মাতৃত্বের সুখ
মাতৃত্বের সুখ


অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো সুমিত । ফেরবার পথে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা কিনে নিলো ও। সুতপার খুব পছন্দের ফুল রজনীগন্ধা। রজনীগন্ধার গুচ্ছ দিয়ে সারা বাড়ি সাজিয়ে রাখে ও বিশেষ কোনো দিনে। আজও তো ওদের জীবনের একটা বিশেষ দিন। আর তাই সুতপা খুশি হবে বলে ও একটু বেশি করেই রজনীগন্ধা কিনলো। আজ কত বছর পর ওদের জীবনে এই সুন্দর দিনটা এলো। কতো অপেক্ষার পর এই সুখবর এলো ওদের দাম্পত্যে। অফিস যাবার পথেই ডঃ রায়চৌধুরীর চেম্বারে গিয়েছিল ও সুতপার রিপোর্টটা আনতে। ডঃ রায়চৌধুরী সুতপার ব্যাপারে কোনো রিস্ক নিতে চাননি, আর তাই ক্লিনিক্যালি সমস্ত রিপোর্ট দেখে তবেই কনফার্ম হয়েছিলেন সুতপার ব্যাপারে। সুতপা ওদের বিয়ের দশ বছর পর সন্তানসম্ভবা হলো। কতো বড়ো খুশির খবর এটা ওদের জীবনে সেটা সুমিত আর সুতপা ছাড়া কেউ জানে না।
ওদের বিয়ের পাঁচ বছর পরেও যখন সন্তান হয়নি, তখন শ্বশুরবাড়িতে সবাই কম গঞ্জনা, অপমান করেনি সুতপাকে। সুমিত কতো বুঝিয়েছিল সেই মূহুর্তে ওর মা, বাবা, বাড়ির লোকজনকে। কিন্তু ওরা কিছুতেই এই ব্যাপারে আপোষ করতে রাজি হয়নি। পদে পদে সুতপাকে অপমান করা ছাড়াও, সুমিতের মন টাকেও ওর বিরূদ্ধে বিষিয়ে দিতে চেয়েছিল ওর বাড়ির লোক। সুমিতকে এটা পর্যন্ত বলেছিল , সুতপাকে ডিভোর্স করে যেন অন্য মেয়েকে বিয়ে করে।যে ওকে পিতৃসুখের আনন্দ দিতে পারবে।
"এই বাঁজা মেয়েমানুষের সঙ্গে থেকে কেন নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছিস বল তো তুই? কি এমন রূপে তোকে বশ করেছে ও। আমরা তোকে আরোও ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দেব। "সুমিতকে যখন এধরণের অশ্রাব্য কথা ওর দিদি শোনাচ্ছিলো, সুমিত আর থাকতে না পেরে সেদিন রাতেই সুতপাকে বলেছিল, এ বাড়িতে ওরা আর থাকবে না। যে বাড়িতে ওর স্ত্রী কে এই ভাষায় অপমান করা হয়, সে বাড়িতে ও কিছুতেই আর থাকবে না। আর তাই পরদিন সকালেই সুমিত, সুতপাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ওর বাপের বাড়িতে গিয়েছিল। তারপর ওখান থেকেই একটা ঘর দেখে , সুতপাকে সঙ্গে নিয়ে ওখানেই ওদের দুজনের নতুন সংসার শুরু করেছিল। যেখানে সুতপাকে কেউ কখনও অপমান করবে না ,এই বলে যে ওর বাচ্ছা হয়নি।
অথচ সুমিত জানে একথা যে, সুতপা বিয়ের পর থেকেই কতো সুন্দর ভাবে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। কখনও কোনো ব্যাপারে ও অভিযোগ করেনি। সুমিতের বাবা মায়ের দেখাশোনা থেকে শুরু করে, ওর বিবাহিতা দিদির যখন তখন ওদের বাড়িতে চলে আসা, সব কর্তব্যই সুতপা মুখ বুজে পালন করতো। এমনকি দিদি সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফেরবার সময় সুতপা ওদের রাতের খাবার পর্যন্ত বানিয়ে দিতো।অথচ এই দিদিই সুতপার বাচ্ছা হয়নি বলে কতোরকম ভাবে ওকে হেনস্থা করেছে। সুমিতের একথাও মনে আছে, সেবছর ওর ছোট বোনের সাধ ভক্ষণের অনুষ্ঠানে সুতপা সারাদিন খেটে কতো রান্না করেছিল বোনের জন্য, বাকি সকলের জন্য। কতো খুশি ছিল ও , বাড়িতে নতুন ছোট্ট অতিথি কদিন পর আসবে বলে। সুতপা সেদিন খুব যত্ন করে বোনের জন্য সাধ ভক্ষণের থালা সাজিয়ে দিয়েছিল নিজের হাতে তৈরী করা বিভিন্ন পদের রান্না দিয়ে। থালাটা বোনকে ধরে দিয়ে বেচারি দাঁড়িয়েছিল ওখানেই। ঠিক তখনই বড়দি আর মা মিলে ওকে সবার সামনে এই কথা বলে সরে যেতে বলেছিল যে,ও থাকলে নাকি বোন আর তার গর্ভের বাচ্ছার জন্য অশুভ হবে । সুতপা সেদিন দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। সুমিতও ওর পেছন পেছন গিয়েছিল ঘরে। সুতপা সুমিতকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল সেদিন। আজ সুতপার সেইসব কষ্টের অবসান হলো। ওর কোল আলো করে ,ওর ঘরেও আসবে নতুন অতিথি।
ডঃ রায়চৌধুরীর পরামর্শে সুতপা ঠিক সেভাবেই সাবধানে ছিল , যেভাবে ওকে থাকতে বলা হয়েছিল। আজ সুতপার সাধ ভক্ষণের অনুষ্ঠানে সুতপার আবদারেই সুমিত ওর মা, বাবা, দিদি ,বোন সবাইকে আসতে বলেছে। যতো যাই হোক ,সুতপা মনে করে ওদের বংশের প্রথম সন্তান আসছে। আর তাই ওদেরও সমান অধিকার আছে , ওদের উত্তরসূরীকে আশীর্বাদ করবার। ডঃ রায়চৌধুরী পরদিনই সিজারের ডেট দিয়েছিলেন। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে সুতপা অসহায়ের মত তাকিয়েছিল সুমিতের দিকে। সুমিত ওর হাত দুটো ধরে ওকে সাহস দিচ্ছিলো। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডঃ রায়চৌধুরী বলেছিলেন সুন্দর, ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে তোমার। সুমিত আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল। সুতপার জ্ঞান আসার পর যখন ছোট্ট পুতুলের মত বাচ্চাটাকে ওকে দেখানো হয়েছিল, ওর বুকের কাছে দেওয়া হয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য, এক অদ্ভুত সুখানুভূতির সঞ্চার হয়েছিল ওর সারা শরীরে, মনে। মাতৃত্বের অনুভূতি যে এতো সুখ এনে দিতে পারে, তা ও প্রতি মূহুর্তে নিজের সন্তানকে বুকের কাছে পেয়ে উপলব্ধি করছিল। পৃথিবীর সমস্ত পার্থিব সুখ এর কাছে তুচ্ছ। আনন্দে ওর চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়েছিল। মাতৃত্বের এই অসাধারণ অনুভূতি সত্যি বলে প্রকাশ করা যায় না। এই অনির্বচনীয় সুখকে শুধুমাত্র উপলব্ধি করা যায়।