কি বাজে
কি বাজে
ক'দিন ধরেই আমার মনটা খুব খারাপ। আমার ফ্ল্যাটের ঠিক উল্টো দিকে যে বাড়িটা, তার তিনতলায় থাকেন যে মহিলা, তিনি পেশায় বোধহয় নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী। আমার সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় নেই কিন্তু তাঁর জীবিকা সম্পর্কে জানতে পেরেছি সাম্প্রতিক, থ্যাঙ্কস টু করোনা।
ভদ্রমহিলার স্বামীও তাঁরই মত কোন এমার্জেন্সি সার্ভিসে আছেন। দু'জনেই রোজ সকাল সকাল বেরিয়ে যান কাজে। একজন আয়া রেখেছেন বোধ হয় তাঁদের বছর সাতেকের শিশুকন্যাটিকে দেখাশোনা করার জন্য। গতকাল সারা দুপুর সেই বাচ্চাটিকে কাঁদতে শুনেছি। শুধু আমি না, নিশ্চয়ই সেটা আসপাশের বাড়িরও অনেকে শুনেছেন।
সকলেই এখন হোম কোয়ারান্টিনে, নিশ্চয়ই আয়াটিও কাজে আসছে না তাঁদের বাড়িতে! তাহলে কি ঐটুকু বাচ্চাকে বাড়িতে একা রেখেই তাঁরা কাজে যাচ্ছেন? এ তো বড় ভয়ঙ্কর ঘটনা, যে কোনো সময় ভালো মন্দ কিছু ঘটে যেতেই পারে। অতটুকু বাচ্চাকে কি বাড়িতে এতক্ষণের জন্য একা রেখে যাওয়া ঠিক?
তাঁদের ইমার্জেন্সি সার্ভিস থেকে ছুটি নেই জানি। এই দুঃসময়ে সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরাই সেকথাও মানি। তবুও একাকী শিশু সন্তান এইভাবে বাড়িতে একা কাঁদবে, আর সব ভুলে তার বাবা-মা জরুরী পরিষেবা দিতে বাধ্য হবেন তাকে ছেড়ে - এটাও মানা গেল না।
সরকার তো এসব ক্ষেত্রে কম্পালসারি ক্রেস সার্ভিস দিতে বাধ্য! কিন্তু সেই পরিষেবাও কি পাচ্ছেন না তাঁরা? তাই বাধ্য হয়ে নিজেদের শিশু সন্তানটিকে এইভাবে একা বাড়িতে রেখে যাচ্ছেন? মানবিকতার খাতিরে, যতই জরুরী পরিষেবা দেবার দরকার হোক না কেন, তাঁদের এই কাজকে মানতে পারছিলাম না কিছুতেই।
কাল সারা দুপুর বাচ্চাটির কান্না শুনেছিলাম, তাই মনটা বড় খারাপ, ভারাক্রান্ত ছিল। যদিও অন্যের কোন ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তবুও ঠিক করেছিলাম - আমার ওই প্রতিবেশী দম্পতির কাউকে সামনে পেলে, দু'কথা না শুনিয়ে কিছুতেই ছাড়বো না।
যথারীতি কাল সন্ধ্যার একটু আগে দেখলাম, সেই নার্স ভদ্রমহিলা এবং তাঁর স্বামী একসাথে নামছেন গাড়ি থেকে। আমি তো দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলাম, তাঁদের মুখোমুখি হয়ে বেশ করে দু'কথা শুনিয়ে দেবো বলে। কিন্তু নেমে তাঁদের সামনে এসে, নিজেই বোকা বনে গেলাম।
তাঁরা গাড়ি থেকে কোলে করে নিজেদের ঘুমন্ত শিশুকন্যাকে নামাচ্ছেন দেখে, আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলাম! ও মা, ওনাদের মেয়ে তো ওনাদের সঙ্গেই ছিল, তাহলে বাড়িতে সারা দুপুর কাঁদছিল কে? আমি কি তবে ভুল শুনলাম! কি জানি?
সন্ধ্যায় পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের সাথে ছাদে পায়চারি করার সময়, দেখা হয়ে গেল। কথায় কথায় তিনিও বললেন - আমাদের এই পাশের বাড়ির ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার বিষয়টা দেখছেন! নিজেরা কাজে যাচ্ছেন ওইটুকু বাচ্চাকে বাড়িতে একা রেখে! সারা দুপুর বাচ্চাটা কাঁদে!
বুঝতে পারলাম আমি ভুল শুনিনি, কিন্তু তাঁদের বাচ্চাটাকে তো তাঁদের সঙ্গেই দেখলাম! তাহলে তাঁদের ঘরে কে কাঁদছিল দিন দুপুরে? মনে মনে ঠিক করলাম, পরের দিন আরও একটু ভালো করে দেখবো, কি ঘটছে ওখানে। বিষয়টা মোটেই ভাল ঠেকছিল না আমার।
আজ দুপুর থেকে যথারীতি বাচ্চাটার কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার ফ্ল্যাটের জানালা থেকে যতটা সম্ভব, উঁকিঝুঁকি মারলাম তাঁদের ঘরের দিকে। কিন্তু কোনো কিছুই নজরে এলো না। তাঁরা কি আজকেও বাচ্চাটিকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে গেছেন, তাহলে তাঁদের ঘরে কাঁদছে কে? দিনের আলোয় তাঁদের ঘরের ভেতরটার সবই দেখা যাচ্ছিল, বাচ্চাটা সেখানে ছিল না।
একটু ভয়ই লাগলো বিষয়টা চাক্ষুষ করে - তবে কি তাদের ঘরে বাসা বেঁধেছে কোনো অশুভ আত্মা? তাই যদি হয়, তাহলে শুধু তাঁরা যখন থাকেন না সেই সময়েই, দিন-দুপুরে এমন করে কাঁদে কেন? ওনারা নিজেরা কি জানেন বিষয়টা? ওনাদের আচার-আচরণ দেখে তো মনে হয় না, এরকম কোন বিষয় নিয়ে তাঁরা চিন্তিত বলে!
সাত-পাঁচ ভেবে তাই ঠিক করলাম, আজ তাঁদের একবার জিজ্ঞাসা করেই ফেলি - তাঁরা জানেন কিনা যা ঘটছে তাঁদের ঘরে? যদি জানেন তাহলে আসল রহস্যটা জানা যাবে, আর যদি না জানেন তাহলে সব জেনে, সাবধান হয়ে যাবেন। সেই মতো সন্ধ্যাবেলা তাঁদের ফিরতে দেখে, সোজা চলেই গেলাম তাদের বাড়ী।
সেখানে পৌঁছে দেখি সদর দরজাটা খোলাই রয়েছে। আমি তিন তলায় গিয়ে দেখি, তাঁরা ঘুমন্ত মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শোয়াচ্ছেন। আমি তাঁদের দরজায় পৌঁছাতেই, কেউ বলে উঠলো - আসুন আসুন, স্বাগতম। কথাটা শুনে আমিও চমকে উঠলাম আর তাঁরাও পিছনে ঘুরে তাকালেন আমার দিকে।
আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি যে, তাঁরা আমায় ওখানে আসতে দেখেননি এবং তাঁদের কেউ-ই স্বাগতও জানাননি আমায়। তাহলে কে বলল আমায় ঐ কথাগুলো? আমার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বোধহয় তাঁরা বুঝতে পারলেন বিষয়টা। তাই সেই ভদ্রলোক আমায় ইশারা করে - ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো খাঁচায় রাখা একটা বড় সড় কাকাতুয়াকে দেখিয়ে দিলেন।
নিজের বোকা বনে যাওয়ার কথা বুঝতে পেরে, হো হো করে হেসে উঠলাম আমি। তাঁরা কৌতুক ভরে আমার পানে চাইতে, তাঁদেরকে জানালাম আমার এখানে আসার প্রকৃত উদ্দেশ্যটা। শুনে হেসে উঠলেন তাঁরাও, বললেন - হ্যাঁ, পাখিটা অবিকল মানুষের গলা নকল করে, এমন কথা বলে বা আওয়াজ করে যে, চোখে না দেখলে বোঝা মুশকিল হয়ে যায়, কোনো মানুষ নয় একটা পাখি বলছে কথা গুলো! তুই জানো কিন্তু আমাকে বলছো না।
