লকডাউনের রোজনামচা ৫
লকডাউনের রোজনামচা ৫
ডিয়ার ডায়েরি, ২৯শে মার্চ, ২০২০... লকডাউনের পঞ্চম দিনে "আমার গৃহদেবতারা"
আমার ঊনত্রিশ বছরের সংসার জীবনে একটি ইষ্টদেবতার আসন পাতবো না... তাকি হয়? হয় না। সুতরাং সংসারে আর পাঁচটা শৌখিন আসবাবপত্রের মতো ঘরে এক সুন্দর ইষ্টদেবতার মন্দির আকৃতির সিংহাসনও স্থাপিত হয়েছে। যথারীতি একজন দুজন করে সেখানে দেবতারাও সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছেন। আসলে যখন যেখানে বেড়াতে গেছি তখনই সেখানে কোনো দেবস্থান বা মন্দির দর্শণ করলেই, সেই দেবতার একটি বাঁধানো ফটোও সংগ্রহ করেছি, বলাই বাহুল্যমাত্র। আজকাল তাই বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে প্রাত্যহিক দেবসেবা করতে হয়। সব কয়জন দেবতার ফটো মোছা, চন্দন পরানো, তারপর আলাদা আলাদা গোটা কয়েক ছোট্ট ছোট্ট পেতলের থালা গ্লাসে করে দেবতাদের ভোগদান করে ফুল বেলপাতা সহযোগে নিত্যপূজা। ধূপ দীপ জ্বেলে সন্ধ্যারতি। দৈনন্দিন কর্মতালিকায় আছেই। এছাড়া বিশেষ বিশেষ দিনে বাড়তি ফল মিষ্টি ইত্যাদি সহযোগে দেবতার ভোগ দেওয়া। সাধারণতঃ রবিবারে ছুটির দিন, বাড়ীতে বাড়তি সময় পাওয়া যায়, সুতরাং পাঁচরকম ফল, পাঁচরকম মিষ্টি দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে ভোগ দেওয়া হয় ইষ্টদেবতার। বিপদ হলো আজ। রবিবার, অথচ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্রের দোকান বাদে বাকি দোকানপাট মুড়ে বন্ধ। আর বাইরে বেশি দূরে গিয়ে কিছু কিনতে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ রাস্তায় পুলিশবাহিনীর নিশ্ছিদ্র টহল। উপযুক্ত কারণ না দেখিয়ে সেই ফাঁক গলে কোথাও যাওয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য কাজ। তাই আমরা অযথা সেই ঝুঁকি নিইনি। ইষ্টদেবতা তো ঈশ্বর, আর তাঁর অজ্ঞাত তো কিচ্ছু নেই। এই সঙ্কটের সময় ঈশ্বর নিশ্চয়ই বুঝবেন আমার অপারগতার কথা, অসহায়তার কথা। মনে মনে এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই পুজোয় বসলাম। ইষ্টদেবতার কাছে জানালাম, "আবার পরে ভালো করে ভোগ দেবো ঠাকুর... এখন যা আছে তাই দিলাম। সঙ্কট মোচন করো ঠাকুর। আজ ফুল নেই, বেলপাতা নেই, পাঁচ রকমের ফল নেই, পাঁচ রকমের মিষ্টিও নেই... কৌটোয় সামান্য যা ড্রাই ফ্রুট আর বাতাসা আছে তাই দিয়ে আগামী আরো অতগুলো দিন আলাদা আলাদা থালায়ও ভোগ দিতে পারবো না ঠাকুর, অপরাধ নিও না।" একটি থালায় একটি কিসমিস, একটি কাজু, একটি পেস্তা আর একটি বাতাসা আর একটি গ্লাসে জল দিয়ে আজ রবিবারের ভোগ দিলাম আমার গৃহদেবতাদের। জানি না, ঠাকুর খান কিনা! তবে আমি তো পুজো দিই আমার মানসিক প্রশান্তির জন্য। আজও তাইই দিলাম। সন্ধ্যারতি পূজা... কেবলমাত্র ধূপে ও দীপে। গৃহদেবতার ভোগের সামগ্রীটুকুও গুনে গেঁথে হিসেব করে সঞ্চয় করে রাখলাম। আমার গৃহদেবতারা শীঘ্রই সুদিন ফিরিয়ে আনুন আমার দেশ তথা পুরো বিশ্ব জুড়ে... শুধু এইটুকুই প্রার্থণা আজ আমার গৃহদেবতাদের চরণে।