ক্ষণিক বসন্ত
ক্ষণিক বসন্ত


ফুলে ফুলে ঢাকা পলাশ গাছটায় পাতা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। বাতাসে হাল্কা শীতের আমেজ। বসন্তের ছোঁয়ায় প্রকৃতি হাসছে। কাছেই কোথাও একটানা একটা কোকিল ডাকছে। পিয়ার চোখ দুটো সেই পাখিটাকেই খুঁজে বেরাচ্ছে। হঠাৎ দুটো শক্ত হাত এসে ওর চোখের উপর আড়াল সৃষ্টি করতেই হাল্কা কেঁপে ওঠে পিয়া। ভিরু কপোতির মতো একটা চওড়া লোমশ বুকে মাথা গুজে পিয়া আদুরে গলায় বলে-"আজও এতো দেরি ?"
-"আমাদের এ জীবনে সঠিক সময়ে কোনো কিছুই হয় না ম্যাডাম। তবুও এখন খেতে বাড়ি আসছি। এখানে ডিউটির কোনো সময় বলে কিছু নেই। সর্বদা হাই এলার্ট থাকতে হয়। "
পিয়া তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খাবার বারতে যায়। হয়তো এখনি ডাক আসবে আবার !! দুদিন সামনের বারা ভাত ফেলে রায়ানকে উঠে যেতে হয়েছিল । পুরুলিয়ার এই অংশে প্রকৃতি যেমন সুন্দর তেমনি এই সবুজ বন জঙ্গল পাহাড়েই লুকিয়ে আছে মাওবাদির দল। তারা যখন তখন সক্রীয় হয়ে হামলা চালায়। যদিও ওদের রাগ সরকারের ওপর, যুদ্ধটাও তাদের সাথে। কিন্তু সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে রায়ান এই ছোট্ট থানার ইনচার্জ তাই ওকেও ছুটতে হয় কর্তব্য করতে। এখানকার লোকাল আদিবাসীরা রায়ানকে ভালবাসলেও সবাই সর্বদা একটা ভয়ে ভয়ে থাকে।
মাত্র একমাস দশদিনের দাম্পত্য জীবনেই পিয়া বুঝে গেছে কোন বারুদের স্তুপের উপর তারা সংসার পেতেছে। ছোট থেকে অনাথ মেয়েটা জেঠুর আশ্রয়ে মানুষ হলেও ভালবাসা পায় নি কখনো। দিদির পুরানো জামাকাপড় আর বইতেই খুশি থাকতে শিখে গেছিল ছোটবেলার থেকে। চাহিদা কিছুই ছিল না। জেঠুর বাড়ির এক কোনে নিজস্ব নিয়মে বেড়ে উঠছিল একটা সতেজ চারাগাছের মতো। দেখতেও আহামরি সুন্দরী নয় সে। কলেজে দু একজন স্তাবক জুটলেও মেয়েটা নিজের সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিল। পাত্তা দেয়নি কাউকে। একটা চাকরি ছিল জীবনের মুল লক্ষ্য, যাতে মাথা তুলে বাঁচতে পারে।
দিদির বিয়েতেই রায়ান এসেছিল জিজুর সাথে, আর জিজুর উদ্যোগেই জেঠু ঘারের বোঝা নামাতে তৎপর হয়েছিল। বি এড শেষ করে পিয়া সবে চাকরীর পরীক্ষায় বসবে তখনি রায়ানের হাত ধরে তাকে চলে আসতে হয়েছিল এই লাল মাটির দেশে।
তবে ভগবান বোধহয় এতদিনে মুখ তুলেছিল। অতীতকে ভুলিয়ে রায়ান ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছিল দুঃখী মেয়েটার জীবন। মাঝে মাঝে এটাকেও স্বপ্ন মনে হতো পিয়ার। এতো ভালোবাসাও তার জন্য ছিল!! রায়ানের বাবা মা ছিল না। দুই বিবাহিতা দিদি বাইরে থাকে। পিয়াকে নিয়েই ঘর বেঁধেছিল অনেক আশা ভালবাসার সাথে। খুনসূটি আর ভালবাসায় ভর করে তরতর করে এগিয়ে চলছিল ওদের সংসার। পিয়া স্থানীয় একটা এনজিওর সাহায্যে ওখানেই একটা স্কুলে আদিবাসী বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করেছিল। তাছাড়া ছুটির দিন ভেতরের গ্ৰামগুলোয় যেত ক্যাম্পে। ওখানকার অল্পেই খুশি সহজ সরল লোক গুলোকে মনে প্রা
নে ভালোবেসে ফেলেছিল সে।
অতীতের না পাওয়ার বেদনা ভুলে সব পেয়েছির আকাশে হারিয়ে গেছিল বোকা মেয়েটা। বোঝেনি ভবিষ্যত সব দেখছে।
প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের সাথে প্রতিটা ঋতু এখানে আলাদা করে চেনা যায়। তবে মাঝে মাঝে যখন ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ বা গোলাগুলি চলার খবর আসে ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে পিয়া। রায়ান এমন সব কাজে গেলে ঠাকুরের আসন আঁকড়ে বসে থাকে সে। অতীতে যখন কিছুই পায়নি জীবনে তখন এতো হারাবার ভয় ছিল না। কিন্তু রায়ানকে পেয়ে একটা কেমন যেন ভয় ওকে আজকাল জড়িয়ে ধরেছে!!
পূর্ণিমার রাতে মহুয়ার মাতাল করা বুনো গন্ধে যখন আদিবাসীদের মাদলের আর গানের তালে তালে প্রকৃতিও নেচে ওঠে পিয়া রায়ানের অপেক্ষায় প্রহর গোনে। ওর মঙ্গল কামনায় প্রদীপ জ্বালায়। রায়ান ফিরে এলেই ও দেবতার থানে পূজা দেয়। এভাবেই কাটছিল বেশ।
কিন্তু ঐ যে মাথার উপর একজন বসে সবার উপর ছড়ি ঘোরায় না, ওনার মতিগতি বোঝা ভার! এমনি এক বর্ষাশেষের রাতে ডাক এসেছিল। পিয়া প্রতিবারের মতো এবারেও প্রদীপ জ্বেলেছিল। রাতে অনেক দূরে গোলাগুলির আওয়াজে কেঁপে উঠেছিল ভীরু মেয়েটা!! সকালের আলো ফুটতেই বারবার থানায় দৌড়ে গেছিল। অবশেষে সকাল সারে দশটায় খবর হয়ে ফিরে এলো রায়ান। পিয়া ভাবছিল তার সিঁথির সিঁদুর বেশি লাল নাকি রায়ানের মাথা দিয়ে যা গড়িয়ে পড়ছে .....
-"আপনি কি একবারো ভেবেছিলেন যে আপনার স্বামী আর ফিরবে না ?"
-"আপনাদের বিয়ের তো ছমাসও হয় নি, আপনি এখন কি করবেন ?"
-"আপনি কি এর জন্য তৈরি ছিলেন?ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছেন?"
-"আজ স্বামী ফিরলে কি রান্না করবেন ভেবেছিলেন ?"
-"আপনাদের কি লাভ ম্যারেজ ?অতীতের কোন স্মৃতিটা আজ সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে?জেনেশুনে পুলিশকে বিয়ে করেছিলেন ?"
পিয়ার কানে প্রশ্ন গুলো তিরের ফলার মতো ঢুকতে থাকে!! অতীত ভবিষ্যত বর্তমান সব গুলিয়ে গেছে ওর। সময় যেন থমকে গেছে। কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া আর কিছুই নেই ওর চারপাসে। সময়ের কালো গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ওর চেতনা।এই শূণ্যতলহীন কালো কুয়োর ভিতর ও পড়েই চলেছে। আচ্ছা, রায়ান যখন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ওর কি এমন কষ্ট হচ্ছিল!!
ফেসবুক জুড়ে চলছে ওদের বিয়ের ফটোর পাশাপাশি এখনকার ফটো কপিপেষ্ট করে লাইক কুড়ানোর খেলা!! মুহূর্তের মধ্যে সবাই চিনে নিচ্ছে ওদের। চ্যানেলের টিআরপি বেড়ে চলেছে!!
পিয়া ভাবলেশহীন শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রক্তে ভেজা সাদা কাপড়টার দিকে, পিয়ার চোখে জল নেই। ও এক দৃষ্টে দেখছে সবাইকে। ওর মনে একটাই প্রশ্ন!! ওর চোখের গভীর দৃষ্টি দেখতে চাইছে আজ যারা ওর অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে কাটাছেড়া করছে তাদের শরীরের রক্তের রঙ কি ?
(সমাপ্ত)