জীবন সায়াহ্ন
জীবন সায়াহ্ন


শেষ পর্যন্ত পুরীর টিকিটটা কেটেই ফেলল বিদিশা। মেয়েও জোর করছিল। একমাত্র মেয়ে মম বিয়ের পর অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। মেয়ে জামাই দুজনেই ওখানের একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। এই মেয়ে জামাই ছাড়া এখন আর আপন বলতে কেউ নেই। বিদিশার বয়স এখন বাষট্টি। দুবছর আগে অফিস থেকে অবসর নিয়েছে। কলকাতা করপরেশানে একটানা বত্রিশ বছর সুনামের সঙ্গে কাজ করেছে। সুকমলও কাজ করত একই অফিসে। সুকমল বিদিশার স্বর্গীয় স্বামী, মমের বাবা। অবসরের আগে বিদিশার জীবন এক ধারায় বয়েছে। সকালে উঠে অফিসের জন্য রেডি হওয়া। সারাদিন অফিসে। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে টি.ভি আর কাজের মেয়েটার সঙ্গে গল্প করে সময় কেটে যেত। এখন সকালে উঠে একটু ঠাকুর পুজো করে কাগজ নিয়ে বসা। দুপুরে খেয়ে নিয়ে একটু শোয়া। বিকেলে ফ্ল্যাটের কম্পাউন্ডে একটু হাঁটা। সন্ধ্যায় টি.ভি। একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে জীবনটা। একটা অবসাদ গ্রাস করছে বিদিশার রোজকারের জীবনটাকে। মম ব্যাপারটা আঁচ করতেই বলল, তুমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে এসো। এতে মনটা একটু ভালো হবে। কিন্তু এই বয়সে একলা আর কতদূর যাওয়া যায়? শেষ পর্যন্ত ঠিক হল পুরী। সোমবার সকালে ফ্লাইট। শুক্রবার বিকেলে ভুবনেশ্বর থেকে ফ্লাইট। যাওয়া আসার টিকিট নিজেই কেটেছে বিদিশা। হোটেলের ব্যবস্থাটা মম করে দিয়েছে। এতেও ঘোরতর আপত্তি ছিল বিদিশার। মম জোর করছিল কাজের মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। উত্তরে বিদিশা বলেছিল, তোর মা এখনও অতটা অথর্ব হয়নি যে সঙ্গে একটা ল্যংবোর্ড নিয়ে যেতে হবে। ছেলেবেলা থেকেই নিজের কাজটা নিজেই করতে ভালোবাসে বিদিশা। আজ শুক্রবার। গোছগাছটা শুরু করে দিতে হবে।
সকাল আটটা দশে ইন্ডিগোর ফ্লাইট দমদমের মাটি ছেড়ে আকাশের মেঘ স্পর্শ করল। ভুবনেশ্বরে নেমে একটা গাড়ি নিল বিদিশা। গাড়ি করে লিঙ্গরাজ দর্শন করে সোজা পুরীর হোটেলে। হোটেলটা ভালো জায়গায় বুক করেছে মম। একদম সমুদ্রের সামনে।
মনে মনে মমের পছন্দের তারিফ না করে থাকতে পারলো না বিদিশা। এখন একটু বিশ্রাম নিতে হবে। যতই সকলের উপর কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করুক না কেন বয়সের কর্তৃত্ব এখন বিদিশাকে মানতেই হয়।
দুপুরের খাওয়া সেরে ব্যালকনির চেয়ারে বসে সমুদ্রের দিকে অপলক দৃষ্টি মেলে দিল আজকের বিদিশা।
মম হওয়ার পর সুকমলের সঙ্গে পুরী এসেছিল। সমুদ্র দেখে মমের কী কান্না। সেই সময় তিনদিন ছিল। একদিন সুকমলের কাছে মমকে রেখে কয়েক মিনিটের জন্য সমুদ্রের কাছে গিয়েছিল।
সেদিনের সেই আক্ষেপ বোধ হয় আজ মিটিয়ে দিল মমের জেদ। আজ আর কোনও পিছুটান নেই। এখন ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি। রোদের তেজ বেশ রয়েছে। অনেক লোকজন সূর্যের তাপ মাথায় করে শীতলতা খুঁজছে জলের মধ্যে। সমুদ্রের নোনা হাওয়ার ঝাপটায় মনের ভিতরে একটা আনন্দ হচ্ছে ষাটোর্ধ বিদিশার।
বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো বিদিশা। একাকীত্বের সঙ্গে স্বাবলম্বীর ককটেলটা বেশ সুন্দর তৈরি হয়েছে। আচ্ছন্নের মতো সায়াহ্নের বালুকাবেলায় হেঁটে চলছে একমনে। হঠাৎ নিজের ডাকনামটা শুনে থামতে হল বিদিশাকে। পিছন ফিরে দেখল সুভাষকে।
- তোকে ডাকছিলাম। শুনতে পাসনি?
- খেয়াল করিনি গো। আসলে পুরীতে কেউ চেনা থাকতে পারে আশা করিনি। তুই কেমন আছিস? এখানে কী মনে করে?
- তোর পিছু নিয়েছি। বলেই হাসিতে ফেটে পড়ল সমবয়সী সুভাষ।
ইউনিভার্সিটিতে একসাথে পড়ত বিদিশা দে আর সুভাষ দাসগুপ্ত। সুভাষের মধ্যে একটা আকর্ষণ করার ক্ষমতা ছিল। অনেক মেয়েই সুভাষের প্রেমে হাবুডুবু খেত। ন্যাকামি করত। বিদিশা অবশ্য কোনোদিনও তাদের দলে পরেনি। তবুও সুভাষ বিদিশার খুব ভালো বন্ধু ছিল। আর বিদিশার একটা কোমল মন ছিল আর বাইরেটা ছিল কঠোর। চাকরি পাওয়ার পর একদিন সুভাষকে নিজেদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিল। সুভাষ চলে যাওয়ার পর বাবা খুব চেঁচামেচি করেছিলেন। তারপর বাবা নিজে দেখাশোনা করে বিদিশার বিয়ে সুকমলের সাথে দিয়ে দিলেন। বিদিশার বিবাহিত জীবন খুব সুখের ছিল। সুভাষ পিকচার সেই পারফেক্ট সিনে কোনওদিন ছিল না।
- কেন রে ?
- আসলে তোকে খুব মিস করছিলাম। বলেই আবার হাসিতে ফেটে পড়ল সুভাষ। আসলে খুব বোর লাগছিল বাড়িতে। চলে এলাম এখানে। পরশু চলে যাব। তুই?
- ধরে নে আমিও তাই। কার সাথে এসেছিস? কোন হোটেলে উঠেছিস?
- কার সাথে আবার? একাই এসেছি। পরশু দিন হোটেল সিগাল-এ উঠেছি।
- আরে ! আমি ও তো তাই।
- তাহলে দেখ, কে কার পিছু নিয়েছে ? বলেই আবার হাসতে শুরু করে দিল সুভাষ। চল ওদিকটায় গিয়ে বসি।
মন্থর পায়ে দুই বন্ধু বালির উপর গিয়ে বসল।
- কতদিন পর বসে আড্ডা দিচ্ছি বলতো? ইউনিভার্সিটির পর আজ। সেদিন তোর বাবা তোর ওপর কত চিৎকার করেছিলেন। আজ সেসব অতীত।
- সেই। বাই দা ওয়ে, তুই বাবার চিৎকারের কথা কীভাবে জানলি ?
- আরে আমি তো সেদিন নীচে নামার সময় তোর বাবার মুখ চোখের অবস্থা দেখেছিলাম। অনুমান করেছিলাম তোর ওপর কী পরিমানের টাইফুন – টর্নেডো আছড়ে পড়তে পারে। আমি বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে গিয়েছিলাম। দরজা খোলাই ছিল। সবাই আসলে তোকে বোঝাতে এতো ব্যস্ত ছিলেন যে আমার উপস্থিতি কেউ টের পায়নি। আমি নিঃশব্দে ফিরে এসেছিলাম। যাকগে সেসব কথা বাদ দে। সে রাম ও নেই রাজত্ব ও নেই।
- তুই রাম কাকে বললি?
- না , মানে বাগধারার প্রয়োগ করছিলাম আর কি।
- কিছু প্রয়োগ করতে হবে না। তুই কী করছিস এখন? ছেলে মেয়ে কটি ?
- সে ভাগ্য আর হল কোথায় বল। সব দিক দেখতে গিয়ে বিয়েটাই আর করা হল না। তবে এই শেষ বয়সে এসে মনে হয় কাজটা বোধ হয় ঠিক করি নি। বিয়েটা করা উচিত ছিল। তা তোর ? ছেলে মেয়ে কটি ? বর এসেছে নাকি ? তোকে আমার সাথে দেখতে পেলেই তো বিপদ।
- না রে। তিনি কয়েক বছর আগেই গত হয়েছে। মেয়ে বিয়ের পর অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। ভয় নেই। কেউ তোকে পেটাবে না। বলেই হেসে ফেলল গম্ভীর বিদিশা।
অনেক পুরনো কথা ঢেউয়ের মত উঠল আবার কিনারায় সেই ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে ভেঙ্গেও গেল। চিরনতুন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কথাগুলো দুজনেরই ভিতর থেকে উঠতে থাকলো। এইভাবে কতক্ষণ কাটলো কে জানে? কয়েক ঘণ্টা না কয়েক যুগ?
- চল এবার ওঠা যাক। একসাথে হোটেলে ফিরি। কাল কলকাতা ফিরতে হবে। পরশু সকালে কলকাতা থেকে সোজা নিউ জার্সি। ওখানে একটা ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার আছে। কয়েকদিন থাকবো। ওখান থেকে সোজা মেলবোর্ন। এইভাবেই জীবন চলতেই থাকবে। আজকের ডিনারটা কিন্তু আমরা একসাথে করছি, বলল সুভাষ।
শুষ্ক বালুরাশির ওপর দিয়ে পদচিহ্ন রেখে চারটি পা হোটেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে। উদ্বেগহীন। উত্তাপহীন।
ঘরে ফিরেই বিদিশার মনে একটা কথা খোঁচা দিতে শুরু করল। কী পরে যাবে ডিনারে? ক্যাসুয়াল না ফর্মাল? যদিও ফর্মাল কিছু আনেনি সঙ্গে। আনারই বা দরকার কী ছিল? কেউ কি ফর্মাল ড্রেস নিয়ে ঘুরতে আসে? শেষ পর্যন্ত একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরে যাওয়া মনস্থির করল। রেডি হতে হতে প্রায় নটা বেজে গেল। নটায় নিচের রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করবে সুভাষ। তাড়াহুড়ো করে লিফটের দিকে এগোল। রেস্টুরেন্টের সামনে অপেক্ষা করছে সুভাষ।
- তোকে এই শাড়িতে খুব গর্জাস লাগছে। আগে হলে তোকে আমি নিশ্চিত প্রপোজ করে ফেলতাম। বলেই ঠোঁটের কোনে একটা দুষ্টুমি মাখানো হাসি ফুটিয়ে তুলল সুভাষ।
সুভাষের দিকে কটমট করে তাকালো বিদিশা।
- সত্যি বলছি। চল। ওই দিকটায় গিয়ে বসি।
চেয়ারে বসে বিদিশা বলল, আজ কিন্তু ট্রিটটা আমি দেব। সেদিন বাড়ি থেকে কিছু না খেয়ে চলে আসতে হয়েছিল তোকে।
- আচ্ছা তাই হবে। তার আগে দেখে নি আমাদের বুড়ো-বুড়ির জন্য এদের কী ব্যবস্থা আছে।
অনেক বাছাবাছি করে খাবারের অর্ডার দিল দুজনে। কাঁটা চামচের আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফিসফাস করে কথা চলতে লাগলো। খাওয়া শেষ হলে বিল মিটিয়ে দুজনে বাইরে বেরিয়ে এল। সমুদ্রের দিকে মুখ করা চেয়ারে পাশাপাশি বসে পড়ল। দৃষ্টি স্থির করে সমুদ্র দেখতে লাগলো। সমুদ্রের ঢেউগুলো সুউচ্চ। এখন বোধ হয় জোয়ার চলছে। বিদিশার মনের ভিতরেও পাহাড়প্রমাণ ঢেউ উঠছে। সেদিনের সেই অষ্টাদশী বিদিশা মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিল সদ্য যুবক সুভাষকে। প্রকাশ করতে বাধো বাধো ঠেকেছিল। মাঝে সংসার সমুদ্র পার করে আজ জীবন সায়াহ্নে এসে বিদিশা আবার পাশে পেয়েছে সুভাষকে। ইচ্ছে করছে হাঁটু গেড়ে সুভাষের সামনে বসে বলতে, আমি সেই কবে থেকে তোকে ভালবেসেছি। এই শেষ বয়সে আমরা একসাথে বাকী পথটা চলতে পারি?
চিন্তাটা ভেঙে গেল সুভাষের গলার আওয়াজে।
- জানিস। আমাদের দেখা না হলেই ভালো হত। আবার দেখা হওয়াটাও দরকার ছিল। সেদিনের সেই অর্ধ সমাপ্ত ঘটনাটা আজ হয়তো পূর্ণতা পেল। আজ আমরা স্বাধীন। তবুও একটা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছি। আজ কেউ হস্তক্ষেপ করার নেই। কিন্তু হয়তো বড্ড দেরি করে ফেলেছি। অনেক বছর ধরে একটা জায়গা খালি পরেছিল। আজ সবটা ভর্তি হয়ে গেছে। তোর সাথে একটা হ্যান্ড শেক করতে পারি ? এই স্মৃতিটা নিয়ে ফিরে যাই নিজেদের ফেলে আসা জগতে। আমাদের অতীত ভারাক্রান্ত। আজ শেষ জীবনে এসে একটা আনন্দের স্মৃতি থাক আমাদের জীবন অ্যালবামে।
বিদিশার চোখের কোল ভারী হয়ে গেছে। করমর্দনের পর যে যার ঘরে ফিরে গেল। কাল থেকে দুজনেই ফিরে যাবে নিজেদের ফেলে আসা জীবনে। আজ পুরীর উত্তাল সমুদ্র সাক্ষী থেকে গেল জীবন সায়াহ্নে পাওয়া একফালি নীরব উষ্ণতার।