কল্যাণমস্তু
কল্যাণমস্তু


কথায় আছে,"সব তীর্থ বারবার,গঙ্গাসাগর একবার"। সব পথ আজ তাই সাগরমুখী। সাগরসঙ্গমে পুণ্যস্নানে মকর- সংক্রান্তির মাহেন্দ্রক্ষণে পাপস্খালনের ভিড়। গঙ্গাসাগর তাই সরগরম। মাহেন্দ্রযোগে কনকনে ঠান্ডায় জলে ডুবে পুণ্যলাভের আশায় ঠান্ডাকে কার্যত পাত্তা না দিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। বহু মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়েছিল বাসন্তীও। তিনবছরের ছেলে বাবুনকে নিয়ে গঙ্গাসাগরে পুণ্যি করতে যেতে বারণ করেছিল সবাই,শোনেনি সে। রমেনেরও খুব মত ছিল না অতটুকু ছেলে নিয়ে ওই ভিড়ে,কনকনে ঠান্ডায় যাবার,কিন্তু তার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে ওকে। তাকে পুণ্যস্নান করাতে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল বাসন্তী। যাত্রাপথে প্রতিটি মুহূর্তে রোমাঞ্চ অনুভব করেছে সে তার পুণ্যলাভের স্বপ্নপূরণ হবার আশায়। লট ৮ থেকে কচুবেড়িয়া ঘাট পৌঁছানোর পথে লঞ্চ থেকে দু'চোখ ভরে দেখেছে অগাধ জলরাশি,ছেলেকে নিয়ে মজা করেছে কত। রমেনেরও খুব ভাল লাগছিল। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল সে যাবার আগেই। পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল,বাসন্তী খুব উত্তেজিত,পরদিন ভোরেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, জন্ম-জন্মান্তরের পুণ্য সঞ্চয় করবে সে,স্বর্গলাভ হবে তার মৃত্যুর পর।
সে রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ল ওরা,ভোরবেলায় উঠতে হবে যে। ভোরবেলায় ছেলেকে পর্যাপ্ত পোশাক পরিয়ে সঙ্গে নিয়ে সাগরতীরে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে বড় আনন্দ করে অবগাহনে পুণ্যস্নান করল বাসন্তী ও রমেন। ভিজে গায়ে কনকনে হাওয়া যেন ছুরি চালাতে লাগল। জলে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে করজোড়ে সূর্যদেবকে প্রণাম করে জল থেকে উঠে ছেলের দেখা আর পেল না তারা। অস্থির বাসন্তী ছুটে বেড়ালো সাগরতীরে "বাবুন বাবুন" করে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে। তার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল শনশন হাওয়ার আওয়াজে, মানুষের ভিড়ে। কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। ভিড়ের মাঝে কে বা কার খবর রাখে? আর তাই ওরাও ছেলের খোঁজ পেল না। বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল বাসন্তী,একবার ভাবল ডুবে গেছে সাগরে,কিন্তু ঐ বিশাল জলরাশির মাঝে কোথায় পাবে তাকে খুঁজে,ভাবে কোথাও ভেসে গিয়ে উঠবে হয়তো দেহ।
মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে বাসন্তী মেলা ভেঙে গেলেও। না কোনও দেহ ওঠেনি ভেসে আশেপাশে কোথাও। ওর দৃঢ় বিশ্বাস ছেলে ওর ওখানেই আছে। কিছুতেই ফিরবে না সে। অনেক কষ্টে রমেন তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনে। শাশুড়ি দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন বৌমাকে সবার কথা অগ্রাহ্য করে জোর করে গঙ্গাসাগরে গিয়ে তার নাতিকে হারানোর জন্য। শেষে শ্বশুরমশাইয়ের বদান্যতায় বাড়িতে স্থান হয় তার। রমেনও বিরূপ কিন্তু বাসন্তীর অবস্থা দেখে কিছুটা নরম হয় সে। বাসন্তী যেন বোবা হয়ে গেছে। কোনো কথা বলে না,চুপচাপ সারাদিন,ঘোরেফেরে,খায়-দায়, যেন কলের পুতুল। বছর ঘুরতে চলল। বাসন্তী ব্যাকুল হয়ে পড়ল গঙ্গাসাগর যাবার জন্য। তার ব্যাকুলতা দেখে রমেন তাকে নিয়ে গেল মেলায়। সেই থেকে প্রতিবছর গঙ্গাসাগর মেলায় যায় বাসন্তী ও রমেন কিন্তু স্নান করে না,চলতে থাকে তাদের খোঁজ আর চলে পুণ্য সঞ্চয়। পুণ্যবলে যদি পাওয়া যায় বাবুনকে। ভিখারিদের ভিক্ষা দেয়,সাধু-সন্ন্যাসী দেখলেই প্রণাম করে আর ঘুরে বেড়ায় ভিড়ের আনাচে-কানাচে। ওর বিশ্বাস ছেলেকে ও খুঁজে পাবে ওই মেলায়।
দেখতে দেখতে ১৫ বছর পার। গায়ে ছাইভস্ম মাখা জটাজুটধারী নাগা সন্ন্যাসীদের প্রণাম করার সময় পায়ের তলায় তেলকের আকারে কাল জরুল দেখে চমকে ওঠে বাসন্তী।"বাবুন?" বলে মুখের দিকে তাকায় সে। সন্ন্যাসী তার মাথায় চামর বুলিয়ে বলে "কল্যাণমস্তু"।