অভিশপ্ত মরিস গাড়ি
অভিশপ্ত মরিস গাড়ি


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (1914 -1918) ঘটনাটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত| কিন্তু এই ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের পিছনে কোন কারণটি সবথেকে বেশি মাত্রায় কাজ করেছিল, তা আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন না|
যদি বলি, একটি অভিশপ্ত মোটর গাড়িকে কেন্দ্র করেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়! ভাবছেন, পুরোটাই হয়তো লোকমুখে শোনা| তবে এ প্রসঙ্গে বলি, ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই মোটর গাড়ির অলৌকিক ভৌতিক কাহিনী বোধহয় সবাই জানেন না| এই গাড়িটির দীর্ঘ জীবনে কত লীলাই না ঘটেছে, কত ঘটনার শোচনীয় পরিণতি, কত প্রমোদ ভ্রমণের মর্মান্তিক যবনিকাই এতে পড়েছে - তা বলে শেষ করা যায় না|
ঘটনাটি ফ্রান্সের| জন পলসন নামে এক জনৈক ফরাসি মোটর মিস্ত্রি বহু অর্থ ব্যয় করে লাল রঙের একটি মরিস গাড়ি তৈরি করেছিলেন| গাড়িটিকে বিশ্ব ইতিহাসে স্থান করে নেওয়ার মতন করেই বানানো হয়েছিল| গাড়িটির নির্মাতা এই আশায় নিজের ঘর বাড়ি পর্যন্ত বন্দক রেখেছিলেন| তার যথাসর্বস্বই এতে নিয়োগ করা হয়েছিল| প্যারিসের রঙের ব্যবসায়ী এক অভিজাত ও ধনী, গাড়িটি কিনবেন বলে কথা দিয়েছিলেন|
কিন্তু এমনটা শোনা যায়, গাড়ির কাজ যখন অন্তিম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল তখন সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি হঠাৎ শেয়ার বাজারে সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন| পলসনের তখন মাথায় হাত পড়ল | গাড়িটি এতোটাই অধিক মূল্যের ছিল যে, রাজ রাজড়া ব্যতীত কারুরই সেই গাড়ি কেনার ক্ষমতা ছিল না| ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজাদের কাছে পলসন গাড়িটিকে কেনার জন্য অনুরোধ করে চিঠি পাঠালেন|
অস্ট্রিয়ার আর্কডিউক ফার্ডিনান্ড প্যারি বেড়াতে এসে স্বচক্ষে গাড়িটি দেখেও গেছিলেন| শোনা যায় তার নাকি গাড়িটি দেখে অত্যাধিক পছন্দ হয়ে যায়| তিনি প্যারিসে এসে টাকা পাঠিয়ে দিলেন| সেই সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন তার নিজের ড্রাইভার কেও- গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য|
কিন্তু এরপর ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে বদলে যায়| এমনটা লোকমুখে শোনা যায় যে জন পলসন গাড়িটির নির্মাতা হলেও সেই টাকা আর ভোগ করতে পারেননি| তার নিজের হাতে গড়া গাড়িই নাকি তাকে চাপা দিয়েছিল|
প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি ছিল কিছুটা এরকম, ডিউক এর নিজের ড্রাইভার নতুন গাড়িটির কলকব্জা তখনও ভালো করে আয়ত্ত করতে পারেননি| গাড়িটি ব্যাক করাতে গিয়ে যত বিপত্তি ঘটেছিল| পলসন ঠিক গাড়িটির পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন| গাড়িটি একেবারে পলসন এর উপরে গিয়ে পড়ল, আর সেই আঘাতেই তিনি পরলোক গমন করলেন|
ডিউক এর লাল মরিস গাড়ি রক্তে লাল হয়ে ভিয়েনায় প্রবেশ করল| গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে এক অলৌকিক অভিশাপ ও যেন অগোচরে অনুসরণ করল| 1914 সালের 28 শে জুন সার্বিয়ার সেরাজেভ শহরে আর্থ ডিউক এই গাড়িতেই বেড়াতে বেরিয়ে সস্ত্রীক এক আততায়ীর হাতে নিহত হন| এর ফল স্বরূপ অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার কাছে কৈফিয়ৎ চেয়ে পাঠাল| তারপরেই শুরু হল 1914-18 সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ|
কথায় বলে, অভিশাপ নাকি পিছু ছাড়ে না| সাধারণ একটি বিষয় হঠাৎ অসাধারণ কর্মকাণ্ডের রূপ ধারণ করেছিল| এই যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন| সর্বনাশা মোটরগাড়িটিই এর জন্য দায়ী ছিল| অভিশাপ বহন করে গাড়িটি এমন প্রচন্ড এক লোকক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করেছিল|
ঘটনা যে এখানেই শেষ হয়েছিল এমনটা কিন্তু নয়| গভর্নরের গ্যারাজে গাড়িটি রেখে দেওয়া হয়েছিল| গাড়িটির ধারেকাছেও কেউ ঘেঁষত না| হঠাৎ একদিন একদল কৌতুহলী ছেলে গাড়িটি দেখতে গিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়| একসঙ্গে ত্রিশটি ছেলে বিস্ফোরণে তখনই প্রাণ হারায়| অপয়া গাড়িটি মনে মনে সেদিন বলেছিল - "আমাকে বন্দি করে রাখলে কি হবে! আমার রক্ততৃষ্ণা এখনো মেটেনি"|
এরপর যে ঘটনাটি ঘটে তা ছিল আরো ভয়ানক| অস্ট্রিয়ার বিজয়ী সামরিক শাসন কর্তা কিছুদিন বাদে প্যারিসে আসেন| তিনি ডিউক এর বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন| সেই বাড়িতে বাস করবার সময় গাড়িটা আবার ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন তিনি| তারও দুর্দৈব শুরু হলো - ভ্যালেডোর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে তিনি উন্মাদ হয়ে যান|
অস্ট্রিয়ার পরবর্তী সামরিক শাসক গাড়ি চড়ে সৈন্যবাহিনী দেখতে বেরোলেন| পথের মাঝে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিতে গাড়িটা পথভ্রষ্ট হয়ে দুজন পথিককে চাপা দিয়ে দ্যানিউব নদীর জলে গিয়ে পড়ল| ড্রাইভার ও সামরিক শাসক দুজনেই জলে ডুবে মারা গেলেন|
সবথেকে বড় অদ্ভুত ব্যাপার ছিল এটিই যে, গাড়িটির সাথে কোন বিপর্যয় ঘটলেও, গাড়িতে অবস্থানকারী মানুষেরাই মারা যেত| কিন্তু গাড়িটি অক্ষতই থাকত|
অভিশাপ এবার বুলগেরিয়ায় প্রবেশ করল| মন্ত্রীর গাড়ি সোফিয়া শহরে ঢোকার পথেই আরেকটি চলতি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেলো| মন্ত্রী আর তার ড্রাইভার তো মারা গেলেনই তার পাশাপাশি অন্য গাড়িটিতে এক নব দম্পতি হানিমুনে বেরিয়েছিলেন, তারাও মাঝপথে খুন হলেন|
গাড়িটি এবার মন্ত্রীর ভাইপো ডাক্তার ফার্বসের হাতে এলো| সাত দিনের মধ্যেই ডাক্তার মদ ভেবে এক তীব্র বিষ পান করে ইহলোক ত্যাগ করলেন| তার স্ত্রীকে সন্দেহ ক্রমে পুলিশ গ্রেফতার করল| বিনা দোষেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল|
এরপরে গাড়িটির মালিক হন একজন রোমান চিত্রশিল্পী| তিনি গাড়িটির প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, গাড়ির ভিতরেই নাকি রাতের বেলায় শুয়ে থাকতেন| একদিন পথচলতি এক চোর তাকে সেখানেই খুন করে রেখে গেল| তারপর থেকে রাত্রে মাঝেমধ্যেই সেই রোমান লোকটির প্রেতাত্মাকে গাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত|
রোমান লোকটির সমস্ত সম্পত্তি তার পাওনাদাররা এক দালালের হাতে দিয়ে দিল| জাহাজ কোম্পানির একটি বিরাট কন্ট্রাক্ট তার হাতে আসার কথা ছিল| যেদিন চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হবে সেদিনই মহানন্দে গাড়িটি চড়ে সপরিবারে তিনি গ্রামে বনভোজনে গেলেন| ফেরার পথে এমন এক জায়গায় তিনি আটকে পড়লেন যে, চুক্তিতে তার স্বাক্ষর করা আর হয়ে উঠলো না| এর ফলে সেই দালাল রাগের চোটে গাড়িটিকে সুইজারল্যান্ডের এক ঘড়ির কারিগড়কে কে বেচে দিলেন|
সুইজারল্যান্ডের লোকটির ঘড়ির কাজে যথেষ্ট সুনাম ছিল| গাড়িটি কেনার পর থেকেই তার ঘড়ির ব্যবসায় মন্দা দেখা দিল| তার পরিবারের সকলে মিলে ওই গাড়িটি করে জুরিখ যেতে গিয়ে কুয়াশায় পথ হারিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেলেন| গাড়িটি খাদে পড়ে গেলেও পরে সেটিকে অক্ষত অবস্থাতেই পাওয়া গেছিল|
এরপর গাড়িটি কেনেন স্যার হার্সফেল্ড নামের এক ইংরেজ ভদ্রলোক| অপয়া গাড়িটি এবার চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ডে ঢুকলো| স্যার হার্সফেল্ড গাড়িটি করে বিয়ে করতে চললেন| বিয়েতে কোন বিঘ্ন ঘটলো না| কিন্তু বিয়ে করে ফেরবার পথে ঘটলো দুর্ঘটনা| নব বরবধূ সহ চার জন বরযাত্রী কে নিয়ে গাড়িটি সোজা সমুদ্রের মধ্যে ডুবে গেল|
পরের দিন 1927 সালের 15 ই জুন এর খবরের কাগজে এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল| রহস্যজনকভাবে যাত্রীসহ ডুবে গেল গাড়ি| খবরের কাগজে খবর প্রকাশিত হলো - "গতকাল রাত্রিতে স্যার হার্সফেল্ড অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও প্যারিসের জন পলসন নামক এক জনৈক ফরাসি মোটর নির্মাতার একমাত্র সন্তানকে বিয়ে করে প্রচলিত রীতি লংঘন করতে সাহস করেছিলেন|"
অর্থাৎ জন পলসন এবং তার পরিবারের সাথে জড়িত সকলকেই এই অভিশপ্ত গাড়িটির জন্য পরলোক গমন করতে হয়েছিল| এইভাবে এই অভিশপ্ত মরিস গাড়িটি শেষ পর্যন্ত তার নির্মাতার বংশ কেও ধ্বংস করে দিয়ে নিশ্চিহ্ন হল|