Manik Goswami

Abstract Inspirational Others

3.8  

Manik Goswami

Abstract Inspirational Others

জীবন তরঙ্গ

জীবন তরঙ্গ

58 mins
370


                                    পর্ব ১

‘বৌমা, একটু চা করে দেবে | মাথাটা ধরেছে | কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে’ |


 'না বাবা, আমার এখন এতটুকুও সময় হবে না | ছেলেদের এখন স্কুলে যাবার সময়, টিফিন টা গুছিয়ে দিতে হবে | সকালে ঘুম থেকে উঠে কাগজ পড়া আর টিভি দেখাই তো কাজ আপনার | মাথার আর দোষ কি, সে তো ধরবেই | তাছাড়া, দৃষ্টিশক্তিও তো কমছে | চোখের ওপর অত চাপ দিলে মাথা তো ব্যাথা করবেই | যান, একটু বাজার থেকে ঘুরে আসুন, কিছু সবজিও আনতে হবে' |


রোজনামচাটা প্রতিদিন প্রায় একই ধরণের | তুমি চলে যাবার পর থেকেই আমার জীবনে আব্দার, চাহিদা, ভালোলাগা সবই কেমন যেন ফিকে হয়ে গেছে | তোমার তৈরী করা বেলা নয়টার চা তো এখন আর পাই না | চাইলেও পাওয়া যায় না | যাক, সেটা নিয়ে আর নিজেকে কষ্ট দিতে চাইনা | কিন্তু একটা চিন্তা তো বারে বারেই ঘুরে ফিরে অন্তরের অন্তঃস্থলে ধাক্কা মেরে যায় | বড্ডো তাড়াতাড়ি চলে গেলে তুমি | জানিনা ছেলেদের সংসারে তোমার আর থাকতে ইচ্ছে করছিলো কিনা, নাকি নিজের অসুস্থ শরীরটাকে আর টেনে নিয়ে যেতে পারছিলে না | সে যাই হোক, আমাকে এই সংসারে একাকী ছেড়ে রেখে তুমি চলে গেছো | নিজে তো পালিয়ে বেঁচেছো, কিন্তু আমাকে রেখে গেছো সংসারের জটিল জালের মধ্যে জড়িয়ে | বয়স তো আমারও হয়েছে, শরীরের শক্তিও গেছে কমে | ভারী কোনো কাজ আর করতে পারি না | মাঝে মাঝেই মনের মধ্যে কেমন হতাশ হয়ে পড়ি, কেননা ছেলের সংসারে একা থাকার ক্লেশ তো ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারি | কিছু করতে গেলেও অনেক কথা শুনতে হয়, আবার কাজ করার ইচ্ছে না হলেও মুখফুটে কিছু বলতেও পারিনা | করতে পারছি না বললেও অশান্তির সৃষ্টি হয় | জীবনের এই শেষ সময়ে পৌঁছে বেশ বুঝতে পারছি, আমার জীবনে তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পাবার যথার্থতা | মনে-প্রাণেই আমি অথর্ব হয়ে পড়েছি, কোনো কিছুই যেন আর ভালো লাগে না | কিন্তু চোখ বুজে বসে থাকলেও তো মন আর চিন্তা চুপ করে বসে থাকে না | অতীত হাতড়ে বেড়ায় |

এই তো বছর কয়েক আগের কথা | নাতি দুটোকে সাথে করে স্কুলে না পৌঁছে দেবার জন্য বৌমা কত কিছুই না বললো | আরে, তোরা যখন ছোট ছিলি আমিই তো প্রতিদিন সাইকেলে চাপিয়ে তোদের স্কুলে পৌঁছে দিতাম | তখন আমার শক্তি ছিল, শরীরে সামর্থ্য ছিল | করিনি ? দিনের পর দিন শুধু বাচ্চাগুলোর একটু আরামের জন্য কতকিছুই না করেছি | তোদের ঠাকুমা চলে যাবার পর থেকে আমি আমার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছি | এখন মন এবং শরীর কোনোটাই আমার সাথ দেয় না | তোরা তো এখন বড় হয়েছিস, নিজেরাই তো স্কুলে যেতে পারিস | আমি সাথে গেলে তোদের বন্ধুরাই তো পেছনে লাগবে, রাগাবে | তখন তোদেরই সম্মানে লাগবে |

আমার শরীর তো সত্যিই আর চলতে চাইছে না | বসে থাকলেই ঝিমুনি আর অতীত ভেসে আসে চোখের সামনে | একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখটা একটু বন্ধ করেই বসে থাকেন জীবনের বিরাশি বছর কাটিয়ে আসা আমাদের গল্পের এই অমলেন্দু বাবু |

     *        *        *        *

আমার শৈশব | ভেড়ামারা গ্রামের একপ্রান্তে একটু থাকার জায়গা | চারপাশটা গাছপালায় ভরা | ছায়া ঘেরা | একটু স্যাঁত্সেঁতেও বটে | গাছ-পালায় ঘেরা এই মনোরম পরিবেশ মনের মাঝে সত্যিই এক প্রশান্তি এনে দেয় | কি শান্ত, নিঝুম এর রূপ | হাওয়ার দোলে বাঁশ পাতার শনশনানি, হেমন্তের হিমেল বাতাস আর রাতের আকাশে একঝাঁক চকচকে তারার মেলা, মনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোনো এক রূপকথারই দেশে | যেখানে আমি উদ্দাম, উচ্ছ্বল হয়েই বিরাজ করতে পারি | কোনো ক্লান্তি নেই, কোনো কষ্ট নেই, নেই কোনো ক্ষেদ | যজমানি করে সংসার চালান বাবা | পূজারী ব্রাহ্মণ | লোকে যেমন শ্রদ্ধা ভক্তি করে, তেমনি ভালোও বাসে | কোনো ভাবে ব্রাহ্মণ মানুষকে একটু সাহায্য করতে পারলেই প্রতিবেশীরা নিজেদের ধন্য মনে করে | কখনো সখনো কারো বাড়ি থেকে সবজি বা আনাজপত্র, চাল-ডাল এমনি এমনিই দান করে যায় ব্রাহ্মণ মানুষকে | এখনকার সময়ে এই সমস্ত আর চিন্তাই করা যায় না | দান করা তো দূরের কথা পয়সা দিয়ে নিতে গেলেও সে মূল্যটাকে তারা ন্যায্য বলে মনেই করতে পারে না, আরো একটু বেশি পেলেই যেন ভালো হতো | মানবিকতার মূল্যবোধ তো নিঃশেষ হয়ে গেছে | এখন শুধু অর্থই চিনতে শিখেছে | অথচ সেইসময়ে লোকে এটা উপলব্ধি করতে পারতো যে একমাত্র পুজোর সময় ছাড়া ব্রাহ্মণদের সংসার চালানোর জন্য এক কানাকড়িও হাতে থাকে না | সারাটা বছরই অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটে | মাঠের কাজে মজুর খেটে কেউ যদি দুপয়সা রোজগার করতে পারলো তো ভালো, যারা পারে না তাদের কষ্টের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না | পুজো কালের দিনে পুজো করে বাবা ঘরে ফিরলেই ব্যাগ নিয়ে টানাটানি | দুই ভাই আর দিদি মিলে ব্যাগের থেকে যেটুকু প্রসাদ পেতাম তাতেই খুশি, তাতেই আনন্দ, উৎফুল্লতা | কি যে দিনগুলো ছিল তখন | ছোট্ট ছোট্ট ভাই বোনেরা হাত ধরাধরি করে কখনও মেঠো পথ ধরে, কখনও জঙ্গলের পথ পেরিয়ে স্কুলে যেতাম | আমাদের গ্রামটা ছিল সুন্দর, ছিমছাম | অবশ্য তখন তো লোকজন বেশি ছিল না - তাই একটু ফাঁকা ফাঁকা নির্জন মনে হতো | আমাদের বাড়ির কাছেই একটা নদী ছিল | সেই নদীতে স্নান করা, সাঁতার কাটা ছাড়াও মাঝে মাঝেই যেতাম মাছ ধরতে | বাবার আবার মাছ ধরাটা একটা নেশার মতোই ছিল | বাবাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমিও সঙ্গে যেতাম | টোপ ফেলে বসে থাকা, কখন ফাতনাটা নড়বে সেই দিকে দৃষ্টি রাখা আর মাছে টোপ গিললে তাকে খেলিয়ে খেলিয়ে ক্লান্ত করে জলের বাইরে নিয়ে এসে, ধরে বালতিতে তুলে রাখা এই সব কাজে বাবাকে যতটা পারতাম সাহায্য করতাম| ধীরে ধীরে আমিও মাছ ধরায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলাম | গ্রামে গাছপালা ছিল প্রচুর | আম, জাম, কাঁঠালের গাছ তো ছিলই, অন্যান্য গাছও এতো ছিল যে বন-জঙ্গল মনে হতো | সূর্য্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মাটি পর্যন্ত পৌঁছতেই পারতো না | তাছাড়া, আগাছাও ছিল অনেক | কয়েকটা জায়গায় এতো ঘন বন হয়ে উঠেছিল যে বুনো শুওরও দেখতে পাওয়া যেত, আর শেয়াল তো ছিলই | একবার তো বনের পথে বুনো শুয়োরের একেবারে সামনে পড়ে গেছিলাম | দিদি সাথে না থাকলে বুনো শুয়োরের ধারালো দাঁতের আঘাতে একেবারে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাম | দিদির প্রত্যুত্পন্নমতিত্বে সে যাত্রা বেঁচে গেলাম | একটা গাছের ডাল ভেঙে বীরবিক্রমে শুয়োরের সাথে লড়াই করে তাকে তাড়িয়ে দিলো দিদি | আর একবার তো পালাগান শুনে বাড়ি ফেরার সময় সামনে একটা বুড়ি মতো মেয়েছেলেকে সাদা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার পা আর সরে না | এক পাও আর এগোতে পারছি না | আমার হাতটাকে শক্ত করে ধরে দিদি আমাকে টানতে টানতে এগিয়ে নিয়ে গেলো | কাছে যেতেই দেখি একটা ন্যুব্জ খেজুর গাছ | পাতাগুলো সামনের দিকে এমনভাবে ঝুকে ছিল যে চাঁদের আলোতে আমার দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল | ভয় তো সত্যি সত্যিই পেয়েছিলাম | এরকম ছোট ছোট কত ঘটনাই যে ঘটতো তখন | বৈশাখী ঝড়ে আম কুড়াতে যাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা | তখন আম কুড়াতে গেলে এখনকার মতো লাঠি নিয়ে কেউ তেড়ে আসতো না | বাচ্চারা আম কুড়ানোর আনন্দে মেতে উঠবে নাকি আমাদের মতো এই বুড়োরা লাফালাফি করবে | জলা জায়গায় হঠাৎ করে আগুন জ্বলে ওঠার ঘটনা তো প্রায়ই ঘটতো | ভয় তো পেতামই, অবাক হতাম | হঠাৎ হঠাৎ আগুন, ফুঁ দিয়ে কেউ ওপর দিকে উঠিয়ে দিয়েই পরক্ষনেই নিভিয়ে দিতো | চিন্তা করেও সে রহস্যের সমাধান আর করে উঠতে পারিনি | অবশ্য ছেলেরা আমাকে এখন বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে সব কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছে তবুও ছেলেবেলার সেই অবাক লাগা, বিস্ময়ে চেয়ে থাকা, প্রকৃতির বুদ্ধির কাছে নিজের বুদ্ধির হার মেনে যাওয়া - সে ছিল এক অনন্য অনুভূতি | এখনকার বাচ্চারা আর সে সব বিস্ময় পেলো কই |

আমাদের গ্রামে একটা সংগঠন বা ক্লাব গড়ে উঠেছিল | প্রতিদিন আমরা ছোটরা আর বড়রা মিলে একসাথেই নানা ধরণের ব্যায়াম, শরীরচর্চা ইত্যাদি করতাম | বড়রা আমাদের শেখাতেন প্যারেড করা | 'বাংলা মার্ দুর্নিবার আমরা তরুণ দল, শ্রান্তিহীন, ক্লান্তিহীন সংকটে অটল '| একদিন ইংরেজ পুলিশ এসে আমাদের ক্লাবের কয়েকজন দাদাকে ধরে নিয়ে গেলো | জানতে পারলাম আমাদের ক্লাবের থেকে কিছুটা দূরে যে একটা বস্তি আছে, সেখান থেকে কেউ পুলিশকে জানিয়েছে যে এখানকার ক্লাব সদস্যরা পরাধীনতার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে - সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে | ঘটনার সূত্রপাত একটা ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করে | একটা ফাউল এর ব্যাপার নিয়ে বস্তির ওই ছেলেদের সাথে আমাদের ক্লাবের দাদাদের মধ্যে কিছু একটা গন্ডগোল বাধে | শেষ পর্যন্ত সেটা মারামারির পর্যায়ে পৌঁছে গেছিলো | দাদারের কয়েকজনকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ায় বাকিরা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলো যে যারা এই কাজের পেছনে আছে তাদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে | কে দায়িত্ব নেবে | দুজনকে এই দায়িত্ব নিতে হবে এবং সেটা ঠিক করা হবে লটারির মাধ্যমে | লটারিতে প্রথম নামটা উঠলো আমার | আমি তখন দলে সর্বকনিষ্ঠ | দাদারা বললো নাম যখন উঠেছে তখন দায়িত্ব পালন করতেই হবে| আমাকে বলা হলো শুরুটা আমাকে করে দিতে হবে | বাকিটা দাদারা দেখে নেবে | রাতের অন্ধকারে সবে জার থেকে কেরোসিন তেল ছুড়তে শুরু করেছি বস্তির বাড়িগুলোতে, আগুন লাগানো হবে বলে, কয়েকটা কুকুর এমন চিৎকার শুরু করলো যে লোকজন জেগে উঠলো আর আমাদের প্ল্যানটাও ভেস্তে গেলো |

খেলাধুলাটাও মোটামুটি ভালোই করতাম | তবে ফুটবল | ক্রিকেট টা আমার একদম পছন্দ হয় নি | খেলতে গেছিলাম একদিন | আমি ছোট | আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলো একেবারে বাউন্ডারি লাইনের ধারে | ঘন্টাখানেক মাঠে ছিলাম একটা বলও আসেনি | একরকম বিরক্ত হয়ে বাউন্ডারি লাইন পার হয়ে সেই যে বাড়ি চলে এসেছিলাম আর কখনও ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামিনি | তবে ফুটবলটা মোটামুটি প্রতিদিনই খেলতাম এবং ক্রমে পাড়ার ক্লাবের একজন ভালো গোলকীপার হয়ে উঠতে পেরেছিলাম |

ঝনটু ছিল আমার বয়সী এক অনাথ ছেলে | বাবা তাকে কোন এক গ্রাম থেকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসে রেখেছিলো | গরু চরাতো, মা কে সাহায্য করতো আর আমাদের কাজ ছিল তাকে মানুষ করে তোলা, পড়াশোনা শেখানো | ঝন্টুর কাছেই শিখেছিলাম কিভাবে মোষের পিঠে চড়ে শুয়ে থাকা যায়.| ঝন্টু এতো বিশ্বাসী আর কর্মঠ ছেলে ছিল যে ওর সারা দিনের কাজের ব্যাপারে মাকে কোনো চিন্তাই করতে হতো না | ঘুম থেকে উঠেই লেগে যেত কাজে | গোয়াল ঘর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে, মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দেওয়া - সবই করতো ঝন্টু | এই ঝন্টুই ছিল আমার খেলার সাথী আর আম কুড়ানোর সঙ্গী | মাঝে মাঝে ওর সাথে আমিও যেতাম গরু ছড়াতে | ওর একটাই দোষ ছিল - আমি যদি কোনো সময় কোনো দুস্টুমি করেছি বা ভুল কোনো কাজ করে ফেলেছি, সোজা এসে মার্ কাছে নালিশ করে দিতো ঝন্টু | ফলে শাস্তিও পেয়েছি অনেক | রাগ হতো ঝন্টুর ওপর | অবশ্য বেশিক্ষন সে রাগ ধরে রাখতে পারতাম না | খেলায় মেতে উঠতাম দুজনে |জীবন যে কিভাবে কাকে কোথায় সরিয়ে নিয়ে গেলো আজ চিন্তা করলে সত্যিই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে |


               পর্ব ২               

জীবনে হঠাৎ নেমে এলো এক অন্ধকার | আমার বয়স তখন কত হবে, দশেও পা দিইনি | লক্ষ্মীপূজার দিন | মায়ের সুন্দর, ছিমছাম সাজানো সংসারে নেমে এলো বজ্রাঘাত | বাবা গিয়েছিলেন পাশের গ্রামে এক যজমান বাড়ি লক্ষ্মী পূজা করতে | বাড়িতে এলো বাবার মৃত্যু সংবাদ | পূজা করতে করতে পূজার আসনের ওপরই পড়ে গেলেন বাবা | স্ট্রোক | বাড়ির লোকেরা অনেক চেষ্টা করেও বাবাকে ফেরাতে পারেনি | আমাদের চোখের সামনে থেকে সুখের পর্দাটা ঝড়ে পড়ে গেলো | শুরু হলো আমাদের জীবন যুদ্ধ | সংসার চালানো দায় হয়ে উঠলো মায়ের কাছে | তিন তিনটে বাচ্চাকে নিয়ে, বিনা উপার্জনে, বেঁচে থাকা এবং বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়লো | সুযোগ সন্ধ্যানী লোকেরা মায়ের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ঘরের জিনিসপত্র চুরিও করতে শুরু করলো | মনে আছে, একদিন রাতে মা হঠাৎ আমাকে ও দিদিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাথরুম করে আসার জন্য জোর করতে লাগলো | আমি যাবো না, কিন্তু মায়ের জোরাজুরির কাছে না গিয়ে থাকতে পারলাম না | দিদিকে আর আমাকে আস্তে আস্তে কানে কানে মা বললেন বাইরে গিয়ে চোর চোর করে জোরে চিৎকার করার জন্য | আসলে একটা সিঁদেল চোর সিঁদ কেটে ঘরের মধ্যে বারে বারে ঢোকার চেষ্টা করছিলো | হ্যারিকেনের আলোতে তার ছায়াটা একটা দেয়ালের ওপর পড়ায় মা বুঝতে পেরেছিলেন যে ঘরে চোর ঢুকেছে | তাই আমাদের বলেছিলেন বাইরে গিয়ে চিৎকার করতে | আমরা দুজনে বাইরে গিয়ে যত জোরে সম্ভব চোর চোর করে চিৎকার করতে লাগলাম | গ্রামবাসীদের লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে আসার শব্দ কানে যেতেই চোর বেচারা দে দৌড় | মায়ের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য সেদিন চোরের পক্ষে আর চুরি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি |

     *       *       *       *

মামা এসে মা, দিদি আর ভাইকে নিয়ে চলে গেলেন রাজশাহী, মামার বাড়ি | আমার ঠাঁই হলো জ্যাঠামশায়ের সংসারে, আলিপুরদুয়ারে | জ্যাঠতুতো ভাই বোনেদের সঙ্গে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম | পড়াশোনাও শুরু হলো, ওখানকার স্কুলেও ভর্তি হয়ে গেলাম| ভালোই কাটতে থাকলো দিনগুলো | জ্যাঠার ছেলেমেয়ের সাথে খেলাধুলা, পড়াশোনা , বাজার-হাট করা - সবই চলতে থাকলো | একটু বড় হতেই অবশ্য বুঝতে পারলাম যে আমার থাকাটাকে বা আমার পড়ার জন্য পয়সা খরচ করাটা জ্যেঠি ভালো ভাবে নিতেই পারছেন না | কোথায় যেন ছন্দ পতন ঘটেছে | আসলে কোনো মানুষ যদি নিজের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে বড় হতে থাকে, তবে কোনো না কোনো দিন কারো কাছে সে বোঝা স্বরূপ হয়ে পড়ে | আমারও মনে হতে লাগলো যে আমি হয়তো এ সংসারের কাছে বোঝা হয়ে পড়েছি | বাড়ির লোকেদের আচার আচরণে তার বহিঃপ্রকাশ হতে থাকলো | বিনা কারণেই বড় দিদিরা জ্যেঠির কাছে আমার বিরুদ্ধে দোষারোপ করতে লাগলো | জ্যেঠিমাও আমার সাথে বিমাতৃসুলভ আচরণ করতে লাগলেন | মারও জুটতে থাকলো কপালে | কারো জীবনে বাবা নামক ছাতাটি না থাকলে তার যে কি দূরবস্থা হয় সেটা আমি আমার জীবন দিয়ে অনুভব করতে পারছি | আমার এই অবস্থার জন্য মায়ের ওপর খুব রাগ হতো | শুধু আমাকেই দূরে পাঠিয়ে দিয়ে দিদি আর ভাইকে নিয়ে চলে গেলেন তার ভাইয়ের সংসারে | আমাকে ভাইবোনেদের থেকে আলাদা করে দিয়ে, মায়ের সান্নিধ্য থেকেও দূরে সরিয়ে দিলেন | আমাকে নির্বাসন দিলেন এক অচেনা, অজানা সংসারে যেখানে জ্যেঠিমার মুখের কথাই কিনা ধ্রুব | কেউ তার অমর্যাদা বা বিরোধিতা করতে পারবে না | সংসারের যাবতীয় কাজ তো আমাকে দিয়েই করিয়ে নিতো | পড়াশোনা করার জন্য মা পাঠিয়েছেন এখানে, আর সেই পড়ার সময়টুকুও কাজের চাপে বার করতে পারতাম না | বড়ো বড়ো দিদিরা তাদের হাসি, তামাশা, মস্করা নিয়েই আরাম কেদারায় পা ঝুলিয়ে কাটিয়ে দিতো | বরং তাদের যাবতীয় ফাইফরমাশ খাটতে হতো আমাকেই | মা আমাকে এ কোথায় পাঠিয়ে দিলেন | মনটা ভীষণ ভারী হয়ে উঠতে লাগলো | মায়ের ওপর রাগ করে বাড়িতে চিঠি লেখাও বন্ধ করে দিলাম | কিন্তু বয়স হতেই, বুদ্ধির বিকাশ হতেই মায়ের ওপর আর রাগ হয় না | তখন বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন তো বুঝতে পারি যে ঠিক কি কারণে মা আমাকে জ্যাঠার বাড়ি পাঠিয়েছিলেন | শুধুমাত্র আমি যেন একটু পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি | এখন বুঝি যে বাপহারা তিন ছেলেমেয়েকে কি করে তিনি মানুষ করবেন, কি করে তাদের মুখে খাবার তুলে দেবেন, সেই চিন্তাতেই অস্থির থাকতেন সব সময় | তাছাড়া চারজন একসাথে হঠাৎ করে মামার সংসারে এসে পড়ায় মামার ওপর যে চাপটা পড়তে শুরু করেছে, সে সব চিন্তা করেই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জ্যাঠার সংসারে | ঘরে উপার্জন করার মতো কেউ নেই যে মামাকে কিছুটা হলেও আর্থিক সাহায্য করতে পারে | তাই মামার সংসারে মা দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করতে থাকেন যেন মামিমা অন্ততঃ ছেলেমেয়েদের কোনোভাবেই অপদস্থ করতে না পারেন, কোনোরকম কটু কথাও যেন শোনাতে না পারেন | জ্যাঠামশায়ের সংসারে আমি যে একটা বোঝার মতো হয়ে রয়ে গিয়েছি, সেটা জ্যেঠিমা আর দিদিরা প্রতি পদক্ষেপেই আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো | জ্যাঠামশাই হয়তো আন্দাজ করতে পারছিলেন জ্যেঠিমার এই বিমাতৃসুলভ আচরণের কথা | তাই তার আদেশ অনুসারে সন্ধ্যের পর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া শুরু হলো গ্রাম থেকে দূরে, মাঠে | সেখানে জ্যাঠার একটা জমির মাঝে ঘর করা ছিল দোতলা উচ্চতায় | কাঠের গুড়ি বসিয়ে পিলার বানানো, তার ওপরে ঘর | ঘরের মেঝে কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি | একা একা সেখানে শুয়ে রাত কাটানো সত্যিই ভয়ের ব্যাপার | কোনোরকমে রাতটা পার করে ভোরেই ঘরে ফিরে আসতাম | মনের মধ্যে একটা কষ্ট হতে থাকলো - কিন্তু সেটা কাওকে জানাতে পারতাম না | রাত হলেই নানারকম পশুর ডাক শুনতে পেতাম | ভয় বাড়তো | পাটাতনের ফাঁক দিয়ে নিচে দেখতে পাওয়া যায় | একদিন জ্যোৎস্না রাতে পাটাতনের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোয় একটা বাঘকে ঘুরতে দেখে ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছিলো | এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে পরের দিনেই মার্ কাছে যাবো বায়না করে ফিরে এসেছিলাম মায়ের কাছে | ক্লাস এইটও পাস করা আর হয়ে উঠলো না |

মামার সংসারে বড় হতে লাগলাম তিন ভাই বোনে | দেখতাম সারা দিনই মাকে কাজ করতে | আমাদের জন্য সময়ই দিতে পারতেন না তিনি | এই ভাবেই কেটে গেলো কয়েকটা বছর | দিদির বিয়ে হয়ে গেলো | জামাইবাবুও পূজার্চনা করেন, তার একটা বইয়ের দোকানও আছে | আমি লেগে গেলাম সেই দোকানে কাজ করতে | মামার বাড়ির থেকেই যাতায়াত করতাম | পথে একটা মিষ্টির দোকান পড়ে | মাঝে মাঝেই সে দোকানে দাঁড়িয়ে দুএকটা মিষ্টিও খেতাম, অবশ্য ঘরের জন্যও কখনো সখনো নিয়ে আসতাম মিষ্টি | মিষ্টির দোকানে আমার একটা মিষ্টি আকর্ষণও ছিল | দোকানদারের সাথে সেই দোকানে বসতো এই বছর বারো তেরোর একটি মেয়ে | সুশ্রী, লাজুক, বিনম্র | দোকান ঠিকমতো চালানোর সমস্ত গুণগুলিই তার ছিল | দোকানের হিসাব ঠিকমতো রাখা, খদ্দেরদের সাথে মধুর ব্যবহার করা ইত্যাদি ইত্যাদি | এই সমস্ত গুণ থাকলেও তার সবচেয়ে বড় গুণ যেটি ছিল সেটি এই যে মেয়েটি খুব সুন্দর করে অনর্গল সংস্কৃত শ্লোক বলে যেত | জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি যে সে শ্রীমদ্ভাগবতগীতার শ্লোকগুলি স্পষ্ট দীপ্ত উচ্চারণে ছন্দ করে গাইতো | সেগুলি শুনতে আমার এতো ভালো লাগতো যে আমি অবাক বিস্ময়ে তার উচ্চারিত শ্লোক শোনার জন্য প্রায় প্রতিদিনই সেই দোকানে যেতে শুরু করলাম | একদিন দেখলাম একখণ্ড কাপড়ের ওপরে সুতোর কাজ করে লিখে দিলো "বাসাংসী জীর্ণানি, যথা বিহায়; নবানি গৃহ্নাতি নরহপরানি; তথা শরীরানী বিহায় জীর্ণা; ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহি "| মানে বুঝতে পারলাম না, কিন্তু বুঝতে পারলাম ধীরে ধীরে আমার ভালো লাগা শুরু হয়ে গিয়েছে | কি যে আকর্ষণ সে বলে বোঝানো যাবে না | আমার চোখের সামনের আকাশটা রঙিন আলোয় আলোময় হতে থাকলো | বাতাসে যেন প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পেলাম | অদ্ভুত এক আকর্ষণ শক্তি প্রতিদিনই আমাকে বারে বারে সেই মিষ্টির দোকানে টেনে নিয়ে আসতে লাগলো | একদিন দেখলাম আগের মতোই আবার কাপড়ের ওপর সুতোর কাজের লেখা বেরিয়েছে - ' পিতা স্বর্গ:, পিতা ধর্ম:, পিতহি পরমং তপো:; পিতরি প্রীতিমা পণ্যে প্রীয়ন্তে সর্ব দেবতা, ভুর্মে গরিয়সী মাতা; স্বর্গা দুশ্চতর: পিতা | জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী' |

গল্প করার প্রবণতাও ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো | ক্রমশ গল্পের মাধ্যমেই দুজনে দুজনকে জানার চেষ্টা করতে লাগলাম | সেই যুগে ছেলেমেয়েদের এইভাবে কথা বলাটা ভালো নজরে দেখা হতো না | মেয়েটির বাবা বোধহয় আমাদের এই কথা বলার প্রবণতাকে খুব ভালো নজরে দেখছিলেন না | তাই একদিন আমাকে ডেকে বললেন,'কি এতো গল্প করো হে ছোকরা | মিষ্টি খেতে এসেছো | মিষ্টি খাও, চলে যাও | এতো গল্পের তো কোনো প্রয়োজন নেই' |


তিনি জানবেন কি করে, আমার প্রধান আকর্ষণটা কি | আমি কি মিষ্টি খেতেই আসি নাকি আমার গীতাকে দেখতে আসি, দুটো কথাই তো বলতে আসি | নিজের মনেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে আমি ওকে গীতা নামেই ডাকবো | আমার গীতা যে অজান্তেই আমার মনের মধ্যে একটা স্থায়ী জায়গা খুঁজে নিয়েছে | সেখানে কারো কোনো উপদেশ বা সতর্কবাণী কিছুতেই গীতাকে সেই স্থায়ী জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না |

                

               পর্ব ৩


একদিন জানতে পারলাম দেশ নাকি ভাগ হয়ে গেছে | আমাদের সোনার বাংলা দুটুকরো হয়ে গেছে | আমরা যেখানে আছি সেটা নাকি পাকিস্তান হয়ে গেছে | জামাইবাবু বললো ‘আমাদের তো তাহলে এই পাড়েই থাকতে হবে | বেঁচে থাকতে গেলে তো দোকানটাও ঠিক মতো চালাতে হবে | অমলেন্দু, তুই এক কাজ কর | ট্রেনে ক্যালকাটা চলে যা | এই একটা প্রকাশকের ঠিকানা দিয়ে দিলাম | আর এই নে, বইয়ের লিস্টটা ধরে | লিস্ট ধরে ধরে সব বইগুলো হিসেবে করে নিয়ে আসবি | দেখিস যেন কিছু বাদ না পড়ে যায়’| এ আর এমন কথা কি | আমি তো বেশ কয়েকবারই ক্যালকাটা (ওহ, এখন তো কোলকাতা হয়ে গেছে) থেকে এর আগে বই নিয়ে এসেছি | আমিও পর দিন সকালেই কলকাতার পথে রওয়ানা দিলাম | শিয়ালদহ স্টেশন এ নেমে কেমন যেন একটু থমথমে ভাব লক্ষ্য করলাম, একটু ভয় ভয়ও করতে লাগলো | রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা | গ্রামের বাড়িতেই কানাঘুষো একটা খবর পাচ্ছিলাম যে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে নাকি মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে গেছে | সেটার প্রভাব এখানেও পড়েছে নাকি | কি জানি | ফাঁকা রাস্তা ধরে রাজাবাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম | কিছুটা এগোতেই দেখি রাস্তার একপাশে একটা ডাস্টবিনের কাছে একটা লোক মাটিতে পড়ে ছটফট করছে | তার পেটের কাছটা বিরাট কাটা, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে আর চারদিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে | হঠাৎ দেখি দুজন লোক হাতে ভোজালি নিয়ে ছুটে আসছে | বেগতিক দেখে ভয়ে উল্টোমুখে শিয়ালদহের দিকে দৌড়োতে শুরু করলাম | লোকদুটো কিন্তু ছুটে আসছেই আমার দিকে | দেখি একটা খালি ট্রাম খুব জোরে চালিয়ে শিয়ালদহের দিকেই যাচ্ছে | আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় গতিটা একটু কমিয়ে দিলো | দৌড়োতে দৌড়োতেই চলন্ত ট্রামে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম | একসময় দেখি কন্ডাকটর দাদা আমার হাত ধরে টেনে গাড়িতে তুলে নিলেন | ট্রামটি আবার গতি বাড়িয়ে চলতে শুরু করলো | ভয়ে আমার সারা শরীর তখন কাঁপছে | লোকদুটো ট্রামের খুব কাছে এসে গেলেও তাতে চড়তে পারলো না | কানে শুধু একটা কথাই ভেসে এলো - 'শালা বাঁচ গয়া' | একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে কন্ডাকটর দাদা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি আর কোথায় বা যাবো | কোথায় থাকি, কি জন্য কোলকাতায় এসেছি সব বললাম | সব শুনে তিনি বললেন, কলেজ স্ট্রিট পার হয়ে গেছে, এখানেই নেমে পড় আর উল্টোদিক থেকে আসা কোনো বাস বা ট্রাম ধরে শিয়ালদহ চলে গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে সোজা বাড়ি চলে যা | ট্রাম থেকে নেমে যেদিকে ট্রাম যাচ্ছিলো সেদিকেই হাঁটতে শুরু করলাম | কোনো বাস বা ট্রাম কিছুই দেখতে পাচ্ছি না | ভয়ে ভয়ে একপা দুপা করে এগিয়েই চলেছি | কিন্তু বিপদ যে আমার কাটেনি সেটা জানতে পারলাম একটু পরেই | কিছুটা হাঁটার পরেই দেখি পাশের একটা গলি থেকে চারটে ষন্ডামার্কা লোক বেরিয়ে এসে আমার দিকেই দৌড়ে আসছে | আমিও পড়ি কি মরি আবার দৌড় লাগালাম | অনেকটা দৌড়োনোর পর দেখি একটা মসজিদের সামনে একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন | আমি সোজা দৌড়ে গিয়ে তার পায়ে পড়ে গেলাম | বললাম, 'বাবা আমাকে বাঁচান, বাবা' | লোক চারজনও তখন কাছে এসে গেছে | ভদ্রলোক হাত তুলে তাদের দাঁড়িয়ে যেতে বললেন | আমাকে তুলে দাঁড় করিয়ে বললেন, 'বেটা, তুম মেরেকো বাবা বোলা হ্যায় না , তুমহারা খরাব কুছ হোনে নেহি দেঙ্গে ' | আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি আর এই সময় কোলকাতায় কেন এসেছি | সমস্ত কিছু শুনে তিনি ওই লোকগুলোকে আমার জন্য কিছু খাবার আর জল আনতে বললেন | তারা বিস্কুট,মিষ্টি আর জল এনে দিলো | ভদ্রলোক বললেন, 'কুছ খা লো বেটা, পুরা দিন তো খানা উনা কুছ নেহি মিলা না'| বলে, আদর করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন | খাওয়া হয়ে গেলে ওই চারজনকে উনি বলেন,' দেখ, এ মেরা বেটা হ্যায়, ইসকো কুছ নেহি হোনা চাহিয়ে | তুম লোগ ইসকো সিধা শিয়ালদহ স্টেশন লে যাও | টিকট বনাকে, গাড়ি মে বৈঠাকে, গাড়ি ছুটনে কে বাদ লোটকে মেরেকো খবর করো | অগর খরাব কুছ হুয়া তো তুম লোগোকো, কিসিকো হম নেহি ছোড়েঙ্গে '| সে যাত্রা বাবার দয়ায় সুস্থ ভাবেই আমি বাড়ি ফিরে আসতে পারলাম |


  *      *       *       *               আমাদের আর বোধহয় এ দেশে থাকা হবে না | চলে যেতে হবে ওপারে ভারতবর্ষে | চারিদিকে শুরু হয়ে গেছে মারামারি, হানাহানি, লুটপাট | আগুনের লেলিহান শিখা আকাশকে স্পর্শ করতে চাইছে | আমাদের নিজেদের গ্রামের অতি পরিচিত জনও আমাদের আর চিনতে পারছে না | ক্রূর দৃষ্টিতে দেখছে | মামা চিন্তিত, মাকেও দেখলাম ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত | আমাদের আড়ালে রেখে মামার সাথে আলোচনা করছেন এই অবস্থায় কি করা উচিত | ঠিক হলো আজ রাতেই এখান থেকে পালাতে হবে | কিছু থালা বাসন কাপড়ে বেঁধে আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ সাথে নেওয়া হলো | আর কি কি নেওয়া যেতে পারে চিন্তা করতে করতেই দূর থেকে ভেসে এলো অনেক লোকের একসাথে চিৎকারের আওয়াজ, সঙ্গে মশাল জ্বলার আলো | মামা, মামী, মা সকলেই বললেন যে এখানে আর এক মুহূর্ত থাকাও ঠিক হবে না | সবাই একসাথে উল্টোদিকে দৌড়োতে শুরু করলাম | সবার মাথাতেই ছোট বড় বিভিন্ন মাপের পুঁটুলি | কতক্ষন যে এভাবে দৌড়েছিলাম নিজেরাই জানি না | পূবের আকাশটা একটু লাল হতেই দেখলাম একটা নদীর ধারে এসে পড়েছি | দেখি দলে দলে লোক পালাচ্ছে | একটা ভিড়ে ভরা নৌকোতেই উঠে পড়লাম সকলে |

নতুন সকাল | নৌকো থেকে নেমে আবার হাঁটা | হাজারে হাজারে লোক হাঁটছে উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতা নিয়ে অতীত কে পেছনে ফেলে, বর্তমানের পথ ধরে অজানা ভবিষ্যতের দিকে | চলতে চলতে এসে পড়লাম এক গ্রামে | গ্রামের ঘরবাড়ি গুলো আছে কিন্তু লোকজন নেই | হয়তো আমাদের মতোই সকলে পালিয়েছে | আমরা এলাম ওদিক থেকে এদিকে আর ওরা হয়তো চলে গেছে এদিক থেকে ওদিকে | চলতে চলতেই দেখা হয়ে গেছিলো দিদি-জামাইবাবুর সাথে | হঠাৎ | আশ্চর্য্য সংযোগ | দিদি আমাদের আর কিছুতেই ছাড়তে চাইলো না | একটা ফাঁকা বাড়ি দেখে নিয়ে সেখানেই থাকার পরিকল্পনা হলো | মামা-মামীরা চলে গেলেন শান্তিপুর | সেখানে কোনো পরিচিত কেউ আছে | তাদের ওখানে গিয়েই উঠবেন | তারপর একটা কোনো থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই | আমরা বাকিরা সকলেই ফেলে রেখে যাওয়া বাড়ির ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজে লেগে গেলাম | হয়তো বাকি জীবন এখানেই কাটাতে হবে |

শুরু হলো নতুন জীবন | ঘর গোছানোর পালা | জরুরি জিনিসপত্র আনা, হাট বাজারের দায়িত্বর সাথে গরু ছাগল চরানোর দায়িত্বটাও এসে পড়লো আমার ওপর | একটু বড়োও তো হয়েছি | সংসারের দায়িত্ব কিছুটা হলেও তো আসবেই | কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাও এসে ভিড় করতে থাকে মাথার ভেতর | গীতার কথা মনে আসে | সারাদিন গীতাকে চিন্তা করতে করতে মনের মধ্যেই ভাবনা এসে ভিড় করে যে আর আমি গীতার দেখা পাবো কি না | কোথায় রয়ে গেলো বা কোথায় হারিয়ে গেলো কে জানে | আমার মনের পুরোটা জুড়েই যে শুধু গীতা, সেটা বুঝতে পারলাম এখানে চলে এসে | কি ভালোই যে কাটছিলো দিনগুলো | প্রতিদিন অন্তত একবার চোখের দেখা দেখার জন্য মিষ্টি কিনতে যাবার অছিলা | রোমাঞ্চ, শরীরে অদ্ভুত কম্পন, উত্তেজনা | দিনগুলো তো হারালো ঠিকই, কিন্তু তার সাথে সাথে আমার গীতাও যে হারিয়ে গেলো জীবন থেকে | মনের মধ্যে, শুধু চিন্তার মাধ্যমে আর মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখার মধ্যে দিয়েই গীতার অস্তিত্ব অনুভব করে ভালোলাগার আবেশে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম দিনগুলো একটা জড়পদার্থের মতো | কাজে কর্মে উৎসাহ পাই না, বাড়ির লোকের কথা বা কাজ করতে বলাটা একদমই নিজের মনে মেনে নিতে পারছিলাম না | অল্পেতেই রেগে যাবার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে বুঝতে পারছিলাম | চেষ্টা করছিলাম নিজেকে শান্ত, ধীর স্থির রাখতে, যাতে বাড়ির কেউ কোনোদিনও যেন ঘুনাক্ষরেও টের না পায় যে মাঝে মাঝেই আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছি |


                পর্ব 8              


দিদির সংসারে তো আর চিরটাকাল বসে থাকতে পারি না | আমাকে এবার একটা চাকরি খুঁজে পেতেই হবে | অন্তত চেষ্টা তো করতেই হবে | জামাইবাবুর বইয়ের দোকান তো ওপারেই পড়ে রইলো | পড়াশোনাও তো আর হলো না | কি করে সৎপথে দুটো পয়সা ঘরে আনা যায় সে চিন্তাই আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো | প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে | ঘরে বসে থেকে শুধু শুধু অন্ন ধ্বংস করা আমার নিজের কাছেই গর্হিত অপরাধ বলেই মনে হতে লাগলো | আর তাছাড়া, নিজের মানসিকতায় আমি কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিলাম না | বাড়ির সকলেই তো তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে | হঠাৎ করে দাঙ্গা শুরু হয়ে যাওয়ায় কেউ তো কিছুই নিয়ে আসতে পারেনি যে কিছুদিন অন্তত পূর্ণ বিশ্রাম নিতে পারবে বা আরাম করতে পারবে | সকলেই তো কাপর্দক শূন্য অবস্থায় রাতের অন্ধকারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি সব ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে | গুরুজনেরা তো তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন ছন্নছাড়া, ভাঙা, বিক্ষিপ্ত সংসারটাকে কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাবার, নতুন করে সংসার গোছাবার | ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সকলে মিলেই সামাল দিচ্ছে | এই বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট জমিটুকুতে যেটুকু তরি-তরকারি উৎপন্ন হচ্ছে, তাই নিয়ে গিয়ে হাটে বিক্রি করে দুটো কাঁচা পয়সা হাতে আনার চেষ্টা তো চালিয়ে যাচ্ছে | এই অবস্থায় আমারও তো কিছু দায়িত্ব থেকে যায় ঘরের জন্য দুপয়সা রোজগার করার |

হঠাৎই একজন প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারলাম যে কলকাতার কাছে ব্যারাকপুরে একটা কোম্পানিতে কাজের জন্য লোক দরকার | কথাটা কানে যাবার পর আর যেন স্থির থাকতে পারছি না | আর এক মুহূর্তও দেরি না করে মাকে জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে | কিছুটা হেঁটে, কিছুটা বাসে করে আর কিছুটা ট্রেনে করে অবশেষে এসে পৌছালাম ব্যারাকপুর | লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসে পৌছালাম কোম্পানির গেটের কাছে | বড়ো বড়ো করে লেখা কোম্পানির নাম | কিন্তু সিকিউরিটির লোকজন আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে কেন | কোনো কাগজপত্র কিছুই দেখতে পারছি না | ওরাও আমাকে ভেতরে যেতে দেবেনা আর আমিও চাকরির একটা ব্যবস্থা না করে ঘরে ফিরবো না | অনেক্ষন ধরেই দুপক্ষের জেদাজেদি চলতে থাকায় অনেক লোকও জড়ো হয়ে গেলো | কেউ কেউ আমার পক্ষেই কথা বলতে শুরু করলো | লোক যখন নেওয়াই হচ্ছে তখন একেও একটা সুযোগ দেওয়া উচিত | এতদূর থেকে যখন এসেছে তখন একবার ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে | তবে বেশির ভাগ লোকই আমার বিপক্ষে | কটু বাক্যে বিরোধিতা শুরু করলো | এইভাবে কি আর চাকরি পাওয়া যায় | হুট্ করে চাকরি দাও বলে চলে আসলেই হলো | যে কেউ হঠাৎ করে এসে চাকুরী দেবার আবদার শুরু করলেই হলো - তাকে চাকুরী দিয়ে দিতে হবে | চাকুরী কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি যে দাও বললেই দিতে হবে | তাহলে তো যে আসবে তাকেই ভর্তি নিতে হয় | অন্য পক্ষ বললো না না চাকুরীতে ভর্তি করে নেবার কথা তারা বলছে না, বলছে এতদূর থেকে ছেলেটা যখন এখানে এসেছে তখন ওকে অন্তত ইন্টারভিউটা নেবার ব্যবস্থা করে দিক, যোগ্যতা আছে কি নেই সেটা যাচাই করে নিক | এইরকম বাগবিতণ্ডার মধ্যেই হঠাৎ করে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো গেটটার সামনে | প্রহরীরা তটস্থ হয়ে স্যালুট করতে করতে খুলে দিলো গেটটা | গাড়ির জানালা খুলে একজন ভদ্রলোক প্রহরীদের কাছে জনতা চাইলেন এখানে কি ঘটেছে | তাদের কাছে সমস্ত ঘটনার ব্যাপারে জানতে পেরে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বলে গেলেন 'আমার চেম্বারে পাঠিয়ে দাও' | আমিও ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র পেয়ে গেলাম | ধীরে ধীরে এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে দেখতে লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসে পৌঁছালাম গাঙ্গুলী বাবুর চেম্বারে | আমাকে ডেকে চেম্বার এর ভেতরে আসতে বললেন | অফিস চেম্বারটা দেখে মনে হলো যেন আমি কোনো স্বপ্নের রাজ্যে এসে পড়েছি | খুবই সুন্দর সাজানো বিশাল একটা ঘর | বেশ কয়েকটা বসবার জায়গা আর সেগুলির সামনে ছোট ছোট টেবিল | ঘর সাজানো হয়েছে অনেক ফটো, ডেকোরেটিভ আইটেম আর বেশ কয়েকটা ফুলদানি দিয়ে | ঘরের একপ্রান্তে একটা বিশালাকার টেবিল | সেটা সাজানো হয়েছে কিছু ফুলদানি, কিছু অ্যাওয়ার্ড, ট্রফি আর কিছু ফাইল দিয়ে | টেবিলটির অপর প্রান্তে একটা সুন্দর ঘোরানো চেয়ার আর সে চেয়ারে যিনি বসে আছেন, তিনিই গাঙ্গুলী বাবু, এ কোম্পানির কর্ণধার | চেম্বারে ঢোকার সাথে সাথেই একটা গুরু গম্ভীর গলায় নাম জিজ্ঞাসা করলেন | কতদূর পড়াশোনা করেছি জানতে চাইলেন | আমার অতীত জীবনের গল্পগাঁথা শুনলেন | বললেন,' তোর যে এখন একটা চাকরির ভীষণ প্রয়োজন বুঝতে পারছি | এখানেও আমার কাজ করার জন্য কিছু লোক দরকার | তোর জেদ এবং কাজ পাওয়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছেটাও আমার ভালো লেগেছে | এই রকম নাছোড়বান্দা মনোভাবই আমি খুব পছন্দ করি | সব কিছুই যে সহজে পাওয়া যাবে, কষ্ট করতেই হবে না এমন তো নয় | নিজের জেদ দেখিয়ে সেটা পাবার যে প্রবণতা তোর মধ্যে আমি দেখেছি তার জন্যই আমি তোকে আমার চেম্বারে ডেকে পাঠিয়েছি | কাজ আমি তোকে দেব | কিন্তু সে কাজ করতে হবে মন দিয়ে | কাজকে ভালোবাসতে হবে | কোনো কাজ ঠিকমতো না হলে সেটাকে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে একেবারে পারফেক্ট করতে হবে | আমার দ্বারা হবে না বা এ কাজটা হবেই না, এই ধরণের কথা আমি শুনতে চাই না | কাজটা সুন্দরভাবে, সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে হবে | আমি মাথাটা হেলিয়ে কিছু একটা বলতে যাবার আগেই তিনি আবার বললেন, 'আমি লোক চিনতে ভুল করি না| তাই আমার বিশ্বাস তুই পারবি, এইরকম জেদ আর ইচ্ছেটা থাকলেই হবে | ঠিক আছে, আজ থেকেই কাজে লেগে যা' | আমি হাতের মুঠোয় পাওয়া স্বর্গটাকে আঁকড়ে ধরে শুধু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে দিলাম | বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই উনি একজনকে ডেকে পাঠালেন | অস্থির হয়ে পড়লাম, লোকটা আসতে এতো দেরি করছে কেন | লোকটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই তার সাথে আমায় পাঠিয়ে দিলেন সমস্ত কারখানাতে ঘুরে দেখতে এবং আমার কাজ বুঝে নিতে | মনের আনন্দ আর ধরে রাখতে পারছি না | লোকটার সাথে যেতে যেতে কারখানার ব্যাপারে অনেক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে নিলাম | লেগে গেলাম মগ পিটিয়ে ফিনিশিং এর কাজে | থাকার ব্যবস্থাও হয়ে গেলো | কোম্পানিরই ছোট ছোট কোয়ার্টার, তার একটা হলো আমার আস্তানা | দুদিনের জন্য বাড়ি গিয়ে মা আর ভাইকে এখানে নিয়ে আসার ইচ্ছেটা জানালাম | ছুটি মনজুর হলো না | বললাম আমার হাতে তো টাকা পয়সাও কিছু নেই, আমি থাকবো কি ভাবে | কিছু টাকাও একজনের মাধ্যমে আমার হাতে এসে পৌঁছলো | অগ্রিম পেলাম |

কাজকর্ম ভালোই চলতে লাগলো | অনেক কাজ শিখেও নিয়েছি ইতিমধ্যে বয়স্ক কর্মীদের সঙ্গে একসাথে কাজ করে | আমাকে দূরে না সরিয়ে রেখে আপনার জনের মতো করেই কাজ শেখাতে থাকলো | আমি বাধ্য ছাত্রের মতো তাদের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব হয় কাজ শিখে নিতে থাকলাম | আমার এই কাজ শেখার আগ্রহ দেখে তারাও যেন তাদের সমস্ত জ্ঞান, বুদ্ধি দিয়ে এক অতি বাধ্য ছাত্রকে তৈরি করতে থাকলো | তাদের প্রত্যেকেই সহযোগিতার হাত যেমন বাড়িয়ে দিয়েছিলো আমার দিকে, তেমনই সুন্দর ব্যবহারে আমাকে তারা আপন করে নিয়েছিল | এই রকম একটা সুস্থ পরিবেশে কাজ শেখা বা করার ইচ্ছেটা অনেক গুন বেড়ে যায় | আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো |

অনেকদিন হয়ে গেলো, এক নাগাড়ে কাজ করছি | একা একা কোয়ার্টারে আছি | নিজের হাত পুড়িয়ে দুবেলা রান্না করছি | অবশ্য মাঝে মাঝেই হৃদয়ের বাড়ির থেকে খাবার নিয়ে আসতো হৃদয়ের বৌ আশা | সে তার দাদাকে হাতের রান্না খাওয়াবেই | খাবো না বা ক্ষিদে নেই বলে পার পেতাম না | এমন ভাবে কথার বানে বিদ্ধ করতো যে শেষ অবধি খাবারটা খেতেই হতো | হৃদয় আর আমি একসাথেই কাজ করি | আমার কাজে যোগ দেবার কিছুদিন পরেই হৃদয়ও কোম্পানি তে চাকুরী পেয়ে গেলো | আমার সমবয়সীই হবে বোধহয় | একেবারে মাটির মানুষ | হৃদয়ের হৃদ্যতার বন্ধনে ধীরে ধীরে এমনভাবে জড়িয়ে পড়লাম যে সে একেবারে নিজের লোক হয়ে উঠলো | এবার সত্যিই দিন কয়েকের ছুটি চাই | গাঙ্গুলি বাবুকে অনেক বললাম ছুটি দেওয়ার জন্য | কিন্তু কিছুতেই তিনি এখন ছুটি দেবেন না | মাকেও এখানে আনতে পারছি না | মনে মনে রাগ, ক্রোধ বাড়তে শুরু করলো | জামাইবাবুকে চিঠি লিখলাম মা আর ভাইকে এখানে পৌঁছে দেবার জন্য | একদিন সেটাও হয়ে গেলো | মায়ে বেটায় তিন জনে মিলে সংসার সাজিয়ে নিলাম |

ভাইকে একটু পড়াশোনাতে ব্যস্ত রাখতে হবে | নয়তো, সারাদিন অলস বসে থাকলে অনেক কুচিন্তাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকবে | কিন্তু আশেপাশে কোনো ভালো কলেজ আছে কিনা জানতে পারিনি | পড়তে গেলে সেই কলকাতায় গিয়েই পড়তে হবে | প্রতিদিন ট্রেনে করে সেই শিয়ালদাহ যাওয়া-আসা, পারবে কিনা ঠিক সাহস করে উঠতে পারছি না | আমিই এখনো ট্রেনে বাসে যাতায়াত করার ব্যাপারে তেমন সড়গড় হয়ে উঠতে পারিনি, আর ও তো আমার কত ছোট | তার ওপর সদ্য গ্রাম থেকে এসেছে | শহরের হাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কিছুদিন তো লাগবেই | এই সমস্ত সাত-পাঁচ ভাবনা মাথার মধ্যে সারাক্ষন ঘোরাঘুরি করতে লাগলো | কোনো একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে | তাই, কলেজের খোঁজ খবরও নিতে শুরু করলাম |

দিনগুলো ভালোই কাটছিলো | নিজেকে আর খাওয়ার জন্য হাত পোড়াতে হচ্ছিলো না | কারখানার কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করলাম | গাঙ্গুলি সাহেব থেকে শুরু করে অন্যান্য অফিসারেরা সকলেই আমার কাজে খুব খুশি | শ্রমিক বন্ধুমহলের সবাই আমার কাজে খুশি তো বটেই উৎসাহও দিতে থাকলো অনেক | ধীরে ধীরে কোম্পানির মোটামুটি সব কাজই আমি করতে শুরু করলাম | কাজকে ভালো লাগতে লাগলো | কাজ করে যে এতো আনন্দ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে শিখলাম |

সুখ বোধহয় আমার কপালে বেশি দিন স্থায়ী হয় না | হঠাৎ একদিন ভাইটা অসুস্থ হয়ে পড়লো | বমি করতে শুরু করলো আর তার সাথে দাস্ত | একদিনেই শরীরটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে গেলো | বাড়িতেই ডাক্তার নিয়ে এলাম | পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওষুধপত্র দিয়ে গেলেন | অবস্থার কোনো উন্নতিই দেখা গেলো না | তিন দিনের মাথায় সব শেষ | মা কে সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না | জামাইবাবুকে জানালাম | তিনি এসে মাকে আবার গ্রামের বাড়িতেই নিয়ে গেলেন | আমার অবস্থা আবার যথা পূর্বং হয়ে গেলো |


                 পর্ব ৫


এক বছরের ওপর কেটে গেছে | সময় ধীরে ধীরে অতীত কে ভুলিয়ে জীবনে চলার পথটা অনেক সহজ করে দিয়েছে | কিন্তু আমি মার সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য কোনো ছুটিও পাচ্ছি না | কেমন সাহেব বুঝিনা | আমাকে ভালোবাসেন ঠিকই, কিন্তু ছুটিও দেবেন না | মনের মধ্যে রাগ গুমরে গুমরে উঠছিলো | এটা আমার ওপর একরকম অত্যাচার হচ্ছে বলে মনে হতে লাগলো | আর সহ্য করতে পারছিলাম না | মায়ের জন্য মনটা সত্যিই খুব খারাপ লাগছিলো | মেয়ের সংসারে পড়ে রয়েছেন | নিশ্চই তারও সেখানে আর মন টিকছে না | তার ওপর সবেমাত্র ছেলে হারানোর যন্ত্রনাটাকে হয়তো একটু একটু করে ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন | মনের বেদনা তো মুখে প্রকাশ করতে পারেন না - কষ্টটা মনের মধ্যেই চেপে রেখে গুমরে মরেন | তার মনের মধ্যে কি চলছে, আমি এতদূরে থেকেও কিছুটা তো অনুধাবন করতে পারি | আবার গাঙ্গুলী বাবুর সাথে দেখা করলাম | আমার অবস্থা, মায়ের মনের অবস্থা সবই বিভিন্ন ভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম | অন্তত দুদিনের ছুটি দেবার জন্য বারে বারে অনুরোধ করলাম | কিন্তু না, চিড়ে ভিজলো না | কিছুতেই আমার ছুটির ব্যাপারে সম্মতি দিলেন না | সম্ভবত তার মনে হয়েছিল যে দুদিনের ছুটিতে গিয়ে আমি যদি আর না ফিরি | কিছুতেই হারাতে চান না আমাকে | তার কথাবার্তায়, হাবেভাবে, আমার এই কথাটাই বারে বারে মনে হতে লাগলো | নিজের মনেই ভাবলাম - আমার এই ধারণাটাই যদি সঠিক হয়, তবে আমিও তাকে একটু ধাক্কা দিয়ে দেখতেই পারি | যেমন ভাবা তেমনই কাজ | একদিন ভোররাতে কাউকে কিছু না জানিয়েই ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে পড়লাম | চললাম মায়ের সাথে দেখা করতে| শুধুমাত্র ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ফিরে গেলাম দেশের বাড়িতে|

হঠাৎ আমাকে ফিরে আসতে দেখে সবাই খুব অবাক হয়ে গেলো | বললাম চাকুরী ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি | সবার মনের মাঝেই উদ্বেগ | কি হলো ছেলেটার | কোনো গন্ডগোল করে পালিয়ে এসেছে নাকি | হঠাৎ ছেড়ে দিলো চাকুরী, না কি ছাড়িয়ে দিলো | নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার ঘটিয়েছে | এমনও হতে পারে যে একা থাকতে আর ভালো লাগছে না, হাঁপিয়ে উঠেছে গতানুগতিক জীবনযাত্রায় | সকলেই চিন্তিত | মায়ের উৎকণ্ঠা যেন আরও বেশি | ‘কিরে, কিছু হয়নি তো | চাকুরী ছাড়লি কেন | পড়াশোনাটা শেখা হয়নি, চাকুরী একটা যাও বা পেয়েছিলি, হঠাৎ করে ছেড়ে দিয়ে চলে এলি | আমাদের চলবে কি করে | তোর ওপর ভরসা করেই তো আমি আমার জীবনের কঠিন ধাপগুলো পার করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি | আমার সে স্বপ্নও কি মিথ্যে হয়ে যাবে | বাবা বল, মনের মধ্যে কিছু চেপে রাখিস না | মন খারাপ থাকলে শরীরেও তার প্রভাব পড়ে, আর সে প্রভাব ক্রমেই সংসারেও ছড়িয়ে পড়ে’ | মা কে জানালাম যে আমি কেন চলে এসেছি | বড়বাবুর আমাকে ছুটি না দেবার মানসিকতা কি ভাবে আমার মনের মধ্যে ক্রোধ আর জেদের সৃষ্টি করেছে | আমি এতটাই নিজেকে অসহায় মনে করছি, এতটাই কারাগারের বন্দি জীবন যাপন করছি যেখানে আমার ইচ্ছা, আমার ভালোলাগার কোনো মূল্যই কেউ দেবে না | তাই আমি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি | যেখানে আমি সম্পূর্ণরূপে পরাধীন, আমি শুধু এক আজ্ঞাবহ দাস, সেই অবস্থাটা তো আমার মন মেনে নিতে চাইছে না | তাই, একটু স্বাধীনভাবে থাকতে পারবো এই আশা নিয়েই তো আমি এখানে ফিরে এসেছি | মাঠের কাজ করে বা গরু চড়িয়েও তো আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি | পেটের ভাত জোগাড়ের ব্যবস্থা হবে না ঠিকই, মনের দিক দিয়ে আমি তো একটু শান্তিতে থাকতে পারবো - একটু স্বাধীন থাকতে পারবো |

আবার আমি গরু চড়ানো শুরু করলাম, শুরু করলাম মাঠের কাজও | শহুরে জীবন ছেড়ে আবার গ্রাম্য জীবনে মনোনিবেশ করলাম | দিন পার হতে থাকলো পুরোনো জীবন পথে |

কিছুদিন পর থেকেই ঘরের লোকেদের মধ্যে ব্যস্ততা, শলাপরামর্শ করা, গোপনে কথা বলা এইসব লক্ষ্য করতে লাগলাম | জানতে পারলাম আমার মতিগতির কোনো স্থিরতা নেই, তাই আমার মনকে শান্ত করে সংসারমুখী করে তোলার জন্য আমার নাকি বিয়ে দেওয়া হবে | এই গ্রামেই, আমাদের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে এক ব্রাহ্মণ পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে | উঠেছে এইরকমই ছেড়ে যাওয়া কোনো একটি ঘরে | ভদ্রলোকের বেশ কয়েকটা ছেলে মেয়ে আছে | সম্বন্ধ করা হচ্ছে বড় মেয়ে শঙ্করীর সাথে | আমি বললাম আমি এখনই বিয়ে করতে রাজী নই, আরো কিছুদিন যাক | নিজের পায়ে ঠিকমতো দাঁড়াই, তারপরে দেখা যাবে | বাড়ির লোকেরা শুনবে না, তারা নাকি ভদ্রলোককে কথা দিয়েছে এখানেই বিয়ে দেবে | বাড়ির মান-সন্মান বলে তো কিছু কথা আছে, সেটা নাকি আমার ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া চলবে না | বিভিন্ন ভাবে তারা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকলো | অবশেষে আমি বললাম, ঠিক আছে আমি তোমাদের কথা শুনতে রাজী আছি, কিন্তু মেয়ে না দেখে আমি কিছুতেই বিয়ে করবো না | শুনে সবাই হৈ হৈ করে উঠলো | আজকালকার ছেলেমেয়েদের কতটা অধঃপতন হয়েছে দেখতে পাচ্ছ | আমরা এই গুরুজন ব্যক্তিরা সমস্ত দিক ঠিকঠাক বিবেচনা করেই তবে না ঘরে বৌ নিয়ে আসবো | সেখানে এই ছোকরা বলে কি | গুরুজনদের সিদ্ধান্ত কে অমান্য করে নিজেই মেয়ে দেখতে যাবে বলছে | ঘোর কলি | কিন্তু এটা তো হতে দেওয়া যায় না | তাই জানিয়ে দেওয়া হলো - গুরুজনদের অমান্য করলে, গুরুজনদের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে না পারলে ওর এই বাড়িতে তো আর স্থান হবে না | চলে যাক বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেদিকে খুশি - তখন নিজেই বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল |

মনটা খারাপ হয়ে গেলো | মনের মধ্যে এখনও তো সেই গীতা | গীতার খোঁজ না পেলে, কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে, জানতে না পারলে আমার জীবনটাই তো বৃথা | অবশ্য খুঁজবোই বা কোথায় - এই বিশাল শরণার্থীদের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে | হয়তো এপারেই আসতে পারে নি | ওপারেই রয়ে গেছে | হয়তো বিধর্মী হয়ে গেছে | বেঁচে আছে কিনা তাই বা কে জানে | সারাদিনই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এই সমস্ত চিন্তা | আবার চিন্তা হচ্ছে যে গুরুজনদের কথা অমান্য করলে আমার তো এখানে থাকাই হবে না | চাকরিটাও তো আর নেই | যাবোই বা কোথায় | এ বিরাট পৃথিবীতে তো আমি একদম একা | এ কি দোটানায় ফেললে আমায় গো ঠাকুর | সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করলাম | বিন্দু মাত্র ঘুম এলো না চোখে | সকাল হতেই চোখ লাল করে জামাইবাবুর কাছে এসে বললাম 'তোমাদের মত ই আমার মত | তোমাদের মত অমান্য করে বাইরে গিয়েও তো মা কে ছেড়ে আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারবো না | তোমরা যা ঠিক করেছো তাই হবে | আমি এই বিয়েতে রাজি' | বলে তো দিলাম, রাজি | কিন্তু নিজের মনকে কিছুতেই মানাতে পারছি না | গীতা যে আমার মনের মধ্যে, অন্তরে, পুরো হৃদয় জুড়ে এমনভাবে স্থান করে নিয়েছে যে, ভেতরে ভেতরে না পাওয়ার যন্ত্রনায় শেষ হয়ে যাচ্ছি | এতো কষ্ট বোধহয় আর কোনো কিছুতেই মানুষ অনুভব করতে পারে না | যদি গীতা বেঁচেই থাকে আর ভবিষ্যতে কোনো দিন যদি তার দেখা পাই, তবে কি সেদিন আমি নিজেকে কোনোভাবে ক্ষমা করতে পারবো এই বিয়েটা করতে রাজি হওয়ার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবার জন্য | যদি সত্যিই সেরকম কিছু ঘটে তবে কি আমি আর মাথা উঁচু করে গীতার চোখের দিকে তাকাতে পারবো | নাকি আমার এই বিবাহিত জীবনটাকে আমি সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে পারবো | আমার জীবনে আসা এই নতুন মেয়েটিকে কি সত্যিকারের ভালোবাসায় আবদ্ধ করতে পারবো - সংসার তিক্ততায় ভরে উঠবে না তো | এই সাত-পাঁচ ভাবনাটাই আমার ভেতরটা কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে | গুরুজনদের মতেই মত দিয়েছি | তাদের সিদ্ধান্ত কে অমান্য করার সাহসও জোগাড় করে উঠতে পারিনি | ফলে সম্পূর্ণরূপেই অন্ধের মতো আমি আমার নতুন জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি | সে জীবন তো এক আশা ভঙ্গের জীবন | প্রতিবাদ করতে না পারার ব্যর্থতার ফলস্বরূপ ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাবার জীবন | যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমাকে এই যন্ত্রনা বয়ে বেড়াতে হবে, এ জীবন কি শুধু যন্ত্রনা বয়ে বেড়ানোর জীবন হয়েই রয়ে যাবে | আজীবন কান্না আর কষ্ট পাবার জীবন হয়েই রয়ে যাবে |

বাড়িতে প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে গেলো | বিয়ের বাদ্যি উঠলো বেজে |


  *       *       *        *

অবাক কান্ড | পৃথিবীতে এরকম অবাক করা কান্ড আজও ঘটে তাহলে | আর তাও সেটা আমার জীবনেই ঘটলো | বিয়ের আসরে জানতে পারলাম আমার সাথে যার বিয়ে হচ্ছে সেই আমার গীতা | কিছুদিন আগেই ওরাও শরণার্থী হয়ে এই গ্রামেই এসেছে এবং আমাদের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরেই একটা ঘরে এসে উঠেছে | মনটা আমার উৎফুল্ল হয়ে উঠলো | যেটা কোনোদিন আর হতে পারে না ধরেই নিয়েছিলাম - ভগবান যেন সেটাই ঘটিয়ে দিলো | তার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ | সমস্ত কিছুই তিনি আমার মঙ্গলের জন্যই করেছেন | আমার অন্তরের ডাকে সাড়া দিয়েছেন | আমার মানসিক শক্তিকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে দৃঢ় করে তুলেছেন |

বিয়ে তো হলো - কিন্তু সংসার চালাবো কি করে ? আমার উপার্জনের সমস্ত পথই তো আমি বন্ধ করে দিয়ে এসেছি | দিদির সংসারে বোঝার পরিমান তো বাড়লো | কতদিন চলতে পারে এইভাবে| গীতাকে আমি সুখী রাখবো কি করে ? চিন্তায় আমার রাতের ঘুম উবে গেলো |

গীতা কিছুদিনের মধ্যেই সবাইকে বেশ আপন করে নিয়েছে | সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম যেমন সামলাচ্ছে, তেমনি সবাইকে নিয়ে খুশিতে বেশ মশগুল হয়েই রয়েছে | তবুও আমার মনে হতে থাকলো, গীতার মনের মধ্যে আমার বেকারত্ব নিশ্চয়ই চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে | লক্ষ্য করলাম, এতো মিশে গেছে সংসারের সবার সাথে অথচ একা থাকলেই মুখটা কেমন গম্ভীর করে রাখে | মনের মধ্যে চিন্তার জট পাকিয়ে মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যাচ্ছে | মুখফুটে কিছু বলছে না ঠিকই, কিন্তু নিজেকে সবার থেকে ছোট করেই ভাবছে | তারই প্রতিফলন দেখলাম সেদিন যেদিন সে বললো যে সে সংসারের জন্য কিছু করতে চায় | দেখলাম ধীরে ধীরে বিড়ি বাঁধার কাজ সে শুরু করলো | তার দাদার কাছ থেকে সে এই মূল্যবান কাজটি শিখে রেখেছিলো | বিড়ি বিক্রি করে কিছু পয়সা তো সংসারে দিতে পারছে, এই সন্তুষ্টিই তাকে উৎফুল্ল রাখতে সাহায্য করলো | সে বিশ্বাস করতো কোনো কাজই ছোট কাজ হয় না | বলতো, "কর্মণ্যে বাধিকা রাস্তে মা ফলেষু কদাচন" | কাজ করে যাও, ফলের আশা কোরোনা | তাই এই কাজটাকেই সে ভালোবেসে, মন প্রাণ ঢেলে করতে শুরু করলো - আর আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যেতে থাকলাম | গীতাকে তো সুখী করে রাখতে পারলাম না - এমনই হতভাগ্য আমি |


                পর্ব ৬


বেশ কিছুদিন কেটে গেলো এইভাবেই | অবশেষে একদিন মনে সাহস সঞ্চয় করে - অকুতোভয় হয়ে দেখা করতে এলাম গাঙ্গুলি সাহেবের সাথে | সোজা ঢুকে গেলাম তার চেম্বারে | আমাকে দেখেই উনি একটু চমকে উঠলেন | ‘তুই, হঠাৎ কি মনে করে | তেজ দেখিয়ে তো চলে গেছিস | আবার এলি কেন' | চলে যাবার পর থেকে যা যা ঘটেছে আমার জীবনে, সমস্ত কিছুই বললাম | নিজের জেদকে অল্প বয়সের অজ্ঞতা ধরে নিয়ে আমার সমস্ত দোষ মার্জনা করার জন্য বারে বারে অনুরোধ করতে লাগলাম | কাজ আমাকে একটা দিতেই হবে | না দিলে এখানেই থেকে যাবো, আর ঘরে ফিরবো না; জানিয়ে দিলাম | বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর তিনি বলে উঠলেন, 'বিয়ে করেছিস, খাওয়াতে পারবি তো ? হঠাৎ এই কান্ডটা ঘটালি কেন | পারবি তো সংসার চালাতে ? অনেক বড় হয়ে গেছিস, তাই না | অ্যাডাল্ট, ম্যাচুওরড | তা এখানে আবার ফিরলি কেন ? আমি কি তোর জন্য চাকুরীটা বাঁচিয়ে রেখেছি যে যখন খুশি হবে এসে আবদার করবি, আর তোর চাকুরীটা আমি তোকে আবার ফিরিয়ে দেব | যা চলে যা এখান থেকে, যে পথে এসেছিস আবার সেই পথেই ফিরে যা | আর কোনোদিন এ পথ মারাবি না | তোর মুখটাও আমাকে আর দেখানোর দরকার নেই | যা, এখুনি বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে" |

একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলাম | মনে সাহস এনে বললাম, 'আমার দোষ আমি স্বীকার করছি | রাগের বশে আমি কাজ ছেড়ে দিয়ে আপনাকে না জানিয়ে চলে গেছিলাম | আমি বড়োই অন্যায় কাজ করেছি | তবুও, আমাকে এবারের মতো মার্জনা করে দিন স্যার | আমি এখন থেকে আমার সাধ্যমতো মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করবো, কথা দিচ্ছি | কিন্তু আমার চাকুরীটা আপনাকে আমায় ফিরিয়ে দিতেই হবে | না দিলে আমি এ ঘর থেকে বেরোবোই না | লোক দিয়ে আমাকে বের করে দিতে পারেন - তবুও, নিজের থেকে আমি কিন্তু বেরোবো না | বিশ্বাস করুন, আমি যতটা না আর্থিক কষ্টের মধ্যে আছি তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি মানসিক কষ্টে একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছি | আমি কি করবো, কি করে সংসার চালাবো - সব সময় এই চিন্তাতেই আমি ভেতরে ভেতরে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছি | আমি কিচ্ছু শুনবো না, আমাকে আমার চাকুরীটা আপনাকে ফিরিয়ে দিতেই হবে' |

"না, না; আর তোকে চাকুরীতে বহাল করতে আমি পারবো না | তোর ওপর আমার যে ভালোবাসা ছিল, যে করুণা ছিল - তা তুই নিজের হাতে শেষ করে দিয়েছিস | আর নয়, চলে যা আমার সামনে থেকে" |

'ঠিক আছে, চলে আমি যাচ্ছি | কিন্তু কোম্পানির বাইরে নয়, যাচ্ছি ওয়ার্কশপে | আপনি আমাকে কিছু টাকা পয়সা দিন বা না দিন, আমি কাজ করে যাবো | আর যদি লোক দিয়ে আমাকে গেটের বাইরে বার করে দেন, তবে যতদিন না আপনি আমাকে চাকুরীতে বহাল করছেন, ততদিন আমি গেটের বাইরেই বসে থাকবো | অনশন করবো | মারা গেলে, আপনার কাছে একটাই অনুরোধ, বাড়িতে শুধু একটা খবর দিয়ে দেবেন'|

"অনেক বড় বড় কথা শিখেছিস, তাই না | রাগ দেখিয়ে, জেদ দেখিয়ে চলে যাবার সময় একবারও তো আমাকে জানিয়ে যাস নি | ফিরতে তো হলোই | আমি জানতাম, ফিরতে তো হবেই | ভালোবাসার দাম তোরা দিতে শিখলি না | যাক, যা করেছিস সেটা অপরাধ | তবে, বয়স কম বলে আমি তোর সব অপরাধ মার্জনা করে দিচ্ছি, শুধুমাত্র আর এক জনের জীবন তোর জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে বলে | মন দিয়ে কাজ করবি তো ভালোবাসাটুকু পাবি | আর দেমাক দেখিয়ে চলে যাবি তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না, সেটা জেনে রাখিস | যা, আজ থেকেই কাজে লেগে যা | আর হ্যাঁ, শোন | মাসে মাইনে পাবি ছাব্বিশ টাকা | যে ঘরটায় থাকতিস সেটা এখন আর খালি নেই | এখানে আর কোনো কোয়ার্টারই খালি নেই | এখন তোকে থাকার জন্য ঘর দিতে পারবো না | আর সপ্তাহের শেষে বাড়ি গিয়ে মা আর বৌকে নিয়ে আসবি | তোর সাথেই তারা যেন থাকে | যা, এখন কাজ শুরু করে দে' |

থাকার জন্য ঘর খোঁজা শুরু হলো | কাছাকাছির মধ্যে যে ঘর গুলোর খবর পেলাম তার ভাড়া এতো বেশি যে ঘর ভাড়া মিটিয়ে সংসার চালানোর জন্য হাতে আর বলতে গেলে কিছুই থাকবে না | অবশেষে অনেক খুঁজে পেতে শ্যামনগরে একটা ঘরের ব্যবস্থা করতে পারলাম | খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর, চারিদিকে হোগলা পাতা দিয়ে ঘেরা | ঘরের দেওয়াল বানানো হয়েছে হোগলা পাতা দিয়ে বেড়া বেঁধে | অর্থের যা সামর্থ্য তাতে এই ঘরেই কষ্ট করে চালিয়ে নিতে হবে | বুঝতে পারছি এই ঘরে গীতার সত্যিই খুব কষ্ট হবে | কিন্তু কি করবো | আমার পকেটের ওজন বুঝেই না আমাকে চলতে হবে |

একসময় দেশের বাড়ি গিয়ে মা আর গীতাকে নিয়ে এলাম এখানে | ঘর দেখেই দুজনেই খুব অবাক হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম | তবে গীতার চাইতে মায়ের দিক থেকেই কথা শুনতে হলো অনেক বেশি | মা তো কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যে এই ঘরে নতুন বৌ থাকবে কি করে | অনেক বোঝাতে হলো মাকে | বললাম বেশি দিনের তো ব্যাপার নয় | কয়েকটা দিন মাত্র | কোম্পানির কোয়ার্টার টা পেয়ে গেলেই সেখানে চলে যাবো | আশ্বাস বাণী শুনে মা ধীরে ধীরে আশ্বস্ত হলেন, তবে মন থেকে যে একদমই মেনে নিতে পারেন নি সেটা ভালোই বুঝতে পারলাম |

সংসার গুছিয়ে উঠতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে গেলো | কোথায় বাজার, কোথায় দোকান, কোথায় বা অন্যান্য দরকারি সামগ্রী পাওয়া যাবে ঘুরে ঘুরে সব কিছুই আসতে আসতে জানতে পেরে গেলাম | শুরু হলো জীবনের নতুন আর এক অধ্যায় | সংসার জীবন | দায়িত্ব, কর্তব্যবোধের সাথে সাথে নতুন রঙিন স্বপ্ন দেখার জীবন |

কিছুদিন মোটামুটি ভালোই কেটে গেলো | হঠাৎ এক রাতে ঘরে চোর ঢুকে সামান্য যে বাসনপত্র সঙ্গে রাখতে পেরেছিলাম তা সবই চুরি করে নিয়ে গেলো | কয়েকদিন আগে থেকেই বুঝতে পারছিলাম যে এই এলাকায় চোরের বেশ উপদ্রব আছে | আরো একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল | অগত্যা এদিক ওদিক থেকে কলাপাতা জোগাড় করে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা সারতে হলো | সময় যখন খারাপ চলে দুৰ্ভাগ্যও জেঁকে বসে |

এলো আমাদের প্রথম সন্তান | অসিত | একে তো ঘরের এই অবস্থা, তার ওপর বর্ষা হলে তো ঘরের কোণে চুপচাপ হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা | একটা চৌকির ব্যবস্থা করেছিলাম | ঘরে জল ঢুকে গেলে সেই চৌকির ওপরেই রান্নাবান্নার কাজ সারতে হতো | কিন্তু তার সাথেই শুরু হলো আর এক উপদ্রব | ঘরে বাচ্চা আছে এ খবরটা জানতে পেরেই বোধহয় প্রায় প্রতি রাতেই শুরু হলো শেয়ালের হানা | ফলে বেশির ভাগ সময়েই রাত কাটানো শুরু হলো জেগে থেকেই | গাঙ্গুলিবাবুকে প্রায় প্রতিদিনই বলতে শুরু করলাম যে এইভাবে তো আর থাকা যাচ্ছে না স্যার |

রাত জাগার প্রভাব পড়তে থাকলো কাজের ওপরই | কাজের মধ্যেই মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ার মতো অবস্থা তৈরি হলো | কোনো রকমে চোখ দুটোকে টেনে বড়ো করে রেখে কাজ করতে লাগলাম | গাঙ্গুলিবাবুও সেটা লক্ষ্য করলেন | অবশেষে একদিন আমাকে ডেকে তিনি বললেন,'যা, কাল থেকে আর তোকে রাত জাগতে হবে না | এখানে একটা কোয়ার্টার খালি হয়েছে | কালই বৌ, বাচ্চা সবাইকে নিয়েই এখানে চলে আয় | আমি আজই লোক দিয়ে ঘর পরিষ্কার করিয়ে রাখবো | হাতে যেন স্বর্গ ধরতে পেরেছি এমনই খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠলাম | মনে হচ্ছে এবার সংসারে স্থিতু হতে পারবো |

দিন কেটে যেতে থাকলো মোটামুটি হিসেবে ভালো ভাবেই | পর পর আরো দুটি সন্তান ঘরে এলো | অসীম আর অনিত | কিন্তু অনিতের জন্মের পর থেকেই গীতা ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে পড়লো | ঘরে ছোট ছোট বাচ্চা | অনিত তো সবে একমাসের হয়েছে | কে দেখবে বাচ্চাগুলোকে | আমি তো সারাদিন কোম্পানির কাজেই ব্যস্ত | মায়েরও বয়স হয়েছে | তার পক্ষে একা তিন তিনটে বাচ্চাকে দেখে রাখাও কঠিন কাজ হয়ে পড়ছে | অবশ্য পাশের কোয়ার্টারের হৃদয়ের বৌ আশা, অনেক করেছে | রান্না করে দেওয়া থেকে শুরু করে বাচ্চাদের সময় মতো খাওয়ানো দাওয়ানো, স্নান করানো, পরিষ্কার করে দেওয়া সব করেছে | আশার অবদান আমি আজও ভুলতে পারি না | অবশেষে মায়ের সঙ্গে কথা বলে, শ্বশুর বাড়িতে কথা বলে, গীতার পরের বোন নমিতাকে নিয়ে এলাম গীতার দেখাশোনা করার জন্য | নমিতার সেবা, যত্ন ও শুশ্রূষায় ধীরে ধীরে গীতা সুস্থ হয়ে উঠলো | চিকিৎসায় খরচও হলো অনেক | দারিদ্র সংসারে জাকিয়ে বসলো | এখন চিন্তা করলে কষ্টই পেতে হয় | বাচ্চাগুলোকে প্রোটিন-ভিটামিন যুক্ত খাবার দেওয়া তো দূরের কথা, দুধের জোগাড় করতেই দৈন্যদশা ফুটে উঠতো | ওদের শৈশবে কোনোদিন একটু ভালো খাবার ওদের মুখে তুলে দিতে পারিনি | কষ্ট হতো, কষ্ট এখনও হয় | অবশ্য তার জন্য বড় হয়ে যাবার পরেও ওদের কারো মনে কোনোরকম ক্ষোভ বা বিদ্বেষ ভাব দেখিনি | সেটাই আমার কাছে বড় তৃপ্তি, বড় প্রাপ্তি | 

কাছাকাছি একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিলাম বড় আর মেজকে | ছোট জন তখন খুবই ছোট | সবে হাঁটি হাঁটি পায়ে চলতে শিখেছে | দেখলাম বড় আর মেজো হাত ধরাধরি করে স্কুলে যাচ্ছে | স্কুলে যাবার রাস্তা একটা পুকুরের পাশ ঘেঁষে | সেই রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বড়োকে দেখতাম মেজোর হাত শক্ত করে ধরে সন্তর্পনে পথ চলতে | দেখে ভালো লাগতো এই ভেবে যে নিজের দায়িত্ব সুন্দর ভাবে পালন করতে শিখে গেছে বড়ো জন | শিখে গেছে এই বয়স থেকেই |

পড়াশোনাটা দুই ভাইয়ে মোটামুটি করতে শিখে গেছে | আমি তো আর সময় দিতে পারতাম না | ওই গীতাই সময় পেলে দুজনকে পড়াতে বসায় | গল্পও করে দেখি ওদের সাথে খুব | রামায়ণ, মহাভারতের গল্প, রূপকথার গল্প, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প | তারাও চোখ বড় বড় করে সেই সব গল্প শুনতো | দেখে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগতো | মনের মধ্যে একটা খুশির ভাব বয়ে যেত | পুকুর পাড় ঘেসে স্কুলে যাবার সময় হয়তো কোনোদিন কাউকে মাছ ধরতে দেখেছে, তাই একদিন দুভাইয়ে হঠাৎ আবদার শুরু করে দিলো যে ওদেরও ছিপ-বড়শি এই ধরণের মাছ ধরার সরঞ্জাম কিনে দিতে হবে | ওরাও নাকি এখন থেকে মাছই ধরবে | ওদের এ আব্দার অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি | দুদিন পরেই, ওদের সামনেই যে ছেলেটা মাছ ধরছিল, ফাত্নাটা নড়তেই ছিপে এমন টান মেরেছিলো যে বড়শিটা এসে সোজা ওর ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের মধ্যে কিভাবে যেন ঢুকে যায় | টানা-হ্যাঁচড়া করে চেষ্টা করেছিল বার করার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে নি | পা একেবারে রক্তে ভেসে যাচ্ছে | শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করে বার করতে হয়েছিল | এই ঘটনাটা চোখের সামনেই ঘটে যাওয়ায় দুই ভাইয়ের মাছ ধরার বাসনাটাও শেষ হয়ে গিয়েছিলো |

ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, পড়াশোনা করাচ্ছি - এই ব্যাপারটা মোটেই খুব ভালোভাবে নিতে পারেননি গাঙ্গুলি সাহেব | বলতেন, পড়াশোনা শিখে কি হবে, বড়ো হয়ে কাজ তো করতেই হবে এখানে | মগ পেটানো কাজের জন্য আর পড়াশোনার দরকার পরে না | শ্রমিকের ছেলে শ্রমিক না হয়ে কি জজ-ব্যারিস্টার হবে ? বিদ্বান হবার জন্য ওসব পড়াশোনা করার কোনো দরকার নেই,| বড়ো হলেই বুদ্ধি বিবেচনা সব নিজের থেকেই এসে যাবে | বড় হোক, কাজের জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না | আমি ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেব | প্রায় প্রতিদিনই ছেলেদের পড়াশোনা নিয়ে এই ধরণের কথা তিনি বলতে থাকলেন | বড় ধাক্কা লাগলো মনের মাঝে | সাহেবের এই কথা শোনার পর থেকেই মাথার মধ্যে একটা ভাবনাই শুধু ঘুরপাক খেতে থাকলো | নিজে পড়াশোনা করতে পারিনি - ছেলেদেরও কি তাহলে পড়াশোনা শেখাতে পারবো না | বুঝে গেলাম যে এখানে থাকলে কোনোদিনই ছেলেদের মানুষ করতে পারবো না | কর্মচারীর ছেলে কর্মচারীই হবে, তার লেখাপড়ায় দরকার কি ? এই মতাদর্শ আমি একদম মেনে নিতে পারছি না | সেই আমার মতোই ছেলেরাও কি প্রতি পদে পদে, জীবনের প্রতিটা মুহূর্তেই ঠোক্কর খেতে থাকবে | এ যে কত বড় অন্যায়, কত বড় অবিচার - গাঙ্গুলি সাহেব বুঝবেন কি করে | তিনি তো তার রায় দিয়েই খালাস | কিন্তু ছেলেদের ভবিষ্যৎ - সে কি কারখানার এই অন্ধকূপের মধ্যে পড়ে থেকেই শেষ হয়ে যাবে | সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বলতে পারবে না যে, দেখো আমরা পড়াশোনা করেছি; উচ্চপদের মর্যাদা পেয়েছি, সাধারণের চোখে আমরা আর নিরক্ষর নই | সুযোগ পেলে আমরাও পারি গাঙ্গুলি সাহেবের মতো উচ্চাসনে বসতে | কিন্তু এ কি বিধান দিলেন তিনি | ছেলেরা পড়াশোনাই করতে পারবে না | আমার মতো সারা জীবন মগ পিটিয়েই কাটিয়ে দেবে | এতে তো দারিদ্র ঘুচবে না | শুধু দিনটা কেমন করে কাটবে এই চিন্তার বাইরে মাথায় তো আর অন্য কোনো চিন্তাই আসবে না | ভবিষ্যৎ কিভাবে গড়বে সে চিন্তা তো আজকের চিন্তার চাপে আর তৈরিই হয়ে উঠতে পারবে না | হা ঈশ্বর, এ আমি কোন অন্ধকূপে এসে পড়লাম | কিভাবে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এই অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়লাম | এ কষ্ট তো আর কেউ অনুধাবনই করতে পারবে না | আমার অন্তরটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে |




                পর্ব ৭


অবশেষে মাথার মধ্যে এক নতুন চিন্তার উদয় হলো | চিন্তা শুধু এখন একটাই, যে ভাবেই হোক এখান থেকে বেরোতেই হবে | এ ছাড়া আমার কাছে আর অন্য কোনো পথ খোলা রইলো না | বেরোতে না পারলে ওদেরও আমার মতোই এই কারাগারে বন্দি দশায় কাটবে | বাইরের সুন্দর পৃথিবীটাকে আর দেখার সৌভাগ্য হবে না | বেরোতে না পারলে ছেলেদের আলোর পথ দেখতে পারবো না, জীবনটা অন্ধকারেই রয়ে যাবে | সবার অজান্তেই খবরা-খবর করে বাইরের লোকজনদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে দিলাম | তাদেরই কেউ একজন খবর দিলো যে কলকাতায় একটা কোম্পানি আছে, যারা একই ধরণের কাজ করে | তার মাধ্যমেই সেই কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম | ম্যানেজারের সাথে দেখাও করলাম একদিন | দেখলাম কোম্পানির অফিসারেরা আমার নাম তো জানেই এবং আমি যে কি ধরণের কাজ জানি সে সম্বন্ধে আগে থেকেই ওয়াকিবহাল | সামান্য কিছু কাজ শিখেছি আর এর মধ্যেই কলকাতার লোকেরা আমাকে জেনে গেছে, এতটাই নামকরা হয়ে গেছি তাদের কাছে | আমার অনেক খবরই তাদের নখদর্পনে | ভালো লাগলো | আমাকে তারা যত শীঘ্র সম্ভব এখানে নিয়ে আসতে চায় | আমি আমার অসুবিধার কথা তাদের জানালাম | বললাম আমাকে তো আসতে দেবে না তারা | ছাড়বেই না | তিনি বললেন, তার জন্য আমাকে কোনো চিন্তাই করতে হবে না | এই কোম্পানিই সেই সমস্ত দায়িত্ব নেবে | তবে আমাদের সঙ্গে তোমাকে একটু সহযোগিতাও করতে হবে | শুধু আমি আসতে চাই কিনা সেটা জানতে চাইলেন | সাথে সাথেই হ্যাঁ বলে দেওয়াতে তিনি ফোনে কিছু পরামর্শ করলেন অন্য কারো সাথে | বললেন আমাকে কিভাবে সংসার গুটিয়ে নিয়ে, সকলকে সাথে নিয়ে কবে মেইন গেটের বাইরে আসতে হবে | তার পরের সমস্ত দায়িত্ব কোম্পানির | 

হিন্দি সিনেমার প্লটের মতো মনে হতে থাকলো আমার | সাবধান করে দিয়ে তিনি বললেন, 'ওরা কিন্তু কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে দেবে না | যে কোনো মূল্যেই ওরা তোমাকে হারাতে চাইবে না, যে ভাবেই হোক আটকানোর চেষ্টা করবে | তাই তোমার এবং তোমার পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব আমরাই নেবো | তুমি শুধু আমাদের পরামর্শ মতো চলবে | আরো অনেক কথাবার্তা বললেন আমার সাথে | বললেন, এখানে থাকার কোনো অসুবিধাই আমার হবে না | নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় নাকি আমি এখানে কাজ করতে পারবো | এই কোম্পানির কর্ণধাররা নাকি কাজকে খুব ভালোবাসেন | সুতরাং যে ভালো কাজ দেখাতে পারবে, কাজকে যে ভালোবাসবে, কোম্পানির উন্নতির জন্য চিন্তা করবে, নতুন নতুন কন্সট্রাক্টিভ আইডিয়া দিতে পারবে, তাকে কোম্পানি আলাদা চোখেই দেখবে, তার সমস্ত অসুবিধাগুলো কোম্পানিই দূর করবার চেষ্টা করবে |এর পরে আরো কিছুক্ষন কথা হলো, তবে সেগুলি শুধু কাজের ব্যাপারেই, আর কিছু নতুন ধারার কাজের ব্যাপারে যাতে কোম্পানি আরো উন্নতি করার চেষ্টা করতে পারে | সাক্ষ্যাৎকার এবং আলোচনা এতো সুন্দর হলো যে আমার মন ভালো হয়ে গেলো | একজন সামান্য কর্মচারীর কাজের ব্যাপারে কি কি চিন্তাধারা থাকতে পারে বা কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে কর্মচারীটির কি কি ধরণের ভাবধারা থাকতে পারে, বা তাকে উৎসাহ দিয়ে অনুপ্রাণিত করার যে প্রচেষ্টা তা আমার সত্যিই খুব ভালো লাগলো | আমি নিজের মনের মধ্যে কেমন উৎসাহিত বোধ করতে লাগলাম| যে বা যারা আমার ভালোর জন্য চিন্তা করবে, কোম্পানির ভালোর জন্য চিন্তা করবে, তাকে বা তাদের তো আমি কাজ করার একশো শতাংশ শক্তি নিশ্চয়ই উজাড় করে দেব | যারা আমাকে আমার জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো ভরসা দিচ্ছেন, তাদের এই আশা, এই লক্ষ্যমাত্রাকে তো আমারও পূরণ করার চেষ্টা করতেই হবে | কোম্পানি যদি উন্নতি করতে পারে তবে সে উন্নতির ভাগিদার তো তার কর্মচারীরাই হবে, তারা অনুপ্রেরণা পাবে |

অবশেষে একদিন গভীর রাতে এখানকার পাট চুকিয়ে জিনিসপত্র কিছু সঙ্গে নিয়ে, স্ত্রী পুত্র পরিবারের হাত ধরে পা রাখলাম কোম্পানির গেটের বাইরে | অবশ্য, এই এতবড়ো একটা ঝুঁকির ব্যাপার সম্ভব হয়েছিল শুধু আমার বন্ধু হৃদয়ের সহযোগিতায় | সে সমস্ত ব্যাপারটা আগে থেকেই সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রেখেছিলো - কিভাবে ? জানিনা | বিনা বাধায় গেটের বাইরে বেরোতেই দেখি একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে | সকলে মিলে তাতে চড়ে বসলাম | হৃদয় ও তার পরিবারের দিকে হাত তুলে বিদায় জানাতে গিয়ে সত্যি সত্যিই চোখে জল এসে গেলো | দেখতে পেলাম ওরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারছে না | রাতের অন্ধকারেই একজগত থেকে অন্য আর এক শহুরে জগতে এসে পড়লাম |

কোম্পানির চৌহদ্দির বাইরে অথচ গায়ে লাগা এরকম একটা বাড়িতে এসে উঠলাম | দোতলা বাড়ি | একতলার দুটো ঘরে যন্ত্রপাতি ঠাসা | কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে দেখলাম সেখানেও দুটি ঘর | সামনের দিকে একচিলতে, একটু লম্বাটে ধরণের বারান্দা | আলোর ব্যবস্থা ছিলই | আলো জ্বালিয়ে ঘর দুটো ঘুরে দেখে বুঝতে পারলাম এখানেও যন্ত্রপাতি নিশ্চয়ই ছিল | আমরা আসবো বলেই তড়িঘড়ি সেগুলি সরানো হয়েছে, তাই পা রাখা যাচ্ছে কিন্তু ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়নি | এই রকম ঘরে কি কেউ থাকতে পারে? কেমন যেন ঘিঞ্জি মনে হচ্ছে | সেই মান্ধাতার আমলের জানালা- দরজা | কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে আসতেই তো ভয় হচ্ছিলো | যদি হঠাৎ করে ভেঙে পড়ে | ঘরের থেকে মেশিনপত্র যা ছিল বার করে নিয়ে গিয়েছে ঠিকই,কিন্তু অনেকদিন এক জায়গায় যদি কোনো লোহার ভারী জিনিস পড়ে থাকে, তবে তার একটা ছাপ পড়ে যায় মেঝের ওপর | তাই বিচিত্র ডিজাইনের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ধুলোভরা এই মেঝের ওপর | ঘরের দেওয়ালগুলোও বলার মতো অবস্থায় নেই | রং চটা দেওয়ালে রকমারি সব ছবি ফুটে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে | কিন্তু প্রথমেই আমার মনে যে চিন্তার উদয় হলো সেটা হচ্ছে যে, ঘর তো দুটো আছে, বারান্দাও আছে একটা, কিন্তু রান্নাঘর কোথায় ? আর বাথরুমই বা দেখতে পাচ্ছি না কেন ? বহুদিনের ব্যবহৃত, কালো ছোপ পড়া বাল্বের আবছা আলোয় কিছুই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছি না | যাই হোক, সবার জন্য না হলেও অন্ততঃ বাচ্চাগুলোর শোয়ার জন্য একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে | গীতা বললো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু এদিক ওদিক দেখলেই তো আর হবে না - একটা ঘর অন্ততঃ পরিষ্কার করতে হবে, সবাই যাতে একটু বসতে পারি | বলে নিজেই লেগে গেলো ঘর পরিষ্কারের কাজে | দেখলাম, গীতা ঘরের ঝাড়ুটাও নিয়ে এসেছে সাথে করে | কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা ঘর মোটামুটি কিছুটা পরিষ্কার হয়ে গেলো | সাথে আনা তোশক, চাদর মেঝেতেই পেতে ছেলেদের শুয়ে যেতে বললো | আর আমাদের ওই চাদরের ওপর বসে থাকতে বলে নিজে লেগে গেলো অন্য ঘর ও বারান্দা পরিষ্কারের কাজে | ধুলোবালি সরিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে বাসোপযোগী করে তোলার চেষ্টাতেই ভোর হয়ে গেলো | সকাল হতেই অফিসের এক কর্তাব্যক্তি এলেন, খোঁজ খবর নিলেন | হাতে কিছু খাবারের প্যাকেট | জলখাবারই হবে বোধহয় | আমার দিকে প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কাল সারাদিন নিশ্চয়ই খুব ধকল গেছে | খাওয়া-দাওয়াও হয়তো সময়মতো কিছু হয়নি | রাতেও ভালো ঘুম হয়নি নিশ্চয়ই | অন্ততঃ সবার চোখমুখ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে | রান্নার কোনো ব্যবস্থাও নিশ্চয় করে ওঠা সম্ভবপর হয়নি এই কম সময়ের মধ্যে | তাই আমি এই খাবারগুলো নিয়ে এসেছি, কোম্পানিই আমার হাত দিয়ে এই খাবারগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে | সবাই মিলে এগুলো খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম নিন | আজকে সারাদিনই আপনাদের রান্নাবান্না করার ঝামেলা ঝক্কি পোহাতে হবে না, দুপুরের এবং রাত্রের খাওয়ার ব্যবস্থা কোম্পানিই করবে | লোক দিয়ে সময়মতো খাবারগুলো পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা কোম্পানিই করবে | তবে হ্যাঁ, আজ কিন্তু মাছ-মাংসের ব্যবস্থা কোম্পানি করতে পারবে না, ডিম থাকবে | আজ আর অফিস যেতে হবে না | আজকের দিনটা আপনাদের পূর্ণ বিশ্রাম | কাল সকালে অফিসে এসে কাজে যোগ দেবেন | এখানে আসার জন্য আপনাকে আমি কোম্পানির তরফ থেকে শুভেচ্ছা জানাই | কাল সকালে আপনার কাজে যোগ দেয়ার সময় আমরা সকলে উপস্থিত থাকবো’ |

"আচ্ছা, ঠিক আছে | দেখুন কোম্পানি যেখানে আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, সেখানে মাছ-মাংস খাওয়ার জন্য আমরা আবদার করবো, এটা তো হতেই পারে না | কোম্পানির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ | আজ আমরা সত্যি সত্যিই বড় ক্লান্ত | রাতেও ঘুমোতে যাবার সময় হয়ে ওঠেনি | ঘরদোর পরিষ্কার করতেই সকাল হয়ে গেছে | তার ওপর রান্নার সামগ্রীও তো জোগাড় করতে হবে বাজার থেকে | এখানে তো উনানও নেই যে চাল-ডাল যেটুকু এনেছি সাথে করে, সেগুলি রান্না করে উঠতে পারবো | কোম্পানির অফিসারদের কাছে আমরা সত্যিই বড়োই কৃতজ্ঞ | তারা আমাদের জন্য চিন্তা করেছেন | আমাদের অসুবিধার কথা উপলব্ধি করতে পেরেছেন | একটা দিন আমাদের সত্যিই বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল | সেটা কোম্পানি আমাদের দিয়েছে, এর থেকে বড় কিছু কি আর হতে পারে" ?

এরই মধ্যে গীতা সাহস করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো যে বাথরুম, টয়লেট তো কিছু দেখছি না | এর জন্য কি আমাদের বাড়ির বাইরে যেতে হবে ?

“আরে না, না; তাই কি হয় নাকি | একতলায় সমস্ত কিছুরই ব্যবস্থা আছে | একটা রান্নাঘর আছে | বাথরুম আর টয়লেটের আলাদা বন্দোবস্ত আছে | বাথরুমে একটা বড় চৌবাচ্চা আছে | নল আছে | নলে সবসময়ই জল পাওয়া যাবে | ওই জলই বাসনপত্র মাজা-ধোওয়ার বা স্নানের জন্য যেমন ব্যবহার করা যেতে পারে, তেমনই খাবার জলও ওই নল থেকে ধরে নিয়ে এসে ঘরে রাখতে পারেন | তবে, সমস্ত কিছুরই ব্যবস্থা নিচে একতলায় একটা পাশে করা আছে | দোতলায় জলের কোনো ব্যবস্থা করা নেই | নিচে রান্নাঘরটা এখন খুলে রাখাই আছে, বন্ধ করতে হলে তালা চাবির ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নিতে হবে | একতলার দুটো ঘরে যে মেশিনপত্র গুলো রাখা আছে, সেগুলি ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হবে | সব মেশিনগুলো সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়ে গেলে ওই ঘর দুটোও আপনারা ব্যবহার করতে পারবেন | তাছাড়া একতলার বড় বারান্দা তো এখন খালিই আছে, সেটা ব্যবহার করুন | দোতলার ওপরে ছাদ আছে, বেশ বড় | উঁচু পাঁচিল দেওয়া আছে ছাদের চারদিক ঘিরে | ছাদটাও ব্যবহার করতে পারবেন, আর বাচ্ছারা তো ছাদে খেলতেও পারবে | ভয়ের কোনো কারণ নেই | আর কিছু জানার দরকার থাকলে বলুন, আমি তো এবার চলে যাবো” |

গীতা জিজ্ঞাসা করে উঠলো, ‘এখানকার বাজারহাট এ বাড়ি থেকে কতটা দূরে আর কি ভাবেই বা যেতে হবে, যদি একটু বলেন’ | ভদ্রলোক বললেন যে, “এখানে কোম্পানির গেটে ঢোকার মুখেই একটা মুদিখানা দোকান আছে, নিত্য প্রয়োজনীয় মাসের জিনিসপত্র সেখানেই পেয়ে যাবেন | আর, সবজি বা মাছের বাজারটা একটু দূরে | তবে এই গলির পেছন দিকটাতে মোটামুটি দশ মিনিট হাঁটলেই বাজারটা পেয়ে যাবেন | অসুবিধা হলে কাউকে একটু জিজ্ঞাসা করে যাবেন | বেলা থাকতে থাকতে একবার সময় করে একটু ঘুরেই না হয় দেখে আসবেন | আচ্ছা, আর যদি কিছু জিজ্ঞাসা করার না থাকে, তাহলে আমি এখন আসি- পরে দেখা হবে’ |

'একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল’, আমি বলে বসলাম | "হ্যাঁ, বলুন কি জানতে চান” | 'বললাম, এখানে কাছাকাছি ভালো স্কুল কোথায় আছে যদি বলেন’ |

“কাছাকাছির মধ্যে দুটি মেয়েদের স্কুল আছে | একটু দূরে, অবশ্য সামান্যই দূরে | ছেলেদের জন্য একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল আছে, ক্লাস এগারো পর্যন্ত; আর একটা কর্পোরেশন স্কুল আছে প্রাইমারি, ক্লাস ফোর পর্যন্ত | আপনার তো তিন ছেলে | এই দুটো স্কুলই কাছে হবে, তবে আরো স্কুল আছে, আরো একটুদূরে | ঘুরতে ঘুরতে দেখে নেবেন | আমি এখন আসি | আমারও ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে | পরে দেখা হবে, নমস্কার' | আমাদের আসতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা, কেউ আটকানোর চেষ্টা করেছে কিনা বা সকলেই সুস্থ আছি কিনা এই ধরণের সব খবরই নিলেন | আর বলে গেলেন, নিচের তলায় ঘরের ভেতর দিকে অর্থাৎ পেছনের দিকে একটা দরজা আছে, যেটা দিয়ে সরাসরি অফিসে ঢোকা যাবে | এমার্জেন্সি দরজা | প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে বলে সেই বন্ধ দরোজার চাবিটা আমার হাতে দিয়ে যত্ন করে রাখতে বললেন | আজকে বিশ্রাম করার পরামর্শ দিয়ে আগামীকাল অফিসে গিয়ে দেখা করতে বলে গেলেন | শুনে অবশ্য একটু অবাকই হলাম | প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে, এই কথাটা উনি বললেন কেন |

                পর্ব ৮


শুরু হলো আবার এক নতুন জীবন | ধীরে ধীরে ছন্নছাড়া এই সংসারটাকে আবার গুছিয়ে তোলার চেষ্টায় মনোনিবেশ করলাম | কোম্পানির কাজেও মন লাগিয়ে দিতে পারলাম | লোকমুখে শুনতে পেলাম বাড়িটা নাকি ভুতের বাড়ি | এর আগে যারাই এখানে থাকার চেষ্টা করেছে দুচারদিনের বেশি থাকতে পারেনি | সত্যি বলতে কি শোনার পর থেকে আমিও যে একেবারে ভয় পাইনি, তা কিন্তু নয় | ভয় পেয়েছি - মনের চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভুতও দেখে নিয়েছি | কিন্তু সেসব কথা প্রকাশ করি কি করে কারো কাছে | যদি ছেলেরা ভয় পেয়ে যায়, যদি গীতা এখানে আর থাকতে না চায় - ভয় ছিল সেখানেই | কিছুদিন পর থেকেই হঠাৎ আমার মনে হতে লাগলো কেউ যেন আমাকে ফলো করছে | আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে | আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টাও করছে | আমাদের বাড়ির ওপরও সবসময় যেন কেমন একটা নজর রাখছে | বাচ্চাদের ঘরের বাইরে যেতে মানা করে দিলাম | স্কুলে পাঠানোর কথা চিন্তা করছিলাম | সে চিন্তাটা আপাতত বন্ধ রাখতে হলো | ভেতরে ভেতরে একটু ভয় হতে শুরু করায় শেষ পর্যন্ত্য অফিসে সমস্ত ব্যাপারটা জানালাম | অফিস থেকে জানালো যে তারা এই ব্যাপারে খোঁজখবর নেবে | আমাকে এবং পরিবারের কাউকেই বাড়ির বাইরে পা রাখতে একেবারে মানা করে দিলো | এমার্জেন্সি দরজা দিয়েই অফিসে যাতায়াত করার পরামর্শ দিলো | এমার্জেন্সি দরজার প্রয়োজনীয়তা এতদিনে বুঝতে পারলাম | অফিস থেকেই জানতে পারলাম যে আমার আগের কোম্পানির গাঙ্গুলি সাহেব আমার গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য লোক লাগিয়েছেন | সময় সুযোগ বুঝে আমাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আবার গাঙ্গুলী সাহেবের হাতে দিয়ে দেবার পরিকল্পনা মতোই সে লোকটা আমার ওপর নজর রাখছে | লোকটা এ পাড়ারই ছেলে, গুন্ডা প্রকৃতির - তার ওপর এক রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় সে রয়েছে | এবারে ভয় পেতে শুরু করলাম | বাড়ির বাইরে বেরোতে পারছি না, ছেলেরাও খেলাধুলার জন্য ঘরের বাইরে যেতে পারছে না | অবশ্য ওদের বাইরে যেতে মানা করে দিয়েছি অফিসের নির্দেশ অনুযায়ী | বলা যায় না, বাইরে গেলে যদি কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে | ভয় বাড়তে থাকলো | এভাবে তো বন্দিদশার জীবন চলতে পারে না | খাবার জিনিস বা সব্জিপাতি নিয়ে অবশ্য আমাদের কোনো চিন্তা করতে হচ্ছে না | আমার ঘরের যাবতীয় সামগ্রী সমস্ত কিছুরই বন্দোবস্ত করে দিলো এই কোম্পানি | অফিসের থেকেই লোক মারফত সমস্ত কিছুই ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে | আমার জন্য এই কোম্পানি যে এতকিছু করছে, দরাজ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তার জন্য আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ | সহকর্মীদের ব্যবহার, মানবিকতা এবং সর্বোপরি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, আমাকে মনের দিক দিয়ে আপ্লুত করে দিয়েছে | তাদের এই অবদান আমার কাছে ঋণ এর মতো বোঝাস্বরূপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে | সারা জীবনভর এই কোম্পানিতে কাজ করেও আমি এই ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারবো না | এই কোম্পানি, কোম্পানির মানুষজন আমার কাছে ভগবান প্রদত্ত আশীর্বাদই মনে হতে লাগলো | মানসিক পরিতৃপ্তি আমাকে এই কোম্পানির প্রতি আমার দায়িত্ববোধ অনেক অনেক গুণ বাড়িয়ে তুললো | যারা আমার জন্য এতো কিছু করতে পারছে, তাদের জন্য আমাকেও তো কিছু করতে হবে -- প্রতিদান তো কাজের মাধ্যমেই দিতে হবে | যদি কোনোদিন কোম্পানিটা এখনকার এই বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় সফলতার মুখ দেখতে পায়, যদি তার চলার পথে অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় মাথা উঁচু করে চলতে পারে, আর যদি আমার প্রচেষ্টাতেই সেই সাফল্য আসে, তবে আজ এইভাবে নত হয়ে আসা মাথাটা সেদিন উঁচু করে তুলে ধরতে পারবো, সেদিন চিৎকার করে বলতে পারবো -- পেরেছি, কিছুটা হলেও পেরেছি এই কোম্পানির কাছে আমার দায়বদ্ধতার এতটুকু অংশও ফিরিয়ে দিতে | তবেই আসবে, আজ আমার এই ভেঙে পড়া, কৃতজ্ঞতার ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাকা মনের মধ্যে একটু শান্তি | আমি আমার কর্মক্ষমতার শত প্রতিশত নিশ্চয়ই দেব এই কোম্পানির জন্য -- মনে মনে শপথ নিয়েই নিজেকে সেইভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্রতে ব্রতী হলাম |

অনেকদিন ধরেই চলেছিল এই নজরদারির কাজ | ভয় দেখানোর চেষ্টা বিভিন্নভাবে হতে থাকলো | রাস্তায় আর বেরোনো হচ্ছে না | তাদের সমস্ত প্ল্যান-প্রোগ্রাম ভেস্তে যেতে বসেছে আন্দাজ করে মনে হয় একটু বেপরোয়া হয়ে উঠলো | ঘর থেকে বার করানোর জন্য নানারকম কার্য্যকলাপ করতে শুরু করেছিল | ঘরের বাইরে চিৎকার, গালিগালাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম ভাবে চেষ্টা করেছিল যাতে আমরা কেউ বাইরে আসি | সন্ধ্যে হলেই রাস্তার দিক থেকে ইঁট বৃষ্টি শুরু হলো | ইঁটের ছোট ছোট টুকরোগুলো বন্ধ ঘরের দরজায় জানালায় আছড়ে পড়তে লাগলো | বাড়ির পাশেই কোম্পানির টিনের চালে ইঁট এসে পড়ে যে আওয়াজ হতে থাকলো তাতে আশেপাশের বাড়ির লোকেদের মনেও আতঙ্কের সৃষ্টি হলো | প্রতিদিনই রাতেরবেলা কারখানার টিনের চলে ইঁটের আওয়াজ - কোনো অশরীরী আত্মার কাজ নয়তো | পোড়ো বাড়িতে হঠাৎ করে লোকজন এসে পড়ায় তাদের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে হয়তো | তাই তারা তাদের রুদ্রমূর্তি দেখানোর প্রচেষ্টা করে চলেছে | এরই মধ্যে পরপর দুদিন দুখানা বোমা পড়লো কারখানার টিনের চালে | বিকট আওয়াজে সবার ঘুম ভেঙে গেলো | ভয়ে, আতঙ্কে সবাই ত্রস্ত | ইঁটবৃষ্টির খবর আগেই জানিয়েছিলাম কোম্পানিকে, এবার বোমাবাজির খবরও জানালাম | অবশ্য সিকিউরিটির কাছ থেকে কোম্পানি আগেই জেনে গেছিলো ব্যাপারটা, রাতেই সিকিউরিটি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলো ব্যাপারটা | তারপরেই পাড়াতে দেখলাম পুলিশের আনাগোনা শুরু হয়েছে | কোম্পানির থেকেই থানাকে রিপোর্ট করা হয়েছিল | শুনলাম দুচারজনকে নাকি ধরেও নিয়ে গেছে পুলিশ | এর পর থেকে ওই লোকটাকেও আর দেখতে পাওয়া গেলো না | হয়তো পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, নয়তো পার্টির কাজে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে, বা গাঙ্গুলী সাহেব হয়তো শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছেন এই ভেবে যে শুধু শুধু লোক লাগানোতে পয়সা খরচ হচ্ছে বলে | অথবা হয়তো পুলিশ জানতে পেরেছে যে এই কাজটার পেছনে ওনারিই হাত আছে | যাই হোক, সব কিছু ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে গেলো | কোম্পানি এতবড়ো পদক্ষেপ নেওয়াতে অনেকটা আস্বস্ত হলাম |

গীতা আর আমার মা একসাথে সংসারের হালটা ভালোভাবেই ধরে নিলো | মাঝে মাঝে অবাক লাগতো এই স্বল্প টাকার মাইনের চাকুরীতে কিভাবে সংসারটা এতো সুন্দর ভাবে চলছে | সম্ভব হয়েছে শুধু গীতার বিচক্ষণতা আর বুদ্ধির সমন্বয়ে | দেখতাম, এতো কষ্টের মধ্যেও গীতা নিজেকে আর পুরো সংসারটাকে আনন্দের মধ্যেই রেখেছিলো | দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর , ঘুমানোর অভ্যাস তো ওর ছিলই না, বরং বই পড়তো | রামায়ণ, মহাভারত নিয়ে বসতো পড়তে | আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেই ওই সময় আমাদের বাড়িতে আসতো মহাকাব্য গ্রন্থের কাহিনী শোনার জন্য | গীতা সুন্দর সুর করে ছত্রগুলি পড়তো আর তারাও মন দিয়ে সে কাহিনী শুনতো | এটা ছিল প্রতিদিনের কার্য্যের মধ্যে একটা কার্য্য | মহাকাব্যের কাহিনী ও ঘটনাগুলো গীতার ছিল একদম নখদর্পনে | তার ফলস্বরূপ আমার ছেলেদের মধ্যেও মহাকাব্যের জ্ঞান খুব সুন্দর ভাবে প্রোথিত হয়েছিল |

কিছুদিনের মধ্যেই দেশে যুদ্ধ লেগে গেলো | ভারত-চীন সম্পর্কের অবনতি হলো | ভারত তখন যুদ্ধের ব্যাপারে মোটেই তৈরি ছিল না | যুদ্ধ যে লাগতে পারে সে ধারণাও ছিল না | ফলে পিছু হটতে বাধ্য হলো | একরকম আত্মসমর্পণ করে যুদ্ধবিরতি করতে হলো | প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সেটা ছিল ভারতের চোখ খুলে যাবার সময় | এর পর থেকে ভারত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও নিজেকে শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করতে শুরু করলো | এর ফল পাওয়া গেলো কয়েক বছর পর পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে | সেখানে আর ভারতকে পর্যুদস্ত হতে হয়নি, বরং মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছিল | পর পর দুটো যুদ্ধের ফল বোঝা যেতে থাকলো বাজার-হাটে | জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকলো | জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসগুলো অগ্নিমূল্য তো হলোই, পাওয়া যেতে থাকলো খুবই কম পরিমানে | তাও গ্রামের মেয়েরা লুকিয়ে-চুরিয়ে জিনিসপত্র শহরে নিয়ে এসে বিক্রি করতে শুরু করলো বলে | চাল পাওয়াটা দুস্কর হয়ে যাওয়াতে শহরের মানুষেরা সেই সময় আধভাঙা গম বা ডালিয়া খাওয়াও রপ্ত করে ফেললো |

ছেলেরা স্কুলে ভর্তি হলো | ঘরে পড়াশোনার একটা মহল তৈরি হলো | আত্মীয়-স্বজনের আসা যাওয়াও শুরু হয়ে গেলো | কলকাতায় থাকার একটা সুবিধা হলো যে এখানে পড়াশোনা করার জন্য ভালো স্কুল কলেজ আছে অনেক | তাই শ্যালকেরাও একএকজন করে এ বাড়িতে থেকেই কলকাতার কলেজ গুলোতে পড়াশোনা করতে লাগলো | এর মধ্যেই আবার একজন আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এলো আমার কাছে | সে সেনাবিভাগে কাজ করে | কলকাতায় থাকার কোনো জায়গা নেই | তাকে দেখে বারবার আমার ভাইয়ের কথা মনে পড়তে থাকায় আমি কিছুতেই আর না বলতে পারলাম না | ফলে তারও এখানে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলো | বারে বারেই ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়তে লাগলো | চেষ্টা করেও তো তাকে সামান্য অসুখের হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি | নিজেকে কেমন যেন অপরাধীই মনে হতে থাকে | একটা বড় ডাক্তার কে দেখাতে পারলে হয়তো ওকে এভাবে এতো অল্প বয়সেই চলে যেতে হতো না | ভগবান বোধহয় আমার মনের ভেতরের দুঃখের কথা শুনতে পেয়েছেন | তাই একজন ভাই পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে | ছেলেরাও কাকা সম্বোধনে তাকে আপন করে নিলো | এই কাকা সম্বোধন নিয়ে তো একবার আমার মাসতুতো ভাইয়ের সাথে আমার এই ফৌজি ভাইয়ের মধ্যে একটা বাদানুবাদ হয়ে গেলো | মারামারি হয় আর কি | ছেলেরা কাকা বলতে এই ফৌজি ভাইকেই মনে করে | মাসতুতো ভাইয়ের সেটা পছন্দ নয় | এই নিয়ে কথাকাটাকাটি হতে হতে সে একেবারে মারামারির পর্য্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় আমাকেই শেষ পর্যন্ত মধ্যস্থতা করে মিটমাট করাতে হলো | স্বাভিমানের ধাক্কাটা এতই বড় ছিল যে ওদের দুজনের মধ্যে কথা বলাটাই বন্ধ হয়ে গেলো, এমনকি মুখ দেখাদেখিও রইলো বন্ধ |

ছেলেরাও ধীরে ধীরে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলো | রেজাল্টও ভালো করতে থাকলো যে যার নিজের ক্লাসে | এখন মনে হয় ওরা হয়তো তখন থেকেই অর্থাৎ ওই বয়সেই আমার আর্থিক পরিস্থিতির কথা উপলব্ধি করতে পেরেছিলো | তাই তো ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো ফল করার ফলস্বরূপ স্কুল থেকে ফ্রীশিপও পেতে শুরু করলো | সে একটা সময় ছিল | ছাত্ররা ভালো রেজাল্ট করলে স্কুল থেকেই তাদের ফ্রীশিপ দেওয়া হতো | তাদের আর স্কুল ফিস দিতে হতো না | এখন আর তো সে সব শোনাও যায় না, চারদিকে শুধু টাকার চাহিদা | পড়াশোনা ছাত্ররা কি শিখলো, না শিখলো মাসের মোটা অংকের ফিস টা দিয়ে যেতেই হবে |

    *        *        *        *

তিন ছেলেই সরকারি চাকুরী পেয়ে গেছে | অসিত, অসীমের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি | ছোটজন অনিত বিয়েই করলো না | জানিনা বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখতে হবে বলে হয়তো নিজের সংসারটাই তৈরী করে উঠতে পারলো না |

অবশেষে একদিন চাকুরী থেকে অবসর পেয়ে গেলাম | ঘরে নাতি, নাতনি আসায় সংসারটাও এখন বেশ বড় আর জমজমাট লাগছে | ওদের সঙ্গে খেলাধুলা হৈচৈ, আদর আবদারে মেতে থেকে অবসর জীবন ভালোই কাটতে থাকলো | কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি একেবারে অসমর্থ হয়ে পড়েছি | কিছু ভালো লাগে না, কিছু করতেও ইচ্ছা করে না | মা তো চলেই গেছেন অনেক আগেই | ভেঙে পড়লেও তবু তুমি ছিলে বলে শরীর ও মনে শক্তি ছিল | সে শক্তি তো জুগিয়েছিল তুমিই | এখন আমি আমার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছি | এগিয়ে চলার সাহসটুকুও আর পাই না | তবে, মনে শান্তি পাই এই ভেবেই যে আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে | ছেলেদের আমি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি | আমার মতো মগ পেটানোর কাজ আর তাদের করতে হয়নি | এটাই আমার সবচেয়ে বড়ো পাওয়া | ভগবানকে ধন্যবাদ আমার সুপ্ত ইচ্ছেগুলোকে বাস্তবায়িত করে তোলার জন্য | ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে | শরীর ও মন জুড়ে শান্তির একটা বাতাবরণ তৈরী হয়েছে | আমি সেই শান্তির সমুদ্রে অবগাহন করছি | কি শান্তি, কি পতিতৃপ্তি, আহা |


    *        *        *        *            


'কতক্ষন ধরে ডাকছি আপনাকে , বাবা | চেয়ারে বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়েছেন | এবার উঠুন | অনেক বেলা হয়ে গেছে | ছেলেমেয়েরাও কখন স্কুলে চলে গেছে, আর আপনি সেই থেকে বসেই আছেন | যান, তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নিন, খেতে দেব' |

'কি হলো | এতক্ষন ধরে ডাকছি, বাবা সাড়া দিচ্ছেন না কেন | অজ্ঞান হয়ে গেলেন নাকি'| বৌমা এগিয়ে এসে এবার গায়ে হাত দিয়ে ডাকার চেষ্টা করতেই অমলেন্দুবাবুর নিথর দেহটা একপাশে কত হয়ে পড়লো | আচমকা একটা ভয় পেয়ে বৌমা চিৎকার করে ওঠে, 'ওগো শুনছো, তাড়াতাড়ি একবার এদিকে এস | ডাক্তারবাবুকে খবর দাও, আসতে বলো | বাবা বোধহয় আর নেই' |


              --------x--------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract