STORYMIRROR

Manik Goswami

Classics Inspirational

4  

Manik Goswami

Classics Inspirational

দেবদূত

দেবদূত

5 mins
332

            দেবদূত                                                                                                                                                                                                                                  মানিক চন্দ্র গোস্বামী

যে বৃদ্ধ মানুষটা প্রতিদিন ভোর হতেই ঘরের দরোজায় এসে দুটো পয়সার জন্য হাত পাততো, দেখতে পাচ্ছি না তাকে বেশ কয়েকদিন হলো | বৃদ্ধের ডাক দেওয়া আর আমার পয়সা দেওয়া প্রতিদিনের প্রাথমিক কাজের মতোই হয়ে গেছে আমাদের |মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট যেমন আছে, তেমনি সুখ- শান্তিও বিরাজমান। একে অন্যের পরিপন্থী। তবু, দৈন্যের মাঝে, বেদনার মাঝে, কষ্টের মাঝে আনন্দকে খুঁজে নিতে পারে কজন। দুটো পয়সা হাতে পেলেই বৃদ্ধের চোখে মুখে যে প্রশান্তির ছাপ ফুটে ওঠে সেটা দেখতে পাওয়াও সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি প্রতিদিন সেই অনাবিল খুশি দেখার আশায় উৎকণ্ঠা নিয়ে ভোরের আলো গায়ে মেখে অপেক্ষা করি। পয়সাটা হাতে পেয়ে বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া, জীর্ণ-শীর্ণ মুখে একগাল তৃপ্তির হাসি নিয়ে যে ভাবে ক্ষীণ হাতদুটি মাথার ওপর রেখে আশীর্বাদ দেন, তাতে আমি পরিতৃপ্ত হই। আমার সারা দিনের পাওয়া সেই আশীর্বাদের ছোঁয়া, আমাকে আমার দিনের কাজের অনুপ্রেরণা জোগায়, আমি ধন্য হই। হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো, মন বললো তাহলে কি বৃদ্ধ বেঁচে নেই | হয়তো তাই | কিন্তু আমার এতো খারাপ লাগছে কেন | আমাদের তো কোনো রক্তের সম্পর্কই নেই | ওহ, তাই বুঝি | রক্তের সম্পর্ক থাকলেই ভালো লাগা বা খারাপ লাগা থাকতে পারে -- নিজেকেই প্রশ্ন করতে থাকি মনের মাঝে | প্রতিদিন যে মানুষটাকে দেখছি একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়াতে, নিজের অজান্তেই যে তার ওপর টান এসে যায় সেটা সত্যিই উপলব্ধি করা যায় এই হঠাৎ করে না আসার কারণেই | জীবনে দুটি পয়সা ভিন্ন অন্য কিছু তো দিতে পারিনি তাকে, পারিনি তার কষ্টের জীবনটাকে নিজের উপলব্ধিতে সামিল করে নিয়ে অন্য কোনো ভাবেও তাকে সাহায্য করতে | তাই হঠাৎ জেগে ওঠা এই মনোবেদনাকে প্রশ্রয় দিয়ে, আবার কোনো একদিন সকালে তাকে দোরগোড়ায় দেখতে পাবো এই আশার ওপর বিশ্বাস রেখেই নিজের মনের মাঝেই একটু ব্যথিত হই | 

তিনদিন হয়ে গেলো, বৃদ্ধ লোকটি আজও এলেন না। সকাল থেকেই মন খারাপের একটা বাতাবরণ তৈরী হয়ে গেলে কাজে মন বসে না। কোনোকাজই ঠিকমতো হতে চায় না। অফিসের কাজেও মন বসছে না। মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ায় কাজে কর্মে ভুল ভ্রান্তিও হয়ে যাচ্ছে। নাহ, এভাবে উদ্বিগ্নতার মধ্যে দিন কাটানো সম্ভব নয়। আমাকে ওই বৃদ্ধের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতেই হবে। পরের দিন শনিবার, আমার অফিস ছুটি। খবরটা আমাকে নিতেই হবে যে বৃদ্ধের কি হলো।

মোটামুটি জানতাম বৃদ্ধ কোথায় থাকে, সঠিক জানতাম না। যাই হোক, জিজ্ঞাসাবাদ করে খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হলাম বৃদ্ধের ঘরে। দেখি, শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে মুখে ক্ষীণ একটা হাসি নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই একরকম জোর করেই তাকে আবার শুইয়ে দিলাম। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম যে আজ তিনদিন হলো বৃদ্ধ জ্বরে পড়ে আছেন। আপন জন বলে কেউ নেই বৃদ্ধের। বৌ অনেক দিন আগেই মারা গেছে। এক ছেলে ছিল। দিন মজুরের কাজ করতো। ভিন রাজ্যেও কাজ করতে যেত মাঝে মাঝে। যা আয় করতো, তাতে বাপ-বেটার খাওয়া পড়ার কোনো অভাব হতো না। ভগবানের অন্যায় বিচারে কোভিড মহামারী ছিনিয়ে নিয়ে গেলো ছেলেকে। অনেক চেষ্টা করেছিল ছেলেকে বাঁচানোর। হাসপাতালে ডাক্তারদের হাতে-পায়ে ধরে অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল। রোগের প্রকোপে ডাক্তাররাও ছিলেন অসহায়। বাঁচাতে পারেন নি একমাত্র ছেলেকে। সেই থেকে বৃদ্ধ একা। ভিক্ষাবৃত্তি করে যে কয়েকটা পয়সা হাতে আসে তাতেই চাল-ডাল ফুটিয়ে নিয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করে। জ্বরে পড়ে থাকায় ভিক্ষায় যেতে পারেনি এই ক'দিন। হাতে পয়সা নেই তাই ডাক্তারও দেখানো হয় নি। পড়শিরা নিজেরাই জ্বর কমানোর ওষুধ কিনে এনে খাইয়েছে। তাতে জ্বর এখনও কমে নি। মানুষের মধ্যে মানবিকতা বোধ বোধহয় আজও জেগে আছে। তাই পড়শিরাও যতটা সম্ভব বৃদ্ধের খাওয়া-দাওয়া এবং সেবা শুশ্রূষার দিকেও খেয়াল রেখেছে। আমিও এই অসহায় বৃদ্ধের কিছুটা হলেও যদি কোনো কাজে আসতে পারি, সেই চিন্তা করেই ডাক্তার ডেকে এনে তার চিকিৎসা করাই। দিন দুয়েক পর সুস্থ হয়ে উঠলে আমি বৃদ্ধ কে একদিন আমার ঘরে এসে দেখা করার জন্য অনুরোধ করি।                                   

ঘরে একসাথে বসে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতে আমাদের অনেক গল্প হতে থাকলো। বৃদ্ধের চোখেমুখে তৃপ্তির একটা ভাব আমি লক্ষ্য করলাম। কে জানে, কতদিনের পর একটু পেট ভরে খাবার খেতে পারছে। 

-'তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব বাবা, তোমার মঙ্গল হোক এই কামনাই করি'। বৃদ্ধ কথাগুলো বলে ওঠার সাথে সাথেই আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, 

-'না, না। এ আবার এমন কি। সামান্য তো দুপুরে একবার খাওয়াতে পেরেছি মাত্র। তার জন্য এতো বিনয়ের প্রয়োজন নেই। আর তাছাড়া আমাকে বাবা বলে ডেকেছেন মানে আপনি আমাকে আপনার ছেলের জায়গায় বসিয়েছেন। সুতরাং আপনার ছেলে হিসেবে একটা আবদার আপনার কাছে আমি রাখতেই পারি। এই সংসারে তো আপনি একেবারেই একা। দেখাশোনা করার, অসুস্থ হলে সেবা-শুশ্রূষা করার, দিনে দুবেলা খেতে দেবার মতো তো কেউ নেই আপনার। এই অবস্থায় আপনি যদি আমাকে সত্যি সত্যিই আপনার ছেলে বলে মনে করে থাকেন, তবে আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ আপনাকে রাখতেই হবে। আমি আমাদের সংসারে আপনাকে এনে রাখতেই পারি, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন কোনো অশান্তি হয়, সে আমাদের তরফ থেকেই হোক বা আপনার পছন্দ নয় এমন কোনো ঘটনা ঘটে, সেটা আমাদের উভয়ের পক্ষেই মঙ্গলকর হবে না। তাই আমি ঠিক করেছি আপনার বাকি জীবনের দায়িত্ব নিয়ে আপনাকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে দেব। এ বিষয়ে আমি এক বৃদ্ধাশ্রমের কর্ণধারের সাথে কথাও বলে রেখেছি। ওরাই আপনার দেখাশোনা করবে। থাকা, খাওয়া, অসুস্থ হলে চিকিৎসার ভার সবই ওদের দায়িত্বের মধ্যেই থাকবে। উপরি পাওনা হিসেবে আপনি আপনার সম বয়সী লোকজনের সাথে একসাথে থাকতে পারবেন, গল্পগুজব করতে পারবেন, শেষ জীবনটা আনন্দে কাটাতে পারবেন'।

-'কিন্তু বাবা, সে তো অনেক খরচের ব্যাপার। আমার কাছে তো কানাকড়িও নেই যে আমি সেখানকার খরচ চালাতে পারবো'।

-'খরচ খরচার ব্যাপারে আপনাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না। সে দায়িত্বটা আমার ওপরেই থাক না হয়। আপনি শুধু চিন্তাহীন সুস্থ জীবন যাপন করুন। আমি আপনার পাশে আছি'।

- ‘এ তুমি আমাকে কি শোনালে বাবা। আমি তো স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারি না। ভগবান নিশ্চয়ই আছেন। আমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। নিজের ছেলেকে হারিয়ে আজ আমি আবার তোমাকে আমার ছেলে রূপে কাছে পেলাম। ভগবান তোমার তোমার মঙ্গল করুন । আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, এমন লোকও পৃথিবীতে এখনও আছে যে অন্যের জন্য চিন্তা করে, অন্যের কষ্টকে অনুধাবন করতে পারে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। পৃথিবীটা এখনও তাহলে রসাতলে যায় নি'।

আমি নিজে নিজেই একটা পরম তৃপ্তির স্বাদ উপলব্ধি করতে থাকি।


             -----x-----


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics