কান্না নেই
কান্না নেই
ধর্মরাজের সামনে আজ নতজানু হয়ে বসে - অতনুর আত্মা। মৃত্যুর পর, তাকে তীব্র ভর্ৎসনা আর কখনও মুক্তি না দেওয়ার যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন, তা প্রত্যাহার করতে, পুনর্বিবেচনার আর্জি নিয়ে এসেছে সে আজ। অথচ তাকে এই সাজা দেবার সময়, সেদিন তো খুব খুশীই হয়েছিলো সে!
তাহলে আজ হঠাৎ সেই আদেশ প্রত্যাহারের জন্য সে ব্যাকুল কেন? - প্রশ্নটা চিত্রগুপ্তই করলেন। সাজা প্রাপ্ত বিদেহী আত্মাদের কাজকর্মের হিসাব রাখার কাজ এখন বিচিত্রগুপ্ত দেখে। কিন্তু সে তো এখন ভাতঘুমে অচেতন, তাই অগত্যা তাকেই নাক গলাতে হচ্ছে শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
অতনু বললো - প্রভু আপনি আমায় যখন ঐ আদেশ দিয়েছিলেন, তখন আমি নিজেও মুক্তির প্রত্যাশী ছিলাম না। মৃত্যুর পরই তখন জানতে পেরেছিলাম, কিভাবে সারাজীবন আমাকে আমার নিজের লোকেরাই ধোঁকা দিয়ে গেছে। তাই ক্রোধের বশেই স্থির করে নিয়েছিলাম - ওদের ওপর প্রতিশোধ নেব।
তাই মুক্তি না পাবার আদেশ শুনে সেদিন এতটুকু কষ্ট নয় বরং খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি বুঝেছি… চিত্রগুপ্ত তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন - একটু ঝেড়ে কাশো তো বাপু। মরে ভূত হয়ে গেছো এতদিন আগে, তাও মর্ত্যের মানুষদের মত ভণিতা করা ছাড়লো না! যা বলবে সোজাসুজি বলো।
অতনু - আমি বিদেহী থাকতে চাই না আর। আবার মর্ত্যে মানুষ হয়ে ফিরতে চাই।
চিত্রগুপ্ত - কোন খুশীতে?
অতনু - যে খুশী আমি কখনও অনুভবই করি নি আগে - শিশুর নিষ্পাপ হাসি, প্রকৃতির ভালোবাসা।
চিত্রগুপ্ত বিরক্ত হয় - আবার হেয়ালি করা শুরু করলে?
অতনু - সেই জন্যই তো প্রভু সব খুলে বলছিলাম। আমায় বলতে তো দিন।
চিত্রগুপ্ত - বেশ, ঠিক আছে। শোনাও, কিন্তু তাড়াতাড়ি শেষ করবে।
অতনু - আমি বেঁচে থাকতে, আমাদের উপদেষ্টার মিথ্যা প্ররোচনায়, নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের জীবন নিয়েছি। আমার পাপের সত্যিই কোন ক্ষমা নেই। কিন্তু আমি কি ভুল করেছিলাম এবং কেন?
ঐ পরামর্শদাতা আমাদের বুঝিয়েছিলেন, ওখানে রাস্তা ঘাট তৈরী হলে, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল হলে বাইরের লোকেরা এসে আমাদের জায়গা কেড়ে নেবে। আমাদের আদিবাসীদের জীবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তার ফায়দা তুলবে সরকার পক্ষের নেতারা!
আমাদের অধিকাংশ অশিক্ষিত, সরল, সাধাসিধে লোক তাঁকে ভরসা আর বিশ্বাস করে বলে, তাঁর কথায় অস্ত্র ধরতে রাজী হয় সবাই - সেই দলে আমিও ছিলাম। সরকারের উন্নয়নের চক্রান্তকে ভেস্তে দিতে খুন করেছি তাদের নেতাদের, মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি সরকারী গাড়ি, অফিস।
কখনও প্রথমদিকে মনে হয়নি, কোন অন্যায় করছি। মনে হতো - তাই আমাদের শেখানোও হয়েছিলো - আত্মপক্ষ সমর্থন আর নিজেদের রক্ষা করতে, আমরা যা করছি সব ঠিক। কিন্তু, যেদিন রাস্তা নির্মাণ আর পুকুর খনন ও ঘাট নির্মাণের কন্ট্রাক্টরের থেকে, তোলা আদায়ের পরামর্শ দিলেন তিনি, আমার মোহভঙ্গ হল।
আমি বিচার করে দেখলাম - সরকারের ঐসব সিদ্ধান্তে, আমাদের ক্ষতি নয় উন্নতিই হতে চলেছিলো। কিন্তু আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। তাহলে এখন কি করার?
ঠিক করলাম, বিডিও সাহেবের আসার কথা - আগের হাসপাতালটাকেই সংস্কার করে দোতলা করে গড়ার পর উদ্বোধন করতে, ওনাকেই বলবো সব কথা। কিন্তু সে সুযোগ আর পেলাম না - হাসপাতালের গেটের কাছে তাঁর গাড়িটাকে আসতে দেখে, তার কাছে যতেই মাইন বার্স্ট করলো। তাঁরা সকলেই প্রাণ হারালেন, আমিও বাঁচলাম না - ছিটকে পড়লাম পাশের খালে।
উঠে এসে দেখি, আমার মৃতদেহ ঘিরে হাজার লোক। আর বিডিও সাহেবের গাড়ি বা লোকজনের দিকে নজরই নেই কারোর! আমি সেদিকে যেতেই দেখি - আমারই খুড়তুতো ভাইয়ের পিঠ চাপড়াচ্ছেন আমাদের সেই পরামর্শদাদা। বলছেন - ভাগ্যিস তুমি তোমার দাদার কথাগুলো বলেছিলে আমায়।
তাই, একঢিলে দুটো পাখি মারা হয়ে গেলো। বিডিওর হাসপাতালও গেলো, আর তোমার দাদার রেবেল হয়ে ওঠার সুযোগও রইলো না। এবার পঞ্চায়েতের প্রধান তুমিই হবে। কোন চিন্তা নেই, আমি আছি তোমার সাথে!
বুঝলাম, আমার ঐ ভাই যাকে বিশ্বাস করে আমি, ঐ উপদেষ্টা নামের শয়তান লোকটার চক্রান্ত ধরে ফেলার কথা বলেছিলাম - সেই বিশ্বাসঘাতকতা করে আমায় খুন করালো! আমার অবশ্য এমনটাই হওয়ার ছিলো।
কিন্তু, যে সরল সাধাসিধে নিরপরাধ লোকগুলো, এখনও বেঁচে রইলো, তাদের মঙ্গলের কি হবে? এই নরাধমগুলো তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে, তাদের মাথায় টুপি পড়িয়ে, আর কতদিন এভাবে নিজের সুবিধার্থে, তাদের পিছিয়ে রাখবে সভ্যতার আলো থেকে - দূরে অন্ধকারে?
এর একটা বিহিত হওয়া খুব দরকার। কিন্তু কে করবে? আমাদের মধ্যে শিক্ষার ছোঁয়া একটু আধটু আমার ছিলো, আর ঐ ভাইয়ের। সে তো এখন বিপথে গেছে, তাই যা করার তা আমাকেই করতে হতো।
তাই, মৃত্যুর পর আমি বিদেহী থেকেই, আমার সেই অপূর্ণ কাজ পূর্ণ করতে চেয়েছিলাম। রাতের অন্ধকার যাকে অস্ত্র করে, একের পর এক খুন করেছি আগে, এবারও তাকেই অস্ত্র করলাম।
আমার নামে শহীদ বেদী বানানো হয়েছিলো গ্রামের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে, যেখান দিয়ে সবাইকে রোজ যেতেই হতো! আমি গিয়ে ওখানেই বসে রইলাম। তারপর রাত নামলে, আমিও রাস্তায় এসে আমার এই কুঠারের এক এক কোপে, নামাতে লাগলাম ঐ শয়তানদের ধর থেকে তাদের মাথাগুলো।
আমার শহীদ বেদী, তাদের রক্তে বার বার লাল হয়ে যেতে লাগলো। আমি নিজের নৃশংসতায় আবার, বেশ উৎসাহী, খুব খুশী হয়ে উঠছিলাম। মানুষ আমায় রীতি মত, ভয় পেতে শুরু করেছিলো। অন্যায়, পাপের পথ ছেড়ে, ভয়ে এক এক করে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরছিলো সবাই! আমি নিজের এই ভীতিপ্রদ চরিত্র নিয়ে, খুব সুখী ছিলাম। কিন্তু, এই পরিস্থিটাও হঠাৎ বদলে গেলো।
ওখানে, কয়েকদিন ধরে তুমুল বৃষ্টি হলো, কয়েক দিন মেঘলা করে থাকলো, তারপর আবার রোদ উঠলো। আমিও ক'দিন ঐ বেদীর তলায় বিশ্রাম নিয়ে, সেদিন রাতে বাইরে এলাম। আস পাশ ফাঁকা দেখে, সেই হাসপাতালের দিকে গেলাম।
সেখানে গিয়ে দেখি - আমার দুর্ঘটনায় মারা যাবার জায়গাটা জুড়ে, ফুটেছে নানা রঙের ফুল, আর একটা ছোট্ট শিশু তার মাঝে হামাগুড়ি দিচ্ছে! কার বাচ্ছা, কে ফেলে গেলো জানিনা! অগত্যা যথাসম্ভব পোশাকে নিজের কংকাল চেহারা মানুষের মত ঢেকে, সারারাত পাহারা দিলাম তাকে।
ধর্মাবতার, সেই প্রথম আমার কংকাল শরীরটাকে, ছুঁয়ে দেখলো, একটা শিশু। আমার হাড়ে হাড়ে ঠোকা লেগে, খটাখট আওয়াজ হতেই, সে খুশীতে হাত পা ছুঁড়ে হেসে উঠলো হো হো করে। আমি তার সেই সরল নিষ্পাপ হাসি শুনে, প্রথমবার উপলব্ধি করতে পারলাম মানুষের আসল সুখ, প্রকৃত খুশী কি?
তার সাথে খেলতে খেলতে ভোর হয়ে এলো। ওখানে ফোটা ফুলেদের মধু খেতে এল প্রজাপতিদের দল। তারাও দেখি - ফুলের পাশাপাশি, আমার এই নোংরা শরীরেও বসলো! আজ এতদিন পর - আমি বুঝলাম, প্রকৃতির স্নেহ কি, তার ভালবাসাকে চিনলাম। আর সেই সঙ্গে বুঝলাম, নিজেরা আজীবন ধরে কত ভুল করে এসেছি।
সকালের আলো ফুটতেই, আমি ওখানেই স্ট্যাচু সেজে দাঁড়িয়ে রইলাম। শিশুটিকে হাসপাতালের একজন আয়া এসে নিয়ে গেলো। সে যাবে না আমায় ছেড়ে বলে, কেঁদে উঠলো! কান্না, হ্যাঁ আমার জীবদ্দশায় সব কিছু ছিলো আমার, তবু পাপ করেছিলাম নিরন্তর, কেন? প্রশ্নটা মনে উঠতেই পিছন পানে চেয়ে দেখি - আমার জীবনকালে সব কিছুই আছে, কিন্তু কান্না নেই! নয়তো, আমি বিপথগামী হতাম না হয়তো।
নিজের সারাজীবনের পাপ পুণ্যের হিসাব কষে, তখন দেখলাম - প্রকৃতি মা আমায় ক্ষমা করেছেন। এবার আমার পালা নিজেকে ক্ষমা করার, মানুষের কাছে নিজেকে ক্ষমার উপযুক্ত করে তোলার, তাদের আবেগকে মূল্য দেওয়ার, রক্ষা করার।
তাই আপনার দরবারে এসেছি। প্রভু আমার কৃতকর্মের সাজা আমি ভুগতে চাই, কিন্তু নিজের সারাটা জীবন মানুষের হিতার্থে ব্যয় করেই, সেই প্রায়শ্চিত্ত করবো। আমায় ফিরে যাবার অনুমতি দিন প্রভু।
তথাস্তু।
কলকাতায় সরকারী হাসপাতালের বেডে, দীর্ঘ পয়ষট্টি দিন মৃত প্রায় অবস্থায় কোমায় পড়ে থাকার পর, আজ সকাল থেকে নাকি হঠাৎ, সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উত্তেজনায় সাড়া দিচ্ছে - জঙ্গলমহলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জননেতা অতনু হেমব্রমের। এ যেন এক মিরাক্যেল, তাই না!