গুঞ্জন
গুঞ্জন
দু'মহলা বনেদি ঘোষালবাড়ির বৌ হয়ে এবাড়িতে পা রাখা ইস্তক রাধারাণী আর কখনো কোথাও যায়নি। তার সবচেয়ে বড় কারণ, তার যাবার বিশেষ কোনো জায়গা নেই। অনাথা মেয়ে, মামারবাড়িতে অনাদরে হেলাফেলায় মানুষ। সতেরো বছর পুরতে না পুরতেই মামা মামী বিয়ে দিয়ে দায় মিটিয়েছিলো। তাই বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িই তার নিজের ঘরবাড়ি হয়ে উঠলো। এখানকার মানুষজনেরাই তার আপনজন হয়ে উঠলো। রাধারাণী এখন আর কনেবউটি নয়, রীতিমতো গিন্নিবান্নি... তিন তিনটি ছেলেপুলের মা।
তাছাড়া বাড়ির বড়বৌ হবার সুবাদে দায়িত্বও তার অনেক। পদে পদে সংসারের ছোট বড় সবাইকার মন জুগিয়ে চলে সংসার করা দুরূহ কাজ বটে, তবে রাধারাণী নির্দ্বিধায় হাসিমুখেই সেসব সামলায়।
ঘোষালবাড়িতে সংসারে লোকসংখ্যা অনেক... নিজেদের ও আশ্রিত মিলিয়ে প্রায় জনা তিরিশেক, ছোটয় বড়য়। সম্পর্কিত ননদ, পিসশাশুড়ি, জায়েরা মিলেই ঘরকন্না রাঁধাবাড়া সামলে নেয়... দুজন অনেক পুরনো কাজের লোকের সহায়তায়। শাশুড়ি বাতবেদনায় কাবু হবার পর থেকে গোটা সংসারের চাবিকাঠিটি বড়বৌয়ের মানে রাধারাণীর আঁচলে বাঁধা। এমনকি স্বামী সুবোধ চন্দ্রের ব্যবসার আয় ব্যয়ের হিসেবটি পর্যন্ত রাধারাণীর নখদর্পণে।
সেদিন সকাল থেকেই সারা বাড়ি জুড়ে গুঞ্জন। রাতে নাকি বড়বৌয়ের ঘরে পরপুরুষের আগমন হয়েছিলো। স্বামী সুবোধ চন্দ্র ব্যবসার কার্যোপলক্ষ্যে অন্য শহরে গেছেন। আর সেই সুযোগেই কিনা এই দুষ্কর্ম! ছিঃ ছিঃ! গুঞ্জন বাড়তে বাড়তে ক্রমশঃ শোরগোলের আকার নিয়েছে। ইতিমধ্যে স্বামী সুবোধ চন্দ্রও ফিরে এসেছেন। বাড়িতে পৌঁছেই স্ত্রীর নামে এমন অভিযোগ শুনে, রাধারাণীকে প্রশ্ন করলেন তিনি, "স্বামীর একদিনের অনুপস্থিতি হতে না হতেই পরপুরুষকে ঘরে প্রবেশাধিকার দিতে হলো?"
সকাল থেকেই গুঞ্জন চলছিলো, আর রাধারাণীও নিজের দৈনন্দিন গৃহকাজ করে যাচ্ছিলো। সবই শুনছে কানাঘুষা, তবে এতোক্ষণ বাড়ির বড়বৌ রাধারাণী নিরুত্তর ছিলো। হয়তোবা আশা ছিলো যে, স্বামী এসে তার বিরুদ্ধে ওঠা এই অহেতুক এতোবড় মিথ্যা অভিযোগটির উপযুক্ত জবাব দেবেন। কিন্তু স্বামীও যখন বিশ্বাস করলেন এই মিথ্যাটিকেই, তখনই এতোদিনের দাম্পত্য সম্পর্কের বিশ্বাসের ভিতখানি ধূলিসাৎ হলো। রাধারাণী আর সহ্য করতে পারলো না। বাল্যবিধবা মামাতো ননদ এই মিথ্যার পর্দা তুলতে অনুরোধ জানালো রাধারাণীকে।
মিথ্যা অভিযোগের অপমানে আহত রাধারাণী বললো, "এতোদিনের চেনা মানুষ আপনজনকে যারা বিনা দ্বিধায় অনায়াসে দুশ্চরিত্রা বলে ভেবে নিতে পারে, তাদের সংসারে আমি আর থাকবো না। আর এদের কাছে কোনো কৈফিয়ৎ দেবার দায়ও আমার নেই। অন্যায়ভাবে পুলিশের তাড়া খাওয়া আমার বাপ মা মরা একমাত্র নকশাল ভাইটাকে রাতে কয়েকঘন্টার জন্য আশ্রয় দেবার সিদ্ধান্তের কারণে আমি দুশ্চরিত্রা নষ্টা প্রতিপন্ন হলাম যখন, তখন কারোর এই ভুল ভাঙানোর কোনো ইচ্ছাও আমার নেই।"
রাধারাণী ছোট্ট একটি পুঁটুলিতে বাবা মায়ের বিবর্ণ একখানা বাঁধানো ফটো আর দুখানা আটপৌরে কাপড় নিয়ে সংসার ছাড়লো একবাড়ি হতবাক মুখের সামনে দিয়ে। ঘোষালবাড়ির চৌকাঠ ডিঙোনোর সময় একবারও রাধারাণী আর পিছনে তাকায়নি। পড়ে রইলো এতোবছরের সংসার, স্বামী, ছেলেমেয়ে, সব। পিছনে তখনও গুঞ্জন চলছিলো জোর কদমে। অবিশ্বাস আর সন্দেহের ভিত্তিতে সংসার দাঁড় করানো যায় না। আর অমনতরো জোড়াতালির সংসার ভেঙে পড়তে ঝড় লাগে না, হাওয়াই যথেষ্ট অমনি তাসের ঘরের মতো সংসার ভেঙে পড়তে। গুঞ্জন... হিতাহিতজ্ঞানশূন্য গুঞ্জনই ঠিক এমন অপরিণামদর্শী অবিশ্বাসী মনোভাবের জন্য দায়ী। আর তার পরিণামেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে গেলো রাধারাণীর এতোদিনের সাজানো সংসার আর পারিবারিক ও ব্যক্তি সম্পর্কের বাঁধনগুলো। জীবন ক্ষণেক থমকালো হয়তো, তবুও গুঞ্জন থামেনি... তবে এবারে বিষয় হলো রাধারাণীর মটমটে দেমাক।
'