ হয়ত ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে |ওরা দুজনেই প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলো|



          ||সপ্তম পর্ব||


পরেশকে সে নিয়ে এসেছে একটি শয়নকক্ষে |শয়নকক্ষটি খুব সুন্দর করে সাজানো |কোন অচেনা মেয়ের সাথে একই বিছানায় শোয়াটা কোন সাধারণ কথা নয় |নীলার চোখের দৃষ্টিতে অস্ফুট স্বরে কথা বলে উঠলো পরেশ |


"আমি কি তাহলে আপনার সাথেই শোবো?"


"কেন আপনার কি আপত্তি আছে?"


কথা বলার ক্ষমতাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো পরেশের |পরেশ কিছু বলার আগেই নীলা এসে শুয়ে পড়লো ওর পাশে |ঠিক সেই সময় ঘরের আলোটা নিভে গেলো |চোখটা সরানো মাত্রই পরেশ দেখলো নীলা মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে ঠিক তার চোখের সামনে |এতো তাড়াতাড়ি এই অন্ধকারের মধ্যে মোমবাতি সংগ্রহের সুযোগ কিভাবে পেলো সে? 


মোমবাতির আলোয় পরেশ দেখতে পেলো, নীলার চোখের দৃষ্টি আর স্বাভাবিক নেই |চুলের বিনুনিটা হাওয়ায় দুলছে |আকারে বড় হচ্ছে |আর অদ্ভূতভাবে পাকানো বিনুনিটা এগিয়ে আসছে তার দিকে |আসতে আসতে এগিয়ে এসে তার গলায় পেঁচিয়ে যাচ্ছে |ক্রমশঃ শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে ওর |কথা বলার শক্তি চলে যাচ্ছে |মোমবাতির শিখাটা তখন শুধুই কাঁপছে |নীলার দেহটা তখন শুন্যে |পায়ের পাতাগুলো উল্টোদিকে |


নিজের চোখে বিশ্বাস করার মত অবস্থায় পরেশ নেই |অট্টহাসির শব্দে তখন বিচ্ছুরিত হতে থাকলো চতুর্দিকে |সে চেষ্টা করেই চলেছে ঐ শক্ত বিনুনির গিট টাকে হাত দিয়ে খুলতে |কিন্তু বেষ্টন আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে |দম বন্ধ হয়ে আসছে |ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে নীলার মুখটা |না সে কোন সাধারণ মেয়ে নয়, সে মায়াবিনী |নীলা একজন ডাইনি |একমাত্র ডাইনীর সত্তাই পারে এরূপ অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী রাখতে কাউকে |আজকের শিকার তবে পরেশ |


মোমবাতির শিখাটা দপ করে নিভে যায় |


সমাপ্ত 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy