Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Classics Inspirational

4.6  

Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Classics Inspirational

জীবন যন্ত্রণা(ষষ্ঠ পর্ব)

জীবন যন্ত্রণা(ষষ্ঠ পর্ব)

13 mins
377


সরকারী প্রকল্পে ব্যাঙ্ক ঋণের নবীন মিষ্টির দোকান করেছিল। মিষ্টির দোকানের ঋন,সরকারী ভর্তুকিবাদে যা ছিল, মিষ্টির দোকানের ঘর বাবদ যা সেলামী সেটা অন্য একজন মিষ্টির ব্যবসায়ীকে তপতী বিক্রি করে দিল। আনুষঙ্গিক যা যা আসবাব ফারনিচার ফ্রিজ সব বিক্রি করে ঋণ শোধ হল।একরকম সব দায় মিটিয়ে গ্রাম থেকে দুরে একবছর মধ্যেই কর্মস্থল বসবাস সব ছেড়েছিল। গোপনে তার পরিকল্পনা বাড়িতে অবধি জানায়নি।নবীন নিখোঁজ পর বাড়ির মানুষদের যেন খুব আনন্দ হয়েছিল, তপতীর আয় চিরদিন তারাই ভোগ করবে ভাবত।এই আনন্দ আর উদাসীনতা যে কী ভাবে তপতীর মন অন্তরকে তীব্র দহন করেছিল বাড়ির মানুষ ভাবতেই পারেনি।


বাড়ির প্রতি তপতীর এত দায়িত্ববোধ, তার নুন্যতম রিটার্ন না দিলে কী ফল হয়, তপতী হঠাৎই একদিন বাড়ি ও কর্মস্থল ছেড়ে চলে যাবার পর বাড়ির মানুষ টের পেল।দোকান বিক্রি, বদলী এতটাই গোপন ছিল তারা টের পায়নি। তপতীর বাবা মা ভাই এদিন বুঝল নবীনকে মেনে না নেওয়া ইর্ষা, আর বেকার নবীন স্বামী হয়ে তপতীর চাকরীর টাকায় আজীবন সুখে থাকবে, আজব হিংসায় নবীনকে তো তাড়াল!কিন্তু সোনার ডিম দেওয়া হাঁস এতটাই ক্ষোভে ক্রোধে তাদের ছেড়ে চলে গিয়ে জব্দ করবে স্বপ্নে ভাবে নেই। আজ নবীনের গুরুত্ব তারা বুঝেছিল। ও তো সব ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি আপন ভেবে শিক্ষিত হয়েও মিষ্টির দোকান করে আপোষ করেছিল!


নবীন ভীষণ আপোষ পন্থী সব কিছুই রফা করা তার বড় গুণ ,আর তপতীকে সত্যিই সে ভীষণ ভালোবাসত তার কোন কথা ফেলতে পারত না।এটাই তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা , তপতী তার বার বার সুযোগ নিতো।


নবীনের কথা মত বাবাজী বড় সাদামাটা টিউশন পড়ানোর হলঘর তৈরী করেছিলেন। বাবাজীর সিদ্ধান্ত ছিল সংযত।এইটের পর আর পড়াতেন না।পাছে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল খারাপ হলে তার কোন দায় না থাকে দোষারোপ না করে।আত্মবিশ্বাসী নবীন যেন একটু আক্রমণাত্মক। দশমশ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের পড়াত। সব বিষয়ে পড়ালেও ইংরাজী বিষয়ের উপর বাবাজীর প্রথম দিকে পরামর্শ সাহায্য নিতো।নবীনের যেন নেশা।নানা বই ম্যাগাজিন সারাদিন পড়ত।বাবাজী রসিকতা করে বলত," তুমি গেরুয়া বসন ধারণ করেছ ধর্ম গ্রন্থ ধর্ম শাস্ত্র কিছুই অধ্যয়ন করো না কেমন গেরুয়াধারী! "


নবীন বলত ,"এ সব আপনার মত বয়সে করব একজন ভালো উত্তরাধিকারী পাই।"


এক দুবছর পর বাবাজীর আশ্রমে ছাত্র ছাত্রীদের ভিড় বাড়ছিল। বিনা বেতনে এত যত্ন করে পড়ানো আর ঠিক পরীক্ষার কদিন আগে নবীনের সম্ভাব্য প্রশ্নের অনুমান ছাত্র ছাত্রীদের অবাক করত, কিন্তু তার আগেই নবীন সব সিলেবাস শেষ করে দিতো।একটা মানুষ এতটা দ্বায়িত্ব চাপ নিয়েও এত হাসি মুখ, কোন ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর হতেন না।


তপতীর ধৈর্য বাঁধ ভেঙ্গেছিল, তার মনে হত সে যেন শোষনের শিকার। ডাক্তার বদলী হয়ে গেছিল নতুন এক ম্যাডাম ডাক্তার। তপতীর বিষয়ে কিছু জেনেছিল অন্য অধস্থন কর্মী। সে সময়ে এমনি ডাক্তার আকাল আবার অজ গ্রামের হাসপাতাল। মহিলা ডাক্তার আবার বিবাহিত। কোয়ার্টার থাকেন না।তপতীর উপর চাপ বাড়াচ্ছিল, কর্মী কম।তপতী লোকাল, অনেকদিন আছে তাই দ্বায়িত্ব চাপ অন্যদিকে মেয়েকে একা সামলানো ,উদ্ধতন মহলে যোগাযোগ করে অনেক দুরে বদলী নিয়ে সেখানেই কোয়ার্টারে থাকত।মা আর মেয়ে নবীনের আশা ছেড়েছিল। ভেবেছিল হয়ত মারা গেছে।

সেই রাতে বা পরে দুঃখে আত্মহত্যা করতে পারে বা পরে রোগ অসুখে মরতে পারে। মাঝে মাঝেই ভীষণ অনুতপ্ত হত।চোখের জল ফেলত।মেয়েকে বাবার বিষয়ে খুব বেশী কিছুই বলত না।


যোল বছরের পর তপতীর মেয়ে সেবার মাধ্যমিক পাশ করেছিল, টিভিতে একটি ছেলে পঞ্চম হয়েছিল, খুব গরীব দরিদ্র ঘরের অজ গ্রামের ছেলে,তার সাক্ষাৎকার নিতে তার বাড়িতে এক সাংবাদিক গেছিল। ছাত্র ও তার পরিবারের মানুষ জানাল, ওর এই সাফল্যের জন্য বাবাজীর আশ্রমের নবীন স্যার সব কৃতিত্ব পাবার অধিকারী। এ বছরই নয়! প্রতি বছর এই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের ভালো ফলের জন্য এই স্কুলের চেয়েও ঐ আশ্রমের স্যারের অবদান বেশির।


এরপর ঐ সাংবাদিক নবীনের এক সাক্ষাৎকার দেখাল।


সেই নবীন! গৌর বর্ন সুদর্শন শান্ত গেরুয়া বসনে। সন্ন্যাসীর বেশ গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মুখে হালকা গোঁফ দাড়ি।স্মিত হেসে বলছিল," ছাত্র ছাত্রীদের রেজাল্ট তাদের কৃতিত্ব আশি ভাগ,আমরা আশ্রমে কোচিং বা টিউটর ক্লাসে চল্লিশ জন ছেলে মেয়েদের পড়িয়েছি যারা এবার মাধ্যমিক দিল।তার মধ্যে আশি শতাংশ নম্বর সবাই পেয়েছে। রাজ্যে প্রথম দশের মধ্যে এবার এক জন। বাকিদেরকও আমি ছোট করব না। নম্বরের এদিন ওদিক তারতম্য হতেই পারে।


মূল্যায়ন একশ শতাংশ নির্ভুল নয়, এতটা প্রচারে তাদের ক্ষতি হতে পারে। আবার আরো আশা করেছিল ভালো ছাত্র ছাত্রী,যারা একটু কম নম্বরের হয়ত কোন কারনে পজিশন পায়নি, তাদের মনে কষ্ট হতাশা আসবে।এতটা হাইলাইট হয়ত কোন কারনে আমাদের দরকার। তবে তা না হলেই ভালো, আর আমার এই সাক্ষাৎকার না সম্প্রচার করাই ভালো। আমারা প্রচারে বিশ্বাস রাখি না।কাজের মধ্যেই থাকতে ভালো বাসী।"


একজন কাছে ছিলেন বয়স্ক মানুষ তিনি বললেন "বাবাজীর আশ্রমের উনাকে যেন ঈশ্বর দুত হিসাব পাঠিয়ে ছিলেন।আজ থেকে ষোল সতের বছর আগে একদিন ভোরে অবসন্ন ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেহে আশ্রমে আসেন।আজও নিজের পরিবার সংসার ঠিকানা কিছুই বলেন না। উনার উদ্যোগে আশ্রমে একটা অনাথ আশ্রম হয়েছে, গতবারে উদ্বোধন হল,ডি এম সাহেব লোকাল এম এল এ এসেছিলেন আপাতত পনের জন আবাসিক আরও বাড়ানোর ইচ্ছা আছে।"


নবীন অতি বিনয়ের সাথে বলে "রতন দা আবার ধান ভানতে শিবের গীত কেন! উনারা আশ্রমের ব্যাপার নয় মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল এসব নিয়েই রিপোর্ট করবেন। "


সাক্ষাৎকারী সাংবাদিক যেন হাতে নতুন খবরের সন্ধান কত রং চরিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।আশ্রমের ব্যাপারে নবীনের কাছে জানতে চাইলেন।


নবীন বলল, "সব বাবাজীর অশেষ কৃপা। উনারই উদ্যোগে আশ্রম, আমি অতিথি। উনি আপন করে নিলেন,আমার সব আবদার হাসি মুখে মানতেন। আমি এক সময়ের প্রাইভেট টিউশন পড়াতাম,ঐ টা কাজে লাগিয়ে বহু ছাত্র ছাত্রীদের এখানে বিনা পয়সার পড়ানোর হয় , আবার তাদের টিফিনের ব্যবস্থা থাকে। সবই বাবাজীর ইচ্ছা।অনেক ছাত্র ছাত্রী সৌভাগ্য বশত বড় বড় পদে আছে।তিন ডাক্তার ,দুজন বি সি এস এক আই এ এস আমাদের এই আশ্রমের ছাত্র।এছাড়া উকিল,শিক্ষক অন্য পেশায় আছে।


ওরা সব স্থানীয় স্কুলের ছাত্র ,এত ভালো ছাত্র ছাত্রী নাকি এই স্কুলে আগে ছিল না ।এমনটাই এই সব ছাত্র ছাত্রীদের ধারনা।আশ্রমের কোচিং পড়ে ওদের এমন সাফল্য! ওরা গ্রামের বাড়ি এলেই আশ্রমে আসে।কি ভাবে আরও আশ্রমের উন্নতি হয়, আমাদের কাছে পরামর্শ চায়।তখন বাবাজী আর আমি বলেছিলাম যদি অনাথ আশ্রম একটা করা যায়।"


আশ্রমের নিজস্ব কিছু সম্পদ আছে ?


"আশ্রমের অনেক জমি, প্রতি বছর, পাশাপাশি জমি বাবাজীর সঞ্চয়ের টাকায় কেনা হয়,মানুষ অনেক সাহায্য করে, এখন প্রায় যাট বিঘা জমি।গ্রামের কিছু স্বেচ্ছাসেবক ছেলে এইসব কিছুই দেখভাল করে ।"


"কতজন কাজ করেন।"


কাজ ঠিক নয়, সে ভাবে বেতন দেওয়ার হয় না।ওরা স্বেচ্ছাসেবক আশ্রমের আবাসিক সাত জন এই মুহূর্তে এই আশ্রমের সেবা করছেন।"


"বাবাজীর সাক্ষাৎকার পাওয়া যাবে!"


"না উনি প্রচারে আসেন না। এখন ধ্যানে আছেন।"


"রতন বলে উনার অনেক বয়স হল আশি উপর তেমন শক্ত নেই।এখন আশ্রমের সব দ্বায়িত্বভার আমার নবীন ভায়ের উপর।"


টিভি অফ করে তপতী হাউ হাউ করে কাঁদছিল আর এই সাক্ষাৎকার দেখতে পারছিল না ।


মেয়ে সুবর্না অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে


"মা তুমি এত কাদঁছ কেন? কী এমন সব কথা যে কাঁদতে হবে!"


তপতী নিজেকে সংযত করে বলে,


"ঐ নবীন সন্ন্যাসী তো বাবা।আজও বেঁচে আছে, কত বড় মহান মানুষ ভাব তোর বাবা। আমি তাই আনন্দে কাঁদছি।"


বর্না খানিকক্ষন চুপ থাকে তার পর বলে ,


"আমি উনার মেয়ে,অন্য ছেলেমেয়েদের পড়ান অনাথ শিশুদের বড় করবেন স্নেহ আদর ভালোবাসা দেবেন। আমার কী দোষ ছিল !আমি কী করে মহান বলব মা!"


"তোকে সব বলি নেই, মিথ্যা বললে ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন না। তোর বাবার এই সন্ন্যাস গৃহ ত্যাগ তার জন্য আমি দায়ী। ওর কোন দোষ নেই।"


"তুমি কী করেছিলে!"


"আমি চরম লাঞ্ছিত করে ঘর থেকে রাতে বেলায় বের করে দি, আর আবার আমার ঘরে এলে পুলিশকে বলে বধূ নির্যাতন দায়ে জেল খাটানোর হুমকির দি।"


"এতো দুরে কী করে ঐ আশ্রমে গেছিলেন!"


"তখন আমি বাপের বাড়িতে,সেখান থেকে দামোদর পাড় বরাবর গেলে পঁচিশ ত্রিশ কিমি ঐ আশ্রমের গ্রাম তবে বাস পথে ঘুরে ঘুরে অনেক পথ।ঐ গ্রামের নাম আমি শুনেছি।"


এরপর মেয়েকে ,নিজের চারিত্রিক কলঙ্ক যে নিজক মানুষের সন্দেহ, আর তা নবীনের কাছে তার সব মিথ্যা কলঙ্কের কথা বলে কানভারী করেছিল ।

" নবীন হয়ত বিশ্বাস করেছিল! যেমন মা ওর বিষয়ে অনেক কিছুই বলত পরে বুঝলাম সব মিথ্যা।"


সুবর্না বলে "সব বুঝলাম তাই বলে এইভাবে সন্ন্যাসী!তুমি খোঁজ করেছিলে!"


"আমি ওর আগের শহরের মেসবাড়ি আর ওদের গ্রামের বাড়ি ছুটেছিলাম। ও তো অন্য পথে নিঃস্ব ভিক্ষুকের মত হেঁটে ঐ আশ্রমে গেছিল। বাবাজীর আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেছিল! কী করে খোঁজ পাব!


আমি পেপারে নিরুদ্দেশ সন্ধান কলমে, চার পাঁচ বার নামী সংবাদপত্র বিজ্ঞাপন দিয়েছি , ওর পুরোন ছবি দিয়েছি। ও তো ছিল নির্জন গ্রাম থেকে দুরে জনশুন্য আশ্রমে! আবার গেরুয়া ধারী সন্ন্যাসী সাধুর বেশে কে চিনবে!"


"একদিন চলো মা ঐ আশ্রমে, পরিচয় দেবো না দেখব কি ভাবে আছে, আমাদের চিনতে পারে কীনা।"


"না , আমি যাব না। ও অনেক বড় মাপের মানুষ। আমি তুচ্ছ সামান্য অথচ কী অপমান হেনস্থাটাই না করেছি। উনি ক্ষমা করে দেবেন নিশ্চিত। কিন্তু আমার আর ওর সামনে দাঁড়ানোর মুখ নেই। শুধুমাত্র আমার জন্য, সব আত্মীয়স্বজন বাড়ি ছেড়েছিল,আমি বাড়ি ছাড়ি নেই।যাদের জন্য, যাদের কান ভাঙ্গা শুনে ওকে আঘাত যন্ত্রণা দিয়েছি, পরে তাদের স্বরূপ চিনলাম। ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিয়েছেন,আরও দেবেন। আজ উনি সন্ন্যাসী মনের আনন্দে আছেন, আমি কাঁদছি ,তুই ভাব আমার জন্যই তুইও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত।"


"আমি ওসব ভাবব কেন! তুমিই আমার সব।হয়ত উনার দোষও আমি দেবো না, কিন্তু মানুষ তো ভুল করে ,হয়ত তুমি করেছিলে, তার প্রাশ্চচিত্য করছ। যাইহোক তোমাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবি না,তিনি যত যোগ্য বিখ্যাত মহান হোন আমার কী।"


সুবর্না তারপর মাকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে ধরে হয়ত আদর করে শ্বান্তনা দিতে।


তপতী সুবর্নাকে বলে," তুই বরং যেতে পারিস। তোর গর্বের বাবা!"


"আমিও উনার কাছে যাব না। আমার গর্বের কিছুই নেই , উনি উনার মত থাকুন, আমি আমার মত।তবে আমার জেদ বেড়ে গেল, আমাকেও অনেক বড় হতে হবে। উনার কোচিং,বা উনার যত্ন সেবা না পেলেও আমার কোন সমস্যা নেই। তুমিই আমার সব।"


"তুই বৃথা রাগ অভিমান করছিস। মানুষটার সঙ্গে একবার কথা বললে তোর ধারনা পাল্টে যাবে।আমি পাগলামি করে বিয়ের আগে আবদারে কী না করেনি! নৈতিক অনৈতিক কোন কিছুই ভাবতো না।আমাকে তৃপ্ত আর খুশী দেখলেই আনন্দ, সব কথা তোকে বলতে পারব না।আর আমিই ওকে কী লাঞ্ছনাই না করেছি! ভাবি তখন আমার উপর মনেহয় শয়তান ভর করেছিল।"


"আফসোস কেন মা! ঐ জন্যই ভাবো না উনি এমন এক আশ্রমে যেতে পারলেন, না হলে মামুলি মানুষ হয়ে থাকতেন। "


"হয়ত সব ঈশ্বরের লীলা, তবু নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারব না। অবশ্য এসব না ঘটলে আমার আপন পর ,মানুষগুলোর সব মুখোশ খোলা আসল রূপটা দেখতে পারতাম না।"


তপতী সধবা বেশে ঠিক থাকত না রঙিন কাপড় পড়লেও শাখা সিঁদুর ছেড়েছিল, বারো বছর না খোঁজ মিললে নাকি মৃত ভাবা হয় । যদিও খাওয়া দাওয়ায় কোন বাছবিচার করত না। সুবর্না হঠাৎই দেখল, মায়ের কপালে সিঁদুর আর হাতে শাঁখা।মায়ের মনে যেন এক প্রফুল্লতা। সুবর্না মুখটিপে হাসত ,মাকে কিছু বলত না,দুঃখ বা লজ্জা পাবে।তবে যতই মায়ের মনে আবেগ আনন্দ অনুভুত হোক সুবর্নার কোন আবেগ অনুডুতি ছিল না। বাল্যকালে দুমাসে স্মৃতি থাকা সম্ভব নয়।আর স্মৃতি ছাড়া আবেগ অনুভূতি সুবর্নার মনে আসত না।


এরপর প্রায় দীর্ঘ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত। তপতীর মনে তীব্র আবেগ আর অনুশোচনায় মাঝে মাঝেই কেমন আনমনা হয়ে যেত।ইদানিং নবীনকে দেখার তীব্র এক আকাঙ্খা মনকে গ্রাস করেছিল। সুবর্না এসব বললে রেগে যায়,হয়ত অভিমান আর উপেক্ষা ! তপতীর শরীর বেশ কিছুদিন ভালো যাচ্ছিল না।বেশ কদিন সে ডাক্তারি পরামর্শে মেডিক্যাল লিভে এখন খুব চিন্তা হয় আত্মীয়স্বজন সব প্রায় সম্পর্ক হীন যোগাযোগ নেই। নিজের বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরের নানা সমস্যা আর রোগ বাসা বানছে ,হঠাৎ কিছু হলে মেয়েটার কী হবে!


সুবর্না এখন একুশ,ইংরাজি অনার্স নিয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ,সামনেই পরীক্ষা।মেয়েকে শারীরিক অসুস্থতার কথা সব খুলে বলে না ও তাতে নার্ভাস হবে,মনের চাপ আসবে পড়াশোনার ক্ষতি হবে।কিন্তু যদি চরম অঘটন বা সে ভীষণ অসুস্থ হয় সুবর্না কী এক সামলাতে পারবে! ভীষণ এক অনিশ্চয়তা আর অবদমিত আবেগে,এদিন সুবর্নাকে বলে,

"একদিন যা তোর বাবার আশ্রমে যা, বলে দেখ না,আমি ওর জন্য আজও অপেক্ষা করে আছি, কী বলে দেখ!"


"তোমার কী সত্যি এটাই মনের কথা!"


"নয় তো কী! সেই আঠার থেকেই আমাদের ভালোবাসা প্রেম বারো তের বছরের কত স্মৃতি এত সহজে কী ভোলা যায়! সেই টিভিতে দেখলাম কত সুন্দর এখনও মনে হয় যুবকদের হার মানাবে!আর কম বয়সে কী রূপ ছিল, তুই তো তাই এত সুন্দরী!"


"আমি এ জন্য প্রেম করি না।করব না।খাটি দুঃখ দেয়, যদি অন্য পক্ষ উদাসীন স্বার্থপর হয়।"


"কী বলছিস তুই! তোর বাবা অমন নয়,ও আমার কাছে চুড়ান্ত অপমান আর উপেক্ষা পেয়েছিল, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে সবার কাছ থেকেই সড়িয়ে রেখেছে।ভাব না,ও তার মা বাড়ি বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন সব থেকেই দুরে।"


"উনি তো সন্নাসী! বিয়ের কী দরকার, সন্তানের জন্মের কী দরকার ছিল!"


"তুই এখনও বাচ্চার মত,পরিনত বুদ্ধি হয় নি,তা হলে তোকে,আমি পেতাম! আমার যা সুখ যা স্বপ্ন সব তো তোকে ঘিরে! এজন্য আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ ,আর তোর অভাব কী! বাবা আজ সন্ন্যাসী একটা বড় ধাক্কা না পেলে কী হত জানি না,তোকে ভীষণ ভালোবাসত, আমি খুব নিষ্ঠুর আচরণ করেছি ভীষণ অপমান করে তাড়িয়ে দি,তুই কিছুই জানিস না। আমার কাছে তোর বাবার নিন্দা করবি না ।আমাকে ভীষণ আঘাত করে। আর বুদ্ধদেব তো স্বেচ্ছায় স্ত্রী সন্তান ছেড়ে সন্ন্যাসী হোন।তিনি তো মহান! তো বাবা নয় কেন!"


সুবর্না বুঝেছিল মায়ের মনের কথা,বাবার প্রতি তার আবেগ শ্রদ্ধা ভালোবাসা আকর্ষন না থাক, মায়ের কিন্তু আজও তীব্র আছে।বাবার প্রতি মন্দ কিছু বলে অসুস্থ মাকে সে আঘাত করতে চায় না।বলল,

"তোমার বাবার বিষয়ে ধারনা তুলনায় আমার ধারনা নগন্য তুচ্ছ ,হয়ত উনি মহান, আমার কোন ক্ষোভ নেই।যদি বলো আমি কাল বাবার আশ্রমে যাব,গাড়ি ভাড়া করে যাব,অনুরোধ করব আমার সাথে এসে তোমাকে যেন একবার দেখে যায়।"


"না রে ও আসবে কেন! ব্যস্ত মানুষ, একটা ওর ছবি তুলে আনবি, সেটা ঘরে বড় করে বাঁধিয়ে দেওয়ালে রাখব।ওকে ছবিতে দেখলেই আমার শান্তি।আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসীরে বলে তপতী কেঁদে ফেলল।"


সুবর্না বিচলিত। এতদিন পর এখনও মা এতটা তার স্বামীকে ভালো বাসে! কোন উত্তর দেয় না মায়ের দু চোখের জল মুছিয়ে আদর করে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,"তুমি যা বলছ তাই হবে।"


তপতীর মনের অনুতাপ আবেগ এতটা তীব্র তার কারন সুবর্নার অনুধাবন করা সম্ভব নয়।নিজের তীব্র অহংকার ব্যাভিচার আর চাকরীর কারনে আর্থিক স্বাধীনতা মানুষের পরিচিতি নিজের সাপেক্ষে সেদিন নবীনকে এতটাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভেবেছিল চরম অবজ্ঞাবশত,তার মনের যন্ত্রণা দুঃখ হতাশা অসহায়তা বিন্দু মাত্র অনুভব করেনি,আজ নিজের একাকীত্ব দুঃখ যন্ত্রণা হতাশা ,দুর্বল শারীরিক অসুস্থতার কারনে চরম অসহায়ভাব, খানিক যেন সেদিনের নবীনের মনের পরিস্থতি অনুভব করছিল। 

মানুষ নিজে না ভুক্তভোগী না হলে অপরের কষ্ট বোঝে না,এই সব ভেবে দিন দিন কেমন তপতী আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিল।এই তীব্র মানসিক চাপ তার হাই প্রেসার সুগার, আর ব্রেন টিউমার ইদানিং ধরা পড়ছে।মেয়েকে সব গোপন করেছে, এই পরিস্থিতিতে যদি তার কিছু অঘটন হলে কন্যা যদি বাবার সাথে একটা যোগাযোগ হয়,খানিক তার চিন্তা দুর হতো। সে আশ্রমে অনেক অনাথ ছেলেমেয়েদের দেখভাল করে,নিজের মেয়ের নিশ্চয় একটা নিরাপদ ব্যবস্থা করবে। কিন্তু পরিচিতি না হলে,সমস্যা না জানলে তার কী করার আছে! মেয়ের জীবনে তার অনুপস্থিতিতে যাতে কোন সমস্যা বা বিপদ না আসে তাই মনটা দিন দিন চরম উদ্বেগে অস্থির হচ্ছিল।


অনেকটা পথ, কাটোয়ার কাছে এক হাসপাতাল সংলগ্ন নার্স কোয়ার্টার তপতী তার মেয়েকে নিয়ে থাকে। আর নবীনের আশ্রম ছিল দামোদর ধারে বাঁকুড়ার এক অজ গ্রামের দুর প্রান্তে।গাড়ী ভাড়া করে সকাল সকাল সুবর্না একা রওনা হয়েছিল। গাড়ীর চলক তপতীর খুব পরিচিত, হাসপাতালের গাড়ী চালায়।খুব গোপন রাখতে তাকে বলেনি ঐ আশ্রমে নবীন মহারাজ তার স্বামী সুবর্নার বাবা।


বাঁকুড়া রুটে চালকে একটু পরিচিত, আশ্রমের গ্রাম টিভির সাক্ষাৎকার সময় বলেছিল।তপতীর তা মনে ছিল, যেন ইষ্ট মন্ত্রের মত স্বামীর আশ্রমের ঠিকানা দিন স্মরন করত। অনেক খোঁজ খবর রাস্তায় জিজ্ঞেস করে সুবর্নারা একসময়ে আশ্রমে এল। বাস রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতর তবে ভালো মোরাম পথ।


এই কবছরে আশ্রম আরো বেড়েছিল। আশ্রমের নিয়ম সুবর্নার জানা নেই, গাড়ী নিয়ে ভিতরে ঢুকতে কজন আশ্রমের কর্মী থামিয়ে বলল ,

"কোথা থেকে আসছেন!আর ভিতরে যাবেন না।"

খানিক উত্তেজিত হয়ে সুবর্না বলে "আমি নবীন মহারাজের মেয়ে ,উনার সাথে দেখা করতে এসেছি।"


ড্রাইভার এত সব জানে না।নবীন মহারাজ কে।কিন্তু ই আবাসিক সমীহ করে বলে,"বোন আপনি বরং আমার সাথে আসুন, গাড়ী এখানে থাক, আশ্রমের কিছু নিয়ম আছে, মুলত নিরাপত্তার কারনে।"


সুবর্না আর তর্ক না করে আবাসিকের সাথে আশ্রমের এক ঘরে গেল। অনেক বড় এলাকা গাছপালায় এক সত্যিকারের আশ্রমিক পরিবেশ। ভিতরে অনেক খুব সাধারণ মানে বাসগৃহ।


"এক বয়স্ক গেরুয়া বসন ঘরে এসে সুবর্নাকে দেখে বলল,বসো মা,নবীন ভাই এখন আশ্রমে নেই একটু অপেক্ষা করো।"


"আপনি কী আশ্রমের বাবাজী!"


"না মা! আমি রতন, আশ্রমের সবার রতন দা।এটা নবীন ভাই চালু করেছিল, সে কবেকার কথা! তখন আশ্রমে আমি আর বাবাজী,তোমার বাবা এলেন , আমাদের বয়স বেশী সামান্য আশ্রম।যা কিছুই দেখছ সব তোমার বাবার পরিকল্পনা প্রচেষ্টা, আর বাবাজী আশীর্বাদ আর্থিক মদত প্রথম ছিল এখন অনেক অনুগামী সরকারের অনুদান কিছু মেলে।তা তুমি মা এ ই আশ্রমে তোমার বাবা আছেন কী করে জানলে!"


"সে অনেক কান্ড, মা টিভিতে দেখেছিল পাঁচ বছর আগে তখন আমি মাধ্যমিক পাশ করি,সফল ছেলে মেয়েদের সাক্ষাৎকার দিচ্ছিল, এই আশ্রমের একটি ছাত্র পঞ্চম হয়েছিল ,তার সাক্ষাৎকার পরে তার কথা শুনে নবীন মহারাজের সাক্ষাৎকার টিভিতে দেখাচ্ছিল,তাই দেখে মা তো পাগল,মায়ের জন্যই আসা।"


"তা এতদিন দেরি কেন মা!"


"মায়ের শরীর ভালো নয় একবার বাবার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছা ।"


"বেশ তো মা নবীন ভাই আসুক।"


"উনি কোথায়!"


"আমাদের এক আশ্রমের ছাত্র আই এ এস, তাঁর ব্যাচের আর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু এখন আমাদের জেলার এ ডি এম সাহেব, উনি ওর বন্ধু যে আমাদের আশ্রমের ছাত্র, গত সপ্তাহে এ আশ্রমে আসেন। আজ এগারোটার সময় উনার অফিসে একটা মিটিং ডেকেছেন, নবীন ভাইকে যেতে বলেছেন। এই আশ্রমের উন্নয়ন আর্থিক সাহায্য আরো জনসংযোগ, প্রচার এই সব তাদের পরিকল্পনা।নবীন ভাই গেছে,আশাকরি একটা দেড়টার মধ্যেই চলে আসবে।"


"আমি এতক্ষণ অপেক্ষা করব!"


"তুমি মা বরং আমাদের আশ্রম টা ঘুরে দেখো, তোমার বাবার প্রচেষ্টা শ্রম আর পরিকল্পনায় কত বড় হয়েছে। তার আগে সামান্য কিছু খাও" এক গ্লাস দৈ সরবৎ আবাসিক স্বেচ্ছাসেবক দের বলে করে আনিয়েছিল দিল।


"আমার ড্রাইভার আছে,সেই খুব সকালেই ওকে নিয়ে বের হয়ছি।"


"দেখেছি ওকেও দেওয়া হয়েছে, তা মা কোথায় তোমাদের থাকা হয়!"


কাটোয়ার কাছে এক হাসপাতাল কোয়ার্টার মা আমি থাকি।


সে তো অনেক দুর,ঠিক আছে মা এখন প্রায় বারোটা একটা হলেই আশ্রমের আবাসিক শিশুদের খাবার ব্যবস্থা থাকে ,তোমরাও খেয়ে নেবে।নিশ্চয় তোমাদের ক্ষিদে পেয়েছে! কোন সকলে তোমরা বের হয়েছ ।"


"কজন অনাথ শিশু রাখেন!"


"আপাতত চল্লিশ জন,আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে, এরা সবাই স্থানীয় থানার, কারও বাবা মা নেই ,অন্য আত্মীয়স্বজন দিয়ে গেছে, কারও বা আত্মীয়স্বজন যত্ন নিতো না ,নির্যাতন শোষন হত,আবার কোন শিশুর জন্ম থেকেই বাবা মায়ের পরিচয় নেই ,হয়ত কুমারীকালীন মা বা অবৈধ সন্তান রাস্তা বা হাসপাতালে ফেলে গেছিল। এখন এরা নানা বয়সের নবজাতক থেকে ছয় সাত বছরের, এদের শিক্ষার জন্য আশ্রমের মধ্যেই একটা নার্শারী আছে। পরে প্রাইমারী স্কুল করার পরিকল্পনা আছে।সেই সঙ্গে নদীর চরা আর সংলগ্ন পাড়ে সরকারের জমি আছে বছরে দুমাস বন্যার জলে চাষ হয় না।সরকারের কাছে সামান্য লিজে আশ্রম একশ বছর নেওয়ার কথাবার্তা চলছে।

 এখানে কী ভাবে পতিত জমি উন্নয়ন করা যায় সেসব আলোচনা আজ হবে। নবীন ভায়ের ইচ্ছা এখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করে বেকার ছেলেমেয়েদের হাতে কলমে শিক্ষা প্রায় একশ একর জমিতে আম গাছ লাগাবে, আর নানা সব্জি শীত গ্রীষ্মে চাষ করে যদি খাদ্য প্রক্রিয়ার জেলি আচার এই সব করা যায়, অনেক গরীব শিক্ষিত স্বল্প শিক্ষিত ছেলে মেয়ের কর্ম সংস্থান হবে।


সুবর্নার ভাবছিল তার বাবা অন্য ছেলেমেয়ে এমন কী অনাথ শিশুদের নিয়ে কত চিন্তা পরিকল্পনা আর নিজের কন্যার জন্য কিছুই ভাবে না।দেখার ইচ্ছা হয় না,এতো দ্বিচারিতা! ক্ষোভে অভিমানে দেখা না করে পালানোর ইচ্ছা হলেও শুধুমাত্র মায়ের জন্য ঐ নবীন মহারাজের দেখা করতেই হবে।


আপনাদের আশ্রমের প্রধান কে ! বাবাজী না নবীন মহারাজ!


বাবাজী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা, উনার নামেই এই আশ্রম তবে যা কিছুই সব নবীন ভাই নির্ভর, উনি ছাড়া আশ্রম কানা।


সুবর্না রসীকতার ছলে বলল,বুঝলাম আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীর মত।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy