ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
খুব বড় রিস্ক নিয়ে ফেলল রুদ্র । আরণ্যক বসুরায় এখন একটি জ্যান্ত লাশ । তথাপি একটি অ্যাম্বুলেন্স এনে বিছানাসমেত বসুরায়কে তুলে নিল অ্যাম্বুলেন্সে । ওরা মা ও ছেলে আরণ্যকের বাড়িতে তালা লাগিয়ে নিয়ে এল তাদের বাড়িতে । যথাসম্ভব ঘটনাটি গোপন রেখে ।
এই সংবাদ পায়নি অরবিন্দ সরখেল। সম্ভবতঃ তাকে লুকিয়ে রাতারাতি চলে এল নিজের বাড়িতে। তাঁকে রাখা হল একটি ঘরে।
গোপালকৃষ্ণ এতে খুশি হলেন কি না জানি না; রুদ্রকে বললেন - চীনা লামাকে ঘরে তুললি ?
বনলতা দেবী খেঁকিয়ে উঠলেন।
- একটা অসহায় লোককে কোথায় ফেলে দিয়ে আসব?
বিবেক বলে তো একটা কথা আছে !
- বিবেক !
হাসলেন গোপালকৃষ্ণ চাকলাদার পেশাগত জীবনে যিনি একজন ব্যারিস্টার ।
- তোমার ওই ফরমালিন মাখানো বিবেক রেখে আসতেই পারতে !
রুদ্র ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল - আ: বাবা ! কি করছেন বলুন তো ? আবার কার্গিলের যুদ্ধ শুরু করলেন ?
মা যা করেছেন; ঠিক করেছেন । সত্যিই তো ! এমন একজন নিশ্চল মানুষকে কার কাছে ছেড়ে আসতেন ? কে আছে ওর তিনকুলে - আমরা ছাড়া !
ক্ষুব্ধ গোপালকৃষ্ণ বাবু আর কিছু বললেন না । একবার ভুগো বাছাধন তখন বুঝবে আমি ঠিক না তোমরা ঠিক। মনে মনে গজরাতে লাগলেন ।
বনলতা দেবী কল্যাণীকে বললেন - বৌমা ! তোমার কষ্ট বাড়িয়ে দিলাম । আর কষ্ট কি ? আমি তো এখনও সক্ষম আছি । কণা যেমন করত তেমনি না হয় - মানিয়ে নেব।
পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে গেল আরণ্যকের । অন্তত তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটল ।
এবার কনকলতার পারলৌকিক ক্রিয়াটুকু পার হলেই শান্তি ।
বিধান নিতে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ডেকে আনা হল । ভট্টাচার্য্য মহাশয় বিধান দিলেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু মানেই অপঘাতজনিত। সুতরাং দশদিন ধরে অশৌচ কর্ম না করলেও চলবে । তা-ছাড়া, ওনার যখন ছেলেপুলে নেই তখন তিনদিনেই শ্রাদ্ধশান্তি করে নেওয়া বিধেয় ।
গোপালকৃষ্ণ নিজের হাতে দায়ভার নিলেন । রুদ্র শ্রাদ্ধ করল ।
চতুর্থ দিনে একদল বৈষ্ণব এসে নামগান করল । রুদ্রর মনে হল বৈষ্ণবদের মধ্যে একজনের চেহারা অবিকল অরবিন্দের মত দেখতে ।
রুদ্র তার পোষাক-আশাক, চাল-চলন, কথা-বার্তার ধরণে কিছুই বুঝতে পারল না । তখনকার মত সে পরিচ্ছেদ সমাপ্ত হল ।
তারপর যথারীতি অফিসে যাওয়া, মেসোমশাইয়ের ডাক্তার ঔষধাদি ঠিক মত চলছিল । কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ লেগেই থাকত । এ নিয়ে রুদ্র মনে একটা অসন্তোষ ছিলই । কিন্তু মা বাবা বলে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারত না ।
কল্যাণী একদিন রুদ্রকে বলল - দু'বছর পিত্রালয়ে যাইনি। এবার পূজোয় তাকে নিয়ে যেতে হবে ।
রুদ্র বলল - এই অবস্থায় যাওয়া কি ঠিক হবে ? দেখ যদি মা বাবা উভয়েই অনুমতি দেন ; আমি না হয় পৌঁছে দিয়ে আসব ।
কল্যাণী বলল - বাবা রাজী হয়েছেন । মা -ই শুধু কিন্তু কিন্তু করছেন ।
- ওরে বাবা ! তবে তো যাওয়া হবে না।
কল্যাণী চুপ করে গেলে রুদ্র বলল - আচ্ছা, আমি দেখব মাকে রাজী করানো যায় কি না । চিন্তা কোরো না ।
কল্যাণীর চিন্তা বেড়ে গেল । মেসোমশাই না থাকলে মা ঠিক রাজী হয়ে যেতেন । এখন যত সমস্যা তো তাঁকে নিয়েই । সে চলে গেলে বনলতা দেবীর উপর চাপ বাড়বে। তাই তো তিনি সম্মতি দিচ্ছেন না ।
বনলতা দেবী কল্যাণীকে ডেকে বললেন - বৌমা ! তুমি হয়তো ভাবছ আমার কষ্ট হবে বলে তোমাকে আটকাচ্ছি । ঠিক কথাই তো ! গত দুবছর যাওনি। এ বছর আর তোমাকে বাধা দেব না । তুমি পূজোটা বাপের বাড়িতে কাটিয়ে এস।
কল্যাণীর বুকে খুশির বন্যা বয়ে গেল । তার মনে হল মাটি ফুঁড়ে জলের ফোয়ারা ফুটছে যেন ।
বলল - মা ! আপনার তেমন মনে হলে একটা ফোন করে দেবেন; আমি পটকাদার সাথে চলে আসব ।
- না মা ! বিয়ে হওয়া থেকে তো ফুরসৎ পাওনি । এমনকি পটকার বিয়েতেও যেতে পারনি । এ বছর পূজোয় সবাই মিলে আনন্দ করে এস ।
গোপালকৃষ্ণ পিছন থেকে টিপ্পনী কাটলেন - এস, গৌর আসরে ! সেই মন খসালে তো এত নাটক করার কি দরকার ছিল শুনি ! নাকি আমি রাজী হয়েছিলাম বলে তুমি বেঁকে বসেছিলে ।
- কি যা তা বল ? যত বুড়ো হচ্ছ তত দুর্মতি বাড়ছে।
সবাই তখন একযোগে হেসে উঠলেন।
রাত তখন দু'টো কি তিনটে হবে । সকলেই অঘোরে ঘুমোচ্ছে । বাড়ির ফাঁকা লনে একটা বিড়াল একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে। এপার্টমেন্টের সকলের ঘুম ভেঙে গেল । বাড়ির পুরুষেরা টর্চ , লাঠি নিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিড়ালটা কোথায় বসে কাঁদছে।
রাত দুপুরে বিড়াল কাঁদা শুভ লক্ষণ নয় । আর এই এপার্টমেন্টে মা ষষ্ঠীর বাহনের অভাব নেই । তবু এই আপাত নিরীহ প্রাণীটির প্রতি সকলের মমত্ববোধ রয়েছে। ভোজনের এঁটো - কাঁটা খেয়ে থাকে। অসুবিধা বলতে নোংরা করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করে না ।
সবার মনে একটা অজানা আশঙ্কার সঞ্চার হয়েছে। একটানা কেঁদে যাচ্ছে বিড়ালটা । কি জানি বাবা কার কি ক্ষতি হয় !
একসময় কান্না থেমে যায়। আর প্রতিবেশীদের একজন সাততলার কিঙ্কর পতিতুণ্ডের বাড়ি থেকে কান্নার রোল শোনা গেল । বিড়াল ছেড়ে সকলে মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিঙ্কর বাবুর এপার্টমেন্টে। শোনা গেল তাঁর একমাত্র পুত্র আমেরিকা প্রবাসী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার যযাতির পথ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।
বনলতা দেবী বললেন - দেখলে তো বিড়াল কান্নার ফল । মারাত্মক ক্ষতি অনিবার্য । এবার ওদের কি হবে?
গোপালকৃষ্ণ বাবু বললেন - এর সঙ্গে দুর্ঘটনার যোগ কোথায় ?
- ওটাই তো ! যোগ তো একটা নিশ্চয় আছে। নইলে বেড়ালটা কিঙ্করবাবুর দরজাতে গিয়ে এমন করে কাঁদবে কেন ! ওটা হয়তো জানিয়ে দিতে এসেছিল ।
গোপালকৃষ্ণ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন কথাটা । যত্তোসব!
রাতটুকু কাটল প্রবোধ দিতে দিতে । ভোরের আলোয় যখন গাছে গাছে পাখি ডাকল, শাখে শাখে ফুল ফুটল, কিঙ্করবাবুর গাছের শেষ কুঁড়িটিও শুকিয়ে গেল ।
যযাতির মা ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন । কিঙ্করবাবু নির্বাক । এই কার্তিকেই ছেলের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। যত দোষ গিয়ে পড়ল সেই অভাগা মেয়েটির উপর । যে বিনা দোষে দণ্ড পেল ।
কল্যাণী প্রথমে ভেবেছিল মেসোমশাইয়ের যা অবস্থা তাতে তাঁর কিছু হতেই পারত। ততটা দুঃখ থিকত না । এ যে বিনা মেঘে বজ্রপাত ।
গোপালকৃষ্ণ একবার আরণ্যকের রুমে গেলেন । দেখে নিলেন উনি ঘুমোচ্ছেন কি না । তারপর নিজের ঘরে এসে বসলেন । কিঙ্করকে কি বলে সান্ত্বনা দেবেন ভেবে পেলেন না।
বিকেল নাগাদ আমেরিকা থেকে শবদেহ এল বিমানবন্দরে । লাউঞ্জের বাইরে শবযান অপেক্ষারত । কফিনে ঢাকা দেহ যখন বাড়ি পৌঁছাল তখন প্রায় রাত হয়ে গেছে।
শ্মশানে নিয়ে যাবার জোগাড় শেষ হতে হতে আবার সেই রাত একটা । রুদ্রর মনে পড়ে গেল মাসীমাকে নিয়ে ওখানকার শ্মশানযাত্রার কথা ।
নাহ্ , এখানে কোন অরবিন্দ নেই, নেই কোন ডোম । রয়েছে জানাচেনা লোকজন আর বৈদ্যুতিক চুল্লি
রুদ্র শ্মশানে যেতে তৈরি হয়ে নিল ।
( ক্রমশ )

