Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Classics

4.5  

Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Classics

ধর্ষিতার অভিশাপ

ধর্ষিতার অভিশাপ

20 mins
359


 তখন বৈশাখ মাস। নমিতার বাপের বাড়িতে মনসা পুজোয় বড় ধুম। মাংসের ছড়াছড়ি, গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতে মানতের পাঁঠা বলি হয়, রক্তে ভেসে যায় মনসা তলা।মেলা তলায় বসত নানান দোকান, ম্যাজিক শো, নাগোরদোল্লা, আর বিশেষ আকর্ষণ কলকাতার বড় দলের ফ্রীতে যাত্রাপালা ।

শিক্ষক স্বামী হরিনাথ ও বড় তিন ছেলে মেয়ের স্কুলে ছুটি নেই। যৌথ সংসারে শাশুড়ি জা দের ভরসায় তাদের রেখে নমিতা দিন কতক, ছোট মেয়ে পাঁচ বছরে জুঁই আর কোলের ছেলে আড়াই বছরের অপুকে নিয়ে, বাপের বাড়ি গেল।এদের এখনও স্কুল যাবার বয়স হয়নি।তবে দাদা দিদির ছড়া ছবির বই দেখার খুব সখ।

খড়ি নদীর পাশে নৃসিংহপুর পুরোন গ্রাম, এখানে নদী বেশ চওড়া আর কিছু দুরেই গঙ্গায় পড়েছে। গ্রীষ্মের সময় নদীতে জল বেশ কম, হাঁটু বরাবর। নমিতা হেঁটেই পার হল, জুই আর অপুকে তার মামা বিমল কাঁধে তুলে নদী পার করল। বিমল নমিতাকে শ্বশুরবাড়ী কুড়মুন থেকে আনতে গেছিল।

গ্রামে ঢুকতেই নৃসিংহপুরের রায়দের বড় জমিদার বাড়ি, পর পর সাতটা শিব মন্দিরের পশ্চিম পাশ বরাবর গ্রামে ঢোকার পথ।

এখন সব মন্দিরের ভগ্ন দশা,তবু একটা একটু ভালো, সেটা এখনও পুজো হয়। জমিদার প্রথা বিলোপের পর, এবাড়িতে জমিদারের বংশধররা কেউ গ্রামে থাকত না। বাড়িটির ভগ্ন দশা, পুরোন আমলের দোতলা মস্ত বড় এলাকা জুড়ে, বাড়ির ইট চুনসুরকীর মোটা দেওয়ালে বট অশ্বথ গাছে ভরে গেছে। বাড়িটা যেন ভুতুরেপুরী ।

জমিদার বাড়ি থেকে পশ্চিম দিক রাস্তার বরাবর একশ মিটার গেলে নমিতাদের বাড়ি, আর জমিদার বাড়ির গা বরাবর উত্তর দিকের রাস্তায় ,জমিদার বাড়ি সদর।এদিকটা বাড়ির হাল একটু ভালো ।সদর দরজা ঢুকেই ডানদিকে রাধাগোবিন্দ মন্দির, বিমল এ মন্দিরের পুরোহিত।

এখন জমিদার বাড়ির বংশধর কেউ না থাকলেও, রাধাগোবিন্দের দেবত্ত্ব সম্পত্তি এখনও আট বিঘা চাষ জমি আর জমিদার বাড়ির ঠিক পুবে মস্ত কাজল দিঘীর দেখভাল করে কালোসোনা। গ্রামেই সে থাকে । জমিদার গৃহে সন্তান স্নেহে পালিত কালোসোনা সর্দার। সে এই দেবত্ত্ব জমির আয় থেকেই রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পুরোহিতের খরচ ও পুজোর উপকরণ আয়োজনের সব ব্যবস্থা করে।

পূর্ব দিকে আর একশ মিটার রাস্তা গেলেই মনসা তলা, মেলা ও উৎসব স্থান। গ্রামের সার্বজনীন উৎসব।

নমিতা বড়, তার মেজ ও সেজো বোনের বিয়ে হয়েছিল, এবার মনসা পূজাতে বাপের বাড়ি আসেনি।ন বোন শান্তির বিয়ের যোগাযোগ চলছে। মজবুত শরীর স্বাস্থ্যবতী দেখতে সুন্দরী। ফুটফুটে হাসিখুসী অপুকে কাছ ছাড়া করে না সে,সব সময়ই তাকে কোলে বা বুকে তুলে নিয়ে বা হাঁটিয়ে ঘুরাবে, এপাড়া ও পাড়া, কাছ ছাড়া করেই না।

বিকেলে গ্রীষ্মের আদ্র গরমে নমিতা আর শান্তি, কাজল দিঘীতে গা ধুয়ে আরাম পায়। সুগন্ধিভরা সাবান ঘষে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শরীরে ভিজে কাপড়ে দুবোনের বাড়ি ফিরতে সাঁজ নেমে আসে। ভিজে গামছা নিকড়ে  আলত বুকে চাপিয়ে তার উপর অপুকে জড়িয়ে ধরে শান্তির বড় আনন্দ ।কাজল দিঘীতে স্নান করে সাঁজ বেলা বাড়ি ফেরা এ কদিন বড়দি নমিতার সাথে শান্তির বিকালটা খুসীতে কাটছে।

মা একা শান্তিকে কাজল দিঘীতে বিকালে স্নানে পাঠায় না। সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী শান্তির যৌবনে শরীর জুড়ে রূপের ঢল নেমেছে! অনেক দুষ্ট লোকের কুনজরে পড়বে । তবে সাহসী শান্তি বেপরোয়া, প্রয়োজনে হাত তুলতেও সে  জানে। ছোট বোন মেনকার মত লাজুক ঘরকুনো নয়।

কাজল দিঘীর সিঁড়ি বাঁধানো ঘাটে অপুকে বসিয়ে সেদিন শান্তি আর নমিতা, গলা অবধি গা ডুবিয়ে কজল দিঘীর কালো জলে বসে, মাথার ঘন লম্বা চুল অবেলায় যাতে জলে না ভেজে,তাই চুল খোপা করে মাথার উপরে বাঁধা।বহুক্ষন গরমের দিনে তারা এভাবেই জলে গা ডুবিয়ে আরাম নিচ্ছিল।

শিশু অপুর ভালো লাগছিল না।বিকালে পড়ন্ত বেলায় দিঘীর চারিপাড়ে সুউচ্চ পুরোন আমলের সারিবদ্ধ তালগাছ। সচ্ছ কাজল দিঘীর জলে যার প্রতিবিম্ব ঢেউ এর তালে নড়লে শিশু অপুর মনে হয়, মস্ত বড় বড় অজাগর সাপগুলো যেন জলের ভিতর মাথা ঝাঁকিয়ে কিলবিল করছে । ভয় আর দুশ্চিন্তা হত,মাকে ধরে খেয়ে ফেলবে না তো! তাই ছোট্ট অপু ভয়ে চোখ বুজে থাকত,আর এত দেরী কেন! অধৈর্য অপু মা মাসীর কাছে বার বার কৈফেয়ত চাইত।

নমিতার দিন তিনেক বাপের বাড়ির তখন আসা হয়েছিল,আর দুদিন তো থাকবে, তাই শান্তির বড় মন খারাপ।এ দিনের যাত্রা পালা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, দুবোনের এ নিয়ে আলোচনা করছিল। পুকুরের জলে মোষের মত গা ডুবিয়ে বসে , কতক্ষণ কে হিসাব নেবে!  হঠাৎই শান্তির নজর পড়ল জমিদার বাড়ির দোতলার ছাদে,তেরো চোদ্দ বছরে কিশোরী শিখা তাদের দিকে তাকিয়ে  কিছু ইশারা করছে ! শান্তি নমিতার নজরে আনল।হয়ত কোন দুষ্টলোক গোপনে তাদের শরীর দিঘীর কোন গাছের আড়াল থেকে গোগ্রাসে গিলছ !

কিন্ত সে সব চুলোয় যাক ! দোতলার ঐ কিশোরী শিখা মেয়েটি যে মৃত, তা শান্তি ও নমিতা জানে। তাই ভয়ে পরি কী মরি ভিজে কাপড়ে আলুথালু শরীরে শান্তি কোন মত অপুকে কোলে তুলে দৌড় লাগল বাড়ির দিকে।নমিতা খানিক পিছনে সেও মরনপণ দৌড়াল।

বাড়িতে এসে দু বোন ভীষণ হাঁপাচ্ছিল, অপুর শরীর, পোষাক জলে ভিজে সপসপে। দুই মেয়ের এমন দৌড়, হাঁপানো,অপুর শরীর পোষাক ভিজে, এসব দেখে নমিতার মা ননীবালা বিস্মিত বিচলিত হয়ে বলে "কী হল তোদের !"

শান্তি কোন কথা বলতে পারে না। নমিতা বলল "মা শিখাকে জমিদার বাড়ির ছাদে দেখলাম আমাদের কিছু ইশারা করছিল। "

ননীবলা বলে  " ঠিক দেখেছিস ! "

শান্তি এবার বলে আমরা দুজনেই ভুল দেখব? দাদাকে আর জমিদার বাড়ির রাধাগোবিন্দ মন্দিরে পুজো করতে পাঠিও না। ও বাড়িতে ভুত আছে।"

শিখা ও তার মা, জমিদারের ছোট ছেলে সরোজের স্ত্রী কন্যা। সরোজ কলকাতার এক প্রাইভেট সংস্থা চাকরী করত। জমিদারী বাড়ি বাদে যা সম্পত্তি ছিল, জ্ঞাতি গুষ্টির মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়েছিল।বেহিসাবি সরোজ তা দুহাতে ফুটিয়েছিল।হেন কোন জায়গা নেই, ভুভারতে যে সে গত দশ বছরে  বেড়িয়ে আসেনি।

 কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে অনেক খরচ করে সৌখিন ভাবে থাকত।আয় না বুঝে ব্যয় করত।তার পর হঠাৎই একদিন পথ দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। হাত শুন্য,বরং ঋণ, আত্মীয়স্বজন কেউ এগিয়ে আসে না।বাধ্য হয়ে সরোজের বিধবা স্ত্রী  কন্যা গ্রামে ফিরল, দু বছরের কিছু আগে। গ্রামের কালো সর্দার তাদের দেবত্ত্ব জমির আয়ের অংশ কিছু দান হিসাবেই দিত। দেবত্ত্ব জমির আয় তো রাধাগোবিন্দ মন্দিরের জন্য !এ সামান্য দানে দুই মা মেয়ের চলে না।

এক কালের  জমিদার বাড়ির বৌ , আত্মসম্মান একটু বেশী। তবুও লজ্জা সম্মানের মাথা খেয়ে সেদিন  তাদের পুরোহিত বংশ,ননীবালার বাড়ির বারান্দায় চুপচাপ মুখ নামিয়ে বসে ছিল।কিছু চায় না, কথা বলে না, হতাশ অসহায়ভরা লাজুক মুখ।অবেলা হয়ে যেতে দেখে, ননীবালা বুঝতে পারে  কী ওদের অভিপ্রায় !

নিজেদের খাবার দুই মা মেয়েকে যত্ন করে খেতে দিল। নীরবে গোগ্রাসে ওরা খেল।এঁটো বাসন ধুয়ে দেবার কথা বললে, ননীবালা দুঃখে চোখের জল চেপে বলে, "আমার তো কাজের লোক আছে, সে ধুয়ে পরিস্কার করবে। আর রা না দিয়ে নীরবে ওরা বাড়ি ফিরে গেল।

 ননীবালা মন এমনই বিচলিত হয়, পুত্র বিমলকে বলে, দিনের রাধাগোবিন্দের  রাতে শীতলের লুচি প্রসাদ, ঐ মা মেয়েকে সবটাই দিয়ে আসবি।ওরা বড় অভাবী,একসময় জমিদার বাড়ির বৌ, কত চাকর বাকর ওদের বাড়িতেই খেতো। আজও রাধাগোবিন্দের দেবত্ত্ব সম্পত্তি থেকেই এই সব পুজোর উপকরণ আয়োজন, আর আমরাও পুরোহিতের পাওনা পাই।"

কালো সর্দার তাদের কিছু চাল ডাল আনাজ মাঝে মধ্যেই দিত। মা মেয়ে বাড়ির গাছের ডাল পালা শুখনো জ্বালিয়ে খেঁচুরি করে কোন মত খেতো।আর রাতে রাধাগোবিন্দের শীতলের পুজোর লুচি, মা মেয়ে যা বানাতো ,বিমল নিতো না,সব প্রসাদ মালবিকা আর শিখাকে দিত।রাতটা তাদের চলে যেত।

এরপরও মাঝে মাঝেই ননীবালার কাছে ওরা আসত। হতাশা ভরা লাজুক মুখে মালবিকা বলত, "শিখা আপনার রান্না বড় পছন্দ,যেন অমৃত! বলল জেঠিমা বাড়ী খেয়ে আসি।বাড়িতে দিন দিন খিচুড়ি ওর ভালো লাগে না।"

ননীবালা অপ্রস্তুত হয়ে কোন দিন যদি বলত "আজ ভালো কিছু রান্না করি নি বোন।আগের দিন রাতে বিমলকে বলবে তো ! আজ নিরামিষ, ডাল শুক্তো আর পোস্ত। "

মালবিকা বলত, "ওটাই ওর বেশী ভালো লাগে দিদি, আপনার রান্না সেটাই আসল।বামুন বাড়ি, পুরোহিত বংশ , খেলে পূণ্যি, আগামী জন্মে এত দুঃখ যন্ত্রণা আর ভোগ করতে হবে না," বলতে বলতে কেঁদে ফেলত। এই ভাবেই বেশ চলছিল, ননীবালার, মালবিকা ও শিখাদের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি ভালোবাসা,আর অন্য তরফে আকাঙ্খা হতাশা নিরাশাময় জীবনে একটুকু আশা। সেটাও বুঝি ঈশ্বরের সহ্য হল না।

মালবিকা একদিন একা, ননীবালার বলে শিখা মা এল না যে! মালবিকার চোখে জল, ওর যক্ষা খুব বেশীদিন আর নেই, বড় সংক্রমণ হয়,  তাই আর বের করি না, একটা ঘরেই থাকে। ছাদে সকাল আর বিকালে একটু মুক্ত হাওড়ায় ঘুরে বেড়ায়।

এ রোগে তখন চিকিৎসা ছিল না,আর থাকলেও ব্যয় বহুল।শিখার খাবার মালবিকা তার সঙ্গে আনা পাত্রে নিয়ে যেত, নিজে খেতো না। বেদনাকাতর স্বরে বলত, "যা নিয়ে যাচ্ছি মা মেয়ের হয়ে যাবে।ও তো এইটুকু খাবে। তবে আপনার রান্নার বড় ভক্ত, খেতে বায়না করে,ওর ইচ্ছা ফেলতে পারি না ,আর তো কদিন!" বলে কাঁদত।

ননীবালার চোখ জলে ভরে যেতো। এবাড়ীর সবার মন ওদের দুঃখে দরদী ছিল, কিন্তু তারা বড় লোক নয়,কোনরকম দিন গত হয়, নাহলে ছেলে পুরোহিত আর স্বামী কলকাতায় এক উকিলের মুহুরী,একা কষ্টে মেসে পড়ে থাকত না। যা স্বামী পেতো নিজের খরচ চালিয়ে মাসের সংসারে মুদি মনোহারীর খরচ চলত।

এর প্রায় আরও তিন মাস পর একদিন শিখা মারা যায় ।খবর পেয়ে কালো সর্দার ও আরও পাড়ার মানুষ কিশোরী শিখার শব দাহ করতে নদীর নিকট শ্মশানে নিয়ে যায়। দাহ করে ওরা ফিরে এলে দেখে মালবিকার শোবার ঘর বন্ধ!কোন সাড়াশব্দ হাজার ডাকাডাকিতে তারা পায় না,অবশেষে দরজা ভেঙ্গে দেখে মালবিকা গলায় দড়ি দিয়ে কড়িকাঠে ঝুলছে ,তাকে সেদিন দাহ করে, হতবাক প্রতিবেশীরা মনে অনেক কষ্টও পেয়েছিল।

আর ননীবালা ! কোন নিকট আপন জন হারানোর মত কেঁদেছিল বেশ কতদিন কে জানে। কিশোরী শিখার নিরীহ হতাশা ভরা মুখ, আর মালবিকার অসহায় কান্না তাকে অনেক দিন মানসিক যন্ত্রণা দেয়। সে তো ছমাস হয়ে গেল। 

এরপর বিমল রাধাগোবিন্দ মন্দিরের রাত আটটার পর শীতের নিশুতি নির্জন নিঃশব্দ পরিবেশেও কতদিন জমিদার বাড়িতে গেছে। রাতের লুচি তৈরী করে পুজো আরতি করে একঘন্টার বেশী ঐ ভগ্ন জমিদার বাড়িতে থেকেছে দিনের পর দিন। কোন দিন ভয় পায়নি,কোন গা ছমছম করে নি। লোক মুখে শুনত, শিখা ছাদে একা ভোড়ে ও সন্ধের সময় ঘুরে বেড়ায়, অনেকে দেখেছে।

ননীবালার ,বিমল, শান্তি কেউ বিশ্বাস করত না। ভাবত তাদের মিথ্যা বলে ভয় দেখাচ্ছে । একটা চালাকী, যাতে বিমল পুরোহিত পেশা জমিদার বাড়ির ছেড়ে দেয়। পুজোর প্রসাদ ভোগ ছাড়াও বিমল মাসিক যা দক্ষিণা পেতো সেটা মন্দ নয়।বছরের পোষাক, দুধের দাম ,জ্বালানী খরচ হয়ে যেত ,তবু কিছু হাতে থাকত।

সেই শিখাকে আজ নমিতা আর শান্তি পোড়ো জমিদার বাড়ির ছাদে দেখেছে। ননীবালার আজ আর বিমলকে একা রাধাগোবিন্দ মন্দিরের রাতে শীতলের ভোগের জন্য লুচি ভাজা পুজোর আরতি করতে কোন মতেই পাঠাবে না।

পাড়ার নমিতার কাকা সম্পর্কে মুক্তো, বয়স চল্লিশ এক চল্লিশ আশপাশ। তাকে ননীবালা ডেকে বলল, "মুক্তো ঠাকুরপো তুমি বিমলের সাথে আজ থেকে  রাধাগোবিন্দ মন্দিরের যাবে ,ওকে সাহায্য করবে, ও একা পারছে না ।"

মুক্তো বলে , "সকালে সব্জি বেচি, সন্ধে চায়ের দোকান চালাই ,রাত আটটার পর তাস পিটোই,  এই সময়টা গেলে যদি দুপয়সা আসে মন্দ কী !   কি দেবে বৌদি?"

ননীবালার বলে, " যা লুচি মন্ডা পুজোর প্রসাদ হবে তার আধাআধি নিও।"

" কিন্তু আমার কী লাভ, বাড়ির লোকে খাবে আমি তো ছাই ভষ্ম খাই, তার জন্য কিছু পয়সা যে চাই ।"

মুক্তোর অনেক গুন, মাতাল, পুকুরের গাছের আড়াল থেকে মেয়েদের লুকিয়ে স্নান দেখে, সে সময়ে গ্রামে নব্বই শতাংশ মেয়ে বৌ মাঠেই যেত প্রাকৃতিক কর্মে।আর স্নান পুকুরেরই করত। আবার মুক্তো কোন কম বয়সের মেয়ে বৌ একা মাঠে প্রাকৃতিক কর্মে গেলে অনুসরন করত।কী উদ্দেশ্য !কী দেখবে ,কি করবে, কে জানে! ভয়ে কোন উপায় না পেয়ে অস্বস্তি কষ্ট নিয়ে সে বাড়ি ফিরত।

ননীবালা সব জানে, কিন্তু মুক্তোকে দিয়ে টাকার বিনিময়ে সব কাজ করানো যায়, এটাও সে জানে।আর পাড়ার মানুষ, কাকা সম্পর্কের, তাই তার মেয়েদের সাথে কোনরকম অসংযত আচরণ বা অসভ্যতা করত না।তার নেশার জন্য কিছু পয়সা দিতে ননীবালা সম্মত হয়।

রাত আটটার সময়  বিমলের সঙ্গ দিতে এদিন মুক্তো জমিদারবাড়ির রাধাগোবিন্দ মন্দিরে রাতের শীতল ভোগের আয়োজন ও পূজার জন্য গেল। সদর দরজা পার হয়ে বিমল  মন্দিরের সিঁড়িতে আর মুক্তো ঠিক তার পিছনে। হঠাৎই  মুক্তোর ভয়ার্ত্ত চিৎকারে বিমল চমকে ওঠে! মুক্তো পরি কি মরি দৌড়ে বাবা গো মাগো চিৎকারে গৃহ ত্যাগ করল।

বিমল কিছুই দেখে নি, শোনেনি,  কী এমন ঘটনা ঘটল, মুক্ত কাকা ভয়ে ছুটে পালালো ! বিমলের সাহসী মনে এদিন ভয় চেপে বসছে। কী করবে!পূজা না করেই পালাবে! ঈশ্বরের পূজার দায়িত্ব পুরোহিতের, তাকে তো এ জন্য সম্মানিক দেওয়া হয় ! কিন্ত সন্ধে তার বড়দি নমিতা বোন শান্তি জমিদার বাড়ির ছাদে মৃত শিখাকে দেখছে, আবার এখন মুক্তো কাকা কী ভীষণ ভয়ে পালাল! ভয়সয়ে নীরবে দিশেহারা হয়ে বিমল দাঁড়িয়ে।

হঠাৎই তার নজরে এল শিখার মা ,মালবিকার ছায়া মূর্তি রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পাশে যে রন্ধন শালা।ঐ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে।যেমনটা জীবিত কালে দাঁড়িয়ে থাকত। হতচকিত বিমল ভয়ে বিবর্ণ মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

মালবিকা বলে,  "তোমার কোন ভয় নেই বাবা ! তোমার কোন অনিষ্ট হবে না ,তুমি ব্রাহ্মণ ,পুরোহিত বংশের ,সৎ চরিত্রবান ,তুমি নিরাপদ নির্ভয়ে পুজো করো,না হলে আমার বংশের মঙ্গল অমঙ্গল নিয়ে আমি আর ভাবিত নয়, তোমাদের বাড়ীর অনিষ্ট, অমঙ্গল হবে।তোমার লুচি আজ ভাজা আছে ,ঘরে মাটির সড়া থেকে মন্ডা বের করে পুজোয় বসো। "

 তারপর মালবিকা ঘরের দরজা থেকে বেশ কিছু দুরে সরে গেল। ইতস্তত বিমলকে আবার সাহস আর ভরসা দিয়ে বলল , "ঐ ওলাওঠো মুক্তোকে আমি কিছু করি নেই! এ গৃহে আমি আমার মেয়ে ছাড়াও আরও এক অতৃপ্ত আত্মা আছে,সে মুক্তোর মত কামুক দুশ্চরিত্র মানুষদের চরম ঘৃনা করে।সে এক ইতিহাস বড় করুন। সে ই ওকে ভয় দেখিয়ে এ বাড়ী ঢুকতে দেয়নি।সেকথা থাক। তুমি বাবা আমার ছেলের মত।তোমার মা আমার জীবনদশায় নিজের বোনের মত কত স্নেহ ভালোবাসা দিতেন, আমি তোমার কোন অনিষ্ট করব ভাবছ কেন !  তোমাকে সদর অবধি পূজোর পর আমি আসব। আমাকে বাবা একটু বিশ্বাস করো! "

বিমল কথা বলেনা।মন্দিরের দরজার শিকল খুলে নিষ্ঠা ভরে পুজোর পর, প্রাসাদ সামগ্রি স্বভাববশত গামছায় বেঁধে, ঠাকুর ঘরে শিকল লাগিয়ে সদরের দরজা চাবি লাগিয়ে বাড়ি ফিরল। মালবিকা তার কথামত সদরের দরজা অবধি এসেছিল,বিমলকে বিদায় জানাল। যেমনটা জীবিত কালে করত।

 বিমলের সবটা কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছিল। নিজের মধ্যেই ছিল না,কেউ যেন তাকে দিয়ে এসব কর্ম সম্পাদন করছিল। রাস্তায় বেরিয়ে নিজেকে ফিরে পেলো।ননীবালাকে মুক্তো কিছুই বলেনি তাই রক্ষা,নচেৎ ননীবালা এতক্ষণ পাগলের মত ছেলের জন্য জমিদার বাড়ি ছুটে আসত। মুক্তো ভেবেছিল আজই বিমল পটল তুলবে। ভয় আর উদ্বিগ্ন মনে বিমলদের বাড়ির কিছু দুরে তার বাড়ির জানালা দিয়ে নজর করছিল বিমল দের বাড়ির হালচাল।

বিমল রাধাগোবিন্দ মন্দিরের রাতের পুজোর পর বাড়ি ফিরে ননীবালাকে বিমল বলল "প্রাসাদ গুলো তুলে রাখো মা।"

মা বলে "গামছাতে তো কিছুই নেই! "

বিস্মিত বিমল বলে " কিছুই নেই মানে লুচি মন্ডা নেই!"

ননীবালা এবার গামছা খুলে বিমলকে দেখালো বলল "কি ব্যাপার বলত? মুক্ত গেল কোথায় ! "

এবার বিমল বুঝল সবটাই অলৌকিক, মালবিকার প্রভাবে সে পুতুলের মত কাজ করেছে, যা সবটাই অজাগতিক।

সবকথা এবার ননীবালাকে বিমল বলল,ননীবালা চমকে ওঠে,পরক্ষণেই মালবিকার প্রতি কৃতজ্ঞতায় দুচোখ জলে ভরে ওঠে। নমিতা অপুকে ঘুম পাড়াচ্ছিল,শান্তি কদিন বড়দির ছায়া সঙ্গী।তারপর আজ আবার এক অজ্ঞাত ভয় তাকে গ্রাস করেছে। নমিতা তো ভয়ে রাতে যাত্রাপালা দেখতে যাবে না। একটু পর মুক্তো এল। বিস্মিত বিচলিত মুক্তো বলে, "বিমল তুই ঠিক আছিস!"

ননীবালার ভৎসনাসুরে বলে, "ওকে অমন একা ছেড়ে এসে তুমি ঠিক করোনি ঠাকুরপো! তুমি সাহসী দায়িত্বশীল তাই জানতাম। "

মুক্তো বলে," বিশ্বাস করো বৌদি কী ভয়ঙ্কর একটা মেয়েছেলে নগ্নদেহে নোংরা দুর্গন্ধ,কালো মুখচোখ বীভৎস আমার দিকে ছুটে আসছিল,  বিমল হয়ত নজর করেনি।"

ননীবালা বলল " বিমলকে সেই আত্মা দেখা দেয়নি ,তবে মালবিকার ছায়া মূর্তি বিমলকে দেখা দেয়। সে ভয় নয় সাহস দিয়েছে।সে বলেছে এক অতৃপ্ত আত্মার কথা ! কে সে বলেনি। সে কামুক লমপট পুরুষদের ভীষণ ঘৃনা করে। তোমাকে ভয় দেখিয়ে ঐ বাড়ী থেকে তাই তাড়িয়েছে। 

মুক্তো এবার কাজের বাহানায় মুখ নামিয়ে লজ্জিত হয়ে এবাড়ি থেকেই কেটে পড়ল।

একটু পর নমিতা সব শুনে বলল, "বিমল তুই কাল সকালেই আমার শ্বশুর বাড়ি যা।"  নমিতার শ্বশুর সনাতন ঠাকুর মস্ত তান্ত্রিক,ভুত প্রেত যাঁকে ভয় পায় সমীহ করে, এ বাড়ীই সবাই জানে।

ননীবালা বলে "উনি ব্যস্ত মানুষ এখানে আসবেন তো!"

নমিতা গর্বিত মুখে বলে,"বাবার সেজো বৌ সবচেয়ে প্রিয় ,আমার আবদার ফেলবেন না, আর ভুতের বাড়ী,ভুতের খবর শুনলেই উনি পাগল, আসতেই হবে।আর এ বৌমা তো শ্বশুরকে কম যত্ন করে না! এখানে আমি আছি, আসবেনই ,দেখে নিও।"

পরদিন খুব সকালেই বিমল নমিতার শ্বশুর বাড়ির রওনা হল ।কদিন আগেই মনসা পূজার উপলক্ষে নমিতাকে সেই আনতে গেছিল।কুড়মুন চার ক্রোশ পথ,তরতাজা যুবা বিমল নটায় নমিতার শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাল। নমিতার শ্বশুর বাড়িতে গতরাতে তার সব অলৌকিক অভিজ্ঞতা ও নমিতা শান্তির ছাদে মৃত শিখাকে দেখা, মুক্তো ভয়ার্ত্ত চিৎকার দৌড়ানো ও কারন বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল।

নমিতার কথাই ঠিক, তার শ্বশুরের আর তর সয় না।এই ভৌতিক জমিদার বাড়ির ,ভৌতিক রহস্য  তিনি উদ্ধার করবেনই। ভূত পেত্নী তাড়ানো দায় তার নেই, সেটা বাড়ির মালিক ঠিক করবে। তবে  সেজো বৌমার ভাই ঐ ভুতুরেবাড়ীর পুরোহিত, রাতে নিত্য পুজো করতে যায়, তাই তার একটা রক্ষাকবজ করে দেবেন।

সত্তর ছুঁই ছুঁই সনাতন এখনও বেশ শক্তপোক্ত,চার ক্রোশ পথ হাঁটা কোন ব্যাপার নয়।দুপুর আড়াইটা তার আরাধ্য দেবী চামুন্ডার স্মরণ নিয়ে যাত্রা করলেন সঙ্গে বিমল। মাঝে নদী থাকায় কিছুটা পথঘাট বেশ অসমতল। ছটার মধ্যেই নমিতার বাপের বাড়ি নৃসিংহপুর পৌঁছালেন।সেই নমিতাকে কনেরূপে দেখতে কবে যেন এসেছিলেন! সুন্দরী নমিতাকে খুব পছন্দ হয়।গরীবের মেয়ে, প্রায় বিনা পণে ,সেজো ছেলের সাথে বিয়ে  দিয়ে গ্রামের সেরা সুন্দরী বৌমা করেন।সে যুগের গ্রাজুয়েট হাইস্কুলের শিক্ষক স্বামী পেয়ে নমিতা আনন্দে আত্মা হারা । দোষের মধ্যে তার স্বামীর সামনের দুটো দাঁত একটু বড় ,আর বড্ড ঘুম কাতুরে।

নমিতা শ্বশুরের পা ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছে ,ভমিষ্ঠ হয়ে প্রনাম করল,সে যুগের রীতি। ননীবালা বেয়ান হলেও বয়সে অনেক ছোট, প্রনাম করলেন,সনাতন খানিকপর গত রাতের ঘটনা আরও বিস্তারিত জানলেন। মুক্তোকে ডেকে সব শুনলেন।

এদিন সকালের পুজো প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ মানিক করেছিলেন। রাত আটটার সময় বিমলকে নিয়ে সনাতন ভুতুরে জমিদার বাড়ি ঢুকলেন।আর কেউ থাকবে না। নির্জন নিঃশব্দ পরিবেশ খুব দরকার।

বিমল কে পূজার উপকরণ আয়োজন করতে বলে সনাতন পন্ডিত হ্যারিকেন হাতে, ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ির এপাশ ও পাশ রাতের আঁধারে অনেকক্ষণ ঘুরলেন।রাধাগোবিন্দ মন্দিরের চত্বরে অনেকক্ষন মৌন বসে তান্ত্রিক সাধনা যোগে অতৃপ্ত আত্মাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছিলেন।তিনি অতৃপ্ত আত্মা দেখাতে পেতেন না বা দেখা দিতে ভুত প্রেত পেত্নী সমীহ করত। কিন্ত তাদের সাথে কথা বলে তাদের দুঃখ যন্ত্রণা আক্রোশ ক্ষোভের কারন জেনে নিতেন ।

তার যা জানার এক ঘন্টার মধ্যেই জেনে গেলেন। বিমলের সাথে  বাড়ি ফিরে, রাতে তাদের বাড়ি থাকলেন। সকালে ঠিক হল, দুপুরের খাবার খেয়ে সেজো বৌমা ও নাতি নাতনীকে নিয়ে তাঁর বাড়ি ফিরবেন। এই ঘটনার পরিপেক্ষিতে নমিতা দুই ছেলে মেয়েদের নিয়ে আর নৃসিংহপুর থাকতে মন চাইছিল না।

শ্বশুর মশাই জমিদার বাড়ির দোষ মুক্ত করলে পরে আসবে। তাদের মাটির দোতলা ঘরের বারান্দার থেকে তাকালে পুবদিকে জমিদার বাড়ির ছাদ আর দোতলার একটা অংশ দেখা যায়।ওদিকে তাকালে নমিতার কেমন ভয় করছিল।

আটটার সময় সনাতন ঠাকুর, গতরাতের তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন। তার আগে কালো সর্দারকে ডেকে পাঠালেন। কালো সর্দার এলে তাকে কাছে বসালেন।তারপর বললেন "তোমার মা ঐ বাড়িতে দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছর অতৃপ্ত আত্মা হয়ে কষ্টে পাচ্ছে।তোমার যখন মাত্র পাঁচ ছ বছর বয়স, তোমার মায়ের অপঘাতে মৃত্যু হয়,আসল ঘটনা হল তোমার মাকে জমিদার গঙ্গা প্রসাদ হত্যা করে।"

একটু থেমে বললেন, "তোমাকে জমিদারের স্ত্রী লক্ষ্মী, সন্তান স্নেহ মানুষ করেছে, তাই তোমার মা জমিদার গঙ্গা প্রসাদের উপর ভীষণ রুষ্ট হয়ে তাকে হত্যাও করলেও।বাড়ির অন্য সদস্যদের দেখা দিত না ,ভয় দেখাত না, কিন্ত তার দুঃখ যন্ত্রণা অভিশাপ এই বাড়িতে আর ওর বংশধরদের উপর আজও অশুভ কাজ করছে।এবাড়ী ছেড়ে সবাই চলে যায়, জমিদারের কনিষ্ঠ পুত্র সরোজের স্ত্রী কন্যা কিন্ত অভাবের কারনে ফের এবাড়ী ফিরে এল। তোমার মায়ের অতৃপ্ত আত্মা তাদের ভয় দেখত না, দেখা দিত না, কিন্ত তার অশুভ দৃষ্টির কারণে, দুজনেই অকালে অপঘাতে মারা যায়।আর তার কুপ্রভাবে তাদের আত্মার মুক্তি হয় না।

এখন তোমার মায়ের অতৃপ্ত আত্মার সঙ্গী হয়ে ওরা ঐ বাড়িতে আছে। যদিও মালবিকার শিখা মৃত্যুর পর ওর প্রভাব মুক্ত, বরং তোমার মা চাপে থাকে। জমিদার গঙ্গা প্রসাদ ছিল চরিত্র হীন।তোমার বাবা সূর্য সর্দার জমিদারের গৃহরক্ষী ছিল।সর্পঘাতে তার যখন অকাল মৃত্যু হয়,তোমার মা সাতাশ আটাশ বছরের যুবতী।কালো কিন্ত দেখতেছিল ভীষণ সুন্দরী , যেমন তার দেহের গঠন তেমন মুখশ্রী।গঙ্গা প্রসাদের তখন বয়স ষাটের কাছাকাছি।দুই ছেলে বিবাহিত, বিগত যৌবনা স্ত্রী ধর্মের মতি দিন দিন বাড়ছে।

তার বাড়ীতেই সূর্য সর্দার থাকত নিচে তোলার চার নম্বর ঘরে। তার মৃত্যুর পর কৃষ্ণা মানে তোমার মা এবাড়ীতেই থেকে যায়, পরিচালিকার কাজ করত।  ,গঙ্গা প্রাসাদের কুনজরে পড়ে, এই বয়সেও গঙ্গা প্রসাদ, ডাম্বেল নিয়ে নিয়মিত এক দেড় ঘণ্টা শারীরিক ব্যামায় করত। কৃষ্ণাকে টাকা গহনার লোভ দেখায়,আবার কৃষ্ণার শারীরিক চাহিদা ক্ষুধা ছিল প্রবল, গভীর রাতে দোতলার বাবুর ঘরে এক দেড় ঘণ্টা কাটিয়ে আসত।

দোতলার চারটি ঘরে,একটি গঙ্গা প্রসাদ, তারপর দুটি ঘরে দুই বিবাহিত ছেলে,আর একটি ঘর, বন্ধ থাকত, গুরুর জন্য যখন আসতেন পাঁচ সাতদিন থাকতেন। নিচের চারটি ঘরে,একটি গঙ্গা প্রসাদের স্ত্রী লক্ষ্মী প্রিয়া,একটিতে তার দুই অবিবাহিত পুত্র সরোজ, সৌরভ, একটি ঘরে কৃষ্ণা ও তার  শিশু পুত্র , আর একটি ঘরেতে,গঙ্গা প্রসাদে বাল্য বিধবা বোন, যে রাধাগোবিন্দ মন্দিরেই পড়ে থাকত।

কৃষ্ণা সাথে বাবার গোপন অবৈধ সম্পর্ক বিবাহিত দুই ছেলে ও বৌমারা জানত, যারা উপর ঘরে শুতো। তবে কোন দ্বিতীয়ত ব্যক্তিকেও বলত না। তাতে অশান্তি বাড়বে,আর বাবা যদি একটু দেহজ সুখ আনন্দ ভোগ করে করুন! কিন্ত বাড়ির বদনাম অশান্তির চাইত না।

একদিন শিশু কালোসোনা রাতে খুব কাঁদছিল, এত রাতে মা কি করছে! থামাতে পারছে না! লক্ষ্মী দোর খুলে দেখে,কৃষ্ণা হন্তদন্ত হয়ে দোতলা থেকে সিঁড়ির বেয়ে নামছে।

লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করে, ছেলে কাঁদছে, তুমি দোতলায় কি করছিলে! কৃষ্ণা কোন উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকে খিল দেয়। পরদিন রাতে লক্ষ্মী ঘুমোয় না, অনেক রাতে কৃষ্ণার ঘরের দোর খোলার শব্দ পেলে একটু পর সে দোতলায় স্বামীর ঘরে যায়। তার যা সন্দেহ হয়েছিল তাই ,ঘরের দোর লাগানো খিল ছিল না। ঠেলতেই খুলে যায়।কৃষ্ণা নগ্ন, স্বামীর উপর চেপে মিলনে লিপ্ত! লক্ষ্মী চিৎকার করে ওঠে, "এ রাতটা সহ্য করছি।কাল সকালেই ওকে বিদেয় করবে ,না হলে আমি গলায় দড়ি দেবো।" তারপর নিচে নেমে আসে।

লক্ষ্মীপ্রিয়া বনেদী ঘরের মেয়ে, এক কথার মানুষ, যা বলে তাই করে, গঙ্গা প্রসাদ তা বিলক্ষণ জানত।

বিচলিত গঙ্গা প্রসাদ, কৃষ্ণাকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে তার দেশের বাড়ী বিহার চলে যেতে বলে।কৃষ্ণা রাজী নয়,বলে,"বুড়ী মরে মরুক, আমাকে বিয়ে করবে।সুখে থাকব, লুকোচুরি দরকার কি! "

"এতটাই সহজ! কী বলছ! পাগল! ছেলেরা মানবে না, আমার সম্মান থাকবে না! আর ও আমার বিবাহিতা স্ত্রী, ছেলেদের মা, ওকে আমি তোমার মোহে মরতে দেবো ! এটা সম্ভব নয়।"

এরপর দুজনের তীব্র বাক্য বিনিময়,তেজী জেদী কৃষ্ণা জানত সে গঙ্গা প্রসাদকে চরম পরিতৃপ্ত করে,যৌবনে তার স্ত্রী যা পারেনি।সেটা গঙ্গা প্রসাদ মাঝে মধ্যেই বলত, কৃষ্ণার মনে আরও কাম বসনা বাড়াতে ।কৃষ্ণা গঙ্গা প্রসাদকে রাগের মাথায় যা খুসী বলতে থাকে, বাপ মা তুলে কুকথা খিস্তি খেউরী করে। হুমকী দেয় সে দরকারে বর্ধমান মহারাজের কাছে নালিশ জানাবে প্রতিকার চাইবে। তাকে বিয়ে করতেই হবে।গঙ্গা প্রসাদ অনড় থাকে। শেষে তার বয়স অঙ্গ ভঙ্গি নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ তাচ্ছিল্য করছিল ।

গঙ্গা প্রসাদ খাট সংলগ্ন আলমারিতে রাখা লোহার ডাম্বেল আচমকাই তীব্র অপমান ক্ষোভে কৃষ্ণার বামদিকের গন্ডদেশে সজোরে আঘাত করলে, কৃষ্ণা অচেতন হয়েছিল। গঙ্গা প্রসাদ,কৃষ্ণাকে মৃত ভেবে, রাতেই বস্তায় ভরে, পরিত্যক্ত পায়খানার গর্তে ভরে দেয়।

ভীষণ কিছু অশান্তির হচ্ছে , লক্ষ্মী ঘর থেকেই অনুমান করছিল।তাই বলে এমন ভয়ঙ্কর খুনোখুনি অবধি গড়াবে স্বপ্নে ভাবেনি। সহসা কালোসোনা রাতে মাকে না পেয়ে ঘুম ভাঙ্গলে কাঁদছিল, লক্ষ্মী তাকে মাতৃ স্নেহ কোলে তুলে নেয়।

পরদিন সকালে জন মজুর দিয়ে খড়ির বালি এনে এই পরিত্যক্ত পায়খানা বালিতে ভর্তি করে গঙ্গা প্রসাদ ভেবেছিল বেঁচে গেলাম। কেউ টের পাবে না। 

হঠাৎই কৃষ্ণার উদাও! গতরাতে অশান্তি চিৎকার চেঁচামেচি! কালোসোনাকে কেন হঠাৎ লক্ষ্মী মাতৃ স্নেহ বরন করে নিল , একটা স্পষ্ট বার্তা ছিল ।

গতরাতে গঙ্গা প্রসাদের ঘরে প্রথমে স্ত্রী লক্ষ্মীর অশান্তি চিৎকার পরে। গঙ্গা প্রসাদ ও কৃষ্ণার তীব্র ঝগড়া বিবাহিত দুই পুত্র ও পুত্র বধুরা সব জানত। কিন্তু কোন আগাম বিপদ অশান্তির ভয়ে না জানার ভান করে ছিল।সে রাতের ভয়ঙ্কর ঘটনা জানত না, দুঃখী বাল্য বিধবা গঙ্গা প্রসাদের বোন ঊর্মিলা আর দুই অবিবাহিত দশ বছরে ছেলে সরোজ আর ষোল বছরের সৌরভ।

 কৃষ্ণার রুষ্ট অতৃপ্ত আত্মা পরের দিন রাতেই গঙ্গা প্রসাদের ঘরে হানা দেয়।সারা শরীর পুরাতন দুগন্ধ মলে ভরা, আর ডাম্বেল আঘাতে বাম চোখ লাল টকটকে, ফুলে ঢোল বামদিকের চোখ থেকে মাথা অবধি ,তীব্র  কালসিটে, এত সুন্দর মুখটা বীভৎস!

গঙ্গা প্রসাদ ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। কৃষ্ণা ক্রোধে গুঁগানীস্বরে হুঙ্কার দিল, তোকেও জ্যান্ত পায়খানার গুয়ে পুঁতে মারব। তার বিকট চিৎকার শব্দ বাড়ির বাইরেও যেন ছড়িয়ে পড়ছিল।গঙ্গা প্রসাদ থর থর করে কাঁপছিল। চিৎকার করে বাড়ির মানুষদের জাগিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিল। চার পুত্র, স্ত্রী ,দুই পুত্রবধু, বিধবা বোন সবাই  আতংকিত। অজানা বিপদে আশঙ্কায় গঙ্গা প্রসাদের দরজা বাইরে থেকেই ওরা ধাক্কাধাক্কি করে ,কিন্ত ঘরে খিল ছিল।

 অনেক শ্রম আর চেষ্টায় যখন শক্তপোক্ত কপাট ভেঙ্গে তারা ঘরের ভিতরে ঢুকেছিল, দরজার ঠিক সামনেই পড়েছিল গঙ্গা প্রসাদের নিস্প্রান নিথর দেহ মুখচোখে তীব্র আতংক আর ভয়ার্ত্তের ছাপ, প্রান ছিল না।মনে হচ্ছিল দরজার খিল খোলার চেষ্টা করেছিল।ঘর থেকে বের হয়ে পালিয়ে প্রানে বাঁচতে চেয়েছিল।কিন্ত কেউ যেন, বাধা দিয়েছিল  তাকে বার বার। ভয়ে হার্ট ফেল করেছিল! না কি ভাবে তার মৃত্যু! কোন ময়নাতদন্ত হয়নি তাই মৃত্যুর কারণ সঠিক জানা নেই।

এই কাহিনী রুষ্ট অতৃপ্ত কৃষ্ণার আত্মা খুব দঃখ যন্ত্রণা নিয়ে, সনাতনকে কিছুটা বলছিল ,বাকীটা তন্ত্র বলে সনাতন পন্ডিত জেনেছিলেন।তবে কৃষ্ণা চেয়েছিল গঙ্গা প্রসাদ কে জ্যান্ত বিষ্ঠার মধ্যেই ডুবিয়ে মারতে! পারে নেই। পরিত্যক্ত পায়খানায় গর্তে কৃষ্ণার চেতনা ফিরলেও দুর্গন্ধ গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু ছিল বড় কষ্টের। তাই এখনও তার বড় আফসোস। 

 তার অনাথ শিশুকে লক্ষ্মী কোলে তুলে মাতৃ স্নেহে মানুষ করছে, এই শর্তে আর এ বাড়ীর উপর কোন প্রতিহিংসা বা তার উপস্থিত প্রকাশ করে বাড়ির অন্যদের বিব্রত করে নি।আবার এমন হতে পারে, তাতে তাকে বাড়ি থেকেই তাড়াতে কোন ভুতের ওঝার শরণাপন্ন না হয়।পুত্র স্নেহে কালোর স্বার্থে নীরবে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেকেছে এই দীর্ঘকাল।

সেই দীর্ঘশ্বাসে আজ জমিদারবাড়ি ভুতুরে বাড়ি।জমিদার গঙ্গা প্রসাদের অন্য জ্ঞতিরা অবশ্য এ ঘটনার অনেক আগেই এবাড়ী ছেড়ে শহরবাসী ছিল।অন্য সম্পত্তির ভাগ নিলেও দেবত্ত্ব জমির পুকুরের কোন তারা দাবী করেনি। রাধাগোবিন্দ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ দায়িত্বও নেয়নি।লক্ষ্মীর ইচ্ছা অনুসারে কালো সর্দার,এই দেবত্ত্ব সম্পত্তির  স্বত্ব ভোগ করত,আর রাধাগোবিন্দ মন্দিরের দেখভাল করত।একটা পৃথক বাড়ি পালিতা মা লক্ষ্মী,কালোকে এ গ্রামেই করে দিয়েছিলেন, যখন কালোসোনা সর্দারের বিয়ে হল।লক্ষ্মী তার এক বছরের মধ্যেই মারা যায়।

কালো এত জানত না । মায়ের দীর্ঘদিনের অতৃপ্ত আত্মার মুক্তির জন্য তার অন্তর কেঁদে ওঠে।বলে ঠাকুর মশাই যা খরচ হয় হোক, ওর মুক্তির ব্যবস্থা করুন।

সনাতন ঠাকুর বললেন, "মালবিকা আর শিখার কোন ক্ষোভ চাহিদা নেই,সামান্য  ক্রিয়াকর্ম যজ্ঞে ওদের মুক্তি সম্ভব। কৃষ্ণার একটা শর্ত আছে,গঙ্গার প্রসাদের ছবি লাগবে।ঐ ক্রিয়াকর্ম যজ্ঞে যেটা না থাকলে কৃষ্ণা এ বাড়ী ছাড়বে না,দরকারে মুক্তি চায় না। দুঃখ যন্ত্রণা নিয়েই এ বাড়ীতেই অশরীরী হয়ে থাকবে অনন্তকাল।জেদী একরোখা স্বভাবের ও জীবন দশা থেকেই।গঙ্গাপ্রসাদের পূর্ন আকারের ছবি জোগাড় করে আমাকে খবর দেবে। 

আমি অতৃপ্ত আত্মার মুক্তির আগে তার যতটা সম্ভব মনের আকাঙ্খা মিটিয়ে দেওয়ার পক্ষে। তাদের এই ক্ষোভ আক্রোশের অনেক যুক্তি থাকে।অবুঝ মানুষের চেয়ে অনেক ওরা বোঝদার। "

বিমলকে, চামুন্ডার পুষ্পের মন্ত্রপুতো তাবিজ করে বলল,এটা বাম বাহুতে পড়ে থাকবে,ঐ গৃহে তোমায় কেউ বিরক্ত বিভ্রান্ত করতে পারবে না,কেউ দৃষ্ট হবে না। আর আমার বিচারে এই পেক্ষিতে এখন লুচি ভোগের দরকার নেই। শ্রদ্ধার সাথে নিয়মিত নিদিষ্ট সময় জল পুষ্প সহকারে পবিত্র মনে  ঈশ্বরের স্মরণ করলেই হল। এবার তোমার অভিরুচি।

সনাতন ঠাকুরের শর্ত মেনে কালো, গঙ্গা প্রসাদের প্রমাণ ছবি, তার তৃতীয় পুত্র সৌরডের কাছে থেকে জোগাড় করে।সৌরভের বর্ধমানে বাড়ি ,ওকালতি করে। যেদিন ক্রিয়াকর্ম যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়,সৌরড নৃসিংহপুর পুরে তাদের ভগ্ন প্রায় জমিদার বাড়িতে হাজির। কাজ কর্ম ক্রিয়া যজ্ঞে মাঝে এক সময়ে সনাতন ঠাকুর কালোকে বললেন, গঙ্গা প্রসাদের ছবি এবার বাইরের পরিত্যক্ত মলাশয়ে মলমুত্র নোংরার মধ্যে নিক্ষেপ করে এসো। কালো  অগ্রসর হলে সৌরড বলল "এটা কেমন কথা! এটা মানছি না। এটা হতে দেবো না। "

সনাতন বললেন, " চিরদিন ওর অভিশপ্ত থাকবে! সংসারে উন্নতি হয়! ছেলেরা বাধ্য! না নিজের শরীর নিয়ে সুখী! "

সৌরড বলে," সব ঠিক, এটা কী ওর অভিশাপে!"

সনাতন বললেন," শুধুমাত্র তোমার নয়,তোমাদের গোটা সংসার অভিশপ্ত। তোমার বাবা ওকে আঘাত করে, অচেতন হলে মৃত ভেবে নোংরা পায়খানায় ফেলে দেয়, ওখানে চরম কষ্টে ওর মৃত্যু। তোমার বাবা ওর পীড়নে আর বীভৎস ভয়ে মারা যায়,কিন্তু পায়খানাতে পুঁতে মারতে পারে নি। তাই আজও  কৃষ্ণার ক্ষোভ। তার নিরীহ দাবী গঙ্গা প্রসাদের ছবি পরিত্যক্ত মলাশয়ে ফেললে,ও এবাড়ী ছাড়বে, ওর মুক্তি হবে।

আমি সেদিন ওকে কথা দিয়েছি।যদি রাজী না হও জোর করব না,আমি উঠলাম, দ্বিতীয়ত বার আমি আর হাজার ডাকলেও আসব না।এটা আমার পেশা নয়, সখ। আর অশরীরীদের প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে। ওরা বেশিরভাগই অন্যায় অত্যাচারের শিকার। "

কালো অসহ্য হয়ে ওঠে,বলে, "তাহলে রাধাগোবিন্দ মন্দিরের চাবি পড়বে,বামুন আসবে না।আর দাদা তোমার বাবার কুকর্মের ফল একটু ভোগ করতে দাও! না অধর্ম করবে! সংসারে অমঙ্গল আর অভিশাপ নিয়ে থাকবে !"

সৌরড অবশেষে সবার চাপে খানিক অভিশাপের ভয়ে, রাজী হয়, অন্যান্য অনুসাঙ্গিক অনুষ্ঠানের সাথে, তার বাবার প্রমাণ আকারের ছবি সেদিন মলমুত্র ভরা পরিত্যক্ত মলাশয়ে নিক্ষেপ করা হয়।

জমিদার বাড়ি থেকে তিন অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি ঘটে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy