Sanchari Bhattacharya

Horror Fantasy Thriller

4.4  

Sanchari Bhattacharya

Horror Fantasy Thriller

সে এসেছিলো একদা

সে এসেছিলো একদা

14 mins
1.1K



||প্রথম খন্ড||


নীলাঞ্জনা একজন লেখিকা| তার কাছে লেখাটা পেশা নয়, নেশা বলতে পারেন| সব কাজের সাথে পেশাদারী কথাটা যোগ করা যায় না- এমনটাই তার বিশ্বাস| যখন যে লেখাতেই হাত দিক না কেন, সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে লেখাগুলো| তবে ইদানিং নীলাঞ্জনা একটু মনমরা হয়ে পড়েছে| যে বাড়িটিতে নীলাঞ্জনা পেইং গেস্ট হিসেবে থাকে, সেখানে মানুষজন ক্রমশ বাড়ছে|


 নীলাঞ্জনার বাড়ি কলকাতায়, চাকরি সূত্রে তাকে নারায়ণপুরে আসতে হয়েছে| স্কুল টিচারের চাকরি পেয়েছে সে| সারাদিন স্কুলে খাটাখাটনি করে ফেরবার পরে, একটু লেখালেখি না করলে শরীর থেকে পরিশ্রান্তির ভাবটা ঝেড়ে ফেলা যায় না| কিন্তু মানুষজনের চিৎকার-চেঁচামেচি বেড়ে যাওয়ায়, লেখালিখির কাজটা বেশ অনেকদিন ধরেই স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে নীলাঞ্জনা| বাড়িওয়ালার নিজস্ব বন্ধুবান্ধব তো ছিলই, সেই সঙ্গে তার ছেলেপুলেরা বড় হচ্ছে, তাদের বন্ধুরা ও একে একে এসে জুটছে- আর হৈ-হুল্লোড় বাড়ছে| নীলাঞ্জনার অর্থের কোন অভাব নেই| কলকাতায় বাবার বিরাট ব্যবসা, এছাড়াও তার বাবা মস্ত বড় উকিল| মা ব্যবসাপাতির কাজ দেখেন| তিনিও উচ্চশিক্ষিত| তবে নীলাঞ্জনার ইচ্ছা ছিল শিক্ষিকা হবার| ব্যবসার কাজ তার মাথায় কোনদিন ঢোকে না| সেই জন্যই সবকিছু ছেড়ে নারায়ণপুরের মত দূর দেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে সে| সারাদিন স্কুল আর সন্ধ্যের পর থেকে লেখালিখিই তার সঙ্গী| সারাদিন স্কুলের ধকল সামলে, বাড়ি এসে একটু জিরিয়ে যখন ঠান্ডা হয়ে লেখালেখিতে বসবে, তখনই শুরু হবে ছেলে বুড়োর গ্যাঞ্জাম| কান পাতাই দায় হয়, লেখা তো দূরের কথা|


 বাবার কাছে অর্থসাহায্য না চাইলেও, নীলাঞ্জনার উদ্দেশ্যে একটি মোটা অঙ্কের টাকা জমা হয়ে যেত তার ব্যাঙ্ক একাউন্টে| মায়ের এই সদিচ্ছাকে কোনদিন অপমান করতে পারেনি সে| শিক্ষিকা হিসেবে বেতন পাওয়ার পাশাপাশি, এই মোটা অঙ্কের অর্থটিও মাসে মাসে জমা হতো তার ব্যাঙ্ক একাউন্টে| শেষ পর্যন্ত আর না পেরে যে বাড়িটায় ও থাকতো সেখান থেকে শুধু নয়, শহর থেকেই বেশ খানিকটা দূরে, একটা ছোট মতন পুরনো বাড়ি কিনেই ফেলল নীলাঞ্জনা|


 শিক্ষিকা হলেও স্বভাবে ডাকাবুকো প্রকৃতির মেয়েই সে, একা একটি বাড়িতে থাকাটা তার কাছে খুব একটা বিপদজনক বলে মনে হয়নি| শান্তিতে লেখালিখি করতে পারার মত একটি জায়গা পেলেই হল, তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো ওই বাড়িতে গিয়ে পাকাপাকিভাবে থাকার|


||দ্বিতীয় খন্ড||


 জিনিসপত্র নিয়ে যখন তার সদ্য কেনা 

 বাড়িটায় এসে পৌঁছলো নীলাঞ্জনা, তখন বেলা পড়ে এসেছে| সামনে পেছনে বেশ খানিকটা জমি নিয়ে তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা বাড়িটা| বেড়ার গায়ে ছোট্ট গেট| যেদিন বাড়িটা দেখতে এসেছিল বাড়িটাকে ঘিরে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঝোপজঙ্গল দেখে বিরক্ত হয়েছিল সে| দালালের কথায় কোনরকমে আশ্বস্ত হলেও কাজের কাজ যে কিছু হয়নি, তা দেখে বিরক্ত নীলাঞ্জনা গেট পেরিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই দেখতে পেল, বন্ধ বাড়িটার ভেতরে, দোতলায় বন্ধ কাঁচের জালনায় মুখ ঠেকিয়ে লণ্ঠন হাতে একটা বুড়ো মতন লোক ওকে দেখছে|


" ও নিয়ে আপনি ভাববেন না| কেয়ারটেকার আছে| ও সব ঠিক করে দেবে"- লোকটিকে লন্ঠন হাতে দেখে দালালের কথাগুলি মনে পড়ে গেল নীলাঞ্জনার|


 নীলাঞ্জনা লক্ষ্য করল লোকটার হাতের লণ্ঠন টা হাওয়ায় দুলছে, লণ্ঠনের আলোর তীব্রতা দেখে তার মনে পড়ে গেল সন্ধ্যে হয়েছে|


" আগের দিন তো একে দেখিনি, ও এই তাহলে কেয়ারটেকার? কিন্তু সেদিন ওকে দেখি নি কেন? " ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে এগোলো নীলাঞ্জনা| বাড়িটার সামনে ঝোপঝাড় ভর্তি হয়ে গেছে, অপরিষ্কার হয়ে পড়ে রয়েছে চারিদিক| কোন এক সময় যে বাড়িটা কে খুব সযত্নে আগলে রাখা হতো তার ছাপ এখনো বেশ স্পষ্ট| নীলাঞ্জনা আজকে আসবে জেনেও, বাড়িটাকে এত অপরিষ্কার করে রাখা হয়েছে কেন! সেটা বুঝতে না পেরে সে একটু চটে গেল| কেয়ারটেকারকে গিয়েই ধরতে হবে- এমনটাই মনে হলো তার| আরো কিছুদূর এগিয়ে যাবার পরে সে দেখতে পেলো সদর দরজাটা খুলে পুরো বাইরে বেরিয়ে এসেছে বুড়ো ভদ্রলোকটি | সদর দরজার কাছে পৌঁছে নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে পড়ল| ওর মনে হয়েছিল বুড়ো ওকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে যাবে ভেতরে| হাজার হোক এই বাড়িটার মালিক এখন সে| বুড়োর কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সে তার নিজের মতোই ঝাড়লন্ঠন টা হাতে নিয়ে নীলাঞ্জনার মুখের দিকে অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে রইল| ডান হাতে লন্ঠন টা নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ইশারায় নীলাঞ্জনাকে ভেতরে যেতে বলল|" লোকটা কি বোবা নাকি কালা"? মনে হলেও মুখে কিছু বলল না নীলাঞ্জনা|


 ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই হঠাৎ করে নাকে এলো এক অদ্ভূত পচা গন্ধ| একবার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠলো|


"এ সমস্ত কি ! বাড়িটা একটু পরিষ্কার করে রাখতে পারোনি?"- ভয়ে নীলাঞ্জনার গলাটা একটু বেশী রকম জোরে হয়ে গেলো |নীলাঞ্জনা লক্ষ্য করলো, বুড়োটা হাতে লণ্ঠন নিয়ে ঠক ঠক করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে |কোন ভাবান্তর নেই | নীলাঞ্জনার এতগুলো কথা লোকটার কানেই গেল না, সাড়াশব্দহীন| যেন শুনতেই পায়নি| নীলাঞ্জনার মুখ দিয়ে ভয়েতে কথাটা বেরিয়ে গেল, "আশেপাশে দেখে সত্যিই ভয় করছে, একটুও ভালো লাগছে না, কোথায় এলাম রে বাবা?"


 বুড়োটার পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ক্রমশ বিমর্ষ হয়ে পড়ছিলো নীলাঞ্জনা| তার আঠাশ বছরের জীবনে এই প্রথম এমন একটা ভয় পেয়ে বসলো, যার স্বরূপ সে ধরতে পারছে না| সমগ্র বিষয়টাই কেমন যেন ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে|


 চারিদিকে শুধু মাকড়সার জাল, চলতে চলতে জড়িয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে| মৃতদেহের মতো ঠান্ডা পরিবেশ| উদভ্রান্তের মতো এদিকে-ওদিকে দৃষ্টি গেলেও কালো জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না| নিজেকে সেই অন্ধকারের মধ্যে থেকে টেনে বার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে নীলাঞ্জনা, অথচ পারছে না| বাড়িতে ঢোকার সময় থেকেই তার পায়ে পায়ে কি যেন জড়িয়ে যাচ্ছে, পায়ের দিকে চোখ যেতেই চোখে কিছুই ঠাহর হচ্ছে না| মনে হচ্ছে পায়ের নীচে যেন কোন মৃতদের স্তূপ শুয়ে রয়েছে, রাতের স্টেশনের প্লাটফর্মের মত? পায়ে জুতো, তাই বোঝারও উপায় নেই|


 মনে মনে বিড়বিড় করল নীলাঞ্জনা, " বলিহারি এই লণ্ঠন টা বুড়োর! কোথায় অন্ধকার ঘুচবে তা নয়, লোকটাকে ঘিরেই যত অন্ধকার"| নীচু হয়ে দেখারও কোন অবকাশ নেই, কোন কিছুই নজরে এলো না|


 দোতলায় পৌঁছে, বিশাল বারান্দা পার হয়ে বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তের ঘরের সামনে এসে পৌঁছনো পর্যন্ত পদে পদে ঠোক্কর খেতে খেতে নীলাঞ্জনার প্রায় টালমাটাল অবস্থা তখন| নিজে ঠোক্কর খেলেও সে ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে, বুড়োটা চলেছে সোজা| একবারও ঠোক্কর না খেয়ে, একঘেয়ে একটা ছন্দে ঠক ঠক করতে করতে| এত অন্ধকারের মধ্যে তার নিজের যখন এই হাল, তাহলে লোকটা কিভাবে সামনের দিকে সোজা হয়ে এগিয়ে যেতে পারে? বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলেও এই সময় মাথায় ঢুকতে চাইছে না নীলাঞ্জনার |


 এরপর একটা ঘরের সামনে এসে লণ্ঠনটা কে সোজা করে ধরলো বুড়োটা| লন্ঠনের আলোয় যতটুকু চোখ পড়ল তাতে সামনে রাখা পিতলের তালা টা বেশ চকচক করছিল| বুড়ো ঘরের তালা খুলে দিলে, ভেতরে ঢুকে নীলাঞ্জনা একটু স্বস্তি পেল| ঘরের ভেতর জমাট বাঁধা অন্ধকার টা এখনো কাবু করছে তাকে, পরিষ্কার করে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে| তবুও অনুভবে বুঝল, ঘরটায় মাকড়সার জাল টাল তেমন নেই| পচা গন্ধটাও ঘরের মধ্যে আর পাওয়া যাচ্ছে না| মনে হয় যেন কিছুটা পরিষ্কারই| ব্যাগের থেকে মোমবাতি আর দেশলাই বার করে একটা টেবিলের উপর রাখলো নীলাঞ্জনা| দেশলাই দিয়ে মোমবাতিটা জেলে দেখল ঘরের মধ্যে সবকিছুই বেশ সুসজ্জিত রয়েছে| চারিদিকে ঘুরে দেখতে গিয়ে হঠাৎ নীলাঞ্জনার খেয়াল হল, " আরে, ওই বুড়োটা কোথায় গেল?" সে দরজা পর্যন্ত এসে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল একবার| কিন্তু চারিদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে বুড়োর লণ্ঠনের চিহ্ন ছিল না কোথাও|


" যাক গে, ঘরে পৌঁছে তো দিয়েই গেছে| ওর আর কি কাজ? আর ওই কালা বোবা কে দিয়ে হবে টাই বা কি?" দরজাটা বন্ধ করে পাশে রাখা পুরনো দিনের একটি ভাঙা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসলো নীলাঞ্জনা| সোজাসুজি চোখ পড়ল সামনের জানালাটার দিকে, বাইরের হাওয়া আসছে, মৃদু ফুরফুরে হাওয়ায় জানলার পর্দাটা আলতোভাবে উড়ছে| বাইরে থেকে তখনও হাওয়ার মধ্যে দিয়ে সেই পচা গন্ধটা আরও একবার নাকে এলো ওর| এত সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাড়িটাকে এত নোংরা ও কুরুচিকর করে রাখবার মধ্যে কি আছে? তা বুঝে উঠতে পারল না নীলাঞ্জনা| এত বাজে গন্ধ কিসের হতে পারে? 


 গন্ধটা যতবার নাকে আসছে শরীর মন, যেন ভেঙে আসছে| সেই কোন সকালে খাওয়া হয়েছে, ভেবেছিল কেয়ারটেকার যখন আছে খাবার দাবারের ব্যাবস্থা ওকে দিয়েই করিয়ে নেবে| সঙ্গে কফি আছে আর কি চাই? নীলাঞ্জনার মাথায় আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই, মস্তিষ্ক একেবারে ফাঁকা| খাবার-দাবার তো দূরের কথা, কোন চিন্তাই সেখানে ঢুকছে না | একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারলেই সে বাঁচে এখন| ঘুমটাই বড্ড দরকার|


 বাইরে প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি শুরু হল, জানালার কাঁচের ওপর বৃষ্টির ছাটের আওয়াজটা পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল| ঘরটার আলো-আঁধারিতে বসে, ঝিমতে ঝিমতে একসময়ে নীলাঞ্জনার মনে হল, এতটা ভয় বোধহয় না পেলেও চলত| কিছুতেই চেয়ারটা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছিল না ওর, তবুও উঠতে হল| মোমবাতি পুরো পুড়ে যাবার আগে রাতের পোশাক পড়ে নিয়ে বিছানায় চলে যাওয়া ভালো| জায়গাটা বড্ড নিঝঝুম| বৃষ্টির রাতটাও ভুতুড়ে| মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে আর যদি না আসে? 


 শেষপর্যন্ত ভয়ে ভয়ে সেই মাঝরাতেই ঘুমটা ভেঙে গেল নীলাঞ্জনার| কেমন একটা অদ্ভূত ভয় যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তাকে| হঠাৎ মনে হল বিছানা থেকে কেউ যেন তার পাটা ধরে সজোরে টানদিয়ে মেঝেতে ফেলে দিতে চাইছে| বিছানা বালিশ টেনে ওকে খাট থেকে নীচে ফেলে দিয়ে একে একে হ্যাচকা টান মেরে বিছানা-বালিশ সব কেড়ে নিতে লাগলো কেউ|" কে? কে?" করে দুবার চেঁচিয়ে উঠলো নীলাঞ্জনা| ভয়ে গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ| ঠিক সেই সময়ে বিশাল ঘরটার চতুর্দিক থেকে অন্ততপক্ষে পাঁচ ছটা মৃদু ফিসফিসে গলা ওকে বলে উঠলো| ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে নীলাঞ্জনা বলে উঠলো, " কে? কে?"


||তৃতীয় খন্ড||


 ঘরের মোমবাতিটা কখন যেন নিভে গেছে| প্রবল ভয়ে খাটের পায়াটাকে আঁকড়ে ধরে কালিগোলা অন্ধকারের মধ্যেও চোখ বন্ধ করে বসে নীলাঞ্জনা স্পষ্টই বুঝতে পারছিল একটা ভারী শরীর থপ থপ করে অনবরত ঘরময় হেঁটে চলেছে | কতক্ষণ এইভাবে ও বসেছিল জানেনা| চেতন অবচেতনের মাঝামাঝি একটা জায়গায় অস্পষ্ট ধোঁয়াটে অনুভব এর মধ্যে ভারি পায়ের থপ থপ আওয়াজ, আর মৃদু ভুতুড়ে গলায় অদ্ভুত একটা ছন্দে, "কে? কে?" শুনতে শুনতে চেতনা বিলুপ্ত হয়ে গেল ওর|


 ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা| টেবিলের উপরে রাখা মোমবাতি জানলা দিয়ে আসা দমকা হাওয়ার ঝটকায় ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল| শান্ত পরিবেশের মধ্যে কার যেন ফিসফিসানি| অচেতন অবস্থায় পড়ে রইলো নীলাঞ্জনা| বেশ অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরে, হঠাৎ করে একটা প্রচন্ড জোরে শব্দে জ্ঞান ফিরল নীলাঞ্জনার| রাত এখন কত? বোঝার উপায় নেই| প্রচন্ড জোরে এক শব্দে ওর চেতনা ফিরেছে| কিন্তু- ধারে কাছে তো একটাও বাড়ি নেই| এই শূন্যস্থানে এত জোরে আওয়াজ তবে কোথায় হল? কটা বেজেছে বুঝতে না পারলেও নীলাঞ্জনা বুঝল তখন রাত হয়েছে|


 শীত করছে| কোনরকমে উঠে ব্যাগ থেকে আর একটা মোমবাতি হাতরে বার করলো নীলাঞ্জনা| দেশলাই কাঠি দিয়ে আগুন জেলে কোনরকমে টেবিলের উপর রাখল মোমবাতিটিকে| ঘুম তো আর আসবেনা| শোবেই বা কোথায়| খাটের বিছানাপত্র একটাও যে নেই, মোমবাতির আগুনে তা দেখাই যাচ্ছিলো| আর ঠিক এই সময়েই নীলাঞ্জনার নজরে পড়লো ঘরময় বড় বড় পায়ের ছাপ| যেন ছাই মাড়িয়ে এলোমেলো হেঁটে গেছে কেউ| বিবর্ণ ধূসর সেইসব ছাপ| নিজের মনকে সান্তনা দেওয়ার মতো অবস্থাও তার আর নেই| বৈষম্যহীন অন্ধকার তার গোটা ভুবনকে যেন গ্রাস করে রেখেছে| মোমবাতির অংশটুকু আলোকিত হলেও ঘরের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ টা তখনও বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন| মাথাটা ভার হয়ে রয়েছে| গা বমি বমি করছে|


 হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল কারা যেন ফিসফিসিয়ে "কে? কে?" করছিল? "এই তো|এখানে"| পাঁচ ছটা গলার ফিসফিসে সেই আওয়াজ, ঘরের ভেতর থেকেই এল! ঘরের চারিদিকটা ভালো করে দেখে ও নীলাঞ্জনা কাউকে দেখতে পেল না| চোখেমুখে অসম্ভব ভয়, বুকের ভিতর উন্মাদনার তীব্র ধুকপুকুনির শব্দ শুনতে পেল সে| ভয়ে ও আতঙ্কে প্রায় অপ্রকৃতিস্থ নীলাঞ্জনার গলা শুকিয়ে গেছে, থেকে থেকে পেটে টান ধরছে| তার ওপরে এই ধকল| সঙ্গে জলের বোতল আছে| কিন্তু সেটা পেতে গেলে একটা আলো অন্তত দরকার| মোমবাতি টা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে| ওই নিভন্ত আগুনটাও আর জ্বলতে চাইছে না| ওটা থাকতে থাকতেই একটা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে| যে করেই হোক| কোনরকমে হাতরে হাতরে ঘরের মাঝখানে রাখা টেবিল টা পর্যন্ত গিয়েই ওর নজরে এলো একদিকের দেওয়ালে একটা দেওয়াল ল্যাম্প আছে| "ও বাঁচা গেল"| এবার অন্তত একটু আলোর মুখ দেখা যাবে| শুকনো গলাটা একটু ভিজিয়ে নিতে হবে- এটা ভেবে নীলাঞ্জনা উঠতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় ওর সামনে এসে দাঁড়ালো একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি| হেঁটে হেঁটে এল না সে, যেন তার সামনে ভেসে উঠলো| আর ওই ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো সামনের দিকে| রক্তে ভেজা দুটো হাত, টপ টপ করে রক্ত চুইয়ে পড়ছে, নীলাঞ্জনা কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল দেওয়ালের দিকে|


 আঠালো রক্তে চটচট করছে নীলাঞ্জনার সমস্ত শরীর,ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে, মোমবাতির আলোটা নিভে যাচ্ছে আবার জ্বলে উঠছে, দেওয়াল ল্যাম্পের আলো টা দপদপ করছে| একবার জ্বলছে একবার নিভছে| এবার পুরোপুরি সব অন্ধকার, এক নিমেষে চারিদিক কালো ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে গেল| নীলাঞ্জনা আবার অসহায়| চারিদিকে আবার সেই সব অদ্ভুতুড়ে ফিসফিসে শব্দ|পরিষ্কার করে কিছুই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না|অজানা আতঙ্কের হাতছানি |গোটা শরীরটা জুড়ে শিরশিরানি |মাথা দিয়ে ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে|আবার ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো নীলাঞ্জনা |চারিদিকটা আবার নিস্তব্ধ|


||চতুর্থ খন্ড||


 চোখে আলো পড়তে আসতে আসতে জ্ঞান ফিরতে লাগলো নীলাঞ্জনার | খানিকক্ষণ শুন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সে মেঝের উপর| নীলাঞ্জনার মুখের সামনে বুড়োটা এসে দাঁড়িয়েছে, চোখের ঠিক সামনে বুড়োর মুখ, এই বাড়িতে এসেই যাকে দেখেছে| হাতে লন্ঠন টা তুলে ধরে নীলাঞ্জনার মুখের পানে চেয়ে আছে বুড়ো| লন্ঠনের আলোয় এই প্রথম বুড়োর মুখখানা ভালো মতন নজরে এলো নীলাঞ্জনার| খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ, রুক্ষ কর্কশ মুখে দুটো চোখ আগুনের মতো জ্বলছে| সারা শরীরে দগদগে ঘা, যেন মাংস খসে পড়ে গেছে| লোকটার কি কুষ্ঠ হয়েছে? ভিতরে ভিতরে ঘৃণায় গুটিয়ে গেলেও এতক্ষণ পরে একটা মানুষ আর আলো পেয়ে যেন মরতে মরতে বেঁচে উঠলো নীলাঞ্জনা| মুখ দিয়ে চিৎকার করতে গিয়েও দমটা কেমন যেন আটকে গেল| মনে হল বুড়োটা কিছু না করেও যেন তার মুখ টিপে ধরেছে| মাথায় যে কথাগুলি ঘুরছিল, মুখ দিয়ে তা প্রকাশ করবার ক্ষমতা নেই নীলাঞ্জনার| কোন রকমে ঢোক গিলতে গিলতে সে নিজেকে প্রস্তুত করল বুড়োটার উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য|


" ও আপনি? এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আলো নেই, খাবার নেই- কিচ্ছু নেই| এগুলো কি আপনার দেখার কথা নয়? আমি তো এদিকে- খিদে তেষ্টায় মরতে বসেছি প্রায়"|


" খিদে পেয়েছে? খিদে পেয়েছে?" ফিসফিসিয়ে বলতে বলতে বুড়োর আগুনের গোলা চোখ দুটো চকচক করে উঠলো লোভে| নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে ভাবলো, " খিদে তো আমার পেয়েছে| বুড়োর চোখ লোভে চমকায় কেন? মাথা খারাপ নাকি?" বিড়বিড় করে বলল, " যাক লোকটা তাহলে বোবা নয়,কালাও নয়"|


" এক্ষুনি আনছি" বলতে বলতে বুড়ো ততক্ষনে লন্ঠনটা সমেত হাওয়া| হেঁটে তো গেল না যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল| নীলাঞ্জনা মনে মনে বলতে লাগল, " আমারও কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? এসব কি দেখছি আমি!" ঘরময় আবার অন্ধকার|" রাত শেষ হতে আর কত বাকি"? রকমারি ভাবনায় নীলাঞ্জনার মাথার মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে|" আর বেশি দেরি নেই"| দুচোখ জড়িয়ে মাথাটা আবার বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছিল, এমন সময় ফিসফিসানি কথাটা শুনে চমকে মুখ তুলল নীলাঞ্জনা| কে বলল? সে তো কাউকে কিছু বলেনি| এ উত্তর তবে কে দিলো? 


 লণ্ঠনের আলোটা যে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে, ঘরের খোলা দরজা দিয়ে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল| নীলাঞ্জনা চনমনিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠলো একটু| যাক বুড়ো তাহলে এদিকে আসছে| সারারাত ধরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তার অবসান হয়তো ঘটতে চলেছে| আস্তে আস্তে এগোতে এগোতে দরজার কাছে পৌঁছে গেল লণ্ঠনের আলো| অবসন্ন নীলাঞ্জনা বসে ছিল চুপ করে| দরজা জুড়ে এসে দাঁড়ালো বুড়ো, এক হাতে সেই লন্ঠন, অন্য হাতে ছোট একটা থালার ওপর বীভৎস একটা কাটা মুন্ডু- রক্তে ভেসে যাচ্ছে| থালা ছাপিয়ে রক্তের ধারা মেঝের ওপর পড়তে লাগলো ঝর ঝর করে| নিজের চোখে কি দেখছে নীলাঞ্জনা বিশ্বাস করতে পারলো না? সামনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে রক্ষক নাকি ভক্ষক? এই প্রশ্নের মীমাংসা করবার মতো পরিস্থিতি আর নেই| ভয় পেয়ে হাত পা আরো সিঁটিয়ে গেল তার| বুড়োর কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখগুলো যেন জ্বলজ্বল করে সেই কাটা মুন্ডুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে| আর একটা চোখ দিয়ে সামনে বসে থাকা নীলাঞ্জনা কে দেখছে, এরপরে যেন তার পালা|


 বুড়ো আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে নীলাঞ্জনার দিকে| কাঁধের ওপর রক্তাক্ত একটা গহ্বর| চোখের সামনে এক্ষুনি যাকে জল জ্যান্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, এখন সে দেখছে মুন্ডহীন কেউ এগিয়ে আসছে তার দিকে| বুড়োটা নিজের মাথাটাই কেটে থালায় সাজিয়ে এনেছে নীলাঞ্জনাকে খেতে দেবে বলে| আতঙ্কে নীলাঞ্জনার মাথার সমস্ত চুল খাঁড়া | বুড়ো এগিয়ে আসতে লাগল| শেষ মুহূর্তে নীলাঞ্জনা জ্ঞান চৈতন্য কিছুটা ফিরে পেয়ে, কোনরকমে সমস্ত শক্তি জোর করে উঠে দাঁড়ালো| মনের মধ্যে শুধু একটি বিষয় কড়া নেড়ে যেতে লাগলো আর দেরী করলে হবে না, এবার পালাতে হবে| যে করেই হোক, এক্ষুনি এই মুহূর্তে, বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে| নীলাঞ্জনার চোখ পরল ঘরের দরজার দিকে, " দরজাটা তো খোলাই রয়েছে| কোনরকমে বুড়োর চোখ এড়িয়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারলেই শান্তি|তারপর তরতর করে কোন রকমে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব|"


" ভয় পাচ্ছো কেন? ভয় কি| আমি তো রয়েছি"| কাঁধের ওপর মুন্ডহীন রক্তাক্ত গহ্বর নিয়ে, ফিসফিসিয়ে বলতে বলতে থালাটা নীলাঞ্জনার দিকে বাড়িয়ে দিল বুড়ো| চোখের সামনে বুড়োর লণ্ঠনের ঘুমন্ত নীলচে আলো, চারিদিকে চাপচাপ অন্ধকার| সেই মৃত্যুহীম অন্ধকারের মধ্যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো নীলাঞ্জনা এপার আর ওপার এর সীমানার কাছে| কাটা মাথাটা দিয়ে তাজা তাজা রক্ত বেয়ে বেয়ে পরছে থালার উপরে| বুড়োটা তারপর দুটো হাত বাড়ালো, এক হাতে থালা থেকে তুলে নিল রক্তঝরা কাটা মুন্ডু, অন্য হাতে চেপে ধরল লন্ঠন টা| একসাথে দুটোকেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল প্রাণপনে| হিমশীতল কাটা মাথা, লণ্ঠনের মৃত্যুহীম আলোয় ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে গেল নীলাঞ্জনার গরম ছুটন্ত রক্তের শরীর| বুড়ো তার মাথাটা ছাড়িয়ে নিল নীলাঞ্জনার হাত থেকে| নীলাঞ্জনার হাতটা তখনো ঠক ঠক করে কাঁপছে, মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারছেনা সে| চোখের সামনে নিজের মৃত্যুকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে | যাকে দেখতে পাচ্ছে সেইই তবে এখানে কোন এক সময় এসেছিল, কিন্তু এখন আর জীবিত নেই| এতদিন মৃতপ্রায় মানুষকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েছে সে, কিন্তু কোন মৃতদেহ কে এভাবে কাটা মুন্ডু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি| 


||পঞ্চম খন্ড||


বুড়োটা তখনও নিজের কাটা মাথাটা হাতে নিয়ে হি হি করে হাসছে, " আমার পরিচয়টা দেওয়া হয়নি তোমাকে, যদিও তুমি জানো, তবু বলি| আমার নাম মুকুন্দ নারায়ন চৌধুরী| এই বাড়িটায় আঠেরোশো পঁচাত্তর থেকে আছি| তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় বাড়িটিকে আগলে রেখেছি| দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর এই ভাবেই আগলে রেখেছি এই সাধের বাড়িটিকে| অতিথি আপ্যায়ন তো দূরের কথা অতিথির আনাগোনাই একেবারে ছিল না, অনেকদিন বাদে আপনাকে দেখে মনের মধ্যে আবার বাঁচার স্বপ্ন ফিরে এলো| তাহলে আপনার হাতে এই বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে আমি বরং নিশ্চিন্তে যেতে পারি|"


 নীলাঞ্জনা হতভম্বের মত তাকিয়ে রয়েছে সেই মৃত বুড়োর দিকে, যা দেখছে এবং শুনছে সে গুলি কি আদৌ সত্যি? বুড়োর কথাগুলো শুনতে শুনতে, নীলাঞ্জনা অনুভব করল তার হৃদস্পন্দন যেন ধীরে ধীরে থেমে আসছে| সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে আসছে| হৃদয়ের মধ্যে ধুকপুক করা প্রাণটা যেন এবার বেরিয়ে যাবে| আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে তার শরীরটা মাটিতে| সেই সময় বুড়োটা আবার কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল, " এবার তবে আমার রিটায়ারমেন্টের সময় এসে গেল, এবার আমি যাব| চলো আমায় এগিয়ে দাও|"


 যেভাবে নীলাঞ্জনাকে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল বুড়ো ঠিক সেইভাবে- লন্ঠন হাতে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নীলাঞ্জনা| বাড়িতে ঢোকার সময় সে যেরকম বুড়োটার পিছু নিয়েছিল, এখন বুড়োটা তার পিছু পিছু আসছে| নীলাঞ্জনার চোখের পলক পরছে না, শরীরে আর প্রাণ নেই| নিথর একটি দেহ| নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে| সে সদরে পৌঁছে দরজাটা খুলে দিল হাট করে | বেরিয়ে যেতে যেতে, বুড়ো পিছনের দিকে চাইল একবার| এরপর আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল|


 নীলাঞ্জনার শরীরটা আস্তে আস্তে দরজাটা বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগল| যে ঘরে সে এতক্ষণ ছিল সেই ঘরের চৌকাঠের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে| হাতে লন্ঠন এর আলোটা নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকলো | নিজের নিথর দেহটার পাশে লন্ঠন রেখে বসল সে, " আজ থেকে এ বাড়ির আমিই কেয়ারটেকার"|


 ঠিক তার পরেই লন্ঠন টা দপ শব্দ করে নিভে গেল


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror