Sanchari Bhattacharya

Horror Fantasy Thriller

3  

Sanchari Bhattacharya

Horror Fantasy Thriller

কঙ্কাল হ্রদ

কঙ্কাল হ্রদ

11 mins
12.4K


কঙ্কাল হ্রদ-কঙ্কাল ছড়িয়ে থাকা এক রহস্য।


"হিমালয়"- এই নামটিই হল ওপার রহস্যের খনি |বহু অবাস্তব ঘটনার সাক্ষী এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি |আমরা চোখের সামনে যা ঘটতে দেখি সেটিই শুধুমাত্র আমাদের কাছে বাস্তবরূপে ধরা দেয় কিন্তু এমনও অনেক ঘটনা রয়েছে যেটি বাস্তবে থেকেও অবাস্তবতার বেড়াজালে আজও জড়িয়ে রয়েছে|কিছু কিছু রহস্যের ভীত অনেক গভীরে নিহিত থাকে |আপনার বা আমার বাস্তবমুখী ধ্যানধারণার চেয়েও অনেক গভীরে |পৃথিবীর বহু প্রাচীন রহস্যের ভীতকে আজও নাড়ানো সম্ভব হয়নি |সেগুলি আজও রয়ে গেছে রহস্যের অন্ধকারেই |গবেষক আর বিশ্লেষকদের একের পর এক তত্ত্ব আর মতামত ভুল প্রমাণিত হতে লাগল হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীর সেরা রহস্যের একটির এখনো কোনো সমাধান খুঁজে পায়নি কেউ|


কঙ্কাল হ্রদ। কঙ্কাল ছড়িয়ে থাকা এক রহস্য।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ মাইল উঁচুতে অবস্থিত একটি হ্রদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে খুঁজে পাওয়া গেল ২০০টি মানুষের কঙ্কাল। বিশ্বজুড়ে খবরটি ছড়িয়ে গেল বাতাসের বেগে। কৌতূহলের কেন্দ্রে চলে এলো "কঙ্কাল হ্রদ"।

উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তে থাকা ত্রিশুল (৭১২০ মি) ও নন্দাঘুটি (৬৩১০ মি) বেসক্যাম্পের কাছেই, হিমালয়ের কোলে লুকিয়ে আছে দু মিটার গভীর এক রহস্যময় হ্রদ রূপকুণ্ড। হ্রদটির উত্তরে আছে জুনারগলি কল। ৪০০ মিটার চড়াই ডিঙিয়ে পথ চলেছে হোমকুণ্ড হয়ে রন্টি স্যাডলের দিকে। রূপকুণ্ডের পূর্বে আছে চন্দনিয়া কোট|রূপকুণ্ড তার বুকে হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে এক রহস্য। আপাত দৃষ্টিতে সৌন্দর্যবিহীন হয়েও বিশ্বের বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও অভিযাত্রীদের কাছে আজও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রূপকুণ্ড।


মহাদেব তৈরি করেছিলেন রূপকুণ্ড|উত্তরাখণ্ডের লোকগাথা তাই বলে। বহুকাল আগে বর্তমান উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার নৌটি গ্রামে বাস করতেন নন্দাদেবী। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল স্বয়ং মহাদেবের। রীতি অনুযায়ী তাঁকে স্বামীর বাড়ি হোমকুণ্ড যেতে হয়েছিল। শোভাযাত্রা সহকারে নন্দাদেবীকে যখন তাঁর স্বামীর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন হঠাৎ নন্দাদেবীর তৃষ্ণা পায়। ত্রিসীমানায় কোনও জলের উৎস ছিল না। তৃষ্ণার্ত নন্দাদেবী তখন মহাদেবকে স্মরণ করেন।দৈববলে মহাদেব তাঁর তৃষ্ণার্ত স্ত্রীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন এক ছোট্ট হ্রদ বেদিনি কুণ্ড। নন্দাদেবী ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই বেদিনি কুণ্ডের জল পান করেছিলেন। এরপর আবার এগিয়ে চলেছিল শোভাযাত্রা। স্ত্রীর আবার জল পিপাসা পেতে পারে ভেবে মহাদেব যাত্রাপথে তৈরি করে দিয়েছিলেন আরেকটি হ্রদ। এটিই হল রূপকুণ্ড।


১৯৪২ সালের গ্রীষ্মকাল,হিমবাহের বরফ সেবার একটু বেশিই গলে গেছিলো। ব্রিটিশ ভারতের ফরেস্ট অফিসার হরি কৃষণ মাধওয়াল ও তাঁর দল, ১৬৪৭০ ফুট উচ্চতায় আবিষ্কার করেছিলেন হিমবাহের জলে পুষ্ট একটি হ্রদ। টলটলে স্বচ্ছ জলের নীচে থাকা পাথুরে ভূমি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল,কাছে গিয়ে চমকে উঠেছিলেন মাধওয়াল। জলের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শয়ে শয়ে নরকঙ্কাল, নরকরোটি ও হাড়গোড়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঠের কারুশিল্প, লোহার তৈরি বল্লমের ডগা, চামড়ার চটি ও ধাতব রিং সহ আরও অনেক কিছু।

বিস্মিত ও কিছুটা আতঙ্কিত মাধওয়াল সাহেব বিশদভাবে সব লিখে পাঠিয়েছিলেন তাঁর উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে। মাধওয়ালের পাঠানো রিপোর্ট পড়ে ব্রিটিশরা অনুমান করেছিল ওই কঙ্কালগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনাদের হতে পারে। জাপানি সেনারা সম্ভবত জুনারগলি গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছিল। প্রবল তুষারঝড়ের কবলে পড়ে তারা প্রাণ হারায়।


তবে ১৯৪২ সালের দিকে একজন বনরক্ষী হঠাৎ হ্রদটি এবং অনেক গণকবর আবিষ্কার করেন। এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যদিও পরবর্তীতে জানা যায়, কঙ্কালগুলো ১২ থেকে ১৫ শতকের সময়কার। কিন্তু মানুষের মনে আজও ভাবনা ঘুরপাক খায় এই ভেবে, কেন ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে সেই নয় শতকের সময়কার একসঙ্গে এতগুলো মানুষের কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা কঙ্কালগুলো এবং প্রাপ্ত গহনা পরীক্ষা করে জানান, এগুলো কোনো রাজকীয় বাহিনী বা একদল তীর্থযাত্রীর। এমনও হতে পারে, এই মানুষগুলো কোনো তীব্র তুষারঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছিলো । তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি হাজির করেন একদল নৃতত্ত্ববিদ। তাদের ভাষ্যমতে, ওই অঞ্চলে বসবাসরত কোনো গোষ্ঠী গণহারে আত্মহত্যা করেছিলেন। এই হলো মূল রহস্য।


পৃথিবীবাসীর সামনে এই রহস্যের আবির্ভাব খুব বেশি দিন আগে নয়। আরেকদল অবশ্য বলে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এই রাজকীয় বাহিনী বা তীর্থযাত্রী দলের মানুষগুলোর মৃত্যু হয়েছে। এ হ্রদটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ মাইল উঁচুতে অবস্থিত। অনেক পর্যটক এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ মানচিত্র ঘেঁটে এবং বছরের পর বছর অনুসন্ধান চালিয়েও হ্রদটির সন্ধান পায়নি। আবার এমনও হয়েছে, অল্প একটু চেষ্টাতেই অনেকে দেখতে পেয়েছেন হ্রদটিকে। সবচেয়ে বড় কথা- এটি সবাই দেখতেও পান না। এর আশপাশের এলাকাও ছিল অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। এতদিন পর্যন্ত কেউই এখানকার হ্রদটির কথা জানত না। কারও বর্ণনায় এই হ্রদের কথা পাওয়া যায়নি। এটি একটি হিমবাহ হ্রদ। এটির অবস্থান ভারতের উত্তরখণ্ডে। এ ছাড়া অনেকে বলেন ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে মানুষ জানত এই কঙ্কালগুলোর কথা। কারা এই হতভাগ্যরা? কীভাবে তারা মারা গেল? যুগের পর যুগ কৌতূহলী মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে।


এই হ্রদটির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ঠিক যে সময় থেকে এ হ্রদটি পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত হলো, তখন থেকেই এর সঙ্গে রহস্যের ব্যাপারটি একেবারে মিলেমিশে গেছে। ভারতে অবস্থিত এই হৃদটিকে মানুষজন রূপকুণ্ডের রহস্যময় অভিশপ্ত কঙ্কাল হ্রদ হিসেবেই চেনে। এখানে ৫০০-র মতো মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। এ কারণে রূপকুণ্ড হ্রদের নাম হয়ে যায় কঙ্কাল হ্রদ। ১৯৪২ সালে নন্দা দেবী রিসার্ভ পার্কের রেঞ্জার এইচ কে মাধওয়াল এই কঙ্কালগুলো প্রথম আবিষ্কার করেন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল এগুলো জাপানি সৈন্যদের কঙ্কাল যারা ওই অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তারা মারা যায়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসন বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে দেখল কঙ্কালগুলো অন্তত এক শতাব্দী প্রাচীন। অনেকে ভাবলেন এটা জম্মু কাশ্মীরের রাজা জেনারেল জরাইয়ার সিংয়ের সেনাদের যারা বালিতস্তান আক্রমণের সময় হারিয়ে গিয়েছিল।

১৯৫৬ সালে ভারতীয় সরকার সেখানে সার্ভে টিম পাঠায়। তারা সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করেআনেন | রেডিও কার্বন ডেটিং করে জানা গেল এগুলো অন্তত ১২ থেকে ১৫ শতাব্দীর সময়কার । তখন অনেকে ধারণা করলেন এরা মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সেনাবাহিনী হবে যারা তিব্বত দখল করতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ১৯৫৬ সালের পদ্ধতি ছিল অনেক ত্রুটিপূর্ণ। অনেকে ধারণা করলেন এরা কোনো মহামারীর শিকার হয়েছে।


এ অঞ্চলের নিচের জনপদগুলোতে লোককাহিনী প্রচলিত আছে যে, প্রাচীনকালে কনৌজের রাজা যসোয়াল এখানে আসেন নন্দাদেবীর উপাসনা করতে; কিন্তু সঙ্গে নিয়ে আসেন বাইজি। এতে এই স্থানের পবিত্রতা নষ্ট হয়। তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত হয়। তাদের ওপর শিলাবৃষ্টি হয় এবং তারা হ্রদের ভিতর নিক্ষিপ্ত হয়। অধিকাংশ মানুষ লোককাহিনীকে গালগল্প বলে ধরে নিলেও এর ভিতর ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে থাকে। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, কনৌজের রাজা যশোয়াল, তার রানী ও পরিষদবর্গসহ নন্দা দেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রার জন্য গেছিলেন।


আজও প্রতি ১২ বছর পরপর রূপকুণ্ডে নন্দা দেবীর মন্দিরে তীর্থযাত্রার আয়োজন করা হয়। তবে কোনো কিংবদন্তিতেই অদ্ভুতুড়ে এই হ্রদের কথা উল্লেখ নেই। স্থানীয় আদিবাসী তো বটেই গোটা বিশ্ববাসীর কাছেই রূপকুণ্ড একটি মৃত্যু বিভীষিকার নাম। ২০০৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের উদ্যোগে একদল গবেষক এই রহস্য ভাঙার উদ্যোগ নেন। এর নেতৃত্ব দেন জার্মানীর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. উইলিয়াম সাঙ্। দলটিতে ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও ছিলেন। তারা নানা হাড়গোড়ের নমুনা সংগ্রহ করেন। দলটি একটি বিশাল সাফল্য লাভ করে যখন তারা একটি অক্ষত দেহ উদ্ধার করে। হিমালয়ের বরফশীতল তাপমাত্রা দেহটিকে সংরক্ষণ করে রেখেছিল। এতে তারা ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করতে সুবিধা পেলেন।


ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা কঙ্কালের খুলিতে অগভীর আঘাতের চিহ্ন পেলেন। পুনের ডেকান কলেজের প্রফেসর ডা. সুভাষের মতে এই অগভীর আঘাতের কারণ কোনো তুষারধস নয় বরং গলফবলের মতো ছোট কঠিন বস্তুর আঘাতের ফলাফল। একই সঙ্গে কয়েকশ' মানুষ মাথায় একই রকম আঘাত পেল এবং মারা গেল| এটা নিশ্চয়ই ওপর থেকে আঘাত করেছে। তাদের ধারণা এটা শিলাবৃষ্টি হবে। প্রফেসর ড. উইলিয়াম সাঙ্ স্থানীয় একটি পালাগানের কথা স্মরণ করেন যেখানে বলা হয়েছে রুষ্ট দেবী পাপিষ্ঠদের উপর এমন শিলা নিক্ষেপ করেন যা পাথরের থেকেও ভারী। এ ছাড়াও বিজ্ঞানীরা কাপড়, জুতো,কাঁচের চুড়ি, বাঁশের লাঠি উদ্ধার করেন। এ থেকে বোঝা যায় তারা তীর্থযাত্রী ছিলেন। সেখানে এখনো বরফের নিচে ৬০০ দেহ চাপা পড়ে থাকতে পারে।


এই নমুনাগুলো ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও কার্বন এক্সিলেটর ইউনিটে পাঠানো হয়। সেখানকার গবেষকরা জানান, নমুনাগুলো ৮৫০ খ্রিস্টপূর্বের। যা ১৯৫৬ সালের রিপোর্টের আরও বহু আগে আবিষ্কৃত হয় । হায়দরাবাদের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় লাশের হাড়ের নমুনা থেকে তিনটি এমন জিন পাওয়া গেল, যা মহারাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের আর কোন জায়গার মানুষের ভিতরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে আরও কিছু মানুষের চেহারা হিমালয়ের আশপাশের মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর। অতএব এটা বলা স্বাভাবিক যে, তীর্থযাত্রীরা স্থানীয়দের কুলি হিসেবে নিয়োগ করেছিল। রূপকুণ্ড থেকে স্থানীয় মানববসতির দূরত্ব ৩৫ কি.মি। তাই বাইরের লোকেরা স্থানীয়দের সহায়তা ছাড়া সেখানে যেতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। এটা ধারণা করা যায় আজ থেকে ১৩০০ বছর আগে এক হাজারের মতো লোক হিমালয়ের উপরে অজানা পরিবেশে চলছিল। তাদের সঙ্গে কুলি হিসেবে ছিল স্থানীয়রা। সেখানে পুরুষ, মহিলা এবং শিশু ছিল। হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। পালানোর কোনো উপায় ছিল না। শিলার আঘাতে একে একে মৃত্যুর মুখে পতিত হলো সবাই। কিছুক্ষণের ভিতর রূপকুণ্ড হয়ে গেল এক মৃত্যুপুরী। তাদের দেহ হ্রদের উপর পতিত হলো। কিছু বরফ চাপা পড়ল। দিন পেরিয়ে মাস হলো, মাস পেরিয়ে বছর, তারপর শতাব্দীও কেটে গেল।

এই তত্ত্ব মানেননি অনেকে |কারণ, হ্রদের জলে পড়ে থাকা কঙ্কালগুলি দেখে মনে হচ্ছিল সেগুলি শত শত বছরের পুরানো। কিন্তু কঙ্কালগুলি কাদের? সেগুলি হ্রদের জলে এলই বা কীভাবে? ১৯৫৬ সালে সেটা জানার প্রথম চেষ্টা চালায় হায়দরাবাদের Center for Cellular and Molecular Biology নামক সংস্থাটি। ডিএনএ টেস্টের জন্য বিজ্ঞানীরা কঙ্কালগুলি থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন|পরীক্ষা থেকে জানা যায় কঙ্কালগুলি দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষদের। বড় কঙ্কালগুলি দীর্ঘদেহী ইরানীয় মানুষদের এবং ছোট কঙ্কালগুলি সম্ভবত স্থানীয় মানুষদের। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, কেন ইরানীরা ওই পথ দিয়ে ভারতে আসবেন? স্থানীয়রা কি তাঁদের আসতে সাহায্য করেছিলেন? ইরানীয়রা ভারতে আসার কারণই বা কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।


তবে আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ওয়াল কুমায়ুনের বিভিন্ন লোকগাথার সঙ্গে জড়িয়ে গেছিলো রহস্যময় রূপকুণ্ড। রূপকুণ্ডের বরফে জমে যাওয়া মানুষগুলি কারা, তা বলে দিয়েছিল চামৌলির লোকগান ও লোকগাথা। তবে বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে লোকগাথার দেওয়া তথ্যের কোনও মিল ছিল না। থাকার কথাও নয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা সেগুলিই বিশ্বাস করেছিল।লোকগাথা, লোকগানগুলি পরবর্তীকালে বিভিন্ন এলাকায় পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হলেও সব কাহিনির অন্যতম চরিত্র হয়ে আছেন কনৌজ রাজ যশদয়াল সিং।রাজা যশদয়াল সিং ও রানি বালামপার উপাখ্যান কয়েকশো বছর আগের কথা |রাজপুরোহিতের নির্দেশ অনুসারে ত্রিশুলী তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছিলেন কনৌজ রাজ যশদয়াল সিং ও তাঁর সন্তানসম্ভবা রানি বালামপা। সঙ্গে ছিল বিরাট একটি দল। দলে ছিলেন মন্ত্রী, সান্ত্রী, পাচক,পরিচারক, মালবাহক, ডুলিবাহক, এমনকি রাজনর্তকীরাও।


রূপকুণ্ড ট্রেক রুটে আজ যেখানে পাথর নাচুনি নামে এলাকাটি আছে, সেখানেই থেমেছিল দলটি। ডুলি থেকে নেমেছিলেন রাজা আর রানী। পথশ্রমে ক্লান্ত রাজার ইচ্ছে হয়েছিল আমোদ প্রমোদের। রাজার তাঁবুতে নাচ ও গান শুরু করেছিলেন রাজনর্তকীরা।


তীর্থযাত্রায় এ হেন অধর্ম মেনে নিতে পারেননি নন্দাদেবী। তাঁর অভিশাপে নৃত্যরত অবস্থায় পাথর হয়ে গেছিলেন রাজনর্তকীরা। সেই থেকে জায়গাটির নাম হয়ে যায় পাথর নাচুনি। আজও সেখানে গেলে কিছু অদ্ভুত আকৃতির পাথর দেখতে পাওয়া যাবে। সেগুলিই নাকি সেই অভিশপ্ত নর্তকীদের প্রস্তরীভূত রূপ।

নন্দাদেবীর রুদ্ররূপে ভীত রাজা ও রানী ক্ষমা চেয়েছিলেন দেবীর কাছে। শান্ত হয়েছিলেন নন্দাদেবী। ক্ষমা করেছিলেন রাজাকে। প্রতি ১২ বছরে একবার তীর্থ যাত্রা করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন রাজাকে। রাজ্যে ফিরে এসেছিলেন কনৌজ রাজ যশদয়াল সিং, তীর্থযাত্রা অসমাপ্ত রেখে।কিন্তু কয়েক বছর পর নন্দাদেবীর আদেশকে অমান্য করে রাজা আবার গেছিলেন হোমকুণ্ডের পথে। সে বছরও সঙ্গে ছিলেন রানী ও কয়েকজন নর্তকী। রূপকুণ্ড পেরিয়ে দলটি যখন জুনারগলির ওপরে, ঠিক সেই মুহূর্তে নন্দাদেবীর অভিশাপে শুরু হয় প্রবল শিলাবৃষ্টি। একই সঙ্গে ফণা তোলে প্রবল তুষারঝড়।


ঝড়ের ঝাপটায় অসহায়ভাবে তীর্থযাত্রীরা একে একে জুনারগলি থেকে রূপকুণ্ডের বুকে আছড়ে পড়েছিলেন। জীবন্ত অবস্থায় তুষার সমাধি ঘটেছিল রাজা রানী সহ সম্পূর্ণ দলটির। গাড়ওয়াল, কুমায়ুনের লোকবিশ্বাস অনুসারে, রূপকুণ্ডের কঙ্কালগুলি কনৌজ রাজের দলটির সদস্য সদস্যাদের।


কঙ্কালগুলি কাদের, তা নিয়ে উঠেছে নানান তত্ত্ব, মেলেনি কোনও প্রমাণ|ব্রিটিশদের বলে যাওয়া ‘জাপানি সেনা’ তত্ত্ব প্রথমেই খারিজ হয়ে গেছিলো । কারণ হ্রদের জলে কোনও আধুনিক অস্ত্র পাওয়া যায়নি। অস্ত্র বলতে পাওয়া গেছিলো বল্লমের ফলা। বল্লম দিয়ে জাপানি সেনারা নিশ্চয়ই বিশ্বযুদ্ধ লড়েনি!


অনেকের মতে কঙ্কালগুলি কোনও হতভাগ্য তীর্থযাত্রী দলের। চামোলির মানুষরা প্রতি ১২ বছর অন্তর অন্তর নন্দা জাত বা নন্দা রাজ জাত নামে এক তীর্থযাত্রায় যান। নন্দাদেবীর নিজের গ্রাম নৌটি থেকে যাত্রা শুরু করে তীর্থ যাত্রীরা রূপকুন্ড হোমকুণ্ড হয়ে পৌঁছান ভগবতী গ্রামে।এই তত্ত্বটিও খারিজ করলেন অনেকে। তাঁরা বললেন, নন্দা জাত-এ মহিলাদের যাওয়া নিষেধ। কিন্তু রূপকুণ্ডে মিলেছে বেশ কিছু মহিলার কঙ্কাল। তাছাড়া কুণ্ডের জলে তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে যা যা থাকার কথা সে সব কিছুই পাওয়া যায়নি।


কেউ বলেছেন এঁরা হতে পারেন ব্যবসায়ীর দল। যাঁরা তিব্বত থেকে পণ্য নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তখনকার দিনে পশুর পিঠে করে ভিনদেশ থেকে পাহাড়ি গিরিপথ ধরে বিক্রয়যোগ্য পণ্য আসত ভারতে। হ্রদের জলে থাকা মানুষের কঙ্কালের সঙ্গে কোনও জন্তুর কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এই কঙ্কালগুলি ভিনদেশী ব্যবসায়ীদেরও নয়। তাছাড়া এই পথে ব্যবসায়ীদের আসা যাওয়া ছিল বলে কোনও রেকর্ড নেই।


কারও মতে ওই অঞ্চলে ‘কিদা জড়ি’ নামে ওষুধের ক্ষমতা যুক্ত মাশরুম খুঁজতে গিয়ে শিলাবৃষ্টির কবলে পড়েছিলেন কোন দল। যুক্তিবাদীরা বলছেন, কিন্তু প্রায় তিনশ মানুষ একসঙ্গে মাশরুম খুঁজতে যাবেন?কেউ বলেছেন হতভাগ্য মানুষগুলি হয়তো নরবলীর মতো ধর্মীয় কোনও ভয়ঙ্কর উৎসর্গ প্রথার শিকার। যুক্তিবাদীরা বলছেন তা হলেও সেটাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকার কথা ছিল।কেউ বলেছেন কঙ্কালগুলি ফিরোজ শাহ তুঘলকের হারিয়ে যাওয়া সৈন্যদলের। কিন্তু এই যুক্তির সপক্ষে মেলেনি কোনও প্রমাণ।


কেউ বলেন কঙ্কালগুলি ডোগরাদের সেনাধক্ষ্য জোরাওয়ার সিং ও তাঁর সৈন্যদলের। ১৮৪১ সালের মে মাস থেকে ১৮৪২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত চলেছিল ডোগরা- তিব্বতিদের মধ্যে যুদ্ধ। জোরাওয়ার সিং-এর তত্ত্ব খারিজ হয়ে গেছিলো,কারণ ইতিহাস বলছে তিব্বতিদের সঙ্গে মিসসারের যুদ্ধে তিনি প্রাণ হারান। এই পথে তাঁর আসার কোনও সম্ভবনাই ছিল না।


২০০৪ সালে একদল বিজ্ঞানী আবার রূপকুণ্ডে বৈজ্ঞানিক অভিযান চালান। তাঁরাও বলেছিলেন হ্রদে কঙ্কালগুলি দুটি পৃথক জনগোষ্ঠীর। হ্রদের পড়ে থাকা কিছু কঙ্কালগুলি খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর। লম্বা কঙ্কালগুলির সঙ্গে ইরানীয়দের নয় বরং অস্বাভাবিক মিল আছে মহারাষ্ট্রের চিতপাভান ব্রাহ্মণদের সঙ্গে।সেই গবেষণা থেকে উঠে এসেছিল আরেকটি ভয়ঙ্কর তথ্য। প্রত্যেকটি কঙ্কালের মাথা ও কাঁধের হাড়ে একই ধরনের ক্ষত ছিল। ৯ ইঞ্চি ব্যাসের কোনও গোলাকার পদার্থ একই ভাবে আঘাত করেছিল হতভাগ্য মানুষগুলিকে।


বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, ভয়ঙ্কর শিলাবৃষ্টির কারণে মানুষগুলির মৃত্যু হয়েছে। শিলাগুলির আকৃতি ছিল ক্রিকেট বলের মতোই। কিন্তু এই দলের বিজ্ঞানীরাও বলতে পারেননি মানুষগুলি কারা? ওই উচ্চতায় কী জন্য এসেছিলেন?


অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির Radiocarbon Accelerator Unit কঙ্কালগুলির রেডিও কার্বন ডেটিংকরে জানতে পেরেছিল সেগুলি ৮২০ থেকে ৮৮০ বছর পুরোনো।কোনও বিজ্ঞানী দল বলেছেন কিছু কঙ্কাল ১২০০ বছরের পুরোনো। কিছু কঙ্কালের বয়েস মাত্র ২০০ বছর। তাই এটা প্রমাণিত, দুটি দল প্রায় ১০০০ বছরের ব্যবধানে রূপকুণ্ডের পথে একই রকম দুর্ঘটনায় পড়েছিল ।


২০১৯ সালের আগস্ট মাসে, ভারতীয়, আমেরিকান ও ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের নিয়ে গড়া একটি আন্তর্জাতিক দল ৩৮ টি কঙ্কালের Biomolecular analyses বাGenome-wide DNA study রিপোর্টের Nature Communications জার্নালে প্রকাশ করেন। উঠে আসে চমকে দেওয়ার মত তথ্য।কঙ্কালগুলির জিনোম স্টাডি থেকে জানা গেছে, ১২০০ বছরের পুরোনো কঙ্কালগুলির বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের এবং ২০০ বছরের পুরোনো কঙ্কালগুলির সঙ্গে মিল আছে পূর্ব ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের মানুষদের।পূর্ব ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের দেশগুলি হল সাইপ্রাস, গ্রীস, লেবানন, সিরিয়া,ইজরায়েল,প্যালেস্টাইন,

তুরস্ক, মিশর, লিবিয়া ও জর্ডন। কিন্তু এখন উঠছে প্রশ্ন অত দূর থেকে মানুষগুলি ভারতে আসতে বা যেতে এই কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলেন কেন?

সবশেষে এটা পরিষ্কার, এত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেও রূপকুণ্ডের কঙ্কাল রহস্যের সমাধান করা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীদের নেওয়া সিদ্ধান্তের মধ্যে দেখা গেছে বিস্তর ফারাক। আজও জানা যায়নি ওরা কারা। আজও সেটা অনুমান হয়েই রয়ে গেছে|কঙ্কালগুলিকে ঘিরে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু জানে রূপকুণ্ড ও জুনারগুলি কল। কিন্তু তারা ভাষাহীন। তাই কয়েকশ হতভাগ্যের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তাই রূপকুণ্ড রহস্য আজও অমীমাংসিত|তাই কঙ্কালগুলিকে ঘিরে থাকা ঘন কুয়াশা সামান্য ফিকে হলেও, একেবারে সরানো হয়ত আর কোনওদিনই সম্ভব হবে না।শোনা যায় এই হ্রদে এমনও কিছু স্থান আছে, যেখান থেকে মানুষ আর কখনো ফিরে আসে না। সে রহস্য বুকে নিয়ে কঙ্কাল হ্রদ চির রহস্যের এক আধার হয়ে রয়েছে।


"Roopkund lake's skeleton mystery solved! Scientists reveal bones belong to 9th century people who died during heavy hail storm". India Today. 31 May 2013. Retrieved 12 June 2013.

Hari Menon (8 November 2004)."Bones Of A Riddle". Retrieved31 May 2013.

"National Geographic expo solves Roopkund skeleton mystery".Deccan Herald. 30 October 2004. Archived from the original on 14 May 2014. Retrieved 29 May 2013.

"Roopkund's human skeletons go missing". Deccan Herald. 24 September 2007. Archived from the original on 28 January 2015. Retrieved 31 May 2013.

Vicki, Pomeroy (2007). Deep in the Indian Himalaya. Garhwal Publishing. p. 63.ISBN 9780615156972.




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror