কাক কাকের মাংস খায় না (১)
কাক কাকের মাংস খায় না (১)
[প্রথম অংশ]
ডালিমবাবু পেশায় কলেজের অধ্যাপক। তার বিষয় বিজ্ঞান হলেও অদ্ভূত সব বিষয়ে লেখালেখি করা তার নেশা। সাহিত্য চর্চায় তার ভীষণ আগ্রহ। অবসরের বেশিরভাগ সময় তিনি খাতা, বই ও কম্পিউটার নিয়ে সময় কাটান। দু-একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন এবং সেগুলোতে “পুস্তক সমালোচনা” বিভাগে বইপত্রের ওপরে মতামত দেন। বইয়ের গুণমান বিচার করেন। যাকে বলে ’রিভিউ' লেখেন। সেক্ষেত্রে ঐ পত্রিকার তরফ থেকে ছাপানো একখানা বইয়ের কপি তাকে দেওয়া হয় এবং লেখা সম্পর্কে তার সুচিন্তিত সমালোচনামূলক রচনা তার থেকে গ্রহণ করা হয়, তারপর যথাসময়ে সেটি সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় ছাপিয়ে দেওয়া হয়। তার গুণগ্রাহী পাঠক পাঠিকার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দীর্ঘদিন লেখালেখিতে অনেক রসিক পাঠক-পাঠিকার সঙ্গে তার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান।
তার সমালোচনামূলক লেখাগুলো যেসব পত্রিকায় ছাপা হয় তার একটির অফিসে একবার একখানা বই কোনো পাবলিশিং হাউস থেকে এলো, ‘কাক’ সম্পর্কে। যে প্রাণীটি আমাদের বাড়ির আশেপাশের গাছে, ছাদের কার্নিশে, জঞ্জালের স্তূপে হরবখত চঞ্চলভাবে হাজির থেকে ক্যা ক্যা করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়, সেই ‘কাক'। বইটি ওই পত্রিকা অফিসে পাঠানো হয়েছে একটি কারণে, একখানি জুতসই রিভিউ পাওয়ার জন্য। পত্রিকার এই রিভিউগুলো পড়েন বহু বইপ্রেমী মানুষ। একখানা জম্পেশ রিভিউ হলে বইয়ের কাটতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে যায়। পরিশ্রমের ফসল তখন পাবলিশার ও রচনাকার উভয়েই তুলতে থাকেন।...
পত্রিকা অফিস থেকে যথারীতি সেই বইটি এবার ডালিমবাবুকে দেওয়া হলো। তিনি দেখলেন, ওই বইটিতে সামান্য এক কাক প্রজাতি সম্পর্কে মজার মজার নতুন সব তথ্য রয়েছে। যেমন, ‘কাকের যে গুণটি মানুষের থাকা উচিত’, ‘খামচি মেরে তারা এটা ওটা কাড়াকাড়ি করে নেয় কেন’, ‘কাকের গলার স্বর কেন কোকিলের মতো নয়’, ‘গায়ের রঙ কালো হওয়ার কি সুবিধা’, ‘তাদের জোট এত শক্তিশালী হলো কিভাবে’, ‘কাক নিয়ে কেন কেউ ভাবে না’ ইত্যাদি নানারকম মুখরোচক তথ্য দিয়ে ঠাসা একখানা ‘থ্রিলার' বলা চলে। এখানে রচনাকার তার প্রকৃত নাম অবশ্য গোপন করেছেন বলে তার মনে হলো। লেখকের জায়গায় যে নামটি দেওয়া হয়েছে সেটি ‘বায়স মিত্র'। বায়স মানে তো কাক। লেখক পরিচিতির এক জায়গায় প্রথম মলাটের ভিতর পাতায় বামদিকে লেখা— “ইনি দীর্ঘদিন কাক নিয়ে পড়ে আছেন... উঠতে বসতে তার কাকের সঙ্গে সময় কাটে...আজ পর্যন্ত তিনি কখনও কাকেদের অসম্মান সহ্য করেননি... বলতে গেলে কাকেরাই তার পরিবার-পরিজন আর তার ঘোরাফেরা বেশিরভাগ কাকেদের বাসার আশেপাশেই, এজন্য কাকেরা তার বিশেষ বন্ধু!"
এটা পড়ে প্রথমে ডালিমবাবু একটু চমকে গেলেন। এই ধরনের টপিকের ওপর রিভিউ ইতিপূর্বে তিনি কখনো লিখেছেন বলে মনে পড়লো না। আজ লিখতে হচ্ছে শুধু পত্রিকা সম্পাদকের অনুরোধে। প্রথমটা তিনি আপত্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, ”কাকেদের সবটা তো আমি জানিনা। লেখক তথ্যগুলো কোথা থেকে পেয়েছেন তা জানার বিশেষ তেমন উপায়ও নেই, কারণ এ সম্পর্কে কোনো বই হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না।”
একথায় সম্পাদক ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি বললেন, “আপনার বাড়ির আশেপাশে অন্ততঃ দু-চারটে কাক সবসময় দেখতে পাবেন। ওদেরকে মোটামুটি কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করুন। আশা করি লেখা উঠে আসবে।”
তিনি আর কি করেন, অগত্যা ঠিক করলেন, লিখবেন।
এরপর রোজ সকালে উঠে তিনি ছাদে চলে যান, ঘন্টা দুয়েক থাকেন, দু'চোখ ভরে এলাকার কাকগুলোর খুঁটিনাটি দেখতে থাকেন। একসময় তাদের চঞ্চল জীবনযাপন দেখে ডালিমবাবু খুব মজা পান। এসময় কাকেদের স্বভাব চরিত্র তাকে বেশ আকৃষ্ট করে ও তিনি সেটা ঝটপট লিখে ফেলতে মনস্থ করেন। সুতরাং বায়স মিত্রের বইটি ভালো করে আদ্যোপান্ত পড়ে ফেললেন। তারপর টানা দু'দিন গভীর ভাবনা চিন্তা করে একখানা রিভিউ তৈরি করে ফেলেন। তার সেই লেখাখানি প্রকাশের পর পাঠক-পাঠিকাকূলে ব্যাপক সমাদৃত হলো। এর কারণ তিনি যখন যা লেখেন তা বেশ ধরে ধরে গুছিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। এইবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি আশা করছেন নতুন একটি টপিকের ওপর লেখা রিভিউ রসিক মহলে বিরাট সাড়া ফেলবে। সাড়া নিশ্চয়ই ফেললো, অনেকেই গদগদ হয়ে তাদের অন্তরঢালা শুভেচ্ছা পত্রিকা অফিসে পাঠাতে লাগলো। সম্পাদক মহাশয় সেইসব উচ্ছাস নিয়ে ডালিমবাবুর বাক্সে পাঠাতে লাগলেন। সব ঠিকঠাক চলছিলো, কিন্তু এরমধ্যে একদিন একটি মন্তব্যে তার মাথা ঘুরে গেলো বা বলা ভালো, বিগড়ে গেলো।
মন্তব্যটা পড়ার সময় চোখগুলো তার গোটা গোটা গোল গোল হয়ে গেলো। চোখের পাতা আর পড়ছে না। দোকানের ঝাঁপের লাঠির মতো কে যেন তাকে আটকে রেখেছে। অনেকদিন হলো তিনি পাঠকদের এই ‘রিভিউ' সার্ভিস দিচ্ছেন, কিন্তু এমন ভাষায় কেউ তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেনি। আগে করেনি বলে পরে তাকে কেউ কিছু করবেনা এখন কোনো কথা নেই। সময় পরিবর্তন হচ্ছে তাই রুচি, মূল্যবোধ আর আগের মতো সব পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে যে রুচি ধারণ করছে তাকে শুধু বিকারগ্রস্ত বলে ক্ষান্ত হওয়া যাবে না বরং অসুস্থ পরিবেশে থাকতে থাকতে যেমন হয় তার প্রতিফলন তেমনি ঘটছে, বলতে হবে। তিনি স্বপ্নে ভাবতে পারেননি একটা মন্তব্য নিয়ে তিনি এত গভীর আঘাতে নিমজ্জিত হবেন। যাদের অনুভূতি সুক্ষ ও কোমল তারা কখনো কখনো সামান্য অপমানও সহ্য করতে পারেন না। তখন মন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে তাদের ওপর, যাদের কল্যাণ চিন্তায় তিনি দিনরাত এক করছেন। সেই পাঠক-পাঠিকা সমাজের মধ্য হতে একজন মন্তব্যকারী এরূপ লিখেছেন
“কাকের পরম বন্ধু, শ্রীমান বায়স মিত্রের বইটি আমি সারারাত জেগে পড়েছি। তারপর আপনার রিভিউটি খুব খুঁটিয়ে দেখেছি। পাগলামো আর কাকে বলে! ...কাক সম্পর্কে মাননীয় লেখকের অভিজ্ঞতাকে আপনি নাটকীয় ও হাস্যকর বলেছেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে আপনার সমালোচনাকে আমার হাসির খোরাক বলে মনে হয়েছে। সমাজে কাকেদের অবস্থান আপনি জানেন কি! কাক হলো এক অপূর্ব প্রাণী। রূপে নয়, গুণে। আমাদের সাহিত্যচর্চায় কাককে অমর্যাদা করা হয়েছে, তুলনায় কোকিলকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কেন কোকিল তো কালো, সে চুরি করে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, তার বেলা! কাক কি সেই বাচ্চাকে দুর দুর করে তাড়ায়! কাক আপনার পাশে থাকে সময়ে অসময়ে কিন্তু কোকিল আসে সুসময়ে, বসন্তে...বাকি সময় খুঁজে পান! ...এভাবে একজন ডোমকে মর্যাদা দেননা, অথচ একজন মরসুমি নেতা-মন্ত্রী আপনার বাড়িতে পদধূলি দিলে কৃতার্থ বোধে অস্থির হয়ে পড়েন।
এসব বিচার করে বলতে পারি, আমার মতে আপনি লেখার স্বাধীন নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। একজন লেখক হয়ে কীভাবে আপনি অন্য একজনের সমালোচনা করেন! এমন হলে অন্য যে কেউ তো আপনার চামড়াও খুবলে খাবে। তখন কার কাছে দৌড়ে যাবেন! জানেন না, একটি কাক অপর কোনো কাকের মাংস কখনো স্পর্শ করে না! আপনি নিজেই যখন একটি কাক তখন অন্য কাকের মাংসের লোভে হামলে পড়েছেন বলে মনে হলো...হাঃ_হাঃ_হাঃ_হাঃ_হাঃ...."
লেখাটা এক নিঃশ্বাসে পড়ার পর নিজের চেয়ারে স্থানুবৎ ঘন্টাখানেক নিঃসাড় হয়ে বসে থাকেন, তার পলকহীন চোখজোড়া ঘরের মেঝের ওপর নিবদ্ধ। কেউ যেন মাথার উপর পেরেক দিয়ে ঠুকতে শুরু করেছে। এ অবধি তিনি অসংখ্য লেখকের নতুন নতুন বইয়ের অগুণতি রিভিউ লিখে দিয়েছেন। অনেক নতুন লেখক তার রিভিউকে সম্বল করে বাজারে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নিয়েছেন। সেই পরিশ্রমের আজ এই কি পুরস্কার!
ভগ্ন মনে টেবিলের ওপর দু'কনুই রেখে দুই হাত মাথার দুপাশে চেপে চোখ বন্ধ করে দিলেন। অকস্মাৎ অনুভব করলেন তার বুকের ভেতরটা আলোড়িত হয়ে চলেছে। হৃদস্পন্দনের গতি পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। এবার “কাক" শব্দটা মাথার খুলির দেওয়ালে এদিক থেকে ওদিক ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগলো। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে চারবার “কা কা" বলে জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন। ...
বিয়ে করেছেন কয়েক বছর হলো, এখনো কোনো সন্তানসন্ততি হয়নি। এখানে এই ফ্ল্যাট কালচারের পরিপ্রেক্ষিতে তার পরিবারে একমাত্র স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। সে সময় স্ত্রী ছিলেন রান্নাঘরে। তিনি মনে করলেন কোনো বেয়াড়া কাক হুট্ করে বারান্দায় ঢুকে পড়েছে। বিশ্বাস করা যায় না, এখনি হয়তো কোথাও পটি করে মানুষের প্রতি বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটিয়ে নিজের রাগ মিটিয়ে ভেগে পড়বে। তাই দ্রুতবেগে তিনি রান্নাঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হলেন। তার ডানহাতে ধরা আছে একটি চ্যাটালো হাতা, যেটি নিয়ে তিনি পনিরের বড়া ভাজা করছিলেন।
ঘুরে ঘুরে বারান্দায়, ড্রইংরুমে, আশপাশের কার্নিশে কোথাও কোনো কাকের চিহ্ন খুঁজে পেলেন না। কি আশ্চর্য! ... তিনি নিজের কানে, সজ্ঞানে পরিস্কার শুনেছেন একটি কাককে জোরে কা কা করে ডাক ছাড়তে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সে হাপিস হয়ে গেলো কোথায়! এবার ঢুকলেন, সোজা ডালিমবাবুর পড়ার ঘরে। স্ত্রীর পায়ের শব্দে তিনি সেদিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। স্ত্রীর দিকে চোখ পড়তেই তিনি বিষম চমকে গেলেন...চ্যাটালো হাতা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে তার এই অকাল প্রবেশের মাথামুন্ডু কিছু বুঝে উঠতে না পেরে কেঁপে উঠলেন। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে তার জিব জড়িয়ে গেলো। আমতা আমতা করে শুধু বলতে পারলেন, “কি হলো ... কিসের হাতা...অমন করে আসো কেন!"
হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই দৃশ্যপটে ডালিমবাবু ভড়কে যান। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। মাথার ভেতরটা তখনও দপদপ করছে। তিনি বলে ফেলেন, “কি হলো মায়া, এমন করছো কেন?" তাঁর স্ত্রীর নাম মায়া, মায়া পারভিন। তিনিও স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষিকা। ঘরের ভিতরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নজর করে দেখে তিনি বুঝতে পারেন এখানে কাকের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এবার ডালিমবাবুকে বলেন, “মনে হলো যেন কোনো এক কাক কোথাও ঢুকে পড়েছে, খুব জোরে ডেকে উঠতে শুনলাম, আমি যাই... রান্না বসানো আছে।"
ডালিমবাবু বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও ...কাক! ...কই দেখিনি তো..."
মায়া বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে...ও নিয়ে আর ভাবতে হবে না...তা, কি হয়েছিলো তোমার, ওভাবে দু'হাতে কান চেপে বসেছিলে কেন?"
একটু আগে ডালিমবাবু একটি মন্তব্য পড়ে এতো গভীরভাবে ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলেন যে, সেই বৃত্ত থেকে এখনো পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেন নি। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন বটে, তার মনটা পড়ে আছে সেই বিছুটির মতো প্রদাহকারী শব্দগুলোর প্রতি। সেগুলো এখনও তাকে কষাঘাত করে চলেছে। এ সময় অকস্মাৎ তিনি আরো একবার “কা, কা” করে ডাক ছাড়লেন। স্ত্রী মায়া এ পরিস্থিতির জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি হতভম্ব হয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিলেন। অতঃপর আঁতকে উঠে দরজা খুঁজে দৌড়ে ঘর থেকে পলায়ন করলেন। রান্নাঘরের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। পাশের ঘরে গিয়ে নিলেন আশ্রয়। রীতিমত ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছেন তখন। ঠিক এসময় ডালিমবাবুর সম্বিৎ ফিরলে বুঝতে পারলেন, বড় ধরনের গোলমাল হয়ে গেছে। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে সটান স্ত্রীর খোঁজে পাশের ঘরে গেলেন। স্ত্রী বিছানায় উপুড় হয়ে ফোঁফাচ্ছেন। গায়ে হাত দিয়ে বললেন, “নিদারুন একটা ভুল হয়ে গেছে। কিছু ভেবোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। বুঝলে, সম্প্রতি আমি একটা পর্যালোচনা পাবলিশ করতে দিয়েছিলাম। সেটা বেরিয়েছে। তারপর অনেক কমপ্লিমেন্ট পেয়েছি, বহু...যেমন পেয়ে থাকি। তার মধ্যে একটি ফাজিল ছেলে নিজেকে সবজান্তা ভেবে যা-তা কমেন্ট দিয়েছে। আমি সেই রাবিশখানা কোন্ কুক্ষণে পড়ে দেখতে গিয়েছিলাম, কে জানে... আমার শীতল মাথা গরম হয়ে উঠেছে। তার কথাগুলো তির বেঁধার মতো মনের দেওয়ালে গাঁথতে শুরু করেছে।"
এবার তার স্ত্রী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “তুমি লেখক মানুষ। তাছাড়া তুমি একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। ওমন সমালোচনা, তিরস্কার হলে এড়িয়ে যেতে হয়। ভেঙে পড়লে তোমার চলে না! ...বুঝেছি, বাদ দাও ওসব... কিন্তু অমন করে হঠাৎ কা—কা রবে চেঁচিয়ে উঠলে কেন?"
“হ্যাঁ, সেটাই তো তোমাকে আমি বলবো। হয়েছে কি, একটা বই আমাকে দেওয়া হয়েছে, কাক সম্পর্কে। ওটার ওপর রিভিউ ওদের চাই। আমি ছাড়া অনেকেই রিভিউ লেখে, তাদের তো দিতে পারতো। কি ঝামেলা বলো দেখি! এতকিছু থাকতে কাক! আর কিছু পেলো না! ... গিরগিটি আছে, বনবিড়াল আছে, খেঁকশিয়াল আছে, কচ্ছপ, শামুক...কত কিছু আছে ... শেষে কাক দিলো আমাকে! ওরা আমাকে কাক বানিয়ে ছাড়বে নাকি!"
এবার স্ত্রী তাকে সান্ত্বনা দেন, বোঝান, “গায়ে মেখোনা বুঝলে...চলো দেখি রান্নার কি অবস্থা—"...এই বলে সেখান থেকে দু'জনে আস্তে করে উঠে পড়লেন।
ক'দিন বাইরে থেকে ডালিমবাবুর আচরণে বিশেষ কোনো অবনতি ধরা পড়লো না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তিনি গুমরে মরে যাচ্ছেন। তিনি ভাবছেন, একে বোধহয় বলে ‘ভাষা সন্ত্রাস’। চতুর ভাষায় কটাক্ষ করে কাউকে দমিয়ে দেওয়া, মনের ওপর চাপ দেওয়া। তিনি যে চাপে পড়ে গেছেন তা বিলক্ষণ টের পাচ্ছেন। আগের মতো নিয়ম করে তিনি আর লেখায় মন বসাতে পারছেন না। মাথায় শুধু কাক আর কাক। কথাগুলো মনে পড়লে মন আনচান করে উঠছে কেমন।
লেখায় তেমন মেজাজ আর আসছে না। এদিকে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকরা তার লেখার জন্য তাগাদা দিয়ে চলেছেন। বিষয়টি যেন তাকে আরো অসহিষ্ণু করে তুলেছে। সম্পাদকদের ঠান্ডা রাখার জন্য এবার মেসেজ করে জানিয়ে দেবেন, ভাবলেন। আসল ঘটনাটা তিনি কাউকে মনখুলে বলতে পারছেন না। রাগ হচ্ছে ঐ সম্পাদকের ওপর যিনি এক কুক্ষণে ঐ ফালতু টপিকের বইটি তাকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বাইরে তাকে দেখাতে হচ্ছে যে, তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মেসেজে তিনি খুব নরম করে এতটুকু লিখলেন যে, “তার শরীর বিশেষ ভালো নয়, তিনি আপাতত লিখতে পারছেন না।" এরপর তার অসুবিধার কথা সবাই তারা হয়তো বুঝতে পারলেন।... কিন্তু সেই সম্পাদক, যিনি এই সংকটময় পরিস্থিতির বাহক বলা যায়, তিনি ডালিমবাবুর মেসেজে লেখা কিছু কথা বুঝতে পারছেন না। তাই ঐ সম্পাদক মশাই পাল্টা একখান মেসেজ আবার তাকে পাঠালেন।
তাতে লেখা আছে, “মাননীয় ডালিমবাবু, আপনি আমাদের পত্রিকার একজন সম্মানীয় রিভিউ লেখক। এতদিন আপনি যা যা লিখেছেন তার সবই আমাদের প্রুফ রিডার অর্থ উদ্ধার করে এসেছে, বুঝতে কোনোদিন কোনোরূপ অসুবিধা হয় নি। কিন্তু এই প্রথম আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না, আপনার লেখা কয়েকটি শব্দ। যেমন, আপনি লেখাটি শুরু করেছেন, ‘কা—কা’ দিয়ে, তারপর আবার শেষও করেছেন ঐ ‘কা—কা’ দিয়ে! তাছাড়া আরো লিখেছেন, ‘কাকের মতো ময়লা খুঁটে সমস্ত পরিস্কার করবো’... ‘কাক ; সমাজের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি কোনোদিন ভঙ্গ করে না।’ ...এধরনের কথাবার্তা আমি আগে কোনোদিন কোথাও শুনিনি। আমাদের অফিসে খোঁজখবর করেও এমন কাউকে পাওয়া যায়নি, যে এটা আগে কোথাও শুনেছে। মাফ করবেন, এটি জানতে চেয়ে আপনার শান্তি ভঙ্গ করে এটা লিখতে হচ্ছে।”
মেসেজটা পেয়ে ডালিমবাবু বেশ মুষড়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন, ‘শান্তি তো ইতিমধ্যেই আমার ভঙ্গ করে ফেলেছেন, আর বাকি কোথায়!' তারপর যখন হুঁশ ফিরলো, তিনি কপাল চাপড়াতে লাগলেন। হায়, হায়! মনের অজান্তে তিনি এসব কী লিখে ফেলেছেন! আসলে, মাঝে মাঝে মনকে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। কাকের ওপর লেখা তার একটি রিভিউ কোথা থেকে এসে যেন তার স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করে জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে।
জনৈক পাঠকের ছুঁড়ে মারা তীক্ষ্ণ বাণ তার মানসপটে দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে, দাপাদাপি করছে। সময় সময় এটা তাকে ঘোরের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে তিনি কাকের বৈশিষ্ট্য অর্জন করছেন বলে বোধ হচ্ছে। নিজেকে কাক কাক মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি প্রমাণ করে ছাড়বেন, ‘কাক হয়ে কাকের মাংস খাওয়া যায় না’ কথাটা সর্বৈব মিথ্যা, হ্যাঁ—একটি কাক অপর কাকের মাংস খেতে পারে, তিনি খেয়ে দেখাবেন...। যতদিন না প্রমাণ করতে পারছেন, ততদিন তিনি মানুষ থাকতে চান না!
বাড়ি হতে কয়েক পা হেঁটে গেলে গাড়ির রাস্তা। কলেজ যাবেন, তাই গাড়ির অপেক্ষায় কিছুক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার নিজস্ব গাড়িতে আজ যাওয়া হবে না। সেটা যে চালায় সেই ড্রাইভারের শরীর হঠাৎ করে খারাপ করেছে।... সেই সময় আচমকা যাত্রীশেডকে লক্ষ্য করে কোথা থেকে উড়ে আসা একটি কাক রাস্তার পাশে যে ইলেকট্রিক খাম্বা আছে, তার ওপর বসে পড়লো। তারপর তারস্বরে কা—কা করে ডেকে পাড়া মাথায় করতে লাগলো। ডালিমবাবুর কেন জানি মনে হলো কাকটি তার দিকে তাকিয়ে ডাকাডাকি করছে।... রাগ কিংবা ভালো লাগা এই দুটির কোনোটি যখন আমাদের মধ্যে বেশি কাজ করে, তখন বিবেক লোপ পায়। অতিরিক্ত ভয় পাওয়া বা রাগের এটি একটি নেতিবাচক দিক।... তার বিশ্বাস কাকটি যেন তাকে লক্ষ্য করেই ডাকছে, তিনি তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন।কাকের চোখে চোখ রেখে তিনি মুহূর্ত স্থির রইলেন। কালবিলম্ব না করে জোরে কা—কা রবে এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ঠিক যেমন দিনকয়েক আগে নিজের লেখার টেবিলে বসে করেছিলেন। তার এই ভূমিকায় কাকটি ভয় পেয়ে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে উড়ে চলে গেলো। সেখানে দাঁড়ানো অন্য কয়েকজন যাত্রী যারা কোনো যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করছিলো, সবাই একযোগে চোখ বিস্ফোরিত করে তার দিকে ঘুরে তাকালো। সুবেশধারী আপাত সম্ভ্রান্ত-দর্শন মানুষের এক অদ্ভূত আচরণে তারা বড় বিস্মিত হয়ে গেছে। ডালিমবাবু এবার অনুভব করলেন, অন্যেরা যেন তার পানে কেমন করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। নিজেকে একটু সামলে নিলেন তিনি, এরপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পরিস্থিতির কথা ভেবে লজ্জিত হয়ে পড়লেন। লজ্জা এড়িয়ে নিজেকে লুকানোর মরিয়া চেষ্টায় এবার পড়িমরি করে সামনে যা পেলেন তাতেই উঠে পড়লেন। এটিও ছিলো তার একটি ভুল কাজ। ফলস্বরূপ তাকে অজানা একটি স্টপেজে গিয়ে নেমে পড়তে হলো। এদিকে আজ তার আদৌ আসার কথা ছিলো না। ...(চলবে)
||গল্পের প্রথম অংশ ||
