কুয়াশার চাদরে...
কুয়াশার চাদরে...


“তিনদিন ধরে নিখোঁজ থাকার পর আজ অবশেষে নিলুফার বেগমের বাড়িতে বাক্সবন্দী হয়ে পৌঁছালো তার দেহের অংশ বিশেষ…”
চোখমুখে কৃত্রিম উত্তেজনা নিয়ে সংবাদটি পরিবেশন করছিলেন সম্পাদিকা; বিরক্ত মুখে উঠে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করলাম। বিগত তিনমাস ধরে এই একটাই খবর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে সকলের। আমিও প্রতিমুহূর্তে নিষ্পেষিত হচ্ছি এর সৌজন্যে। আজও বসের কাছে কথা শুনতে হলো, আজ তো তিনি রীতিমতো হুমকি দিয়ে বসলেন দুদিনের মধ্যে ভালো কিছু জোগাড় করতে না পারলে আমাকে সরিয়ে দেবেন এই কেসটা থেকে।
“প্লিজ বাবা তুমি এসব নিউজ দেখা বন্ধ করো, আর সহ্য করতে পারছিনা… আর পারছিনা…” দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলাম। বাবা আস্তে করে হাত রাখলেন মাথায়,
“শান্ত হ, একজন সাংবাদিককে আরও কত ঝড় সামলাতে হয়। এই টুকুতেই ভেঙে পড়লে চলে নাকি!”
“কিন্তু বাবা…”
“চোখ মোছ দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঠান্ডা জলে একটু স্নান কর। দেখবি ভালো লাগবে, আমিও তাই করতাম।”
বাবার গলাটা শুনলেই এক অদ্ভুত রকমের ভরসা পাই, এই চাকরিতে আসার অনুপ্রেরণাও তো আমার বাবাই। আর পাঁচটা মানুষের মত বাবা কোনোদিনও মেয়ে বলে এই প্রফেশনে আসতে বাধা দেননি, উল্টে সাহস দিয়ে গেছেন বরাবর। নিজের রুমে ফিরে এলাম, টাওয়েলটা নিয়ে বাথরুমে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে মুঠোফোনটা বেজে উঠলো রিনরিন করে, সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম তার সারা দেহ জুড়ে এখন শুধু রৌনকের ছবি। মুখটা বিকৃত করে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। এই মুহূর্তে রৌনকের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার।
*************************************************************
ফোনটা রিং হয়ে হয়ে কেটে যেতেই হতাশ রৌনক সেটা ছুঁড়ে ফেললো খাটে। সামনের ক্যানভাসে একটা অসমাপ্ত পেন্টিং, মহিলা মুখের আদল স্পষ্ট, শুধু চক্ষু দানটাই বাকি। সৌমিলি একবার যদি আসতো… কতদিন ওকে দেখেনি রৌনক। ওর মনে যদিও সৌমিলির ছবি স্পষ্ট তাও ও চায়না এই পেন্টিংটায় কোনো ভুলচুক হোক। এটা যদি শেষ করতে পারে তাহলে এটা রৌনকের মাস্টার পিস হয়ে থাকবে। সৌমিলি আজকাল ফোনও ধরে না, ওকে তো জানানোই হয়নি যে আসছে শীতে রৌনকের পেন্টিং গুলো নিয়ে একটা এক্সিবিশনের ব্যবস্থা হয়েছে। এক্সিবিশনটা একবার যদি সাফল্য পায় তাহলে রৌনককে আর পায় কে! কিন্তু সৌমিলি ফোন ধরছে না কেন? আচ্ছা এমনটা নয় তো যে সৌমিলি ওকে এড়িয়ে চলছে! এই ছা পোষা পঙ্গু শিল্পীটাকে আর পছন্দ হচ্ছেনা নামি সংবাদপত্রের সাংবাদিক সৌমিলির… এমনটাই কি? না না… এ হতে পারেনা। সৌমিলি ছাড়া রৌনকের আর আছেটাই বা কে! ছোটবেলার থেকে ভালোবাসার কাঙ্গাল রৌনক, সৌমিলিকে ও পাগলের মত ভালোবাসে, সৌমিলিকে ছাড়া রৌনক বাঁচবে না…
**************************************************************
সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে মুষল ধারে বৃষ্টি নেমেছে আজ। আজও খবরের সন্ধানে পুলিশ স্টেশনে একবার ঢুঁ মারতে এসেছিলাম, আজ অবশ্য খুব একটা হতাশ হতে হয়নি। সেখান থেকে রাস্তায় নেমে এসে টোটো, অটো কিছুই পেলামনা। অগত্যা তাই নিজের দুই পায়ের উপর ভরসা করে হাঁটতে শুরু করলাম। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে পাল্লা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে লোকটার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়াটা উচিৎ হয়নি, ওর গাড়িতে লিফ্ট নিয়ে নিলেই হতো। আসলে এই দু’দিন তথ্য সংগ্রহের আশায় পুলিশ অফিসার রণিতের প্রস্তাবে ওর গাড়িতে লিফ্ট নিয়েছিলাম কিন্তু কালকের পর থেকে কেন জানিনা মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছেনা তাই আজ আর…
তবে এখন মনে হচ্ছে বেশ ভুলই হয়ে গেছে। স্ট্রিটল্যাম্পগুলোও জ্বলছে না আজ, চারিদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। বুকটা কেমন যেন ঢিপঢিপ করছে, মনে হচ্ছে যার সন্ধানে সবাই ছুটে বেড়াচ্ছে সে এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ঘাড়ে। যদিও আজকের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আমার ওপর তার আগ্রহ থাকার কোনো কারণ নেই, কিন্তু সে না হয়ে অন্য কেউও তো হতে পারে। আজকাল পথেঘাটে কখন কি হয়ে যায় কে বলতে পারে! ©সায়নদীপা পলমল
সহসা থেমে যেতে হল আমায়। অন্ধকারেরেও নিজস্ব একটা আলো থাকে, সেই আলোয় পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আপাদমস্তক কালো বর্ষাতিতে মুড়ে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে পথ আটকে। বিদ্যুৎ চমকালো, সেই আলো ছিটকে গেল আগন্তুকের হাতে ধরা ধারালো ছুরিটার গায়ে। বুকটা ধক করে উঠলো আমার। এই কি তবে সে! নিস্তব্ধ অন্ধকার রাস্তায় এখন শুধু “ও আর আমি”। নাহ নিস্তব্ধ পুরোপুরি নয়, বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ হয়ে চলেছে এক নাগাড়ে। ও ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে, পরিষ্কার বুঝতে পারছি। অজানা আতঙ্কে পা দুটো ভারী হয়ে গেছে, ছুটে পালাতে চেয়েও পারছিনা, সে ক্ষমতা হারিয়েছি। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম। আমার ভেজা কাঁধের ওপর অনুভব করতে পারছি ওর শীতল নিশ্বাস, একটা সাপ যেন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরছে আমার কোমর… তারপর গলার ওপর তীক্ষ্ণ একটা অনুভুতি। বৃষ্টির সাথে মিশে এখন রক্ত নামছে বোধহয়…
একটানা বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে হঠাৎ গুম করে একটা শব্দ, সেই সঙ্গে গগনভেদী আর্তনাদ। চমকে উঠে চোখ খুললাম। বিদ্যুতের আলো আবার পিছলে গেল রাস্তায়; সেই আলোয় স্পষ্ট দেখলাম রক্তে ভেজা বাম পা’টা জড়িয়ে ধরে রাস্তার ওপর বিক্ষিপ্ত হয়ে বসে আছে সে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইন্সপেক্টর রণীত টর্চ ফেললেন তার দিকে, আলোটা তার মুখে ঠিকরে পড়া মাত্রই চিৎকার করে উঠলাম আমি…
***************************************************************
বাবার সাথে পুলিশ স্টেশনে এসেছি, সেদিন সন্ধ্যের স্মৃতি স্বরূপ গলা চিরে বের হওয়া লাল রেখাটাকে ঢাকতে বাঁধা একটা সাদা ব্যান্ডেজ। আজকে অফিসার রণীতের চোখে মুখে দেখছি ঝড় পরবর্তী প্রশান্তির ঝলক, হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের। কয়েকটা দিন মাঝে কেটে গেলেও ঠিক যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারিনি এখনো, চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় যেন শুনতে পাচ্ছি রৌনকের চিৎকার, “আমার কি হয়েছে... আমি এখানে কেন…
আমাকে বাঁচাও সৌমিলি… ছেড়ে যেও না আমায়…”
সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল, এতদিনের চেনা মানুষটাকে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিল।
“স্যার রৌনক…!” বাবা জিজ্ঞেস করলেন অফিসারকে।
“চিকিৎসা চলছে, এমনি মোটামুটি ঠিক আছে।”
“কিন্তু স্যার ও তো হাঁটতে পারতো না, তাহলে কিভাবে”
“মিঃ সোম এর উত্তর লুকিয়ে আছে ওর অতীতে।”
“মানে?”
“সে অনেক লম্বা গল্প।”
“গল্প!” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“হুম, গল্পই বলা যায় তাকে।
আপনি নিশ্চয় জানতেন সৌমিলি যে রৌনককে ছোটোবেলায় ওর মা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।”
“হ্যাঁ, ও বলেছিল যে ওর যখন সাত বছর বয়স তখন ওর মা ওকে ওর বাবার কাছে রেখে দিয়ে অন্য একজন ধনী লোককে বিয়ে করে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। আর তাই ও সবসময় খুব কমপ্লেক্সে ভুগতো যে আমিও ওকে হয়তো…”
“ছেড়ে চলে যাবেন; তাইতো?”
“হ্যাঁ।”
“আর আপনি এও নিশ্চয় শুনেছেন ওর মা চলে যাওয়ার পরই ওর পা দুটো অবশ হয়ে যায়?”
“বলেছিল ও।”
“কিন্তু এটা কি জানেন ওর পা দুটো আসলে অবশ নয়, এটা সম্পূর্ণ ভাবে একটা মানসিক বৈকল্য যেখানে মানুষ ভাবে যে তার কোনো একটা অঙ্গ অবশ হয়ে গেছে।”
“কি বলছেন কি! তার মানে ও চাইলেই হাঁটতে পারতো?”
“হ্যাঁ তবে কনশাস মাইন্ডে কখনোই নয়। আসলে ওর মায়ের চলে যাওয়াটা ওর কাছে ছিল একটা চরম মানসিক আঘাত আর সেই আঘাত আরও বিষিয়ে ওঠে যখন স্কুলে এবং কলেজে দুটি মেয়ে ওর সাথে কয়েকদিনের জন্য প্রেমের অভিনয় করে ওকে ছেড়ে চলে যায়। আর ওই বিষিয়ে ওঠা ক্ষতটা একটু একটু করে ওর সমস্ত শরীর মন সব কিছুকে পচিয়ে ফেলতে থাকে আর সেই পচনে এবার অনুঘকের কাজ করে এই মাস চারেক আগে ওর মায়ের দেশে ফিরে আসা।”
“ওর মা দেশে আছে এখন!” ©সায়নদীপা পলমল
“উঁহু… আছেন নয় ছিলেন। প্রথম যে খুনটা হয়েছিল অদিতি শর্মা…”
“উনি রৌনকের মা!”
“ইয়েস। রৌনক নৃশংসভাবে নিজের মাকে খুন করে ওর মায়ের বর্তমান স্বামীর কাছে পার্সেল করে পাঠায় তাঁর দেহটা।”
“ওহ মাই গড!”
“ক্ষুধার্ত পশু রক্তের স্বাদ পেলে যেমন হয় ওরও তেমন করে নেশা লেগে গিয়েছিল। এরপর ওর সেই প্রেমিকা দুটিকে শেষ করে।
কিন্তু তার পরেও ওর রক্তের পিপাসা মেটেনি। এরপর সন্ধান করে করে এমন সব মহিলাদের ওর টার্গেট বানায় যারা কোনো না কোনোভাবে তাদের আপনজনদের ঠকিয়েছিল।”
“আই কান্ট বিলিভ…!”
“প্রথম তিনটে খুনের ভিকটিমের পাস্ট হিস্ট্রি ঘাঁটতে গিয়ে একটা কমন নাম পেয়েছিলাম আমরা রৌনক সেন, কিন্তু পরের খুনগুলোর সাথে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না ওর কানেকশন।”
“একটা কমন ফ্যাক্টর ছিল সবার মধ্যে যেটা আপনি একটু আগে বললেন।”
“হ্যাঁ বাট সেটা খুঁজে পেতে একটু সময়ই লেগেছিল আমাদের। যাইহোক আমার মন বলছিল যে রৌনক লোকটাকে একটু দেখতে হবে ভালো করে আর তাই আমরা টার্গেট করি আপনাকে, যেহেতু আপনার সাথে বর্তমানে ওর একটা সম্পর্ক ছিল তাই আমাদের আশা ছিল কিছু সূত্র পেলেও পেতে পারি। আয়াম সরি টু সে বাট চব্বিশ ঘন্টা আমাদের নজরে ছিলেন আপনি; যদিও সেদিন সন্ধ্যের ব্যাপারটা পুরোটাই আনএক্সপেক্টেড ছিল। ও আপনাকে কেন যে মারতে গেল সেটা এখনো বুঝতে পারছিনা, ও নিজে মুখ খোলেনি এখনও।”
“আমার মনে হয় ও ভেবেছিল...আসলে কাজের চাপে এই মাস দুয়েক ওর ফোন ধরিনি প্রায়… ও হয়তো ভেবেছিল আমি ওকে…”
“ডিচ করছেন! হুম তাই হবে হয়তো। ডাক্তারদের অনুমান লোকটা স্প্লিট পারসোনালিটির শিকার, এখনো নিশ্চিত করে অবশ্য কিছু বলতে পারছেন না ওনারা।”
“স্ট্রেঞ্জ! এতদিনে একবারও কিছুই বুঝতে পারিনি…”
“সে যাই হোক, তবে আপনি লাকি যে সেদিন ঠিক সময়ে আমরা পৌঁছে যাই নয়তো…”
“পৌঁছতে তো আপনাদের হতই। নজরবন্দি করে রেখেছিলেন তো আমায়। একসাথে দুই জোড়া নজরের বন্দি ছিলাম আমি… একদিকে পুলিশ আর অন্যদিকে রৌনক।”
পুলিশ স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। আজ বৃষ্টির লেশ মাত্র নেই, ঝলমলে রোদ উঠেছে। হঠাৎ নজরে পড়ল ইলেকট্রিকের তারের ওপর বসা একজোড়া চড়ুই পাখি, খুনসুটিতে মেতেছে ওরা। মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল, এই রহস্যঘেরা জটিলতাময় পৃথিবীতে কেউ তো এখনো আছে বেঁচে নিষ্কলুষ সরলতা নিয়ে। মনে মনে বললাম, “এভাবেই ভালো থাক তোরা…”
...শেষ...