কালচক্র
কালচক্র
প্রথম পর্ব
নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছে একটা সাদা ঘোড়া তার সওয়ার-কে নিয়ে। অনেক পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে তাকে পৌঁছতে হবে সেই গুহা-টায়, যেখানে অপেক্ষা করছে চারভি। কয়েক'শো মাইল পথ অতিক্রম করে জঙ্গলের দুর্গম অভ্যন্তরে একটি গুহার সামনে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন মধ্যবয়স্ক তূর্যবর্মণ। সাতবাহন বংশের অবসান ঘটিয়ে সিংহাসনে বসা-ই যার একমাত্র লক্ষ্য। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে গুহার মুখ যেন এক মায়াবী দানবের আগ্রাসনের সম্মোহনী আকর্ষণ, যেখানে প্রবেশ করা যায়, কিন্তু বেরিয়ে আসা অসম্ভব।
তূর্যবর্মণ অতি সাবধানে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলেন। একহাতে তরোয়াল আর আরেক হাতে গুহার দেওয়ালে আটকানো একটি মশাল তুলে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর পৌঁছলেন নিজের গন্তব্যস্থলে। এটি গুহার প্রায় শেষ প্রান্ত, হালকা আলোয় প্রায় অন্ধকার গুহার মাত্র ২ হাত দূরের বস্তুও চোখে দেখা দুষ্কর। কিছুটা দূরে দেওয়ালের গায়ে আটকানো মশালের আলো- তে দেখা গেল একটি বিকট, ভয়ংকর পাথরের নারী মূর্তি। হয়ত কোনো ভগবান কিংবা, শয়তান! মূর্তির সামনে খোলা চুলে প্রায় অর্ধনগ্ন একজন নারী দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু মন্ত্রপাঠ করছে আর তার সাথে পাশের পাত্রে রাখা তাজা রক্তে ভেজানো ফুল, সেই মূর্তির উদ্দেশ্যে অর্পণ করছে। তূর্যবর্মণ শান্ত গলায় ডাকলেন - চারভি!
ঘূরে তাকাল সেই পূজারিণী। অল্প আলোতেও তার চোখের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা বুঝতে একমুহূর্ত সময় লাগল না তূর্যবর্মণের।
- তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। মা-এর পায়ে আহুতি দেওয়ার সব আয়োজন সমাপ্ত। এদিকে এসো- বলল চারভি।
- এতে কি সত্যিই আমি যা চাইছি সেটা পাবো? জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন করলেন তূর্যবর্মণ।
- তোমার কি আমার উপর ভরসা নেই? একমাত্র আমিই পারি তোমাকে সিংহাসন লাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তবে, তোমাকেও একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে, বলে চলল চারভি। রাজা হওয়ার পর প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে একজন করে সামর্থ্ পুরুষ -কে তুমি আমার কাছে পাঠাবে মা-এর পায়ে বলি দেওয়ার জন্য। আমার সাধনার জন্য ,আমার অমরত্ব লাভের জন্য এইটুকুই আমার দাবি।
অবাক হলেন তূর্যবর্মণ। "তার মানে এটা একরকম ব্যবসায়িক চুক্তি? আর নরবলি? মানুষ হত্যা? এতবড় পাপ করব আমি?"
"পাপ?" হাসতে থাকল চারভি। "রাজত্ব লাভ করতে চাওয়া, সিংহাসন দখলের জন্য আমার কাছে আসা, এগুলো পাপ নয়? আর ব্যবসা? কোনো কিছুই নিঃস্বার্থ ভাবে হয়না। আজ তোমার ইচ্ছাপূরণ- এর জন্যও কাউকে মা-এর পায়ে সমর্পণ করতে হচ্ছে, কাল আমার নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য তুমি সেই ব্যবস্থা করবে। "
এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার তূর্যবর্মণের চোখ গেল মূর্তির বেদীর দিকে, যেখানে বছর ২৫-এর এক যুবক -কে শোয়ানো আছে। তূর্যবর্মণের মাথা কাজ করছিল না, একটা গরম স্রোত ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে রাগের অন্তিম স্তরে পৌঁছে দিচ্ছিল। নিজেকে কোনোরকমে শান্ত রেখে সে বলল,
"কিন্তু তুমি আমাকে শুধুমাত্র সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে। নরবলি বা সাহায্যের পরিবর্তে প্রতি- সাহায্যের কথা তুমি আগে বলনি।"
- অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল চারভি, "তুমি এখন আমার ফাঁদে পড়ে গিয়েছ। তোমাকে আমার সব কথা মানতেই হবে। নচেৎ রাজার কাছে আমি তোমার সব কথা জানিয়ে দেবো আর তার ফল কি হবে সেটা তুমি ভালোভাবেই জানো।"
তরোয়ালটা এতক্ষণ হাতেই ছিল, এবার সেটা নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেল, একবার, দু'বার...... রক্তাক্ত অবস্থায় পেট-এ হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল চারভি। বিকট চিৎকারে কেঁপে উঠল গুহার প্রতিটি কোণা। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিজের রক্তে রাঙিয়ে দিল সেই বিকট দর্শন মূর্তির বেদী, আর তূর্যবর্মণের উদ্দেশ্যে শেষবারের মত বলতে লাগল, "প্রতি জন্মে আমি ফিরে আসব ..... বার বার...... তোর ধ্বংসের কারণ হয়ে.... "
যুবকের হাতের বাঁধন খুলে তাকে সঙ্গে নিয়ে তূর্যবর্মণ গুহা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এগোতে লাগল। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বেরোনোর পথ খুঁজে পেল না। কোনো অদ্ভুত ক্ষমতাবলে চারভি যেন তাদের বেরোনোর সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
(ক্রমশঃ)