কাজের ভিতর আপন ছবি
কাজের ভিতর আপন ছবি




আমি মানুষটা একটু উদ্ভট; বন্ধুজন স্বীকার করেন আর শত্রুজন বলেন, একটু নয়, বেশ অনেকটা।
জীবনে দুবার চাকরি করেছিলাম। বুঝেছি চাকরিটা কাজ নয়।
মাইনে পেতে গেলে কিছু দেখাতে হয়। দোকানে বিক্রি করতে গেলে শুধু ছবি দিয়ে দোকান চালানো একটু মুশকিল, তাই সব দোকানে সাজানো শো -কেস আলো দিয়ে ঝলমলে। দেখো, খুশি হও, তবেই তো দামটা দেবে!
চাকরিতেও কাজ হয়, সেটা চাকরির জন্যে কাজ, কাজের জন্যে কাজ নয়। আর আমার উদ্ভট মাথাটা কাজের জন্যে কাজ খুঁজে বেড়ায়। এক্কেবারে ফ্রি ইলেক্ট্রন। কিংবা মৌমাছিও বলতে পারো।
একটা এটম-এ থামলাম কিছুদিন, তাপরেই দৌড় আর এক এটম এর সন্ধানে, নতুন বাঁধন বাঁধতে, নতুন সংসার
পাততে। হলুদ ফুলে মধু খাচ্ছি, দেখি আকাশে উড়ছে রং -বেরং প্রজাপতি ডানা মেলে। দৌড়লাম তাকে ধরতে।
আজকে ঝাপসা চোখে নিজেকে দেখি আর বুঝি আমি কি জন্যে চাকরি করতে পারিনি - দোষটা সম্পূর্ণ আমার, চাকরিটা কিংবা চাকরির ক্ষেত্র বা মানুষেরা নয়। এটা আমার আদিম মানুষের যাযাবর মানসিকতা। তারা চলতো নতুন জায়গার সন্ধানে, আর আমি চলেছি নতুন কাজের সন্ধানে।
জীবনে কাজ করেছি অনেক রকম। গীতাতে তিন রকমের কাজের কথা বলেছে : কর্ম, অকর্ম এবং বিকর্ম -আমি ঠিক জানিনা এই তিনটে কী। তবে স্থির জানি আমি কোনো-না -কোনো সময়ে তিন রকমের কাজই করেছি। তাই ভাবলাম একটা কাজ যেটা করে সব চেয়ে মজা পেয়েছি সেটাই লিখে রাখি।
এখানে আমার একটু পরিচয় দেবার দরকার আছে, যাতে আমার পাঠকেরা আমার মজার একটু স্বাদ পায়।
পড়াশুনা করেছি ভালোই। Physics, Electrical Technology, Control Systems, Field Theory তে ডিগ্রী আছে। নাড়াচাড়া করেছি Civil, Mechanical, Mining, Food Processing, Hydrology, Economics, Social Science আর Computer নিয়ে -অর্থাৎ আমাকে চৌখশ বললে খুব একটা মিথ্যে হবেনা।কিন্তু নজর কারো আমি কৃষি নিয়ে কোনো কাজ করিনি। বাগানে একটা পেঁপে গাছ লাগিয়েছিলাম,অনেক পেঁপে বেশ কবছর পেয়েছি ,প্রতি বছর কিছু গাঁদা আর চান্দ্রমল্লিকা লাগাই। কখনো ফুল হয়, কখনো গাছটাই লিলিপুট হয়ে থাকে। মাটি, ফল, ফুল আর ফসলের সঙ্গে এইটুকু পরিচয়।
কিন্তু আমার জীবনের শান্তি ভগবানও চায় না। আমাকে ধাক্কা দিয়ে পাঠালো মাঠে চড়ে খাবার জন্যে, মাঠের কাজে। আমি একটু যে বিরক্ত হইনি তা নয়। তবু কাজের ডাক, তাকে উপেক্ষা করা আমার মতো কাজবীরের শোভা পায় না, তাই দুগ্গা -দুগ্গা বলে নেমে পড়লাম।
এই পুরো ঘটনাটা হলো চাকরি versus কাজের কারণে। যিনি এই কাজ দেখতেন তিনি চাকরির জন্যে কাজ করতেন, তাই সহজে কাজটা নয়, চাকরিটা ছেড়ে দিলেন, আমাকে Awful অকুল পাথারে ছেড়ে। আমি হাবুডুবু খেতে খেতে ঠিক করলাম, no পরোয়া, কাজটা শিখেই করবো।
বলতে ভুলে গেছি আমি Management এরও ট্রেনিং নিয়েছিলাম। কিচ্ছু না জেনেও কি করে কাজটা চালানো যায় সেই টেকনিক পুরো না জানলেও কাজ চালাও লেভেলে জানতাম, সেটাই রক্ষে -কাজটা থামতে দিলাম না-এঁকে বেঁকে, হামাগুড়ি দিয়ে চালিয়ে গেলাম। আমাকে সাহস দিলো সরকারি কাজগুলো, সব স্যারেরা কিচ্ছু না জেনে যদি চাকরির কাজ করতে পারে তো আমিও পারবো, সেটাই হলো আমার ভরসা।
আমি এরই মধ্যে শেখবার জন্যে লেগে পড়লাম। ভাবলাম একটা এমন কাজ শিখবো যাতে প্রায় সব চাষীদের কাজে লাগে। ভেবে দেখলাম ধানের চাষ সর্বশ্রেষ্ঠ option, কারণ আমাদের এদিকে প্রায় সব চাষী ধানটা করেই থাকে।
একজন কৃষি বৈজ্ঞানিকের কাছে গেলাম। তাঁর ধারণা আমি তাকে বোকা বানাতে গেছি; আমি নিশ্চই তাঁর কোন চাকরির কাজে ভুল ধরে তার প্রমোশন টা আটকাবো, যাতে তার সতীর্থের রাস্তাটা খালি থাকে। আমাকে না বললেন না; কিন্তু বোঝালেন গ্যালিলিও থেকে আইনস্টাইন সবাই কৃষিকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমার তাতে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু ধান কি করে হয় বললেন না। ঠিক উনিশটি দিন ঘা খেয়ে আমিও শেষে থামলাম,গঙ্গারামের মতো।
তখন বাধ্য হয়ে মাঠে গেলাম। এক চাষী একটা ছোট জমি তৈরী করছে। সে জানালো এই জমিটুকুতে বীজ থেকে চারা বানাবে। আমার খুব উৎসাহ, কাজের হাতে হাত মেলালাম। দিনের শেষে কাজটা শেষ হলো।
এবার আমার জানবার পালা। পাশের রাস্তায় চায়ের দোকান; আমি দিলাম গুরু দক্ষিনা, চা আর লেড়ো বিস্কুট।
তখন জানলাম এই বীজ থেকে চারা বেড়োবে আর দিন পঁচিশ বাদে একটু শক্ত পোক্ত বিঘেত খানেক লম্বা হলে খেতে পুঁতবে। বর্ষার জল পাবে, গাছ বড়ো হবে, ধানের ফুল আসবে, সেই ফুলে কাঁচা ধান দুধে ভরা, তারপরে দুধ শুখিয়ে ধান হবে; গাছের কাজ শেষ তাই শুখিয়ে যাবে।‘ তখন খড় আর ধান সাবধানে কেটে ঘরে নিয়ে যাবো।‘ আমার চাষী গুরুর চোখে স্বপ্ন, কেমন কবির দৃষ্টি।‘ তারপরেও কত কাজ! ধান মাড়াই, শুখিয়ে বস্তা ভরে ঘরে তুলবো। ‘
একটা কথা ঘুরপাক করতে থাকলো আমার মাথায়, এগাছ বড়ো হবে,ধানের ফুল আসবে, সেটাই আমার অভিজ্ঞতা। আমি জানি কেমন করে গাঁধা ফুলের গাছ হয়। তাহলে ধান ফুলের গাছ করতে পারবো।
মাঝে মাঝে গুরুর কাছে যাই। তাঁর কি অত সময় আছে? খেত তৈরির কাজে লেগে আছে। দিন দশ বাদে চারাগুলো দু -তিন ইঞ্চি হয়েছে, আমার জানা গাঁধা ফুলের চারার সাইজে। গুরুর কাছে একটা চারা চাইলাম। একটু অবাক, কিন্তু আপত্তি করলেন না। বেদের কথা শোনালেন: 'এক্কেবারে বাচ্ছা, শেকড় শক্ত হয়নি, সাবধানে তোলো, নইলে শেকড় নষ্ট হলে খাবে কি করে' ?
মাটির মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে মাটি শুদ্ধু একটা চারা তুললাম। একটা ছোট ফুলের টবে তাকে তার মাটি শুদ্ধু সাবধানে পুতলাম। পাশের টবগুলোতে গাঁধা ফুল। প্রায় রোজ অল্প অল্প জল দি সব টবে। প্রথম দিন কুড়ি ধান চারা নেতিয়েই থাকলো, আমি ভাবলাম গ্যালো বুঝি! তারপর তার কলেবর বাড়তে লাগলো গাঁধা চারাকে পেছনে ফেলে দৌড় লাগলো। একদিন দেখি তবতাতে ফাটল ধরেছে। তাড়াতাড়ি টবটাকে ভেঙ্গে মাটি শুদ্ধু একটা অনেক বড়ো টবে ট্রান্সফার করলাম। তিনি বাড়তে থাকলেন, একটা গাছের থেকে গোটা কুড়ি ডাল, প্রত্যেকটা ডালে অনেক শীষ আর শীষগুলো ধানের ভারে নুইয়ে পড়ছে।
আমার কৃষি বৈজ্ঞানিক দেখলেন। বেশ অবাক হলেন। বলে গেলেন তিনি নিজে এসে গাছ কেটে ধান তুলবেন। করলেনও,গুণলেন কটা ডাল, কটা শীষ, প্রতি শীষে কটা ধান, তারপর ধানগুলোকে কাঁচের বাটিতে নিয়ে চললেন। ধান শুখিয়ে ওজন হলো। সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথরের ডাক্তারের মতো চোখ গোলগোল করে জানালেন ,'Amazing case,এত ফসল আমাদের দেশে হয় নি।‘
গাছ তুলে মাটি সরিয়ে দেখি শেকড় লম্বা নয় একটা বড়ো ওলের মতো।
আমার চাষী গুরুর কাছে দৌড়লাম শুভ সংবাদ দিতে। শুনলেন, ভাবলেন, তারপর দিলেন তাঁর দার্শনিক বিচার:
'শেকড় থেকে তুলে নতুন জায়গা, সেখান থেকে আবার শেকড় ছেড়ে আর একটা জায়গা। পরানটাকে বাঁচাতে হবে তো, তাই আরও মোটা শক্ত শেকড়। অত শেকড়ে কত খাচ্ছে, ধান তো অনেক হবেই।'
আমার মনে হলো আমিই ওই ধানগাছ। কাজের সন্ধানে এক শেকড় ছেড়ে আর এক শেকড়, সেখান থেকে আরও কত নতুন টব, আবার নতুন শেকড়। চাকরি ছেড়ে কাজ খুঁজে চলেছি, শেকড়টা লম্বা হয় নি, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের চেহারা নিয়েছে।