হসপিটালের বেড নম্বর
হসপিটালের বেড নম্বর


চারিদিক নিস্তব্ধ তখন রাত প্রায় দুটো । হঠাৎ হসপিটালের এমার্জেন্সি তে এলো এক চৌত্রিশ বছর বয়সী মহিলা। সঙ্গে অনেক লোক, বেশ নয়েজ শুরু হলো কিছুটা । ওখানে যারা ছিলেন সিকিউরিটি,ওয়ার্ড বয়, আনুষাঙ্গিক আরো কয়েকজন সবাই এগিয়ে এলো। একজন গিয়ে ডাক্তার কে ডেকে আনলেন।
ডাক্তার এসে বললেন, "পেসেন্ট কই? "
মহিলাকে নিয়ে একজন এগিয়ে এল । সঙ্গে বাকি লোকজন বলেতে শুরু করলো তাড়াহুড়ো করে। ওই মহিলা নাকি বার বার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছেন। আর এখন ওরা এনাকে ভর্তি করতে চায়। বাড়িতে রাখলে রিস্ক হতে পারে। এমার্জেন্সির ডাক্তার কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন তারপর ভর্তি নিলেন । সিলেক্ট হলো বেড নম্বর ৭৭। বাড়ির লোকজন কে একটা ফ্রমটা ফিলাপ করতে বলা হলো।
ওয়ার্ড বয় কাগজ পত্র নিয়ে বললো, "আসুন আমার সঙ্গে ।"
পেসেন্ট গেল, সঙ্গে আরও দুজন গেল। লিফ্ট এ করে পৌঁছে গেলো দোতালায় তারপর ৭৭ নম্বর বেড এর সামনে। ওই রুমে আরো ও কয়েকটা বেড আছে। ৭৮নাম্বার বেডে একজন পেসেন্ট শুয়ে আছে। ওই কোনের দিকে ৭৪নম্বর বেডে এক বয়স্ক মহিলা আর বাকি বেড গুলো এখনো পুরো ফাঁকা।
নাইট ডিউটি তে যে সিস্টার ছিলেন ওয়ার্ড বয় তাকে ডাকলো , " সুবোলা দি.. পেসেন্ট এসেছে ৭৭রে।"
পেসেন্ট কে বেডে থাকতে বলা হলো আর বলা হলো কেউ একজন আসুন , সিস্টার ডিটেইল জানতে চাইল।
সুবোলা অন্য একটি নার্স কে ডাকলেন, "অর্চিতা ..........পেসেন্ট এর পালস্, বি.পি , ই. সি. জি টা করতে হবে।"
অর্চিতা এসে কাজ গুলো শুরু করলো। কিছু ক্ষন পর ডঃ মান্ডি এলেন পেসেন্ট এর কাছে জানতে চাইলেন কি সমস্যা...? পেসেন্ট জানালো আজ সে ১০ বার সেন্সলেস হয়েছিল। পেসেন্ট কে চেককাপ করে ওষুধ দিয়ে উনি চলে গেলেন। পেসেন্ট এর বাড়ির লোকজন বললো আমরা আসছি এখন । পেসেন্ট কান্নাকাটি করতে শুরু করলো, তার এক সাত বছরের মেয়ে আছে তার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে । বাড়ির লোকজন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেল। প্রায় ঘড়িতে ৩টে আবার নিস্তব্ধতা চর্তুরদিক।
পরেরদিন সকাল ৭৮নম্বর বেডের পেসেন্ট এর দিকে তাকিয়ে ৭৭রের ওই মহিলা হাসলেন। তারপর জিগাসা করলো , " তোমার কি হয়েছে?" সে উওরে জানালো তার সমস্যার কথা। তারপর ৭৭ বললো খুব করুন ভাবে, আমার না খুব চিন্তা হচ্ছে জানো.... আমার মেয়ে টা ঘুম থেকে উঠেই আমায় খুঁজবে আমার মেয়ে খুব ছোট । কি হবে কে জানে....এই ভাবে আরো কথা বলতেই থাকলো মেয়ের কি হবে , স্কুলে যাবে কি করে, কে ওকে খাওয়াবে........।
ওদিকে ৭৪ নম্বরের বয়স্ক মহিলার হাঁটুর অপারেশন হবে তাকে নিয়ে গেল। সুবোলা র ডিউটি শেষ সকালে। সকালের নতুন সিস্টার এনা এলো, তাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে সুবোলা। "৭৭রের পেসেন্ট এর এম.আর.আই হবে আজ। আর একজন অপারেশন এ গেছে আর ওই ৭৮রের তাকে......"
কিছুক্ষন পর এম. আর.আই করতে নিয়ে যাওয়া হলো৭৭কে। সুইপার রুম সাফ করতে করতে ৭৮রের বেডের সামনে একটা ডিবান রাখা ওখানে বসলো দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তারপর পেসেন্ট এর দিকে হাসলো আর জিগ্যেস করলো খুশি খুশি গলায়, "কেমন আছো? " সঙ্গে সঙ্গে ব্রেকফাস্ট ঢুকলো আয়া এসে খাবার সার্ভ করলো । তারপর সুইপার মহিলা বলতে শুরু করলো , "খেয়ে নাও । এত কম খেলে হবে? বলো? দেখো, শরীর হলো মন্দির যার মধ্যে আছে আত্মা যা হলো ঈশ্বর তুমি যদি না খাও তাহলে আত্মাকে অসুখী করলে মানে ইশ্বর কেই কষ্ট দিলে এ ভাবে উনি আরো কত কি বলতে থাকলেন......"
মেল ওয়ার্ড এ সিস্টার লিসা ৩৪ নম্বর বেডের পেসেন্ট এর কাছে এসে বললো, " নিন ওষুধ গুলো খেয়ে নিন । আয়া মাসি এদিকে এসো ওনার ব্লাড টা প্যাথোলজিতে পাঠাতে হবে ,নিয়ে যাও তুমি।"
৩৪নম্বরের পেসেন্ট কে দুশ্চিন্তায় থাকতে দেখে সিস্টার লিসা বললেন, "চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে ।এই তো আপনার মেয়ে এসে গেছে , নিন কথা বলুন মন খুলে।"
মেয়ে বলে উঠলো, " বাবা কেমন আছো ?সব ঠিক আছে তো ?কোনো অসুবিধা হচ্ছে তোমার? পেসেন্ট বিমর্ষ গলায় মুখ নীচু করে বলে উঠলো, এখানে থাকতে আর ভালো লাগছেনা। ডাক্তার ছাড়বে কবে ? কিছু বললো? "
মেয়ে তখন বললো, "এত অধৈর্য হলে হয় । দাড়াও সব টেস্টের রিপোর্ট গুলো আগে আসুক । তুমি চিন্তা করো না বাবা। "
উনি আবার বললেন, "কত খরচ হয়ে যাচ্ছে তাই না রে।টেস্ট গুলো তে কত হলো রে?"
মেয়ে বলছে, " উহঃ বাবা... তোমাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না । শোনো রাঙা দির মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে জানো .....তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো বাবা । তোমাকে যে..... "
দুপুর গড়িয়েছে সিঙ্গেল কেবিন ৪ নম্বর বেড এর পেসেন্ট একটা মেয়ে , সকালেই অপারেশন হয়েছে তার। তার রুমে যে আয়া ছিল তাকে ডেকে সে বলছে," আমি টয়লেট এ যাবো।"
আয়া তখন বলে উঠলো , "দাঁড়া ও বেড প্যান দিচ্ছি । "
পেসেন্ট ঝিমানো গলায় বললো, " না না আমি বেড প্যান নেবো না আমকে বাথরুমে নিয়ে চলো।"
আয়া বললো, "এখন এই ওষুধ ,সেলাইন এসব নিয়ে ঝামেলা ,তুমি বাথরুমে পারবেনা । এটাতেই করো না। "
পেসেন্ট ক্লান্ত গলায় আবার বললো, "তুমি এগুলো ধরো এসব সেলাইন, আমি ঠিক পারবো।"
আয়া সেলাইন নিয়ে বাইরে আর পেসেন্ট টয়লেট এর ভিতরে, সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন সে ভাবতে থাকলো তার জীবনের এক ঠকে যাওয়ার মূহুর্তের কথা , যাকে তার একদিন ভালোলেগে ছিল , সেই সম্পর্ক টা আসলে তাসের ঘরের মতো মিথ্যে ছিল । দেখতে দেখতে প্রায় দুবছর কেটেছে কিন্তু মেয়েটি ওই ভাঙা সম্পর্ক থেকে বেরোতেই পারছিলো না ,একটা অদ্ভুত ডিপ্রেশন তাকে ঘিরে ছিলো। জীবন থেকে একদিন সে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল। নিজের দিকে ভালো করে তাকাতোই না সে ,তাই হয়তো শরীরের প্রতি অবহেলা থেকে এই অসুস্থতা । কিন্তু অপারেশনের পর এই ৪নম্বর বেড এ শুয়ে তার হঠাৎ মনে হলো আজ .....জীবনের আরোও কিছু জানা আরও কিছু দেখা বাকি আছে তার । এখন হসপিটাল এর টয়লেট এর আয়নায় সে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করলো । গতকাল রাত্রে বাড়িতে সে আর আজকের হসপিটাল এর সে, সুবিশাল তফাৎ। পুরানো সম্পর্কের ডিপ্রেশনের চিহ্ন নেই এখন। বাইরে তখন মেঘলা আকাশ, হালকা একটা হাওয়া তার চুল গুলো কে দুলিয়ে গেল আর তার মনের মধ্যে অজস্র শব্দ ভীড় হয়ে এলে, কবিতার লাইন হবে বলে। মেয়েটি কবিতা লিখতে ভালোবাসত কিন্তু তার পুরোনো সম্পর্ক ছিল যার সাথে, সে পছন্দ করতো না ।আর মেয়েটি সম্পর্কে দূর্বল হয়ে নিজের এই ভালোলাগা টাকে দূরেই রেখেছিল। তার মনে হলো সে ভুল করেছে, সময়ের অপব্যয় করেছে এতগুলো দিন। সে নতুন করে আবার লিখতে চায়। প্রায় অনেকক্ষন বেরোচ্ছে না সে ।
তাই দেখে আয়া , সেলাইন হাতে বলে উঠলো, "তোমার হলো ..... কোনো সমস্যা হচ্ছে কি? আর তখনই টেপ থেকে জলের কল কল শব্দ ,সঙ্গে ভেসে এল মেয়েটি র গলার মৃদু আওয়াজ , আসছি....."
সিস্টার দের মধ্যে কথোপকথন চলছে। সিস্টার ন্যানি বললো, " জানো তো প্রাচীদি ওই ৩২নম্বর বেডে এর কাছ দিয়ে গেলেই কেমন একটা লাগে আমার, ওই যে সেবার সেই ভদ্রমহিলা মারা গেলেন। ওখানে আমারই তো ডিউটি ছিলো, কত কথা বলতেন উনি । ওখান দিয়ে গেলেই খালি মনে পড়বে জানো। আমাকে কত গল্পই করতো। ওনার ছেলে মেয়েদের কথা, ছেলে মেয়েরা কেউই তেমন ভালো ছিল না । খুব কষ্ট পাচ্ছিল ।"
সিস্টার প্রাচী বলে উঠলো, "ওখানে কাল একটা পেসেন্ট এসেছে না?"
সিস্টার ন্যানি বললো, "হ্যাঁ অনেক দিন বেডটা খালি ছিল । প্রায় একবছর হতে যায়, ওখান দিয়ে গেলেই ওনার কথা মনে পড়ে কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে যায়।"
সিস্টার প্রাচী বললো, " এসব নিয়ে বেশি আর ভাবিস না । কত পেসেন্ট এর সাথে কত কথাই তো হয়ে যায় আমাদের। যাওয়া আসা তো চলতেই থাকে। কারোর জন্য কিছু কি থেমে থাকে রে, বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রাচী । আবার শান্ত গলায় বলে উঠলো, সবাই একদিন চলে যায় কিন্তু জীবনের গল্পগুলো থেকে যায়......"
ডঃ ঝা ঢুকলেন ৭৪নম্বরের বয়স্ক মহিলা কে চেক-আপ করতে এসেছেন।
মহিলা বলছেন," আমাকে কবে ছাড়বেন?"
ডঃ ঝা বললেন," আপনি আগে হাঁটবেন তারপর। এখন আর কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? "
মহিলা বলে উঠলেন, "আমাকে পনির খেতে যেনো দেওয়া হয়। আর আমি টয়লেট এ বেডপ্যান চাওয়ার আগেই কয়েক বার করে ফেলেছিলাম বলে ওই আয়া মাসি খুবই বাজে ব্যবহার করেছে বলেই উনি কেঁদে ফেললেন।"
ডঃ ঝা ডাকলেন, "সিস্টার....তারপর বললেন, এসব কি শুনছি আমি, উনি বয়স্ক মানুষ এমনটা তো হতেই পারে তাই বলে ওনার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করবেন আপনারা। "
সিস্টার বললো , "আমি তো সকালে ডিউটিতে এসেছি । রাত্রে ব্যাপারটা হয়েছে আমি দেখছি স্যার , কে ওনার সাথে এরকম বিহ্যাব করেছে।"
ডঃ ঝা আবার বললেন, " ওনাকে লাঞ্চ এ পনির যেন দেওয়া হয় আপনি একটু দেখবেন। "
তারপর চলে গেলেন।
সিস্টার এসে আবার কথা বললো বয়স্ক মহিলার সাথে।
বয়স্ক মহিলা বললন, "আমার তো বয়স হয়েছে তাই কেউ আর আমাকে সময়ই দেয় না, ছেলে মেয়েরা ব্যস্ত, নাতি নাতনীরা ও নিজের মতো বাড়িতে কেউ আমার কাছে বসে একটু কথাই বলে না।"
সিস্টার বললো, " না না এ আপনার মনের ভুল। ছেলে মেয়েরা আপনাকে কতো ভালোবাসে হসপিটাল এ সবসময় আপনার খোঁজ নিচ্ছে। এত অশান্তি মনে রাখবেন না। ছেলে মেয়েদের ও তো একটা কাজের জগৎ আছে তাই না !"
মহিলা তখন মুখ নীচু করলেন.....
বেলা পড়েছে তখন, লিফ্ট এ করে পেসেন্ট উঠছে। চারদিকে ভীড় লোকজন এর । বিকেলের ভিসিটিং আওয়ার শুরু হলো।
সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে উঠছে ময়ূরী ।
গতকাল ওর এক আত্মীয় ভর্তি হয়েছে, আজ ও দেখতে এসেছে তাকে কিন্তু এখন কোনদিক টায় ঠিকমতো খুঁজে পাচ্ছে না সে ।
হঠাৎ চোখ পড়লো একটা কেবিন ৭নম্বর বেডটা ।
বছর পাঁচেক আগে ময়ূরী একটা সমস্যা নিয়ে ওই বেডেই ভর্তি হয়েছিল।
সেই দিন গুলোতে তার মন তাকে অনেক কিছু চিনতে শিখিয়ে ছিলো।
ঠিক ভুলের এক অদ্ভুত পরিসীমা সে বুঝতে শিখেছিল।
ওই বেড টাতে শুয়ে থাকার দিনগুলোতে সে অনুভব করেছিল ,কিছু অপেক্ষা অর্থহীন।
জীবন কে অপমান করে, ছোট করে ।
আর কিছু অপেক্ষা অনন্ত হলেও সবটা পাওয়া হয়ে যায়, জীবনকে মুক্তি দেয় এক আশ্চর্য উদারতায়।
স্মৃতির পাতা ওল্টালেই সে খুঁজে পায় ওই হসপিটালের ৭নম্বর বেড এ কাটানো মুহূর্তগুলো, একটা ছোট কাহিনী হয়ে থেকে গেছে । যা ভীষণ দামী এখন।
ময়ূরী র ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বেজে উঠলো..... ময়ূরীর ঘোর কাটলো।
ফোনটা রিসিভ করে বললো, "হ্যালো..... ..
ফোনের ওদিকে একজন বলে উঠলো, " কি রে .?...কোথায় তুই? খুঁজে পাসনি তুই..?
সেকেন্ড ফ্লোরে ডানদিকে এসে বেড নম্বর ৫৬..... "