মার্কিনি চাষীমা
মার্কিনি চাষীমা
আমার পান্ডিত্যের পুরস্কারে সেবার আমেরিকা যেতে হলো।
বিশাল ব্যাপার। থাকলাম শহরের মাঝে একটা হোটেলে। ইউনিভার্সিটি শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে। গাড়ি করে নিয়ে যান এক বৃদ্ধ মানুষ বেশ ভোরে। সারাদিন কাজ। রাতে খেয়ে দিয়ে তিনিই ফেরত আনেন হোটেলে। সুন্দর কাজ,সুন্দর ব্যবস্থা। শনিবার ছুটি থাকে ,কিন্তু আমার জন্যে ওটাও কাজের দিন। আমি খুব খুশি ,একা একা কি করবো। রবিবারটা ছুটি। আমাকে যাঁরা ডেকেছেন জিজ্ঞেস করলেন রবিবারের জন্যে কিছু করতে হবে কিনা। সারা সপ্তাহ আমার সঙ্গে ,ওদেরওতো ঘর সংসার আছে। তাই আমি ওদের ছুটি দিলাম। বললাম শহরের বাইরে কোনো গ্রাম যদি থাকে তো নিজেই ঘুরে আসতে পারবো। আমাকে হোটেলের কাছেই একটা স্টেশন দেখিয়ে দিলেন। ওখান থেকে সারা দিন ট্রেন পাওয়া যায়। চারটে স্টেশন ছাড়লেই গ্রাম। নামটা লিখে নিলাম।
পরদিন উঠলাম একটু দেরীতে। ভালো করে স্নান করে ভালো করে ব্রেকফাস্ট খেলাম যাতে দিনের খাবার না খেলেও অসুবিধে না হয়। কে জানে গ্রামে খাবার দাবার মিলবে কি না। স্টেশন হাঁটা পথ, রিটার্ন টিকিট কিনে উঠে পড়লাম ট্রেনে। গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছলাম একটা নাগাদ। ঝলমল করছে চারদিক। ফেরার ট্রেনের খবর নিলাম, কোনো চিন্তা নেই, বেশ রাত অব্দি ট্রেন আছে।
স্টেশনের পাশে বিশেষ কিছু নেই। যেদিকে চোখ যায় আঙুরের খেত। বর্ধমানে ছোটবেলায় দেখেছি ধান ক্ষেত্। তার চেয়েও বড়ো আঙুরের খেত। মাঠে কাজ করছে অল্প বয়সী কজন ছেলে আর মেয়ে, আঙুর কাটছে কাঁচি দিয়ে আর ঝুড়িতে রাখছে। তারপর আসলো একটা গাড়িতে চেপে ছোট হাফ ডজন খুদে। হৈ হৈ করতে করতে তারাও আঙুর কাটার কাজে নেমে পড়লো, ঠিক যেমন ধান কাটার সময়ে সবাই মিলে ধান কাটে সেইরকম। আমাকে আলাদা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটি ছেলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো আমি আঙুর কাটতে এসেছি কিনা। বললাম আমার পরিচয় আর জানালাম কেউ শিখিয়ে দিলে আমিও আঙুর কাটতে পারি।
আমাকে মাঠের মাঝে নিয়ে গিয়ে একটা কাঁচি আর একটা ঝুড়ি দিলো, বুঝিয়ে দিলো কোন কোন থোকা কাটতে হবে।
আমার শিখতে সময় লাগেনি, আর আমার হাত ছোট, আমার আঙুলের গতিবেগ ওদের সবাইকার থেকে বেশি। তাই আমার ঝুড়ি ভরতে সময় লাগলোনা।বেশ কঝুড়ি আঙুর তুললাম খেতে রাখা ট্রেলরে। সময় কাটলো হু হু করে। পাঁচটা নাগাদ ট্রেলর ভর্তি হলো। বাচ্ছারা ছুটি নিলো, সবাইকে এক থলি আঙুর আর পারিশ্রমিক দেওয়া হলো। আমি ফেরার জন্যে তৈরী। যাদের খেত তাদের একজন আমাকে পারিশ্রমিক দিতে আসলো। আমি নিলাম না, বললাম সবাই মিলে কাজ করেই যা আনন্দ পেয়েছি ওটাই যথেষ্ট।
নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ওদের সঙ্গে যেতে বললো। আমার যাবার খুব ইচ্ছে তবু ইতস্তত করলাম, বাড়ির অন্যেরা কী ভাববেন। শুনলোনা আমার কথা, প্রায় জোর করেই নিয়ে গেল ওদের বাড়ীতে। খেত ছাড়িয়ে একটু দূরে বাড়ী। কাঠের তৈরী বেশ বড়। নতুন লোক দেখে বেড়িয়ে এলেন গৃহক
র্ত্রী। ছফুট লম্বা, বিশাল দেহ। বোঝাই যাচ্ছে রান্না করছিলেন, কোমরে গামছা, মাথায় রুমাল। ছেলে মেয়েরা পরিচয় দিলো আমার, মহিলা তাঁর বিশাল খাবার মধ্যে আমার হাতটা ধরে বললেল ভেতরে আসতে। নাম বললেন জুলি।
ভেতরে আসতেই তাঁর কমান্ডার -ইন -চিফের মূর্তি প্র্র্রকাশ পেলো। আমার পা থেকে মাথা দেখে প্রথম অর্ডার,'যাও ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে এসো খাবার টেবিলে। আমার রান্না তৈরী।'
বসলাম একটা লম্বা কাঠের টেবিলে আটজনের বসার চেয়ার। রান্না ঘর থেকে মা নিয়ে আসলেন একটা বড় হাঁড়ি ভর্তি সুপ্; পাশেই রাখা লোহার উনুন থেকে বেড়োলো বিশালকায় পাঁউরুটি। বোম্বাই হাতা দিয়ে সবাই সুপ্ নিলো নিজের নিজের প্লেটে।দু হাতার কম কেউ নিলোনা। আমি হাফ হাতাতেই খুশি, মায়ের তীখ্ন দৃষ্টি, কিন্তু কোনো কথা বললেন না। সামনে প্লেট ভর্তি সুপ্, কেউ খাচ্ছে না। আমি বুঝলাম সবাই কমান্ডের জন্যে অপেক্ষা করছে। মা বসলেন টেবিলের মাথায়। হাত জোর করে প্রার্থনা করলেন, আমেন বলে শেষ করলেন। ওটাই খাবার শুরু করবার কম্যান্ড। বড়ো বড় পাউরুটি দিয়ে সুপ্ কমিনিতে শেষ।
মা উঠে পড়লেন, সঙ্গে দুই কন্যা রান্না ঘরের দিকে।
ফিরলেন একটু পরেই। একটা ঠেলা গাড়ি থাক থাক দেওয়া। থাক থেকে এক একটা প্লেট এক এক জনের সামনে রাখতে শুরু করলেন। সঙ্গের দুই কন্যা - একটা প্লেট রাখছেন মা, প্রথম কন্যা চকোলেট রঙের ঝোল ঢালছে, অন্যজনা একটা চিমটাতে ধরে আধা কিলো সবুজ পাতা দিয়ে ঢাকছে মায়ের রান্না। সিঁদুর পরিয়ে লজ্জাবস্ত্র দিয়ে নতুন কনের মতো। আমার সামনে মা, দিলেন তাঁর হস্ত শিল্প -আমার মুখে বাক্যি নেই। কমপক্ষে দেড় কিলো ওজনের হাড্ডি ছাড়া মাংসোর রোস্ট, এক ইঞ্চি উঁচু বারো বাই আট সাইজ। আমার মুখে কি যেন দেখলেন, সবাইকে পরিবেশন করে ব্যাক - টু -আমার পাশে।ততক্ষনে সিঁদুর পড়ানো, লজ্জা বস্ত্র ঢাকা হয়ে গ্যাছে। করুণ মুখে আমি আর্তি জানালাম, অন্তত চারভাগের তিন ভাগ থেকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু দয়াহীন মাতৃ হৃদয় একটুও গললো না। ছোট্ট কম্যান্ড, Eat Sonny, চুপচাপ খেয়ে নাও পুত্তুর।
আমরা সবাই খেলাম, সব কিছু খেয়ে থালা সাফ করে খেলাম; বাঘের মতো মাংস খেলাম, ছাগলের মতো পাতা চিবলাম। একমনে খেয়ে তবেই মাথা তুললাম - মা দেখছেন আমাকে। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই মুখ থেকে বেড়িয়ে আসলো,'কী অপূর্ব রান্না; আমার ছোটবেলার মায়ের হাতের মতো।' মার্কিনি মায়ের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি আমার বাঙ্গালী মায়ের মতন এক্কেবারে এক।
ট্রেনে চেপে ফিরছি। বুঝেছি আজ, শহরের মানুষেরাই দেশ ভাগ করে। মাটির সঙ্গে যারা থাকে তাদের চোখে মাটির রং, গাছের রং দেশের রঙের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় না। সব দেশের চাষিরা মাটির সঙ্গে খেলা করে, সেই মাটি ধরিত্রী - দেশ নয়। সব চাষীমায়েরা একই ভাবে সন্তানকে বলে, Eat Sonny, সমান মমতা ভরে।