Manik Goswami

Classics Fantasy

4.5  

Manik Goswami

Classics Fantasy

আশীর্বাদ

আশীর্বাদ

6 mins
16


আশীর্বাদ

মানিক চন্দ্র গোস্বামী


- 'কি হলো কাকিমা, এতো রাতে তোমাদের ঘর থেকে এতো হৈচৈ, কান্নাকাটির আওয়াজ আসছে কেন ? পাশের বাড়ির ছেলে অরূপ ঘুম থেকে উঠে পড়ে জিজ্ঞাসা করে মনোজের মাকে। 

- 'চেঁচামেচি, কান্নাকাটি কি আর সাধে ? রাত-বিরেতে ঘুমের মধ্যেই মনোজকে সাপে কেটেছে রে বাবা। হয় ভগবান, এটা তুমি কি করলে ? আমার সোনার টুকরো ছেলেটাকে তুমি এইভাবে কেড়ে নিলে ? মনোজের মা অরূপের সাথে কথা বলেই নিজে একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

- 'কাকিমা, যত শিগগির পারো মনোজকে হাসপাতালে নিয়ে যাও'।

- 'কে নিয়ে যাবে রে বাবা। ঘরে তো তোমার কাকুও আজকে নেই। সে তো শহরে গেছে। সেখানে কোন এক উকিল সাহেবের সাথে তার নাকি কথা আছে। ওই যে জমিটা নিয়ে ক্ষুদু শেখের সাথে তার একটু কথা কাটাকাটি, মারপিটের উপক্রম হয়েছিল, তারই জেরে তাকে শহরের কোর্টে ডেকেছে, তাই উকিলের সাথে কথা বলতে গেছে।

- 'মারামারির উপক্রম হয়েছিল বলছো কেন কাকিমা ? মারামারিই তো হয়েছিল। মার খেয়ে কাকু তো বাঁশ দিয়ে মেরে ক্ষুদু শেখের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলো। আর তাতেই তো ক্ষুদু শেখ পুলিশের কাছে ডায়েরি করে দেয়। সে যাগগে, ঘরে সরোজ নেই ? অবশ্য সরোজ তো খুবই ছোট। ও আর কি করতে পারবে' ?

- 'সরোজকে তো পাঠিয়েছি পাশের গ্রামের ওঝার কাছে। তার হাতে পায়ে ধরে যদি নিয়ে আসতে পারে,তবে ঝাড়ফুঁক করে যদি মনোজের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারে'।

-'ওঝা ? ওঝা, গুণীনে কিছু হবে না। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আর তুমি কি বলো তো কাকিমা। ওই একরত্তি ছেলে সরোজকে তুমি এই গভীর রাতে ওঝাকে ডেকে আনতে পাশের গ্রামে পাঠালে ? ভগবান করুক কিছু যেন না হয় ওর। ভয়টয় যেন না পেয়ে যায়। আচ্ছা, এক মিনিট অপেক্ষা করো, আমি আসছি'।

মনোজ এ বাড়ির বড় ছেলে। এই এ বছরেই স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ দিয়ে কলেজে উঠেছে। শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে। সামনেই পুজো, তাই ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এমন কপাল যে ঘুমের মধ্যেই সাপে কাটলো। প্রথমে বুঝতে পারেনি। ভেবেছিলো বুঝি স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নে মনে হচ্ছে যে, কোনো কিছু তার শরীরে ধীরে ধীরে একটা তরল পদার্থ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসতেই ঘরে লণ্ঠনের হালকা আলোতে দেখতে পায় সাপটাকে বন্ধ ঘরের দরোজার নিচের ফাঁক দিয়ে বাইরে চলে যেতে। কি সাপ সেটা ঠিক বুঝতে পারেনি। তবে সাপই যে ছিল সেটা নিশ্চিত।

মনোজ চোখের সামনে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে। মৃত্যুভয় মনের মধ্যে চেপে বসছে। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই সব শেষ হয়ে যাবে। জীবনের আরো অনেকটা পথ হাঁটার কোনো সুযোগই থাকছে না আর। ভগবানের এটা কি ধরণের অবিচার। তার মানে, ভালো কিছু করার কোনো মূল্যই পাওয়া যায় না আর। এই যে সেদিন চোখের সামনে একটা লোককে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলো,তার কোনো প্রতিদানই সে পাবে না ? স্টেশনে ধীরে ধীরে ঢুকছিল ট্রেনটা। সবার আগে উঠে বসার জায়গা দখল করবে বলে লোকটা লাফিয়ে উঠতে গিয়েই পা পিছলে পড়ে গিয়ে একেবারে ট্রেন আর প্লাটফর্মের ফাঁক টুকু দিয়ে ভেতরে পড়ে যাচ্ছিলো। চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটতে দেখে মনোজ আর স্থির থাকতে পারে নি। দৌড়ে গিয়ে দুহাত দিয়ে ভদ্রলোকের কোমরের কাছে জড়িয়ে ধরে প্লাটফর্মের দিকে টেনে নিয়ে আসে। নিজের বিপদ যে হতে পারতো, সেটা একবারের জন্যও মাথায় আসে নি। বিপদে সাহায্য করা উচিত এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই দৌড়ে গেছিলো সে। অসংখ্য প্রশংসা পেয়েছিলো সেদিন। মনে মনে গর্ব বোধও হয়েছিল একটা জীবনকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দোর গোড়া থেকে টেনে এনে নতুন জীবন পাইয়ে দেবার জন্য। কিংবা, ওই যে সেদিন সেই ভিখারীটা, যে সারাদিন হাত পেতে, কাকুতি মিনতি করেও একটা পয়সা ভিক্ষা পায়নি, তাকে মনোজ তার স্কুলের টিফিনটা দিয়ে তো দিয়েইছিলো, উপর থেকে নিজের পকেটে থাকা হাত খরচের একশো টাকাও দিয়ে দিয়েছিলো সেই ভিখারীটাকে, এই ঘটনাটাও কি ভগবানের চোখে পড়েনি নাকি ভুলেই গেছে। এ রকম অজস্র ঘটনা আছে যেখানে মনোজ মনপ্রাণ দিয়ে চেয়েছিলো অন্যের ভালো হোক, নিজের ভালোর কথা চিন্তাই করে নি। অথচ, আজ এই অসময়ে, যখন তার সাহায্যের বড়ো প্রয়োজন, যখন সে তার মৃত্যুকে সামনে দেখতে পাচ্ছে, ভগবান কি এইভাবে চোখ ঘুরিয়ে থাকবেন ?

 অরূপ এসে দাঁড়ালো মনোজদের ঘরে।

- 'মনোজ এখন কেমন আছে গো কাকিমা ? ওই তো, জ্ঞান তো আছে দেখছি। এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে মনোজকে বাঁচানো যেতে পারে কাকিমা। আচ্ছা কাকিমা, তুমি কি করে বুঝলে যে সাপে কামড়েছে'।

- 'হ্যাঁ, মনোজ নিজেই তো দেখেছে সাপটাকে চলে যেতে। আর তা ছাড়া, আমি দু দুটো কাঁচালঙ্কা ওকে চিবিয়ে খেতে দিয়েছি। লঙ্কাগুলোয় এত ঝাল, অথচ ওর এক বিন্দুও ঝাল লাগেনি। এ সাপের কামড় ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না'।

- 'থাক না কাকিমা। তোমার এইসব টোটকা কাহিনী শুনে কি হবে? তার চেয়ে এখন একটা দড়ি জাতীয় কিছু দাও। বাঁধতে হবে। কিন্তু এমন জায়গায় কামড়েছে, পায়ের একেবারে ওপর দিকে, কোমরের একটু নিচে। ওখানে দড়ি বাঁধাই তো মুশকিল। তবুও দাও, কোনোভাবে একটু বেঁধে দিই। কিন্তু কাকিমা, ওকে হাসপাতালে কি ভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে ? গরুর গাড়িতে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে তো অনেক সময় লেগে যাবে। তাছাড়া এখন তো রাতের বেলা, গরুগুলোকে গাড়ির সঙ্গে জুড়তেই সময় লেগে যাবে। এক কাজ করা যাক কাকিমা। নাড়ুর একটা মোটর বাইক আছে না ? হ্যাঁ, এই তো কিছুদিন হলো কিনেছে। যাই নাড়ুকে ডেকে তুলে বাইক টা নিয়ে আসতে বলি'।

অবশেষে নাড়ুর কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে বাইকে করে মনোজকে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। নাড়ুই বাইক চালিয়ে নিয়ে এলো। মনোজকে মাঝখানে বসিয়ে পেছন থেকে অরূপ তাকে জাপটে ধরে নিয়ে এলো। মাঝে রাস্তায় ঘুমের ঘোরে নাড়ু বাইক নিয়ে তো নদীতেই নেমে যাচ্ছিলো। চিৎকার চেঁচামেচি করে অরূপই সে যাত্রা নাড়ুর হুশ ফেরায়। সদর হাসপাতালে যে ডাক্তার আছেন, তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। চেয়ারে বসেই রাতের ঘুমটুকু সেরে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। গভীর রাত। এ সময় সাধারণত রোগী নিয়ে কেউ আসতে চায় না, খুব বেশি জরুরি অবস্থা না হয়ে পড়লে। তবুও সরকারী নির্দেশে রাতেও হাসপাতাল খোলা রাখতে হবে। একজন ডাক্তারকেও হাজির থাকতে হবে হাসপাতালে। আচমকা রোগী এসে পড়ায়, ঘুম চোখ মুছে নিয়ে ডাক্তারবাবু রোগীর কি হয়েছে জানতে চাইলেন। সব শুনে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, 'কি সাপ' ?

-'কি সাপ সে তো বলতে পারবো না ডাক্তারবাবু। তবে মনোজই রাতে সাপের কামড় খেয়ে ধড়ফড় করে উঠে পড়তেই সাপটাকে দেখতে পায় দরোজার নিচে দিয়ে চলে যেতে'। অরূপ ডাক্তারবাবুকে নিজের ক্ষমতামত বোঝানোর চেষ্টা করে।

-'হুঁ, সাপ না হয়ে ইঁদুরও তো হতে পারে। বড় ধেড়ে ইঁদুর কামড়ালে সাপে কাটার মতো পাশাপাশি দুটো রক্তমাখা ফুটো দেখতে পাওয়া যায়। যাই হোক, আমি ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি। তবে এতক্ষন হয়ে গেছে, মুখ দিয়ে যখন ফেনা জাতীয় কিছু বেরোয় নি, তখন চিন্তার কোনো কারণ নেই। এমনও হতে পারে, যে সাপটা কামড়েছে সেটা নির্বিষ ছিল, বিষধর নয়। এই আমি ইনজেকশন দিয়ে দিলাম। একটু ঘুম ঘুম পাবে। ও পাশের ওই বেঞ্চটাতে একটু শুইয়ে রাখো। মনে হচ্ছে সুস্থ হয়ে যাবে। যদি অবস্থা খারাপের দিকে যায়, আমি তো আছি । চিন্তার কিছু নেই। রাতে ফিরতে হবে না। ভোরের আলো ফুটলে ওকে নিয়ে যেও'।

মনোজ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। মনের মধ্যে একটা প্রশ্নের উত্তর ও কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। কামড়ালো কিসে ? অথচ কিছু একটা কামড়েছে তো ঠিকই। দুটো পাশাপাশি কাটা ক্ষতও তো দেখতে পাওয়া গেছে। রক্তও বেরিয়েছিল দু ফোঁটা। অথচ শরীরে কোনোরকম অস্বস্তি তো হয় নি। ভয় পেয়ে গিয়েছিলো খুব, সেটা ঠিক। সেটা ছাড়া আর অন্য কোনোরকম কষ্টবোধ তো হয় নি। এটাই কি তাহলে ভগবানের আশীর্বাদ। এ ভাবেই কি ভগবান কোনো ভালো কাজের পুরস্কার দিয়ে থাকেন নিঃশব্দে। আমরা, সাধারণ মানুষেরা, সেটা বুঝতে না পেরে অজান্তেই এই অদৃষ্ট শক্তির ওপর অযথা অভিমান করি, রাগ দেখাই।    

             -----x-----


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics