Debdutta Banerjee

Tragedy

0.7  

Debdutta Banerjee

Tragedy

ললাট লিখন

ললাট লিখন

5 mins
16.6K


আনমনে রুবিক কিউবটা মেলাতে মেলাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অঙ্কন। নয় ঘরের ছ'টা চৌখুপিকে জায়গা মত সাজিয়ে ছ'টা রঙ আলাদা করে খাপে খাপে বসাতে ওর বেশি সময় লাগে না। কিন্তু একেক সময় মনে হয় যদি জীবনটাও এমন সহজ সরল হত ! যদি সব কিছু এমন খাপে খাপে মিলে যেত! কিন্তু অঙ্কনের জীবনটা একটা ঘেঁটে যাওয়া রুবিক কিউবের মতো। কিছুতেই সেটাকে আর সাজিয়ে তুলতে পারছে না সে। 

সামনের বাড়ির বাগানে বাসি প‍্যান্ডেলের কাপড় খুলছে ডেকরেটার্সের লোক। মল্লির বিয়ে হয়ে গেলো। একটু আগেই এক গা গয়না পরে স্বামীর সাথে ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে করে ভবিষ‍্যতের পথে পা বাড়িয়েছে মল্লি। কোমল এসেছিল বোনের বিয়ের জন‍্যই। পাঁচ বছর পর কোমলের সাথে অঙ্কনের দেখা। আরো সুন্দর হয়েছে কোমল। বিয়ের জল আর নিশ্চিত ভবিষ‍্যত ওর সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়েছে। আড় চোখে অঙ্কনকে দেখলেও সামনে এসে কথা বলেনি কোমল। অবশ‍্য বলার আর ছিলোই বা কি। সব কথা তো পাঁচ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছিল। 

অথচ একটা সময় এমন ছিল অঙ্কনকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারতো না কোমল। ওকে পড়তে নিয়ে যাওয়া, গানের ক্লাসে পৌছানো, আঁকার ক্লাসে নিয়ে যাওয়া সব অঙ্কনের দায়িত্ব ছিল।

দুই বাড়ির সকলেই জানত ওদের সম্পর্কের কথা। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ঠেলে আসে অঙ্কনের ভেতর থেকে। পশ্চিম আকাশে সিঁদুর গুলে বিদায়রত দিবাকর আর ঘরে ফেরা পাখির কলকাকলী যেন ওকে ব‍্যঙ্গ করছে মনে হয়। এমনি এক গোধূলীর কনে দেখা আলোয় কোমলকে সম্পুর্ন নিজের করে পেতে গিয়েও ও পায়নি। অলক্ষ‍্যে কে যেন হেসে ওঠে, পরিস্কার শুনতে পায় অঙ্কন। এক অদৃশ‍্য গলা ব‍্যঙ্গ করে বলে, -"পাওনি ! নাকি গ্ৰহণ করতে ভয় পেয়েছিলে ? পালাতে চেয়েছিলে?"

চারপাশের গাছ পালা, ফুল, পাখি, সবাই যেন গলা মেলায় -"পালাতে চেয়েছিলে। তুমি ভীতু, কাপুরুষ...."

দু হাতে কান চেপে মেঝেতেই বসে পড়ে অঙ্কন। সহ‍্য হয় না। এর চেয়ে কোমল যদি সেদিন সপাটে একটা চড় মারত হয়তো আজ এতটা কষ্ট হত না। 

কাঁধের উপর একটা নরম হাতের স্পর্শ আর চুরির রিনরিনে আওয়াজে বাস্তবে ফেরে অঙ্কন। 

আধো অন্ধকারে মৌলীর মুখটা দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। ওকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে শক্ত করতে চায়। মৌলীর দু চোখের কোল ভিজে ওঠে।

আজ আর ঘুম আসবেনা অঙ্কনের। মৌলীর বাবার দেওয়া বড় ডিভানটায় এপাশ ওপাশ করে কিছুক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থেকে অবশেষে উঠে পড়ে। বারান্দায় এসে বুক ভরে শ্বাস নেয় অঙ্কন। বাতাসে বেল ফুলের মিষ্টি গন্ধ। চোখ বন্ধ করে সেই গন্ধটা অনুভব করতে চায় ও। দূরের গির্জার বড় ঘড়িতে দুটো ঢং ঢং আওয়াজ ঘোষনা করে মধ‍্যযাম শেষ। 

মল্লিদের বাড়িটা ঝিমিয়ে পড়া চায়না টুনির সাজে এখনো আলো ছড়াচ্ছে। সেই রাতেও এমন করেই সেজেছিল বাড়িটা। বাড়ির মানুষগুলোও খুব আনন্দে ছিল। আত্মীয় সমাগমে বাড়ি ভরে উঠেছিল।  হঠাৎ মল্লিদের দোতলার কোণের ঘরে আলো জ্বলে ওঠায় অঙ্কন চোখ তুলে তাকায়। কাচের বন্ধ দরজা আর পাতলা নেটের পর্দা ভেদ করে একটা অবয়ব হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। কোলে বাঁদরছানার মত লটকে আছে কেউ। আরেকটা অবয়ব দ্রুত কিছু করছে। রাত্রির নিস্তব্ধতা চিরে বাচ্চার মৃদু কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। উৎসুক দুটো চোখ চেয়ে থাকে ঐদিকে। কোমল নিজের মেয়েকে দুুুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে।

কখন যে মৌলী উঠে এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়েছিল অঙ্কন টের পায়নি। আবার যখন একটা ভরসার হাত এগিয়ে আসে, ও নিজেতে ফেরে। 

বিয়ে বাড়িতে কোমলের ডল পুতুলের মতো মেয়েটাকে দেখেই আদর করতে ইচ্ছা করছিল।দু'চার পা হাঁটে, আর আধো আধো উচ্চারণে বা, মা, দা, কয়েকটা শব্দ বলেই কি খুশি একরত্তি তন্নি। বুকের মধ‍্যে চিনচিনে ব‍্যাথাটা তখনি জানান দিয়েছিল কি একটা নেই। মনে হয়েছিল নিজের অধিকার হেলায় হারিয়েছে একদিন।

মৌলীর বোবা অবুঝ দৃষ্টির সামনে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে আজকাল। মৌলীর কোনো দোষ নেই। তবুও বিধাতা ওকে জড়িয়ে দিয়েছে অঙ্কনের সাথে। ওর পাপে আজ মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।

কোমলের সাথে বিয়ের শপিং শুরু হয়েছিল। আশির্বাদ উপলক্ষ‍্রে সেজে উঠেছিল ওদের বাড়ি। ঠিক তিনমাস পর বিয়ে। কদিন থেকেই পেটে ব‍্যাথাটা বেড়েছিল কোমলের। অনিয়ম, শপিং এ গিয়ে উল্টোপাল্টা খাওয়া , তাই পাত্তা দেয়নি। সেদিন নার্সিংহোমে নিয়ে যেতেই ধরা পড়ল ওভারী জুড়ে চকলেট সিস্ট, একটা ওভারী পুরো বাদ গেছিল। বড় অপারেশন। দশদিন ওখানেই থাকতে হয়েছিল কোমলকে। ডাক্তার বিশ্বাস অঙ্কনকে ডেকে বুঝিয়েছিল ভাগ‍্য ভালো হলে একটা ওভারী নিয়েও মা হওয়া যায়। যে ধকল গেছে মেয়েটার শরীর ও মনের উপর, তাতে অঙ্কনকেই ওকে সামলে রাখতে হবে। অঙ্কনের সহযোগিতা ভীষণ প্রয়োজন কোমলের। 

বাড়িতে সবার মুখ ভার। বংশের একমাত্র ছেলে অঙ্কন, জেনেশুনে ঐ খুঁতো মেয়ের সাথে ওর বিয়ে কি করে হয়। মা বাবা একদম পাথর হয়ে গেছিল। জেঠিমা, ঠাকুমা, মামারা কেউ রাজি নয়। এই সিস্ট নাকি বারবার হয়। বায়পসি রিপোর্ট আসার আগেই রোগ নির্নয় হয়ে গেছিল কোমলের। অঙ্কন চিরকাল মুখ চোরা, জোরে কথাই বলেনি কখনো। এতো ধরনের আলোচনায় ও নিজের বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলছিল ধীরে ধীরে। 

অঙ্কনের বাড়ির লোক আর যায়নি নার্সিং হোমে। অঙ্কন বুড়ি ছোঁওয়ার মত রোজ একবার যেত। কোমলের মা-বাবার মুখের দিকে ও তাকাতে পারত না। কোমল বাড়ি ফিরতেই অঙ্কনের বাবা বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল। 

মল্লি এসেছিল অঙ্কনের অফিসে। অঙ্কন কথাই খুঁজে পায়নি। বাড়ির বিরুদ্ধে যেতে পারবেনা টা ছিল অজুহাত। আসলে সাহসে কুলায়নি একা এই লড়াই এ নামার।

মল্লি বলেছিল, -"একটা মেয়ের সব পরিচয় কি ঐ ইউটেরাস আর ওভারী অঙ্কনদা? দিদিয়ার মন বলে কি কিছু নেই? এটা আর তিন মাস পর হলে তুমি কি করতে? ছুঁড়ে ফেলে দিতে নিজের স্ত্রী কে? এই ভালবেসেছিলে আমার দিদিয়াকে ?"

অঙ্কন চুপ। উত্তর দিতে পারেনি। 

বাড়িতে এক দমবন্ধ পরিবেশ। মুখোমুখি বাড়ি। ভয়ে ওদিকে তাকাতো না অঙ্কন। 

মল্লি বলেছি্‌ -"ভগবান মঙ্গলময়। হয়তো আমার দিদিয়া বেঁচে গেল। ঐ পরিবারে গেলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হতো। "

-"মল্লি ..." অঙ্কন সহ‍্য করতে না পেরে বলে ওঠে। 

-"আমি চলে যাচ্ছি। তবে কাজটার ফল তোমরাও পাবে। " মল্লি আর দাঁড়ায় নি।

তিনমাসের ভেতর বাবা মা জোর করে মৌলীর সাথে অঙ্কনের বিয়ে দিয়েছিল। দেরি করলে যদি অঙ্কন মত বদলায়। উল্টোদিকের বাড়ি বলে কথা!! 

অবশ‍্য কোমল কে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অঙ্কনের বিয়ের চারমাস পর শুনেছিল কোমলেরও বিয়ে হয়ে গেছিল দিল্লিতেই। একটা ভার নেমে গেছিল অঙ্কনের বুক থেকে। যে অন‍্যায় বোধ ওকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল সবসময় সেটাও কেটে গেছিল।

অঙ্কন মৌলীকে নিয়ে ঘুরতে গেছিল ভুটান। দুর্ঘটনাটা ওখানেই ঘটেছিল। কোমরের হাড় ভেঙ্গে ছয় মাস বিছানায় ছিল অঙ্কন। আর মৌলীর ভোকাল কর্ড ছিড়ে কথা বলার ক্ষমতা চলে গেছিল। প্রান চঞ্চল মেয়েটা একটা জ‍্যান্ত পুতুল সেদিন থেকে। কিন্তু তখনো অঙ্কন জানতো না ভগবান তার পাপের অনেক বড় শাস্তি দিতে চলেছে। ধীরে ধীরে অঙ্কন জেনেছিল সে পিতৃত্বের ক্ষমতা চিরতরে হারিয়েছে। মৌলীর কোলে কেউ কখনো আসবে না। বংশে বাতি দিতে কেউ আসবে না । থাপ্পড়টা আরো জোরে মেরেছিল মল্লি। দিদিয়ার মেয়ে হয়েছে বলে মিষ্টি খাইয়ে গেছিল গত বছর সবাইকে। মৌলীকে বলেছিল,-" এবার তুমিও ভালো খবর দাও বৌমনি। "

মৌলী বাক শক্তি হারালেও মনটা একই রয়েছে। চোখের জলে বালিশ ভেজায় প্রতিরাতে। বলার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ভগবান হয়তো ওকে জিতিয়ে দিয়েছে। ওর ঐ নির্বাক চাউনির সামনে প্রতিনিয়ত অঙ্কন মরমে মরে থাকে। 

কোমল মেয়ে কোলে স্বামীর সাথে আজকাল ঘন ঘন বাপের বাড়ি আসে। ওদের বংশেও ছেলে নেই। কোমলের মেয়েই এখন সবার চোখের মনি।

#positiveindia


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy