কালবৈশাখী
কালবৈশাখী


প্রিয় ডায়েরি,
আজ বিকালের দিকে হঠাৎই আবার বৃষ্টি শুরু হলো আমাদের এখানে। বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু সেটা অবশ্যই বর্ষা কালের। কিন্তু এখন তো সারাবছরই বৃষ্টি হয়।যদিও চৈত্র বৈশাখ মাসে কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে এইসময়টাতে বৃষ্টিও হয় অল্প। এই কালবৈশাখীর ঝড় নিয়ে আমার ছোটবেলার স্মৃতি অসাধারণ। এখনও মনে গাঁথা হয়ে আছে সেইসব দিন। আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে প্রচুর আমগাছ ছিলো। কালবৈশাখী ঝড়ে আমরা জ্যাঠতুতো,খুড়তুতো ভাইবোনেরা সব আমবাগানে দৌড়ে চলে যেতাম। আর, পেছন থেকে মা,জ্যেঠিমা, কাকিমা রা চিৎকার করে বলতো,"মাথায় আমগাছের ডাল ভেঙে পড়বে সবকটার। তারপর হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসবো।আর ইয়া বড়ো বড়ো ইঞ্জেকশন ফোটাবে।তখন তোরা বুঝবি কত ধানে কত চাল। হাড়মাস কালি করে দিলো গো এই ছেলেপুলের দল। এদের পাপচক্ষে একটু ঘুম নেই গো দুপুরে।" কিন্তু আমরা চোখের নিমেষে উধাও তখন। আমাদের তখন তো মেলা কাজ।ঝড়ে আম না কুড়িয়ে আনলে,ওটা দিয়ে আম থেঁতো খাবো কি করে।ঝড়ে কুড়িয়ে আনা আম থেঁতো করে,তার মধ্যে নুন, মিষ্টি, কাঁচা লঙ্কা বাটা দিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। এরজন্য মায়ের হাতের ঘা কতক খেতেও হতো তখন। কিন্তু কিছু ভালো পেতে গেলে একটু তো কষ্ট করতেই হবে। অত ভালো আম থেঁতো খাওয়ার জন্য মায়ের হাতের ঘা কতক খাওয়া , আমাদের কাছে ঠিক এরকমই ছিল তখন। ঝড় উঠলে আম কুড়োতে যাওয়া, ছাদে ঠাকুমার আচার চুরি করা। আর কিছু না পেলে কখনও কখনও গুঁড়ো দুধ চুরি করে খাওয়া। একবার তো গুঁড়ো দুধে বিষম লেগে আমার কাকার মেয়ের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কোনো রকম জল খাইয়ে তাকে শান্ত করি আমরা। কালবৈশাখী ঝড়ের শেষে যখন বৃষ্টি হতো, কি সুন্দর মাটি থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ বের হতো। আজ ও সেই গন্ধ নাকে লেগে আছে।আসলে ছোটবেলার কিছু স্মৃতি ভোলা যায় না।
আমার বাবার বাড়ি এবং মামার বাড়ি দু জায়গাতেই যৌথ পরিবার ছিলো। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছে যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার। যে সৌভাগ্য আমার এবং আমার বোনের ছেলে মেয়েদের হয়নি। ওরা শুরু থেকেই একারাই বড়ো হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি সবসময় আমার মেয়েকে আমাদের ছোটবেলার বেড়ে ওঠার, আনন্দ করার গল্প শোনাই। আজকাল তো মানুষ মানুষের বাড়িতে যাওয়া আসার রীতিটাই কমে এসেছে খুব। কিন্তু আমার মনে আছে, আমাদের বাড়িতে প্রায় রোজই দুপুরের দিকে কেউ না কেউ এসে হাজির হতো। আর অতো বেলাতেও মা,জ্যেঠিমারা সব হাসিমুখে তাদের নিজেদের খাবার অতিথিকে খেতে দিতো এবং নিজেদের জন্য পরে ভাত,আলুসেদ্ধ করে সেটা আনন্দ সহকারে খেতো। এই মানসিকতা এখন আর পাওয়া যাবে না। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি কথাটা। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বদলায়,আর বদলায় মানসিকতা। একটা ছোট্ট চকোলেট কে দশটা টুকরো করে , সবাইকে দিয়ে খাওয়ার যে আনন্দ, সেই আনন্দ হয়তো একা একটা বড়ো চকোলেট খাওয়ার মধ্যে নেই। তাও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা টাও জীবনের একটা অংশ। সেটা না করলে পিছিয়ে পড়তে হবে আমাদের। তাই ভালো মন্দ মেশানো এই জীবনে সবাই ভালো থাকুন।