Sanchaita Roy Chowdhury

Tragedy Others

4.0  

Sanchaita Roy Chowdhury

Tragedy Others

ইচ্ছা

ইচ্ছা

4 mins
405


 


লঞ্চ চলেছে বাবুঘাট থেকে বেলুড়মঠের দিকে , সরোজিনী একদৃষ্টে নদীর জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছে।সরোজিনীর বান্ধবী পায়েল তার পাশেই বসেছিল , দেখল সরোজিনী কিছু ভাবছে , তাই সে বলল , ' কি রে , তুই কি ভাবছিস ? তোর বোন আসার সময় কাঁদছিল তাই তুই ভাবছিস ? '


সরোজিনী বলল , ' না ' , তখন পায়েল বলল, ' তাহলে...হুম্.... বাড়িতে কোনো অসুবিধা চলছে ? বাড়ির সবাই ভালো আছেন ? কি রে, ওই.......'

সরোজিনী বলল,'না পায়েল, সব ঠিক আছে । '

পায়েল বলল, ' তবে? '

সরোজিনী বলল, 'আমি ভাবছি ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হসপিটালে কুন্তলার শেষ দিনটার কথা । ' পায়েল দুঃখে মাথাটা নীচু করে নিল , ধরা ধরা গলায় বলে উঠল , 'হ্যা।'

সরোজিনী বলল, ' মারণ রোগ কুন্তলাকে কীভাবে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল সেদিন । আজ আমরা সবাই আছি , শুধু ও নেই । '


আমাদের সকলেরই একটা ছোট - বড়ো ইচ্ছা থাকে । কারুর ইচ্ছা থাকে সে খুব বড়ো ডাক্তার হবে , কারুর বা বিজ্ঞানী হওয়ার, আবার কারুর ইচ্ছা থাকে ভালো চাকরি করে দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে শান্তিতে জীবনযাপন করার । মানুষের আরও কত কি ইচ্ছা থাকে । আসলে ইচ্ছা ছাড়া তো জীবন অসম্পূর্ণ । কারুর আবার ইচ্ছা বড়ো হয়ে চাকরি পেয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আর ঠিক এরকমই একটা ইচ্ছা ছিল সরোজিনীর প্রিয় বান্ধবী কুন্তলা কোলের।


কুন্তলার ডাক নাম ছিল দীপা । এই কুন্তলার ইচ্ছা ছিল ইংরেজিতে মাস্টার্স পড়ে ভালো চাকরি করে দুঃস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর । কিন্তু এই ইচ্ছার পথে যে এত কাঁটা ছড়ানো ছিল তা কে জানতো ?


হুগলির এক অজ গ্রামে থাকতো কুন্তলা । বাড়িতে ছিল তাঁর বাবা-মা আর ভাই-বোন । বাবার একটা ছোট ব্যাবসা, কিন্তু দেনার দায়ে সে জর্জরিত । বাবা ছাড়া এই সংসার টানত সে নিজে। কারণ সে ছিল বাড়ির বড়ো মেয়ে,তাই তাঁর যথেষ্ট দায়িত্ব ছিল । বাকি দুই ভাই-বোন খুবই ছোট,মা গৃহিনীর কাজেই নিয়োজিত থাকেন সারাক্ষণ । কুন্তলা ছোট থেকেই পড়াশোনা করতে ভালোবাসতো । পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল সে। অতিকেষ্ট সে নিজে টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাত । এইভাবেই সে বি.এ. ইংরেজি অনার্সে প্রথম স্থান অধিকার করে । সে ভেবেছিল তাঁর ইচ্ছা পূরণ হতে আর কিছু অংশ বাকি।


কিন্তু মানুষের যে সব ইচ্ছাপূরণ হয়না, তা হয়তো কুন্তলা জানত না । এমন সময়ই তাঁর বাবা এক সুপাত্রের খোঁজ পান এবং তাঁর সাথে কুন্তলার বিয়ে দেন । আসলে গরিবের ঘরে আর পাঁচটা বাবা-মা যা চান , কুন্তলার বাবা- মা ও তাই-ই চেয়েছিলেন ।


বিয়ের পর কুন্তলা তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে তাঁর ইচ্ছার কথা জানালে , তারা তা মেনে নেননি । তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁকে সমস্ত কিছু ছাড়তে হয়েছিল ।


বিয়ের সময়ই কুন্তলা টিউশনি করা ছেড়ে দিয়েছিল, যার ফলে এখন তাঁর নিজস্ব রোজগার বলে কিছু ছিলনা । এবার সে কি করবে? তবে কি আর তাঁর মাস্টার্স পড়া হবে না?একথা ভেবে তাঁর পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল । কিছুদিন পর সে তাঁর বাপের বাড়ি ফিরল , ভাবলো সে আবার এখান থেকে পড়ানো শুরু করবে । তাই সে শ্বশুরবাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাপের বাড়িতে কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে শুরু করল , একটু ভয় পেয়েছিল সে, যদি তাঁর স্বামী কোনোভাবে জেনে যায় , তাহলে কি হবে? এইভাবেই সে বিশ্বভারতীতে নিজের শ্বশুরবাড়ির লোককে না জানিয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স পড়ার জন্য ভর্তি হল।সে তাঁর সাংসারিক চাপে বেশি ক্লাস করতে পারত না । এইভাবেই সে মাস্টার্স-এর ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিল।


আর ঠিক এরপরই তাঁর শরীরে দেখা দিল ব্লাড ক্যানসার (অ্যাকুয়েড ম্যালোলয়েড লিউকোমিয়া)।এই রোগের লক্ষণ হলো শরীরের যে-কোন জায়গা থেকে রক্ত ফেঁটে বেরিয়ে আসে ।ওর ক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছিল । দিনটা ছিল ২১শে এপ্রিল, ২০১৯ , সেদিন সকাল থেকেই ওঁর শরীরটা ভালো ছিল না ।ওঁর মা ওঁকে দেখতে গেলে, কুন্তলা বলছিল, 'জানো মা , আজ আমার মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণা করছে ।' কিন্তু কে জানত তখনই তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ আরম্ভ হয়ে গেছে । এর ঠিক কিছুমুহূর্তের পরই কুন্তলা কোমায় চলে যায় । ডাক্তার ২২শে এপ্রিল ,২০১৯-এ জানালেন যে,কুন্তলার মৃত্যু হয়েছে।


কুন্তলার মা-ই কেবল তাঁর ইচ্ছার কথা জানতেন, আসলে সে তাঁর বাবাকে কখনো তাঁর ইচ্ছার কথা বলতে পারে নি,কারণ সে তাঁর বাবার আর্থিক অবস্থার কথা জানত।কুন্তলার মৃত্যুর ঠিক ২মাস পর তাঁর মাস্টার্স-এর ফল বেরোয়,তাঁর মা জানতেন যে কুন্তলার লড়াই থেমে গেছে,তাও সে তার মেয়ের মাস্টার্স-এর ফল দেখতে গেলেন।তিনি দেখলেন তার কুন্তলা মাস্টার্স-এ প্রথম স্থান অর্জন করেছে ।কুন্তলার মা তার মেয়ের এই ফল দেখে পাথরের মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে রইলেন ।কুন্তলার মা ভাবতে থাকলেন , 'আজ শুধুই কুন্তলার নাম আছে,কিন্তু কুন্তলা তো নেই ।'

সরোজিনী খুশি হয়ে বলেছিল , 'কাকিমা , কুন্তলা কোথায়?ও আসবে না,ও খুব ভালো রেজাল্ট করেছে ।কাকিমা?'

পায়েল বলল,'কাকিমা,কুন্তলা আসবে না?কাকি..'

পায়েলের কথা শেষ হওয়ার আগেই কুন্তলার মা চোখ ভর্তি জল নিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,'কুন্তলা যেখানে গেছে,সেখান থেকে আর কখনোই ফেরা যায় না , ফেরা যায় না,যায় না ফেরা ........' বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন।সরোজিনী আর পায়েল পরে সবটা শোনে কুন্তলার বাবার কাছ থেকে।


লঞ্চ থামলো গঙ্গার ঘাটে,সরোজিনী ও পায়েল চোখ মুছে নিজেদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেল ।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy