Jeet Guha Thakurta

Classics Comedy

4.8  

Jeet Guha Thakurta

Classics Comedy

রম্যকথা: নামবিভ্রাট

রম্যকথা: নামবিভ্রাট

5 mins
356


হাসি কান্না হীরা পান্না : নামবিভ্রাট


নাম মনে রাখা সত্যিই খুব চাপের ব্যাপার।


না, নিজের নাম নয়। নিজের নাম বহু জায়গায় লিখতে লিখতে বলতে বলতে এতদিনে কেমন যেন মুখস্থ মতোন হয়ে গিয়েছে। খুব একটা ভাবতে হয় না। ঠিক মনে পড়ে যায়। সমস্যা হয় অন্যদের নাম নিয়ে। এই যেমন ধরুন মেট্রোতে।


কলকাতার মেট্রোতে চড়তে গেলে, আপনাদের কী হয় জানিনা - আমার কিন্তু মেট্রো ষ্টেশনের নাম নিয়ে ভীষণ অসুবিধা হয়। বিশেষ করে শহরের দক্ষিণ অংশে।


দমদম, শ্যামবাজার, শোভাবাজার থেকে পার্কস্ট্রিট, ময়দান পর্যন্ত কোনো ঝামেলা নেই। জায়গার নামেই ষ্টেশনের নাম। মনে রাখার জন্য ব্রেনোলিয়া লাগে না। সমস্যার সূত্রপাত হচ্ছে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে। অর্থাৎ, নেতাজি।


দু'টো ষ্টেশন আছে নেতাজির নামে। একটার নাম নেতাজি। আর তার থেকে অনেকটা দূরে আরেকটা ষ্টেশনের নাম নেতাজি ভবন। হে পাবজিমুগ্ধ পাঠক, হে সেল্ফিপ্রেমী পাঠিকা, আপনারাই বলুন তো, এই দশ কোটি বাঙালির দেশে মহামানবের কি এতোই আকাল পড়েছিলো ? ইতিহাসের পাতা উল্টে উল্টেও কি আরো দু'একটা নাম পাওয়া গেলো না, শেষে সেই নেতাজিকেই ডবল রোলে নামাতে হলো ?


তা নামাতেই যদি হয় তো সহজ করে নাম রাখলেই হয়, নেতাজি ১, নেতাজি ২। কিংবা নেতাজি উত্তর, নেতাজি দক্ষিণ। চুকে যায়। তা নয়। একটা হলো নেতাজি ভবন। সে না হয় তবু বোঝা গেলো যে সেখানে সুভাষচন্দ্র বসুর পারিবারিক বাসবভন ছিলো হয়তো। তাই নাম হয়েছে নেতাজি ভবন। কিন্তু অন্যটার নাম কী ? নেতাজি। শুধুই নেতাজি। মানেটা কি ? এটা নেতাজির বাসভবন, আর ওটা কি তাহলে স্বয়ং নেতাজি ? কী কান্ড। কোথায় কোথায় লোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁকে, জাপান থেকে তাসখন্ড, দেশে-বিদেশে। আর তিনি দিব্যি একটা ষ্টেশন সেজে দাঁড়িয়ে আছেন এই খোদ কলকাতায়। কি কনফিউশান। একদিন তো মেট্রোতে এক ভদ্রলোকের কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো রীতিমতো। ছোটবেলা থেকেই জানি, নেতাজি ঘরে ফেরে নাই। এই ভদ্রলোক সেদিন ঘুমন্ত এক সহযাত্রীকে ঠেলা মেরে তুলে দিয়ে বললেন, "উঠে পড়ুন, নেতাজি এসে গেছে।"


নেতাজির মতোই রবিঠাকুরেরও ডবল রোল। রবীন্দ্র সরোবর, আর রবীন্দ্র সদন। কলকাতায় কিছুদিনও যারা থেকেছেন তারা ভালোই বুঝবেন, কী অসাধারণ দু'টো জায়গা দেওয়া হয়েছে কবিগুরুকে। এই কলকাতার ওই দু'টো জায়গাতেই তো ভালোবাসা যাহোক টিঁকে আছে এখনো। প্রেমের জোয়ারে, ভাসাবে দোঁহারে। চলুন এগোনো যাক।


"উত্তমকুমার এলেই সব ফাঁকা হয়ে যাবে।"


আজ্ঞে এটা আমার উক্তি নয়। কোনো এক অফিসযাত্রীর উবাচ। কারুর সন্দেহ হতেই পারে যে এই উত্তমকুমার কোনো গুন্ডা-রংবাজের নাম কিনা যে এসে দাঁড়ালেই সব ফাঁকা হয়ে যায়। তাই হয়তো পরিচয় বোঝাতে ষ্টেশনের অফিসিয়াল নাম রাখা হয়েছে মহানায়ক উত্তমকুমার। পুরো নাম মনে করে বলতে বলতেই পরের ষ্টেশন চলে আসবে। কেন বাবা, সোজাসুজি টালিগঞ্জ নাম রাখতে কী হয়েছিলো ? ঠিক যেমন বাঁশদ্রোণী ষ্টেশনের নাম মাস্টারদা সূর্য সেন। নাম, পদবী, কোন পেশায় যুক্ত ছিলেন, সব মনে রাখতে হবে মেট্রোয় চড়তে গেলে। মানে বাঁশ দেবে, তাও আবার দ্রোণাচার্যের কায়দায়! তার চাইতে বরং বাঁশদ্রোণী নামটাই রেখে দিলে সুবিধা হতো না ? কী কষ্ট যে হয় জায়গার সাথে ষ্টেশনের নাম মেলাতে, সে আর বলার নয়।


সবার নাম তো মনেও রাখতে পারি না। একবার গড়িয়ার জন্য টিকিট কাটতে গিয়ে সেই ভদ্রলোকের নাম ভুলে গেছি যার নামে ষ্টেশনের নাম। ভিড় লাইনের সামনে কাউন্টার আটকে দাঁড়িয়ে আমি মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিছুতেই আর মনে পরে না। শেষে কাউন্টারের লোকটি অধৈর্য্য হয়ে বললেন, "কোথায় যাবেন ?" আমি তৎক্ষণাৎ হাত মুঠো করে যা মনে এলো সদর্ভে গেয়ে উঠলাম, "দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।"


সেখানে উপস্থিত যাত্রীরা ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও কাউন্টারের মালিক কিন্তু ঠিক ধরে ফেললেন, "আচ্ছা, কবি নজরুল, মানে গড়িয়া বাজার। তা সরাসরি সেটা বলুন না।"


'সরি সরি' করে সেযাত্রা ম্যানেজ করলাম। সবসময় এতো সুবিধা অবশ্য হয় না।


যেমন ঠিক তার পরের ষ্টেশনের নামই কোনো এক শহীদের নামে। কিন্তু সঠিক নাম মনে আসে না। তখন আন্দাজে তিতুমীর কিংবা মিরকাশিম বলে কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে দেখি। আন্দাজ করার চেষ্টা করি আমি কিছু ভুল বললাম কিনা। ওপারে যিনি থাকেন, তিনি হয়তো আমার মতো এরকম ক্ষুরধার স্মৃতিধর যাত্রী কখনো দেখেননি। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি যাবেন কোথায় ?" কী মুশকিল। তার মানে এইদুটোর কোনোটাই নয়। লাগে তাক, নয় তুক ভেবে বলি, বিনয় বাদল দীনেশ, মাতঙ্গিনী হাজরা। কিন্তু সেসবে বরফ গলে না। আমাকে সাইডে রেখে পরের জন টিকিট কাটতে থাকেন। আমি তখন হাতড়ে হাতড়ে অন্য নাম খুঁজতে থাকি। শহীদ হয়েছিলো কে ? শহীদ কে হয়েছিলো ? কিছুতেই ক্ষুদিরাম মনে আসে না, শুধু মাথার মধ্যে একটা নাম বরুণ ধাওয়ান ঘুরতে থাকে। আমি নিশ্চিত যে সে এখনো শহীদ হয়নি। তাই বলতে ঠিক সাহস হয় না যে আমাকে একটা বরুণ ধাওয়ান দিন। কিন্তু সঠিক নাম মনে পড়লে তো!


আপনি মেট্রোর যাত্রাপথ শেষ করে হয়তো ভাববেন নামবিভ্রাট থেকে বাঁচা গেলো। আর তখনই দেখবেন নিউ গড়িয়ায় সুভাষচন্দ্র বোস আবার এসে হাজির। কিন্তু এবার তিনি কবিরূপে। একদম ট্রিলজি। প্রথমে তিনি ছিলেন নেতাজি। তারপর নিজ বাসভবনে বন্দি। অতঃপর তিনি হলেন কবি। অবশ্য কেউ কেউ বলে যে এই সুভাষ সেই সুভাষ নন, ইনি হলেন কবি সুভাষ। কিন্তু আমার ঘোর সন্দেহ হয় যে আমার মতো ভুলোমনের মানুষকে জব্দ করতেই মেট্রোরেলের এই পরিকল্পনা। রীতিমতো চক্রান্ত।


নাম মনে রাখতে না পারার কাহিনীতে সবার আগে আছেন সেই ভদ্রলোক। যার কথা আপনারা সবাই আগে অনেকবার শুনেছেন নিশ্চয়ই। তবু ভালো গল্প বার বার বলা যায়। তো সেই ভদ্রলোক সত্তর বছর বয়সেও তার থেকে দু'বছরের ছোট অর্ধাঙ্গিনীকে হামেশাই ডাকতেন স্যুইট হার্ট, ডার্লিং কিংবা মাই বেবি সম্বোধনে। সবসময়ই এমনতরো রোমান্টিক আহবান। এই দেখে একদিন তার এক কৌতূহলী প্রতিবেশী তাকে একান্তে জিজ্ঞাসা করলেন, "আচ্ছা আপনাদের এই বয়সেও এতো ভালোবাসার রহস্যটা ঠিক কী বলুন তো ? যখনই আপনার মিসেসকে ডাকেন, দেখি আপনি খুব রোমান্টিকভাবে ডাকেন।"


ভদ্রলোক অসহায়ভাবে বললেন, "কী করি বলুন, বছর কুড়ি হয়ে গেলো আমি আমার বউয়ের নামটাই ভুলে গেছি। আর এখন আমার সাহসও হয় না এই এতো বছর পর তার নাম জিজ্ঞাসা করতে।"


গল্পটা গল্পই। কিন্তু আমার সঙ্গে একবার এরকমই একটা ঘটনা বাস্তবে ঘটেছিলো।


হয়েছিলো কী, সেবার কোনো একটা মলে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার এক বন্ধু সৌরভ ও তার স্ত্রী এসেছিলো সেদিন শপিংয়ে। হঠাৎ দেখা। বেশ একটু হাই-হ্যালো হলো ওদের সাথে।


পরদিন আরেক বন্ধু কৌশিকের সাথে আড্ডা হচ্ছিলো। তো কথায় কথায় বললাম, "জানিস, কাল সাউথ সিটিতে গিয়েছিলাম, ওখানে দেখি সৌরভ এসেছে পারমিতাকে নিয়ে। গল্প হলো কিছুক্ষণ ওদের সাথে।"


কৌশিক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো, "পারমিতা আর সৌরভ ? তুই ঠিক দেখেছিস ?"


"হ্যাঁ। ঠিক দেখবো না কেন ? কথাও তো হলো।"


"সাউথ সিটিতেই ?"


"হ্যাঁ।"


"অদ্ভুত। আমাকে তো অন্য কিছু বলে বেরিয়েছিলো পারমিতা।"


"সেকি, সৌরভের বউয়ের সাথে তোর কথা হয় ?" আমি অবাক হলাম।


কিন্তু কৌশিক আরো বেশী অবাক হলো, "কে সৌরভের বউ ?"


কৌশিকের এই কথায় আমি প্রমাদ গুনলাম। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো। কী সর্বনাশ কান্ড করেছি আমি। একজনের বউকে আরেকজনের ঘাড়ে বসিয়ে দিয়েছি। বন্ধুদের নাম মনে থাকে, তাদের বউদের নাম তো সব ঠিকঠাক মনে থাকে না। মনে থাকলেও, কার বউ কে, সেটা ভুল হয়ে যায় মাঝে মাঝে।


আমি কৌশিককে বললাম, "আমি মনে হয় ব্লান্ডার করেছি একটা। পারমিতা নয়, পারমিতা নয়। পারমিতা তো বুবাইয়ের বউয়ের নাম। সৌরভের সাথে সৌরভের বউ মানে চন্দ্রানীই এসেছিলো। আমি বুবাইয়ের বউকে সৌরভের বউ বানিয়ে দিয়েছি রে, ভেরি সরি। ভেরি সরি।"


কৌশিক আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো, "তুই বুবাইয়ের বউকে সৌরভের বউ বানাসনি। তুই আমার বউকে প্রথমে সৌরভের বউ বানিয়ে এখন আবার বুবাইয়ের বউ বানিয়েছিস। পারমিতা আমার বউয়ের নাম। সৌরভের বউ হলো ইন্দ্রাণী।"


সেই শেষ। তারপর থেকে বন্ধুদের বউয়ের ব্যাপারে আমি আর রিস্ক নিই না। শুধুই সর্বনামে ডাকি তাদের। অমুকের বউ, তমুকের বউ, এইভাবে।


~ সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics