Manik Goswami

Romance Others

3  

Manik Goswami

Romance Others

বন্ধন

বন্ধন

6 mins
185



‘চলো না আজ কোথাও ঘুরে আসি| আর তো ঘরে বন্দি হয়ে বসে থাকতে পারছি না। কতদিন হয়ে গেলো, তোমার সঙ্গে দেখাও হয়নি, ঘুরতে যাওয়াও হয়নি। আজকে যেতেই হবে। চলো না, মিন্টো পার্ক বা মিলেনিয়াম পার্ক, কোথাও একবার চলো। না গেলে ভালো হবে না কিন্তু, চিরদিনের জন্যে আড়ি হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি'। হোয়াটস আপে মেসেজ টা পড়েই রণিত একটু হাসলো | শ্রেয়া পাঠিয়েছে মেসেজটা | মেয়েটা সত্যিই ঘরে বন্দি থেকে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে | এখন তো লক ডাউনের জন্য স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল, রেস্টুরেন্ট সবই বন্ধ | অজুহাত দেখিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর আর কোনো রাস্তাই তো খোলা নেই | কি ভাবে দেখা হতে পারে শ্রেয়ার সাথে। হাজার চিন্তা করেও তো দেখা করার জন্য কোনো উপায় বার করা যাচ্ছে না। একটু বিমর্ষই হয়ে পড়ে রণিত। কতদিন দেখা হয়নি শ্রেয়ার সাথে | ঘরে বন্দি থেকে শ্রেয়া কতটা হাঁপিয়ে উঠেছে, রণিত নিজেকে দিয়েই সেটা বেশ উপলব্ধি করতে পারছে। সত্যিই, আর একদম ভালো লাগছে না। এবার কোনো একটা উপায় বার করতেই হবে। মোবাইলের মাধ্যমে ভিডিও কলে যেটুকু দেখা হয় বা কথা হয়, ব্যস, ওই পর্যন্তই | দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটানো যায় ? তাও তো আবার কথা বলতে হয় লুকিয়ে চুরিয়ে | বাড়ির কেউ যদি দেখে ফেলে বা জেনে যায় তাদের মনের টানের কথা, তাহলে তো আর আস্ত রাখবে না | সেই মুহূর্তেই হয়তো মারধোর করে ঘর থেকে বের করেই দেবে | রণিত তো তবু দোকান বাজার করার জন্য কিছুক্ষনের জন্যে হলেও বাইরে বেরোতে পারছে। শ্রেয়ার পক্ষে তো সেটাও করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক দিন হয়ে গেলো, ঘরের বাইরে পা ই রাখতে পারছে না, রণিতের সাথে দেখা হওয়া তো দূর অস্ত | রণিত মেসেজের উত্তরে জানালো, ' কি আর করবে বলো শ্রেয়া | চারিদিকে যে মহামারী শুরু হয়েছে, তাতে কেউ তো আর সাহস করে ঘরের বাইরে বেরোতেই পারছে না | খাবার-দাবারও তো অনলাইন আনাচ্ছে | এ অবস্থায় আমাদের ইচ্ছে থাকলেও আমরা তো আর বাইরে দেখা করতে যেতে পারছি না | ফলে হোয়াটস আপই ভরসা | ভিডিও কলে তোমাকে অন্তত একবার হলেও তো দেখতে পাই’|

- ‘তবে আর কি, ছবি দেখেও শান্তি পাও। ঘরে বন্দি থেকে থেকে যেদিন সত্যি সত্যিই ছবি হয়ে যাবো, সেদিন বুঝতে পারবে কি হারালে’।

- 'এরকম কথা বলছো কেন। তোমার সাথে দেখা করতে না পারলে, ঘুরে বেড়াতে না পারলে, আমারই কি ভালো লাগে বলো। কিন্তু পরিস্থিতি তো আমাদের এইভাবে আটকে রেখে দিয়েছে। সরকার থেকেই তো নিয়ম বেঁধে দিয়েছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো চলবে না'।

-'আমাদের দেখা করাটা কি জরুরি প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে না? ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে দেখা করাটা। খুব তাড়াতাড়ি দেখা করার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করো'। 

-'একটু ধৈর্য্য ধরো শ্রেয়া। মহামারীর প্রকোপটা কমলেই লক ডাউন উঠে যাবে ঠিক। তখন আমরা আবার আগের মতোই মেলামেশা করতে পারবো'।

- কিন্তু রণিত, আমি তো আর ঘরে থাকতেই পারছি না | অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি | লক ডাউন কবে উঠবে তার তো কোনো ঠিক নেই। হয়তো উঠলোই না, এইভাবেই চলতে থাকলো। তাহলে, এ জীবনে আর কি আমাদের দেখাই হবে না। এই, তোমাদের বাড়ি চলে যাই | তোমার সঙ্গে দেখা করে দুটো কথা বলে আসি?

- আরে, পাগল হয়ে গেলে নাকি | আমার বাড়িতে তো সবাই জেনে যাবে তাহলে | এমনকি তোমার খোঁজে বেরিয়ে তোমাদের বাড়ির লোকেও তো জেনে যাবে সবটাই | আর আমাদের কি হাল হবে তারপর সেটা বুঝতে পারছো কি?

- আমি অতশত বুঝি না | আমার বাড়িতে থাকতে আর একদমই ভালো লাগছে না | তুমি যা হোক একটা ব্যবস্থা করো |

- কি অবুঝ মেয়ে রে বাবা | আচ্ছা ঠিক আছে | দেখি আমি কি করতে পারি |

হঠাৎ করেই রণিতের জ্বর এসে গেলো | ধুম জ্বর | ডাক্তার ডেকে ওষুধ পত্র খাইয়েও জ্বর কমছে না | জ্বরের ঘোরে অনেক কিছুই বলতে থাকলো | তারই মধ্যে ঘুরে ফিরে মুখে শ্রেয়ার নাম | শ্রেয়াকে আসতেই হবে, না হলে জ্বর কমবে না | শ্রেয়া কে ?- বাড়ির লোকে সেই প্রশ্নই করতে লাগলো একে অন্যকে | রণিতের ছোট ভাই সৈকত বোধহয় জানতো শ্রেয়াকে | সবার সামনেই রণিত আর শ্রেয়ার একে অন্যকে ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা সৈকত একেবারে গড়গড়িয়ে জানিয়ে দিলো। সেই স্কুলের সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগে থেকেই যে তাদের জানাশোনা, একে অন্যকে ভালো লাগতে থাকা, অবশেষে কেউ কাওকে এক দিনও না দেখে থাকতে না পারার কথা, সবই জানাতে বাকি রাখলো না সৈকত। 'এতদূর এগিয়ে গেছে আর আমরা জানতেই পারিনি' - রণিতের মায়ের গলায় একটা আক্ষেপের সুর যেন ভেসে উঠলো। শ্রেয়া কেমন মেয়ে, কি পড়াশোনা করছে, বাড়ির লোকেরা কেমন, বাবা কি করেন, এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে সৈকত শ্রেয়ার হয়ে একেবারে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে দিলো। শ্রেয়াদির মতো মেয়ে ভূভারতে পাওয়া যাবে না, পড়াশোনায় কেউ ওর ধারে কাছেও আসতে পারে না, ওর বাবা-মা এতো ভালো যে ওদের মতো মানুষ এখনকার সময়ে পাওয়া দুর্লভ, বাবা সরকারি অফিসের খুব বড় অফিসার, সব জানিয়ে দিলো সৈকত। বাড়ির সবাইকে সৈকতই শ্রেয়ার বাড়ির হদিস দিয়ে দিলো | রণিতের বাবা বললেন, 'ছেলেটা চাকুরীতে যোগ দেবে আর এক সপ্তাহ পরেই। যদিও এখন ঘরের থেকেই অফিসের কাজকর্ম করবে, তবুও প্রথম চাকুরী বলে কথা। এইসময় যদি এতো অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে, কাজকর্ম করবে কি করে। নাহঃ, জ্বরটা তো যে ভাবেই হোক কমাতেই হবে। শ্রেয়া শ্রেয়া করে ছেলেটা যেমন ভুল বকেই চলেছে, তাতে শ্রেয়াদের বাড়িতে আমাকে একবার যেতেই হবে। শ্রেয়া কে দেখে যদি জ্বর টা কমে'।  

বাবা চলনেন শ্রেয়াদের বাড়িতে | পরিচয় পর্বের পর, ছেলের অসুখের খবর নিয়ে ও তার মুখে বারে বারে শ্রেয়ার নাম শুনেই তিনি যে ছুটে এসেছেন জানিয়ে অন্তত একবারের জন্য হলেও রণিতের পাশে শ্রেয়ার থাকার অনুরোধ জানালেন | অনেক কথা, অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর শ্রেয়ার মা-বাবা রাজি হলেন শ্রেয়াকে রণিতের কাছে পাঠানোর জন্য | তবে শ্রেয়ার মা ও যে সঙ্গে যাবেন সেটা রণিতের বাবাকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন | সব শুনে শ্রেয়াও আনন্দে লাফিয়ে উঠলো |

রণিতের হাতে হাত রেখে শ্রেয়া বলে উঠলো, 'তোমার এই অদ্ভুত অসুখের জন্য আমরা আবার কাছাকাছি আসতে পারলাম রণিত | কি যে ভালো লাগছে। তবে আমাদের দেখা হওয়ার জন্য তোমার এই জ্বরের অভিনয় করার জন্য ধন্যবাদ'। -'কি বলছো তুমি, অভিনয় ? আজ্ঞে না মশাই, এটা অভিনয় নয়। সত্যি সত্যিই আমার জ্বর হয়েছে। আর সেটা এমনি এমনিই আসে নি। রাতের বেলায় সবাই যখন ঘুমোচ্ছে, প্রায় পাঁচ- ছয় ঘন্টা আমি চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসেছিলাম। সকালের দিকে যখন ঠান্ডা লেগে জ্বর এসে গেছে তখন উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। এমনি এমনি তোমাকে কাছে পাই নি। অনেক কষ্ট করে, অনেক সাধনা করে তোমাকে আমার কাছে আনতে পেরেছি'। - 'যাই বলো, তোমার এই সাধ করে জ্বর আনার কৌশল বাস্তবে কার্যকরী হয়েছে। অনেক দিন পর আমরা আবার দেখা করতে পেরেছি। তবে আমাদের দুই বাড়ির সকলেই আমাদের মেলামেশার, দেখা করার ব্যাপারটা জেনে গেলো। এখন সবার কাছেই সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমরা এখন অবাধেই মেলামেশা করতে পারি, কি বলো। রণিত বলে উঠলো, ‘শ্রেয়া তুমি যখন এসেই গেছো আমার এই অদ্ভুত অসুখটা তুমি ভালো করে দাও | আমাকে সারিয়ে তোলো | আমি জানি, শুধুমাত্র তোমার হাতের ছোঁয়া পেলেই আমার সমস্ত অসুখ ভালো হয়ে যাবে | তুমি আমার মাথায় তোমার হাতের ছোঁয়াটুকু দাও’ | শ্রেয়া অতি আদরের সাথে রণিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো | দরোজার বাইরে থেকে রণিতের মা ওদের দুজনকে এতটা আন্তরিকভাবে কথা বলতে দেখে শ্রেয়ার মাকে বলে উঠলেন, ' এবার তো আমাদের তাহলে ভেবে দেখতে হয় দিদি | এতটা ভালোবাসা বোধহয় আমরা কেউ কোনোকালেই দেখাতে পারিনি আর পারবোও না | তাছাড়া অসুখ সারানোর ডাক্তার যখন ঘরের কাছেই আছে, তখন সেটিকে তাহলে ঘরে এনে তুললেই হয় |

-' ঠিক বলেছেন দিদি | আমিও একই কথা ভাবছিলাম | ওদের এই প্রেম, ভালোবাসাকে যদি আমরা উঠতি বয়সের ভ্রম বা আবেশ বলে একে অন্যের থেকে আলাদা করে দেওয়ার চেষ্টা করি, আমার মনে হয় সেটা উচিত সিদ্ধান্ত হবে না। তাছাড়া, দুজনেই এখন প্রাপ্ত বয়স্ক। একজন কলেজ পাশ করতে চলেছে, আর একজন তো চাকুরী জীবন শুরু করতে চলেছে। ওরা নতুন যুগের ছেলে মেয়ে, ওদের চিন্তাধারা এবং সাহস সম্পূর্ণ আলাদা | একদম আমাদের চিন্তাধারার সঙ্গে মিলবে না, কিন্তু আমরা মানিয়ে নিতে পারলেই সব মঙ্গল | ওদের মত ই আমাদের মত হোক না | আমরা বরং এবার তাহলে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠার প্রস্তুতি শুরু করে দিই | কি বলেন' |

- 'অবশ্যই'।

                              ------x------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance