গল্প হলেও মিথ্যা
গল্প হলেও মিথ্যা
কলমটা টেবিলের উপর রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন ভবতোষ বাবু। কাগজগুলোর উপর পেপার-ওয়েট চাপা দিয়ে রাখা। তা না হলে পাখার হাওয়ায় হয়তো ঘর জুড়ে উড়ে বেড়াত কাগজগুলো। সেই কাগজের আড়ালে হয়তো চাপা পড়ে যেত ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পোড়া সিগারেটের টুকরোগুলো। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ছ’টা বাজে। রাতে ঘুম হয়নি ভবতোষবাবুর। স্বর্ণালীকে আর নিজের কাছে আটকে রাখা যাবে না। ওকে ছেড়ে দিতে হবে আজ! দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ভবতোষবাবু। দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে যেমন স্বস্তি রয়েছে ঠিক তেমনই রয়ে গেছে স্বর্ণালীকে ছেড়ে দেবার একরাশ যন্ত্রনা।
শেষ চার পাঁচটা মাস স্বর্ণালীর সাথে খুব সুন্দর কেটেছে ভবতোষ বাবুর। একসাথে ডিনার, একসাথে রাত্রিযাপন, একসাথে স্বপ্ন দেখা আর হাজারো খুনসুটি, কত কিছুরই সাক্ষী থেকেছে শেষ চার পাঁচটা মাস। বেশ কিছুদিন পর জ্যোৎস্না রাতে ঘরের আলো নিভিয়ে আবারো যখন স্মৃতিচারণ করবেন ভবতোষবাবু, তখন হয়তো ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে নিজের মনে মনে হাসবেন উনি স্বর্ণালীর কথা মনে করে।
ভবতোষবাবু ব্যাচেলার মানুষ। বিয়ে থা করেন নি। একটা ভাড়া বাড়িতে একাই থাকেন। বাজার-হাট, টুকটাক রান্নাবান্না নিজেই করে নেন। বাড়ির অবস্থা খুবই শোচনীয়, দুটো ঘর আগোছালো হয়ে পরে থাকে সবসময়। তার মধ্যে কিভাবে যে ভবতোষ বাবুর দিন গুজরান হয় তা শুধু উনিই জানেন। আর রান্নাঘর, বাথরুম! সেসবের অবস্থা তো আরোই তথৈবচ। শুধু যত্ন পায় একটা শো-কেস। যত্ন করে তাতে ট্রফি, মেডেল, সার্টিফিকেট রাখা আছে। সকালে, বিকেলে রোজ শো-কেসের কাঁচটা, ট্রফিগুলো উনি মোছেন। ওনার সারাজীবনের সঞ্চয় বলতে তো ওই পুরস্কারগুলোই শুধু।
সেদিনটায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বছর পঁচিশের একটা মেয়ে পুরো চপচপে ভিজে উল্টোদিকের বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখছিলেন ভবতোষবাবু। রাস্তার চলন্ত গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলো মেয়েটির মুখে বারেবারে পরে মেয়েটির মুখের অসহায়তা, দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট করছিল।
ওমা! বলা নেই, কওয়া নেই। হঠাৎ দৌড়ে মেয়েটা ঘরে ঢুকে এলো।
- জিজ্ঞেস না করেই ঢুকে এলাম। এত বৃষ্টি হচ্ছে আসলে।
- ইয়ে মানে ভালো করেছেন।
- করেছেন কি!! করেছ বল। আপনি ঠাপনি আমার পোষায় না আবার।
- ও, আচ্ছা! হ্যাঁ, মানে ভালো করেছ।
- তুমি কিরকম মানুষ হে! একটা মেয়ে এরম চপচপে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে। আর তুমি তাকে একটা তোয়ালেও দিচ্ছ না! বলিহারি তোমায়।
- হুমম, তাই তো। এসো ঘরে।
জানলা দিয়ে বৃষ্টির জলের ছিটা গায়ে আসছে। তাতে কি! ভবতোষবাবু কল্পনার তুলি দিয়ে তখন তো নতুন গল্প বোনা শুরু করেছেন রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে। মেয়েটি কখন বাসে উঠে চলে গেছে তা খেয়ালও করেননি ভবতোষবাবু। বরং কল্পনার রঙে মেয়েটি তখন তোয়ালে দিয়ে গা হাত পা মুছে ভেজা চুলে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
আর দেরি করলেন না ভবতোষবাবু। তার নতুন উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন। মেয়েটির নাম কল্পনা করে নিতেও দেরী করলেন না। নাম দিলেন স্বর্ণালী। কলমের আঁচড়ে স্বর্ণালীর নানাবিধ চরিত্র ফুটে উঠতে থাকল। গল্পের নায়কের নাম দিলেন সুকান্ত। খালি অবাক হয়ে সুকান্ত তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। একজন অচেনা অজানা মেয়ে সুকান্তের আগোছালো ব্যাচেলার লাইফটাকে নতুন রঙে সাজিয়ে তোলে ক্রমশ। নিজের যুবক বয়সের হাজারো না পাওয়া নিজের কলমের আঁচড়েই মেটাতে থাকেন ভবতোষবাবু। কলমের আঁচড়ে বারবার সুকান্তর প্রতি স্বর্ণালীর প্রেম ফুটে উঠতে থাকে। ভবতোষবাবু নিজেই লেখেন, আবার নিজেই সেই গল্পের স্বাদ প্রাণ ভরে গ্রহণ করেন সুকান্ত হয়ে।
একদিন লোডশেডিং! মোমবাতি জ্বালিয়ে গল্প লিখছেন ভবতোষবাবু। স্বর্ণালীর তখন সুকান্তকে বেশ মনে ধরেছে। সুকান্ত সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরেছে, স্বর্ণালী জল নিয়ে এসেছে। কপালে তার বড় গোল টিপ, আটপৌরে শাড়ি পরা।
- ব্যাপার কি গো! শাড়ি ফাড়ি পরে!
হাসল স্বর্ণালী। ইশারা করে সুকান্তকে পেছন ফিরতে বলল। তারপর একটা কালো কাপড় দিয়ে স্বর্ণালী সুকান্তর চোখ বেঁধে দিল পেছন থেকে।
- কি করছ?
- কথা বোলো না।
তারপর সুকান্তকে নিয়ে পাশের ঘরে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেল স্বর্ণালী। চোখের কাপড়টা আস্তে আস্তে খুলল। ঘরে আলো জ্বলছে না। টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বলছে। পাশে একটা কেক, দুটো ওয়াইনের গ্লাস, কাবাব আরো কত কত রকমারী খাবারদাবার।
- ক্যান্ডেল-লাইট ডিনার?
- ইয়েস! সারপ্রাইস!!!
একটা লোডশেডিং যে কখনো ক্যান্ডেল-লাইট ডিনারের শখ সুকান্ত, স্বর্ণালীর মাধ্যমে মিটিয়ে দেবে তা আগে কোনোদিনও ভেবেও দেখেননি ভবতোষবাবু। তাই তো গল্প থেকে বেরিয়ে যখন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ান তখন এসব ভেবে নিজেই মিটিমিটি হাসেন। এই তো পঁচিশে ডিসেম্বরের দিন সুকান্ত স্বর্ণালীকে নিয়ে পার্কস্ট্রিট, প্রিন্সেপ ঘাট ঘুরে বাড়ি ফিরল। ভবতোষবাবুরও মানস ভ্রমণ হয়ে গেল এক-ই সঙ্গে।
পাবলিশার্স বড্ড তাড়া দিচ্ছে আসলে। তাই আজ-ই উপন্যাসে ইতি টানলেন ভবতোষবাবু। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে আছে। একা মানুষ তো। কোনো বন্ধুবান্ধবও তেমন নেই। সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও শত হস্ত দূরে। কোনো নামীদামি পাবলিশার্সও কোনোদিনও যোগাযোগ করেনি। টুকটাক নতুন প্রকাশকদের কাছে নিজের লেখা দিয়ে যতটুকু রোজগার হয় তা দিয়েই কোনোরকমে চালিয়ে নেন। একাকিত্বের আড়ালে তাই হয়তো নিজের গল্পের কিংবা উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথেই নিজেকে জড়িয়ে নিতে, সারাক্ষণ নিজেকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখতে এতটা ভালোবাসেন ।
একখানা সাদা ঢলঢলে জামা পরে ভবতোষবাবু বের হলেন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের কাছে জমা দিতে। খুব বেশি লোক পড়বেন না হয়তো, কিন্তু যারা পড়বেন তারাও তো স্বর্ণালীকে পছন্দ করবেন নিশ্চয়। বড্ড দ্বন্দ্বের মধ্যে পরেছেন ভবতোষবাবু। স্বর্ণালী আর তার একার থাকবে না। আরো কত লোক পড়বেন, হয়তো স্বর্ণালীর প্রেমেও পড়বেন তারা। লেখক হিসেবে নিশ্চুপ থেকে সব কিছু মেনে নিতে হবে ভবতোষবাবুকে। আর যদি তেমন বিক্রি না হয়! তবে তো লেখক হিসেবে হেরে যাবেন। বড্ড অদ্ভুত দোটানা! একদিকে লেখক হিসেবে হেরে যাবার ভয়, আর অন্যদিকে স্বর্ণালীকে জনসমুদ্রের মাঝে হারিয়ে ফেলার ভয়। ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ভবতোষবাবু।
প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি জমা দেবার পর পড়ন্ত বিকেলে ট্রামলাইন ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন তখন ভবতোষবাবু। ঘুম হয়নি তো রাত্রে। বড্ড ক্লান্তি লাগছে। চা খেলে ভালো হয় খুব। বরং চা-পাতা কিনে নেওয়া যাক! বাড়ি গিয়ে নিজে বানিয়ে নেবেন ক্ষণ। চা-পাতার দোকানটা খোলাও আছে!
- দাদা, চা পাতা দিন।
- আসাম না দার্জিলিং?
- যেটার কম দাম। বুঝে দিন না!
আসাম না দার্জিলিং? কি প্রমাণ আছে যে আসাম বা দার্জিলিং থেকেই চা পাতাগুলো এসছে? নিজের মনেই অদ্ভুত প্রশ্ন ভেবে হাসেন ভবতোষবাবু। আচ্ছা! এমন যদি হত! একজন চা পাতা কিনতে এসে সত্যি সত্যি প্রমাণ চাইল আর দোকানদারও সেই ক্রেতাকে সঙ্গে নিয়ে আসাম চললেন। বা! বেশ ভালো একটা পটভূমি হবে কিন্তু নতুন একটা গল্পের, নতুন একটা বন্ধুত্বের গল্পের।