Debdutta Banerjee

Tragedy

2.0  

Debdutta Banerjee

Tragedy

কমলী

কমলী

5 mins
1.7K


#কমলী

#দেবদত্তা_ব‍্যানার্জী


বারান্দার কোনে ছেড়া খাটিয়ায় কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে বুড়োটা , ঠিক একটা জড় পদার্থর মত।মুখের চামরা জুড়ে ফুটে ওঠা হাজার বলিরেখায় ফুটে ওঠে কত না বলা ইতিহাস, খড়ি ওঠা হাত পা আর মরা মাছের মত চোখ দুটোর ঘোলাটে চাওনি, মাথায় কয়েকটা সাদা চুল, আর একটা নোংরা কাপড় জড়ানো শরীরের অপ্রয়োজনীয় একটা মনুষ‍্যতর জন্তুর মত মাঝে মাঝে কেশে উঠে জানান দেয় সে বেঁচে রয়েছে। রঞ্জার কেমন যেন ভয় লাগে আজকাল বুড়োকে দেখলে। তবে বুড়োটা কথা বলে না। সকালে একটা ভাঙ্গা কাপে লাল চা আর কলাইয়ের বাটিতে মুড়ি বা জল চিড়া, দুপুরে একটু শাক ভাত, কোনো কোনো দিন গেড়ি গুগলির চচ্চড়ি, কখনো বা শাপলা সেদ্ধ যেমন জোটে বুড়ো তাই খায়। রাতে দুটো গুড় রুটি, বা ছাতু মাখা দিলেই হয়ে যায়। অবশ‍্য এর বেশি ওদের জোটে না, যা জোটে তাই ওরা ভাগ করে খায় বেঁচে থাকার জন‍্য। মাঝে মাঝে রঞ্জা ভাবে একে কি বেঁচে থাকা বলে?

রঞ্জার মানুষটা, সেই কাক ভোরে দুটো বাসি পান্তা খেয়ে শহরে যায় মজুর খাটতে। কাজ জুটলে ফিরতে রাত হয়, কাজ না জুটলে বেলা থাকতে গ্ৰামে ফিরে রেল লাইনের ধারের ঠেকে ঢুকে বাংলা চোলাই খায়। 

রঞ্জা সকালে তিনবাড়ি বাসন মাজে, ফেরার পথে মিত্তিরদের পুকুর থেকে গেড়ি গুগলি আর শাক পাতা নিয়ে ফেরে। কখনো দুটো চুনো মাছ বা কই মাছ পেলে হরির দোকান থেকে বাকিতে একটু তেল পেয়াজ চেয়ে আনে। ক্ষেত থেকে দুটো আলু তুলে আনে। সে দিন দু মুঠো চাল বেশি নেয়। 

বুড়োটাকে আজ এত গুলো বছর এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে রঞ্জার একেক সময় মনে হয় ওটা ঠিক মানুষ তো? সকালে একবার ওঠে বুড়ো, ঠুকঠুক করে লাঠি ঠুকে পাশের এঁঁদো পুকুরে যায়, বিকেলেও কখনো একবার যায় । ওটুকু না গেলে ঐ নোংরা রঞ্জাকেই ঘাঁটতে হত। ওটাই প্রমান সার আছে এখনো। 

গত পাঁচ বছরে বুড়োটার মুখে কাশির শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ পায়নি রঞ্জা। অথচ বিয়ে হয়ে এসে রঞ্জা এই বুড়োর দাপট দেখেছিল। বুড়ো তখন চৌধুরীদের লেঠেল ছিল। এর ওর ক্ষেতের ফসল দেনার দায়ে যখন চৌধুরীদের লোকেরা কেটে নিত এই বুড়ো একা লাঠি হাতে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতো। একা পঞ্চাশ জনকে আটকাতে পারত বুড়ো। রঞ্জা বিয়ে হয়ে এসে দেখেছিল ওর মানুষটা মেজ চৌধুরীর খাস লোক। তখন রঞ্জার পরণে উঠতো ডুরে শাড়ি, পায়ে রূপার মল। কানে গলায় ছিল রূপার মাকরি। সতেরো বছরের রঞ্জার কালো ছিপছিপে শরীরটার টানে মানুষটা ঘরে ফিরত। কখনো রঙিন ফিতা, টিপের পাতা, ঠোঁটের রঙ নয় মাথার তেল আনত, মানুষটা ওর জন‍্য। আর ছিল ছোট্ট ছন্দা, ঠিক যেন একটা রঙ্গীন প্রজাপতি, রঞ্জার ননদ, বৌদি বলতে অজ্ঞান। বাচ্চা মেয়েটা ছিল বর্ষার মেঘের মত চঞ্চল, বৃষ্টির মত স্নিগ্ধ, বুড়ো বাপের মুখের উপর ঐ মেয়েই শুধু কথা বলতে পারত। এই ঘরের লাগোয়া জমিতে বড় কাঁঠাল গাছটায় দড়ির দোলনায় দোল খেত ছোট্ট ছন্দা, বাতাবী জামরুল আর পেয়ারা গাছে বাদরের মতো লাফিয়ে উঠত। মিত্তিরদের পুকুর এক ডুবে এপার ওপার করত। ওর চঞ্চলতায় হার মেনেছিল গাছের পাখি থেকে কাঠ বিড়ালী। 

কার যে নজর লেগেছিল রঞ্জা জানে না। দশ বছর আগের সেই জল ঝড়ের রাতে মাত্র বারো বছরের মেয়েটা যে কোথায় হারিয়ে গেলো!!

রঞ্জার মেয়েটা তখন খালি পিপি বলতে শিখেছিল। বাড়িতে সবাই চুপ করে গেলেও সেই অবুজ শিশু পিপির খোঁজ করেই যেত। এর পরেই বাপটা বুড়ো হয়ে গেল রাতারাতি কেমন করে যেন। কাজ ছেড়ে সারাক্ষণ পরীকে নিয়েই থাকত। তিন বছরের পরী, পিপিকে ভুলতে দাদুকে আঁকড়ে ধরেছিল। ততদিনে মেজো চৌধুরী গত হয়েছে। রাজত্ব ছোট চৌধুরীর হাতে। সবাই বলত ছোট চৌধুরী সাক্ষাত শয়তান, গ্ৰামের মেয়েরা কেউ রেহাই পেত না ওর নোংরা নজর থেকে। রঞ্জার মানুষটার কাজ আগেই গেছিল, সেবার বর্ষায় নদীর ভাঙ্গনে আবাদী জমিটাও গেল। বাধ‍্য হয়ে রঞ্জা কাজ নিয়েছিল মিত্তিরদের বাড়ি, আর প্রসাদদের বাড়িতে। মানুষটা শহরে গেছিল কাজের খোঁজে। আর বুড়োটা বাড়ি আর পরীকে আগলে রাখত। মাঝে মাঝে বিরবির করে কি সব বলত। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলত। 

মিত্তিরদের বাড়িতেই কানাঘুষোয় কথাটা শুনেছিল রঞ্জা। ছন্দা ছাড়া গ্ৰামের আরো কিছু বাচ্চা মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। প্রমাণ না থাকলেও সবাই পেছনে ছোট চৌধুরীর নাম করত। লোকটার নিত‍্য নতুন মেয়েছেলে লাগে, কচি মেয়েদের দিকেই বেশি নজর। বিকৃত রুচির লোকটা পয়সার জোড়ে পুলিশকে কিনে রেখেছিল। 

পাঁচ বছর আগে এক শীতের বিকেলে পরী গেছিল ক্ষেত থেকে মটরশুঁটি তুলতে, পলু ওর খেলার সাথী এসে বুড়োকে বলেছিল পরীকে তুলে নিয়ে গেছে ছোট চৌধুরীর লোক। বুড়ো লাঠি হাতে একাই ছুটেছিল চৌধুরী বাড়ি। কিন্তু লোহার দরজার ওপার থেকে পরীর চিৎকার শুনলেও বুড়ো দরজা ভাঙ্গতে পারে নি। ভেতরটা ভেঙ্গে গেছিল বুড়োর। চৌধুরীদের লোকেরা ফেলে গেছিল একটা দলা পাকানো লাশের মত বুড়োকে ঐ খাটিয়ায়। তারপর থেকে পাঁচ বছর বুড়োটা জড় পদার্থ হয়ে বেঁঁচে আছে। 

রঞ্জার মানুষটা মদ ধরেছিল মেয়েকে ভুলতে। আর রঞ্জা কয়েকদিন পর বুকে পাথর বেঁঁধে তিনটে পেটের জোগাড় করতে নেমেছিল।পেট গুলো যে অবুজ। 


কমলীটার ভরা মাস, অত বড় পেটটা নিয়ে চলতে কষ্ট হয়। পরের অমাবস‍্যায় বিয়োবে মনে হয়। ভাতের ফ‍্যানটুকু ওকে দিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রঞ্জা। কমলী তো তার মেয়ের মতই। পরীর পর ওকেই আঁঁকড়ে ধরেছিল রঞ্জা। কমলীও এই বাড়ির চারদিকেই ঘোরে, ছন্দার মত, পরীর মত চঞ্চল সে। 

সেদিন সন্ধ‍্যায় মিত্তিরদের বাড়ি কাজ শেষে ফেরার পথে চেঁঁচামেচিটা কানে গেছিল রঞ্জার। ক্ষেতটা পার করে তেলী পুকুর, তার পাশেই ভাঙা মন্দির পার করে বড় বট গাছ। বাঁশ বনের শেষে ওদের ভিটাটাই গ্ৰামের শেষ সীমানা। তারপর রেলের জমি পার করে স্টেশন। চেঁঁচামেচিটা ওদিক থেকেই আসছে। আবার কি হল!! কূ ডাক ডাকে ওর মন। দ্রুত পা চালায়। বাঁশ ঝাড়ের সামনে ভিড়ের মাঝে চেনা গলাটা পেয়ে ওর পা দুটো মাটিতে গেঁথে গেছিল। সামনে গিয়ে সবটা দেখে গাটা কেমন গুলিয়ে উঠেছিল রঞ্জার। এরা মানুষ!! 

বুড়োটা তখন চিৎকার করে চলেছে, আমার ছন্দা, পরী সব কটাকে খেয়ে শখ মেটে নি তোর। আর কত সর্বনাশ করবি। আজ তোকে শেষ করে ফাঁসি যাবো আমি। অত জন মিলেও বুড়োকে ধরে রাখতে পারছে না। বুড়োর লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়েছে রক্তাক্ত প্রায় উলঙ্গ ছোট চৌধুরী।একটা কেন্নোর মত গুটিয়ে গেছে ওর পৌরুষ । একপাশে ভারি পেটটা নিয়ে পড়ে রয়েছে কমলী, না না পরী, না ওটা ছন্দা। হাতের বেথুয়া শাক ফেলে ছুটে আসে রঞ্জা। কমলীকে কোলে টেনে নেয়। রক্তে ভিজে ওঠে কাপড়। মা হতে পারল না কমলী। আর্তনাদ করে ওঠে আরেক মা, -''পরী..ই..ই...ই..''।

শেষ বারের মত কেঁপে ওঠে রক্তে ভেজা কমলীর কালো শরীরটা। চোখের কোনে দু ফোটা জল।

বুড়োটা তখনো পা দিয়ে লাথি মারছে ছোট চৌধুরীকে। ''আর একটাকেও খেতে দেবো না। আজ তোকে শেষ করবো। ''

আস্তে আস্তে ভিড়টা বাড়ছে, গুজগুজ ফিসফাস চলছে। শেষ অবধি কিনা চৌধুরীর এই বিকৃত রুচি!! ছাগলটার পেটটা দেখেও মায়া হল না!! পশুরও অধম লোকটা!!

রঞ্জা, কমলীকে জড়িয়ে ধরে বলে -'' কমলীও যে মেয়ে, মেয়ে জন্মটাই ওর অভিশাপ।''


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy