কিস্তিমাত
কিস্তিমাত
ওর সাথে আজ বোধহয় দশ বছর পরে দেখা।ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ কিন্তু এই স্টুডিও পাড়াতে নয়। ওর বাড়িতে তখন ওর মাথায় রূপালী পর্দায় কাজ করার ভুতটা ঢোকে নি। ভাগ্গিস ওর বাবার আলাদা করে প্রোমটারি ব্যবসাটা ছিলো তাই নয়তো চার পাঁচ ছবি ফ্লপ করার পর নায়িকা হিসেবে কাজের সাহস কেউ দেখাতো না। তবে খুশির খবর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম "প্রাইভেট চাকুরী" তে আর সম্প্রতি রিলিজ পাওয়া কিছু ওয়েব ফিকশন ছবিতে ও সফলতা পেয়ে সাম্প্রতিক।
আমার লেখা ‘শেষ চিঠি’ হঠাৎ করে ওকে নায়িকা হিসেবে নিয়েছেন দেখলাম পরিচালক চক্রবর্তী বাবু। ক্যারিয়ারে প্রথম থেকেই দিয়া ভালো অভিনেত্রী ও মডেল সেটা প্রমাণ দিয়েছিল বিজ্ঞাপন আর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তবে পুরোদস্তুর অভিনেত্রী হিসেবে ও যে মানানসই চরিত্র আর গল্প পেলে অসাধারণ সাবলীল অভিনয় করতে পারে তার উদাহরণ ও দিয়েছে বহুবার। ছবি নির্মাতা চক্রবর্তী সেটা জানেন ভালো ভাবে । ওনার পরিচালনায় স্বল্পদৈর্ঘ্য ফিকশন ছবি "কয়নে" ও ভালো অভিনয় করেছে।
আমার গল্পে আছে প্রেম, পরিবার আর বিচ্ছেদের রেশ। আর এমন গল্পে দিয়া যদি ওর সাভাবিক অভিনয়টা করে। তাহলেই দেখা যাবে তা সাম্প্রতিক সময়ের সম্ভাবনাময় এক সাবলীল অভিনেত্রী হিসেবে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসবে রিয়াকে। কারণ ছবি গল্পটা হয়তো ওর চরিত্র সাথে মিল নেই কোন তাই আমি খুব ভয় পেয়ে ছিলাম। আমি আজ শেষ দিন স্টুডিও পাড়ায় এলাম কারণ। লোকজন বলছে ফাটাফাটি অভিনয় করেছে ও।
আমি আড় চোখে ওকে দেখলেও, ওর সাথে যখন কথা বললাম না। তখন ও সাবাইকে অবাক করে, আমার কাছে এলো নিজে থেকে। যতোই পুরোনো সম্পর্ক থাকুক ও এখন একটা স্টার অভিনেত্রী । একটা সিগারেট ঠোঁট লাগিয়ে বললো " লাইটার আছে?"
আমি বললাম " আমি এখনো সিগারেট খাইনা"
ও বললো "ভালো আমি খাই না। দেখতে। চাইলাম বদলে গেছো কিনা। চেহারাটা আগের থেকে ভালো হয়েছে।"
আমি বললাম " ধন্যবাদ "
ও বললো " ধন্যবাদ তো আমার তোমাকে দেওয়া উচিত। আমি নিজে নিজে এখন কফি বানাতে পারি! পেক আপ পর যাবে কফি খেতে আমার বাড়ি?"
হেসে সম্মতি দিলাম। আমার লেখা গল্পে বর্তমান আধুনিক সময়ে এসেও সমাজের এক শ্রেনীর মানুষের চিরকালীন ধ্যান ধারণা এবং চিন্তা-চেতনার আঁকড়ে ধরে থাকার প্রতিচ্ছবি উঠে তুলে ধারার চেষ্টা করেছি। এক গানের অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় নায়ক এবং নায়িকার। তারপর সে পরিচয় রূপ নেয় ভালোবাসায়। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ ভালোবাসে ঘর বাঁধে। নায়িকা অনাথ মেয়ে তাই তার শাশুড়ি ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেয়নি তাকে কখনো। তার কাছে এ সমাজে ভালোবাসার কোনো অবস্থান নেই, শুধু আছে বংশ আর পরিচয়। এই টানাপোড়েনে চলতে থাকে চলতে থাকে ওদের সংসার। শাশুড়ির মনের ভাব গোপন থাকেনা নায়িকার কাছে কিন্তু নায়িকা নীলাঞ্জনা একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে বলে নিজের জায়গা থেকে সবটা করার চেস্টা করে যায়। কিন্তু একসময় দাম্ভিক এবং অহংকারী মা জিতেও হেরে যায়! কিন্তু তখনই আবার গল্পে নতুন মোর চাকুরী পায় নীলাঞ্জনা , আর সেখানে আলাপ হয় প্রদীপের সাথে। ও ঘর ছাড়ে নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে কিন্তু ওর আর ঘর বাঁধা হয় না। নীলাঞ্জনা বাকি জীবনটা একা হয়ে কাটায়।
কিভাবে কি হয় আর সেটাই দেখানো হয়েছে এই ফিকশনে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বউ হিসেবে নীলাঞ্জনা চরিত্রে দিয়া একবারও চরিত্রের বাইরের কেউ মনে হয়নি। শ্বাশুড়ির সাথে বনিবনা না হওয়া, নিজের মনের নানা বলা-অবলা কষ্ট চেপে রাখা সত্ত্বেও মুখে হাসি এনে সংসার করা তরুনীর ভূমিকায় রিয়া সোজা বাংলায় কিস্তিমাত করেছে। এমন চরিত্রেই আমরা সাধারণ দর্শকরা রিয়া দেখতে চেয়েছে কিনা আমি জানি না। ওকে আজ অবধি সবাই একটু বড়োলোকের বদ মেজাজী মেয়ে হিসেবে দেখছে। কিন্তু এই ছবিতে শুধু চিত্রনায়িকা নয় একজন অভিনেত্রীও বটে সেটা প্রমাণ করবে। আজ ছবির শেষ দিন তাই আমি এসেছি।
নীলাঞ্জনা চরিত্রে তার লুক, সিম্পল সাজপোশাক, চোখের অভিব্যক্তি, ডায়লগ ডেলিভারি সব কিছুতেই যেনো অনবদ্য দীয়া। কয়েকটা ইন্টারভিউতে বলেছে আমার গল্প বলেই নাকি ও চরিত্রটা এতো সুন্দর ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।
আমার গল্পে প্রথম ছবি তৈরি হচ্ছে কিন্তু তবুও আমি কেন যেনো খুশি না। আসলে নীলাঞ্জনা চরিত্রে শেষ পর্যন্ত হয়তো চোখে জল আনবে দর্শকদের।‘শেষ চিঠি’ তে রিয়ার পাশাপাশি যশ রাহুল দা ও অভিনেত্রী অপরাজিতা দি তাদের সেরাটাই দিয়েছেন। এমনকি শ্বাশুড়ি চরিত্রে সায়ন্তনী ফাটাফাটি। অনেকদিন পর মনকাড়া পারফরম্যান্স উপহার দিলেন। আরেকটি চরিত্রে মিলি মুন্সীও নিজের ছাপ রেখেছে। দক্ষিণী সিনেমাটোগ্রাফি বরাবরের মতোই মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। কালার গ্রেডিংও ঠিকঠাক। তবে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের। গল্প, চিত্রনাট্য এবং দৃশ্যের সাথে মিল রেখে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর টিম প্রশংসার দাবিদার। ম গাওয়া দুটো গানই বেশ শ্রুতিমধুর। সবমিলিয়ে বাংলার মন্দা ছবির স্বল্পদৈর্ঘ্য ফিকশন ভালো লাগার মতোই একটি কাজ। তবে দিনশেষে অভিনেত্রী হিসেবে রিয়া্য প্রত্যাবর্তন এই কাজটিকে আলাদা একটি স্বতন্ত্রতা এনে দিয়েছে পুরোপুরিভাবে। সামনের দিনে রিয়ার নিজের দক্ষতা এবং ভালো চরিত্রে নিজেকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মনোযোগী হবে এটাই কামনা করি। YouTube টেলার দেখতে বুহু মানুষ ভিড় করছে। ফলে সফলতা ও পাবেই।
" শেষ চিঠি " আমার নিজের জীবনের গল্প। তবে দিয়াতো একটা সময় এই জীবনের অংশ ছিলো। উত্তম কুমার তনুজা ছবির ফ্যান ছিলাম আমি। ওর মামা ছিলো তখন বাংলা এবং হিন্দি ছবির সুরকার। আমি তখন উরতি কবি । স্বপ্ন ছিলো আমার গান বাংলা ছায়াছবির গান হিসেবে গাওয়া হোক। ওদের ডাইভারকে পটিয়ে গাড়ির ম্যাকানিক কাম ডাইভার হিসেবে চাকরি নিয়ে ওদের বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ হলো। আমি উত্তম ও তনুজা প্রেম তো হবার ছিলো। সবাই জেনে গেলো সুরকার হতেই আমি ছদ্দবেশ এসেছি। কিস্তিমাত হয়ে গেছিলো ও আমার ছোট ছোট চালেই কিন্তু অসুবিধা হলো যখন দিয়া অভিনেত্রী হাবার জন্য জিদ ধরলো।
তারপর কি আবার " শেষ চিঠি" গল্পটা। নীলাঞ্জনা সাথে দেখা। ও চলে গেলো কিন্তু আমি অপেক্ষায় নষ্ট করলাম দশটা বছর।
কফিতে চুমুক দিয়ে দিয়াকে বললাম " বাহ ভালো কফি বানাতে শিখেছো দেখছি। "
ও বললো " ও ধন্যবাদ। কিন্তু অভিনয় কেমন করেছি বললে না তো?"
আমি বললাম " আমার গল্প পরে লোকে নীলাঞ্জনাকে ঘৃণা করবে। কিন্তু তোমার অভিনয় দেখে নীলাঞ্জনার জন্য লোকে চোখের জল ফেলবে।"
ও হেসে বললো " তাহলে তো কিস্তিমাত। তুমি তো সেটাই চাও মনে মনে। কারণ এখনো তো তুমি ওকে ভালো বাসো। "
আমি বললাম " না"
ও হাসলো বললো " তাই নাকি ! তাহলে আজ রাতটা আমার কাছে থেকে যাও"
আমি তাকালাম। কারণ কথাটা আমাকে কিস্তিমাত করে দিলো।
