Manik Goswami

Abstract Others

3.8  

Manik Goswami

Abstract Others

ক্ষমাপ্রার্থী

ক্ষমাপ্রার্থী

4 mins
324



'তোমার কি হয়েছে বলতো | যে কোনো কথাতেই এতো রাগ, এতো বিরক্তি | বিয়ের পর থেকেই তোমার এই পরিবর্তন, কারণটা কি | আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না | যদি একটু বলে দাও|


আমরা দুজনেই সেই কিশোর বয়স থেকেই একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছি | তুমিই তো আমায় সাহিত্যের রসধারায় সিক্ত করে রেখেছিলে | প্রথম দিকে আমার সব চাওয়া তো বহির্মুখী ছিল | খেলাধুলা ভালোবাসতাম | সাহিত্যের দিকে মন দিতেই পারতাম না | তুমিই তো আমার মনের জগতে পরিবর্তন এনেছিলে | গল্প, উপন্যাস, কাব্য, কবিতা তুমি এতো ভালোবাসতে যে ধীরে ধীরে তোমার এই ভালোবাসার স্রোতে আমিও ভাসতে শুরু করে দিয়েছিলাম | নিজের অজান্তেই কখন যে সাহিত্য আমার অন্তরে অনুভূতি তৈরী করেছিল তা অবচেতন মনেও বুঝে উঠতে পারিনি| বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সাহিত্যের প্রতি আমাদের দুজনের অনুরাগ আমাদের জীবন লক্ষ্যকে এক নতুন পথের দিশা দেখিয়ে দিলো|


দুজনে পাশাপাশি বসে কত না সাহিত্য চর্চা করেছি এক সময়, আজ যেটা সত্যিই স্বপ্নের বলে মনে হয় | রাতের আকাশে তারাদের ভিড়ে নিজেদের হারিয়ে যেতে তুমিই শিখিয়েছিলে | তুমিই দেখিয়েছিলে যে মাঠের ঘাসের ওপর বসে থেকেও চাঁদ-তারাদের দেশে কল্পনার জাল কি ভাবে বোনা যায় | শুধু তারার পানে চেয়ে থেকেই কত কবিতা রচনা করা যায় | তুমিই প্রথম শিখিয়েছিলে যে পায়রাদের বক বকম শব্দের মধ্যেও ভালোবাসার কত তরঙ্গ বয়ে যায় | নিজের মনের মধ্যে জেগে ওঠা ভাবটাকে কত সহজে পাশে বসে থাকা সঙ্গীটির প্রাণে প্রবেশ করিয়ে বসন্তের মৃদু হাওয়ার দোলায় দুলতে থাকা গাছের পাতাগুলোর মতো তার হৃদয়েও দোলা দেওয়া যায় | তুমিই তো শুনতে শিখিয়েছিলে কোকিলের কুহু স্বরে প্রাণের আর্তি মিশে গিয়ে শ্রবণেন্দ্রিয়র মাঝে কেমন এনে দেয় মিষ্টি, সুরেলা, মধু মাখানো অনুভূতি | সুনীল আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলির দিকে তাকিয়ে থেকে তুমিই তো আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলে মনটাকে সর্বদা সাদা রাখার প্রয়োজনীয়তা, স্বচ্ছতা বজায় রাখার কৌশল আর পিছন পানে না চেয়ে, ভাসতে ভাসতে, হাসতে হাসতে এগিয়ে চলার মন্ত্র | সমুদ্রের তরঙ্গের মধ্যেও তুমি খুঁজে পেতে কাব্যিক ছন্দ|


চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এমনকি অমসৃণ তটের বাধাকে উপেক্ষা করে একতালে এগিয়ে চলার প্রতিশ্রুতি | বাগিচায় রঙিন ফুলের মাথা হেলিয়ে একে অন্যের কাছাকাছি আসার প্রবণতার মাঝেও তুমি খুঁজে বেড়াতে কাব্যের মহিমা - কবিতার ছন্দ | ফুলে অলি এসে বসুক বা নাই বসুক, ফুলের কানে মিলন বার্তা দিক বা নাই দিক, তুমি কিন্তু ফুলের দোল খাওয়ার ছবিটাকে চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরে বুঝিয়ে দিতে কেউ তোমাকে ভালো বাসুক বা নাই বাসুক, আদরে আদরে ভরিয়ে দিক বা নাই দিক, তুমি কিন্তু তোমার মনটাকে ফুলের মতোই নিষ্পাপ রেখে দেবে আর মনটাকে সদা প্রফুল্ল রেখে ফুলের মাথা দোলানোর মতোই বিনম্রতাকে ধরে রাখবে | অলির শত আঘাতেও যেমন পুষ্পরাজি রুষ্ট হয় না তেমনই তুমি তোমার ওপর যতই বাহ্যিক আঘাত আসুক না কেন মুখের হাসিটাকে বিলীন হয়ে যেতে দিতে না | যে সিঁদুরে মেঘ দেখলে ঘর পোড়া গরুও ভয় পায়, সেই মেঘের অন্তরের রঙিন ছবিটাকে তুমি তোমার উপলব্ধিতে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত রঙিন ইচ্ছাটাকে সাহসে পর্যবসিত করে বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার আশ্বাস এনে দিয়েছ |


আজ হঠাৎ এমন কি হলো যে তুমি সংসারের মায়াজালে এইভাবে আবদ্ধ থেকে তোমার অমূল্য উপলব্ধিগুলোকে হেলায় সরিয়ে দিয়ে, শুখনো মরু বালুর ওপর দিয়ে এগিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে | তোমার চিন্তাধারার সাথে ভাবনা গুলোকে বেঁধে নিয়েই তো আমরা এগিয়ে এসেছি এতটা পথ | আজ হঠাৎ বজ্রাঘাতে আমার মনের ইচ্ছেগুলো, কল্পনাগুলো, চিত্রপট গুলো সব কেমন ভেঙে যাচ্ছে | আমার চিন্তাশক্তি, যা আমি তোমার কাজ থেকেই পেয়েছি, আর আমার অন্তরের অভ্যন্তর থেকে ফুটে ওঠা সেই শক্তি আজ আমি হারিয়ে যেতে বসেছি শুধুমাত্র তোমার সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য | সংসারের একটা দায়িত্ববোধ তো থাকবেই, কিন্তু সেটা কিভাবে এবং কখন দুর্বিষহ জ্বালা হয়ে উঠলো যে সারাদিনের ব্যস্ততা আর রান্নার আগুনের উত্তাপ তোমার চিন্তাধারাকেই বন্দি করে দিলো ঘরের কোণে | তোমার মনের এই বন্দিদশা, যা কিনা ওই মুক্ত আকাশ আর সেই আকাশে পাখিদের মতো তোমার মুক্ত বিচরণকে, মনের অভিব্যক্তিকে, সাহিত্য রসে সিক্ত হবার প্রগাঢ় অনুভুতিগুলিকে এক লহমায় ছিনিয়ে নিয়ে তোমাকে তো স্থবির, জড় পদার্থ বানিয়ে তুললোই, আমাকে করে দিলো নিঃস্ব, সর্বসান্ত | আমি সত্যিই হেরে গেলাম | হয়তো ভুলটা আমিই করেছি | তোমাকে সংসারের জটিল বন্ধনে আবদ্ধ না করে আমরা যদি সারা জীবন শুধুমাত্র বন্ধু হয়েই থাকতে পারতাম, যদি আমরা সারাজীবন ধরেই নিজের মনের ভাবধারাকে একে অন্যের চোখের সামনে তুলে ধরতে পারতাম, কল্পনার জগতে সাগরের লহরীর মতো উত্তাল হতে পারতাম, তাহলে আমি আমার সেই চিন্তাশীল, ভাবুক, পৃথিবীর সৌন্দর্য্যকে নিজের বিশ্লেষণে অনন্ত সুন্দর করে গড়ে তোলার ক্ষমতা সম্পন্ন মনের মানুষটিকে, মনের অনেক অনেক নিকটে রাখতে পারতাম | একটা প্রতিভাকে, একজন সৌন্দর্য্য প্রেমিককে, স্বপ্নের বাতাসে ভাসতে শেখানোর প্রশিক্ষক এবং পরামর্শদাতাকে এভাবে হারিয়ে যাবার রাস্তা প্রশস্ত করে দেবার জন্য আমি সত্যিই অনুতপ্ত, ক্ষমাপ্রার্থী | তুমি আমাকে মার্জনা করে দিও |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract