একটি মেয়ে...(পর্ব - এগারো)
একটি মেয়ে...(পর্ব - এগারো)
একটি মেয়ে...
চঞ্চল বাড়ি এসেছে দিন পাঁচেক হলো।আজকে বাড়িতে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান রয়েছে। অনুষ্ঠানটা চঞ্চলকে ঘিরে হলেও, চঞ্চলের কোনো উচ্ছ্বাস নেই। যেন মনে জোর করে নিমপাতা গেলবার মতো অবস্থা।
চঞ্চল শিলিগুড়ি থেকে ফেরার পথেই জানতে পেরেছে বাবা আর জামাইবাবুর এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ। একটা বিষয় খুব খারাপ লেগেছে চঞ্চলের, ওর প্রায় সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে এসেছে তারা, এমন কি বাইকটাও গাড়ির মাথায় তুলে নিয়েছে। বললেও শোনেনি, তারা জানিয়ে দিয়েছে চঞ্চলের আর ওই বাড়িতে থাকা চলবে না, ওদের সব বাড়াবাড়ি চঞ্চলের মেনে নেওয়ার একটিই কারণ ছিল যাতে কোনভাবেই হরকিশোর বাবুদের অপমানিত হতে না হয়। গাড়িতে বসেই বুঝতে পেরেছে ও যা করেছে ঠিক করেছে,কারণ চঞ্চলকে তারা জানিয়েছিল ওই বাড়ির লোকেরা সুবিধাজনক না। চঞ্চল অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করায় জানিয়েছিল,"ওই বাড়ির মেয়ে কুমারী মা হয়েছিল, তাহলে ভেবেই দেখ কেমন পরিবার? আর তোর জামাইদার বন্ধু অর্ণব কথাটি নিজে জানিয়েছে, সেসময় সে ওখানকার আদালতে কর্মরত ছিলো।"
চঞ্চলের জামাইদা বললো " বাবা আমি আগে জানলে ওকে এখানে থাকতে দিতাম না একটা দিনও, ওর দিদিকে পুরোটা জানাইনি। আপনি সেদিন ফোন করে ঠিকানা দিতেই আমার কি মনে হতে অর্ণবকে ফোন করি। তাই ঘটনাটা জানতে পারি।"
" হু, ঠিকই করেছ।... " আরও কিছু বলছিল ওরা, কিন্তু চঞ্চলের সেসব কথা শুনতে ইচ্ছে করেনি।তার সে ইচ্ছে করে চোখ বন্ধ করে নেয়,সারা রাস্তা আর কিছু বলেনি, বলতে ইচ্ছে করছিল না ওর। কি মানসিকতা, একজন মেয়েকে একজন ঠকালো সে নিয়ে কথা নেই, উল্টে মেয়েটারই দোষ ধরছে। তারমানে চঞ্চল কিছুতে বাঁধা দিলেই ওরা হরকিশোর বাবুদের অপমান করতে পিছপা হতোনা, তা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলো।
বাড়িতে পৌঁছেও একই কচকচানি শুরু করছিল সবাই, চঞ্চল বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিতে আর সে বিষয় নিয়ে কথা বলার সাহস পায়নি তারা।
দিন দুই পরে ঘুম থেকে উঠে দেখে দিদির ননদ কেয়া এসে হাজির। বাড়ির সবাই ওকে নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছিলো দেখে চঞ্চল চুপচাপ বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ার জন্য বাইকে বের করছিল । এমন সময় কেয়া সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো " কি মশাই চিনতেই পারছেন না আপনি..?.."
" চিনতে পারবো না কেন? আমি একটু আসছি।"
চঞ্চলের মা এগিয়ে এসে বললো " বারে মেয়েটা আসলো তোর অসুস্থতার কথা শুনে আর তুই চলে যাচ্ছিস।"
" আমি তো সুস্থই আছি মা, আমাকে দেখার মতো তো কিছু নেই। আমার একটা কাজ রয়েছে করে আসি।"
" সে যেখানে যাবি যা, মেয়েটাকে সাথে নিয়ে যা।"
চঞ্চল এবারে বড় বিরক্ত হলো, একেই ওর কিছুই ভালোলাগছে না। এক কেয়াকে ঘেন্না করছে আর আরেক কেয়াকে নিয়ে মাথায় তুলে নাচছে। অদ্ভুত এই সমাজ, চঞ্চল যখন লিভইনে থাকত,তখন যদি ওর বান্ধবী গর্ভবতী হয়ে যেও তখনই সে খারাপ হয়ে যেত, আবার সে মেয়ে যদি বাচ্চাটাকে গোপনে হত্যা করতো তখন সমাজ জানতে পারতো না, ভুলও ধরতো না,খারাপ হতো না মেয়েটা এ সমাজের কাছে। কিন্তু একজন মেয়ে একটা প্রাণকে বাঁচিয়ে ভুল করে ফেলেছে, সমাজের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছে। যে পুরুষটা এতোগুলো মেয়ের জীবন নিয়ে খেললো, তার কোনো দোষই নেই, সে কোনো ঘৃণা পাবেনা কেবলমাত্র পুরুষ হয়ে জন্ম নিয়েছে তাই।
" কি রে বাবু কি ভাবছিস?"
" কি ভাববো? কিছু না। আমার কাজ রয়েছে, তাই যাচ্ছি। আর তাছাড়া আমি একজন অবিবাহিতা যুবতী মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে পারবো না। আমাকে কিছু বলবে না এ সমাজ, কিন্তু কেয়াদের ছাড়েনা এ সমাজ।"
বলে আর কোনো কথা না বলে বেড়িয়ে যায় চঞ্চল। শেষ কথাটা দিয়ে ও যেন এতোদিনের জমে থাকা ক্ষোভ বিক্ষোভ হিসেবে বেড়িয়ে আসে।
ওর কোনো কাজই ছিলো না, বাড়ির পরিবেশটা ওর দমটা বন্ধ করে দিচ্ছিলো। তখন ঘড়িতে এগারোটা হবে, সূর্যের তেমন তেজ নেই, এই সময়টা অফিস স্কুলের চাপ থাকে, চঞ্চল বাইক নিয়ে সোজা একটা পার্কের এসে ঢুকলো, একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজে চুপ করে বসে রইলো। আজকাল ওর পার্কে আসতে ভালো লাগে না, অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা যা অকালপক্ব হয়েছে, যা সব করে। তাদের লজ্জা না লাগলেও যারা দেখে তারা লজ্জায় মরে যায়।
কিন্তু কোথায় যাবে চঞ্চল? নিজের আজন্ম পরিচিত বাড়িটাকেই সে চিনতে পারছেনা।তাছাড়া আগে মন খারাপ হলে, কিছু হলেই দিদি বা বুনুর সাথে কথা বলত। কিন্তু আজকে সবাই ওরা একদিকে হয়ে গিয়েছে, ওদের মতো করে চঞ্চলের ভালো করার জন্য মেতে উঠেছে। চঞ্চলের মনের কথা কেউ বুঝতে পারবেনা, চঞ্চল কি করে বোঝাবে এখন স্বপনে শয়নে একটা মুখই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠে। আগেও তো প্রেম করেছে, লিভইন পর্যন্ত করেছে। কিন্তু কোনো দিনও এমন হয়নি কারো জন্য চঞ্চলের। খালি মনে হচ্ছে কি যেন একটা নেই ওর, কিন্তু কি তা সে জানেনা। এই দুই দিন বাড়িতে থেকে একটা ফোন পর্যন্ত করতে পারেনি হরকিশোর বাবুদের। এমনকি ফোন করে পৌঁছানোর খবর পর্যন্ত দিতে পারেনি। চঞ্চলের খুব লজ্জা লাগছিলো, তারা তো কম করেনি চঞ্চলের জন্য। আর খেয়া, খেয়ার কথা ভাবতেই খেয়ার সারল্যমাখা মুখখানা চোখের ভেসে উঠলো। চঞ্চলের খুব ইচ্ছে করছিল হাতখানি ধরতে,চঞ্চল সম্মোহিতের মতো হাত বাড়ালো ছোঁয়ার জন্য। সামনে হোঁচট খেতেই বুঝতে পারলো নিজের ভুলটা। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পরে ফোন করলো,ফোনটা রিং হতেই কেঁটে দিলো। কেমন একটা সংকোচ ওকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু কারণটা বুঝতে পারলো না। দ্বিতীয়বার ফোনটা করলো, কেটে দিলোনা। ফোনটা সুবলা দেবী ধরলেন। চঞ্চলের গলা শুনে প্রথমেই বললেন " কে চঞ্চল? কেমন আছো বাবা?"
" আমি ভালো আছি.."কথাটা শেষ না হতেই সুবলা দেবী বললেন " পৌঁছে একটা খবর দিলে না, আমার চিন্তায় ছিলাম। তোমাদের কারো ফোন নাম্বার তো নেই আমাদের কাছে।"
চঞ্চল কি বলবে ভেবে পেলো না, শেষে বললো " মাসিমা শরীরটা ভালো ছিলো না। বাড়ির সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই খবর দিতে পারে নি। কিছু মনে করবেন না। "
" না না, কিছু মনে করিনি বাবা। শরীরটা তোমার তো ঠিক ছিলো না, সেটা নিয়েই চিন্তা করছিলাম। এতোটা পথ, শরীর নিতে পারবে কি? তা তোমার বাবা আর জামাইবাবু ঠিক আছে তো, তোমার বাবার তো বয়েস হয়েছে, উনার জন্য চিন্তা হচ্ছিলো, এতোটা পথ এসে বিশ্রাম না নিয়েই চলে গেলেন। " চঞ্চল অভিভূত হয়ে গেল কত ভালো মানুষ উনারা, একজন অপরিচিত মানুষের জন্যও কতটা চিন্তা। আর চঞ্চলের পরিবার ওদের বিষয় না জেনেই কি সব বলছে। চঞ্চল সহজভাবেই উত্তর দিলো " ওরা ঠিক আছে, কাকিমা আছেন কেমন সেটা আগে বলুন, আমি তো অসুস্থ দেখে এসেছি,চিন্তা হচ্ছিলো। "
সুবলা দেবী খুশী হলেন বোঝা গেল, তিনি বললেন" অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে উনি.."
" তাই ভালো খবর তো।"
" হু, আমাদের আর ভালো মন্দ খবর। ভালো কি ভুলতে বসেছি।"
চঞ্চলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যি এই পরিবার কতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে এ সমাজের সাথে, অতীতের সাথে, নিজের মনকষ্টের সাথে। তার উপর সন্তান হারানো যন্ত্রণা। তবুও এই পাষাণ সমাজ এদেরকেই ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে। চঞ্চলের গলাখানিও আর্দ্র হয়ে গেল,সে বললো " এমন করে বলবেন না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে.." কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেল চঞ্চল। সে জানে ঠিক হওয়ার কিছু নেই। কি করেই বা হবে?
" ঠিকের কথা আর ভাবিনা বাবা,আমাদের শুধু বেঁচে থাকা। খালি খেয়া আর পিকলুটাকে নিয়ে চিন্তা হয় জানো। আমাদের আর কি, এখন শুরু মৃত্যুর জন্য দিন গোনা।"
" এমন করে বলছেন কেন? আপনাদের কি এমন বয়েস? অনেক দিন বাঁচবেন আপনারা।"
" জানি বাবা জানি, এতো সহজে আমার নেই। আর কত কি দেখতে হবে কে জানে?"
চঞ্চলের কথাগুলো শুনতে বড্ড খারাপ লাগছিলো। তাই সে কথাটা ঘোরাতে বললো " কাকাবাবুর শরীর ঠিক আছে তো?"
সুবলাদেবী চোখ মুছে বললো " আছে আর কি,এই বয়েসে যতটা ভালো থাকা যায় আরকি।" চঞ্চলের খুব খেয়ার কথা জানতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারলো না।
সুবলা দেবী নিজে থেকেই বললেন " রান্না বসিয়েছি, এখন রাখি বাবা। মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ নিলেও ভালো লাগবে।"
চঞ্চল হ্যাঁ বলে সম্মতি জানালো।
ফোন রেখে চুপ করে বসে থাকলো, মনে মনে চিন্তা করলো। কি করছে এখন খেয়া, নিশ্চয় পিকলুকে খাওয়াচ্ছে, নইলে মায়ের মাথার কাছে বসে রয়েছে।
এমন করে অনেকক্ষণ বসেছিলো, তারপর দেখলো বেশ বেলা হয়েছে। সে তাই বাড়ির পথে রওনা হলো। নিশ্চয় এতোক্ষণে বাড়ির অতিথি নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন।
বাড়িতে পৌঁছাতেই দেখে মা গোমড়া মুখে রয়েছে, চঞ্চলের সাথে কোনো কথা বললো না,দেরির কারণ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলো না। চঞ্চলও কিছু জিজ্ঞেস করলো না,নিজের ঘরে চলে গেল।
তারপর দিন তিনেক কেটে গিয়েছে, চঞ্চল অফিসে একসপ্তাহের ছুটি ম্যানেজ করেছে। চঞ্চল ফিরে যাবে বুঝতে পেরে আরও তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে সবাই, কিন্তু চঞ্চল অনড়, কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি না।শেষে একদিন চঞ্চলের দিদি এসে হাজির, দিদিকে চঞ্চল অসম্ভব ভালোবাসে, আজ পর্যন্ত তার সব ইচ্ছে দিদিই পূর্ণ করেছে। আর ও নিজেও দিদির কথা ফেলেনা। দিদি এসে বললো "ভাই তুই চাস না আমি ভালোভাবে মা হই?"
" কেন এমন কথা বলছ? আমি কি করেছি?"
" তোর চিন্তায় চিন্তায় আমি ঘুমোতে পারিনা, ডাক্তার আমাকে বিশ্রাম নিতে বলেছে।চিন্তামুক্ত থাকতে বলেছে,তার কি জো আছে?"
চঞ্চল দিদির পায়ের কাছে বসেছিলো, এবারে কোলে মাথা রেখে বলল" আমি তো ভালো আছি দিদি, অকারণ চিন্তা করো কেন?"
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দিদি বললো " তুই আমার একমাত্র ভাই, একা একা থাকিস। কি খাস কে জানে? অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলি, তোর পাশে তখন কেউ ছিল না, তোর আপন কেউ। মানে তোর বৌ তোর পাশে থাকলে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম।"
" আবার শুরু করলে বিয়ে বিয়ে, ভালো লাগে না।"
" কেন রে? তুই কি বিয়ে করতে চাস না?"
" আমি কি তাই বলেছি, তবে.. "
" কি তবে? কেয়াকে তোর পছন্দ নয় কি?"
" কেয়াকে নিয়ে আমি কখনো ভেবে দেখিনি।"
" ভাবিস নি, এবার ভেবে দেখ।"
চঞ্চল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো " দিদি আমি যদি এমন একজনকে বিয়ে করি সে কথা বলতে পারেনা, তোমার কি মেনে নিতে অসুবিধা হবে? "
এই কথা শুনে ক্ষেপে উঠলো সে, " ও আমি ঠিক আন্দাজ করেছিলাম, তুই ওই বাড়ির মেয়েটার প্রেমে পড়েছিস,তাই বুঝি কেয়ার মতো মেয়েকে তোর মনে ধরলো না। আমি কোনোদিনও.. " এই কথাটা শেষ না হতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে।চঞ্চল দিদিকে অনেক শান্ত করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। দিদিকে উত্তেজিত হতে দেখে সে দুইহাতে জড়িয়ে ধরেছিলো, নইলে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলো। চঞ্চল দিদিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, হাত ধরে বসে রইলো যতক্ষণ না চোখ খুলে, ডাক্তার এসে সব দেখে যাওয়ার পরেও চুপ করে বসেছিলো। চোখ খুলতেই চঞ্চল বললো " তুই যা বলবি তাই হবে রে দিদি, আমি তোর কথাই শুনবো।"
তার দিন দুই পরে আজ চঞ্চলের আশীর্বাদ, ওর দিদির ননদ কেয়ার সাথে....
_______
চঞ্চলের ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই আশীর্বাদের পরের দিনই শিলিগুড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু চঞ্চলের জামাইদাদা ওর বন্ধু অর্ণবের মারফতে একটা পিজি ঠিক করে দিয়েছে মাস দুয়েকের জন্য। কারণ আড়াই মাস পরে ওর বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গিয়েছে, বিয়ের পরে তো ঘর ভাড়া করতে হবে। চঞ্চল চুপচাপ যে যা বললো করে গেলো, তারপর নিজের ঘরে চলে এলো সোজা। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো, যাতে কেউ আসলে বলতে পারে ওর মাথা ধরেছে। শুয়ে থাকতে থাকতে চোখটা লেগে এসেছিলো, কারণ একটা রাতও ঘুমাতে পারছেনা ও, ঘুমোতে গেলেই দেখতে পাচ্ছে সেই মুখ,যাকে সে দেখেনি বটে, তবে চেনে তাকে,কারণ চঞ্চল জেনেছে সবকিছু। চঞ্চল দেখতে পায় কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কতো কষ্ট চোখেমুখে। চঞ্চল ঘুমোতে পারেনা, উঠে বসে বিছানায়, জল খায়। তাই আজ ক্লান্তিতে চোখ দুখানিতে তন্দ্রা ভর করছিলো। এমন সময় কোমল হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায় চঞ্চলের, সে অস্ফুটে বলে উঠে খেয়া। তারপর সম্বিত ফেরে সে তো বাড়িতে খেয়া আসবে কি করে?
চোখ মেলে দেখে কেয়া( বড়দির ননদ) বসে রয়েছে। চঞ্চল সাথে সাথে উঠে বসে, অবাক স্বরে বলে " আপনি?"
" কেন? কাকে আশা করেছিলে?"
হঠাৎ করে কেয়ার মুখে তুমি শুনে বিরক্ত লাগে চঞ্চলের ,কেয়া তো এতোদিন আপনি বলতো। আজ হঠাৎ তুমি বলছে, চঞ্চল মনে মনে বলে "মানলাম আশীর্বাদ আর আংটিবদল হয়ে গেল আজ। তবে বিয়ে তো হয়নি।"
কেয়া কৌতুকের সুরে বলে " বিড়বিড় করে কার নাম নিচ্ছিলে? মনে হলো তো আমার।"
চঞ্চল কিছু বল্লো না মুখে। তবে বুঝতে পারলো, ও যে খেয়ার নাম করছিলো, তা কেয়া ভেবেছে।
" আজকে আমাদের আশীর্বাদ হয়ে গেল, ভাবা যায় যে মানুষটার সাথে আমি কত ঝগড়া করেছিলাম, তারসাথে বিয়ে হবে। আমি তো ভাবি একসাথে থাকব যখন, তখন কত ঝগড়া হবে।" বলে হাসতে শুরু করে কেয়া।
চঞ্চলের এবার বিরক্তিটা বেড়ে যায়, সে বলে " আমি একটু ঘুমোতে চাই, বড্ড মাথা যন্ত্রণা করছে। " বলে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে। কেয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, সে কতটা আশা নিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্নের নিয়ে কথা বলতে এসেছিলো চঞ্চলকে। এমন করে যে অবজ্ঞা জুটবে বুঝতে পারেনি। সে বড় আদরের, বড় দাদার পরে ও। দাদা বোনকে মাথায় তুলে রাখে। আর বাবা কাকাদের ও একটা মেয়ে। কেয়া ছুটে বাইরে বেড়িয়ে যায়,চোখ ফেঁটে জল আসছিল ওর। তাছাড়া ও তো নিজে আসতে চায়নি,বাড়ির সবাই পাঠিয়েছিল ওকে চঞ্চলের খোঁজে। জোর করে তো বিয়ে হচ্ছে না,দুইজনের দুই বাড়িটা মতেই হচ্ছে সব।
কেয়াকে ওমন করে বেড়িয়ে যেতে বুঝতে পারলো কেয়া কষ্ট পেয়েছে, চঞ্চলের খুব খারাপ লাগলো, সে তো ওমন করে বলতে চায়নি। সবার উপরে বিরক্তিটা ওর উপরে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। কি ভেবে চঞ্চল ঘরের বাইরে বেরোলো। চঞ্চল দেখলো রাগান্বিত মুখে ওর মা আসছে ওর ঘরের দিকে। চঞ্চলের বুঝতে বাকি রইলো না, তাই ওকে কিছু বলার আগে বললো " মা কেয়ারা চলে গিয়েছে? "
" না, তা গেলে তুই খুশী হতিস আমি জানি।"
" না মা সেটা না, মাথাটা বড় যন্ত্রণা করছিলো, যাইহোক সেকথা বাদ দাও। আমি ভাবছি কেয়াকে নিয়ে একটু বাইরে যাব।"
এই কথাটা শুনে ওর মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে, ছেলে যেচে বলছে ওদের পছন্দের মেয়েকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবে। ভালো যাক না। তবে মুখে বললেন " সে না হয় যা, তবে এমন করে সবার সামনে দিয়ে যাওয়াটা দৃষ্টিকটু।"
চঞ্চল সাথে সাথে বললো " তবে থাক।"
চঞ্চলের মায়ের নিজের চালে নিজেরই পরাজিত হওয়ার মতো অবস্থা, তাই তিনি বললেন "আরে থাকবে কেন? যা নিয়ে। তোর তো হবু স্ত্রী বলে কথা।"
তারপর যেতে যেতে বললেন " তুই তোর বাইকটা বের কর, আমি ওকে পাঠাচ্ছি ছোটকে দিয়ে।" ছোট মানে চঞ্চলের বোন। চঞ্চল আর কিছু না বলে ঘরে চলে এলো। পাঞ্জাবীটা আগেই খুলে রেখেছিল, এখন পাজামা ছেড়ে জিন্স আর টিশার্ট পড়ে নিলো। তারপর বাইক বাইরে বের করার প্রায় সাথে সাথেই দেখলো বোনের সাথে কেয়া এসে গিয়েছে, বুঝতে পারলো এতোটা দেরি হওয়ার কারণ। শাড়ি খুলে একটা সালোয়ার পরনে, সালোয়ারটা বেশ চেনা, চাকরি পাওয়ার পরে বোনকে কিনে দিয়েছিল ও।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ইশারা করলো কেয়াকে। " বারে দাদা শুধু বৌদিকেই নিয়ে যাবি, আমি বুঝি ফেলনা। এখুনি এই.."
চঞ্চল বললো " চল, আমি বারণ করিনি।"
সাথে সাথেই ছোট বললো " না না, আমি বাবা কাবাবের মাঝের হাড়টা হতে চাইনা। তোরাই যা।"
এবারে কেয়া মিষ্টি কণ্ঠে বললো " চলো না আমাদের সাথে। "
" না গো তোমরা যাও, আজ নাইট ডিউটি আছে আমার। একটু ঘুমিয়ে নেবো আমি।"
আর কেউ কিছু বললো না, চঞ্চল বেড়িয়ে গেল কেয়াকে নিয়ে।
___________
সপ্তাহ খানেকের উপর হয়ে গিয়েছে চঞ্চল শিলিগুড়িতে এসেছে, যে পিজিতে রয়েছে ও,সেই পিজিটা একজন নেপালী দম্পতির। নিচে ওদের রেস্টুরেন্ট আর উপরে ওরা থাকে, চঞ্চল ছাড়াও দুই তিনজন পেইনগেস্ট রয়েছে। একটা ঘরে দুইজন করে থাকতে হয়। শহরের বেশ জমজমাট জায়গা ওটা। কিন্তু চঞ্চলের ভালো লাগে না। বিশেষত ওর বাইকটা আনা হয়নি, রাখার স্থানে নেই দেখে। এখান থেকে অফিসটা কাছে না, তাই অটো করে যেতে হয়। একটা রাতও ঘুমাতে পারে না চঞ্চল, না সেই মেয়েটা আর আসেনা, তবে খেয়াকে খুব মনে পড়ে।অন্যদিন তো কাজে ডুবে থাকে, তবে ছুটির দিনগুলো কাটতেই চায়না। আগে চঞ্চল ছুটির প্রতীক্ষায় থাকতো,আর এখন ও কাজে ডুবে থাকতেই ভালোবাসে। নইলে একা থাকলেই খালি খেয়াকে মনে পড়ে, খেয়া কি করছে? মনে হয় পিকলুকে পড়াচ্ছে, এখন বুঝি সুবলা দেবীর সাথে কথা বলছে। না কথা বলছে না, আবার অন্য মূহুর্তে ভাবে ওরা তো ঠিক ওদের ভাষায় কথা বলে। যারা ওদের আপনার তারাই বুঝতে পারে। আচ্ছা ওর কথাটি কখনো মনে পড়ে খেয়ার? অকারণেই খুব অভিমান হয় চঞ্চলের।
এমন করেই কাটছিল, একদিন ওর ঘরের রুমমেট, যিনি একজন ব্যঙ্ককর্মী,সে রাজস্থানি। তিনি বললেন " কি করো ভাইয়া, হার রাত দেখি উঠকে বসে আছো। নিন্দ আসে না নাকি?"
চঞ্চল কিছু বললো না, কিবা উত্তর দেবে।এই মানুষটাকে ওর বেশ লাগে, কি আগ্রহ বাংলা শেখার। অবশ্য বছর চারেক আছে বাংলাতে, কিছুটা শিখেছে, ৫০% বাংলা আর ৫০% হিন্দি থাকে। চঞ্চলের শুনতে বেশ লাগে। চঞ্চল বলেছিল সে হিন্দি বোঝে মোটামুটি কাজ চালানোর মতো বলতে পারে, তবুও রাজি হয়নি। তার কথায় "ভাইয়া কব সে বাংলা শিখার কৌশিস করছি, ধংকা কাউকে মিলছে না। আব আপ আছেন আপনার সাথ বলে বলে প্র্যাকটিশ করবো। বহুত মিষ্টি ভাষা আছে এই বাংলা, মালুম হয় ইস বজেসে ইতনা বাঙ্গালী শিংগার হয়। কিশোর কুমার, কুমার সানু, সান.. আউর বহুত আছে।"
" কি ভাউয়া কিউ চুপ আছেন? "
চঞ্চল বললো " এমনই কি আর করবো দাদা।"
" চলুন সাথ মে কোথা সে ঘুমকে আসি।"
চঞ্চলের ইচ্ছে করছিল না, রবিবারগুলো অন্য রকম করে কাটাত ও আগে। এখন খেয়ার কথা ভেবেই কেটে যায়। তবুও আজ কি মনে হতে বললো " চলুন ঘুরে আসি, শুকনা যাবেন?"
" শুকনা, উধার কি আছে? "
" জঙ্গল, ভালো লাগবে আপনার। "
" জঙ্গল? " বলে মুখটা কেমন করে নিলো রাঠোর।
"যাবেন না? ঠিক আছে থাক তবে। "
" নেহি নেহি চলুন, ঘুমে... না না ঘুরে আসি।"
চঞ্চল খুশী হলো। চঞ্চল বললো " আপনার সাথে তো বাড়িওয়ালার বেশ সম্পর্ক, উনার বাইকটা ভাড়া নেওয়ার কথা বলতে পারবেন? ভাড়া আর তেল খরচ আমার। "
কি একটা বসে ভাবলো রাঠোর। তারপর বললো " হু, বল তো সাকটা হু, কিন্তু কুছু যদি মনে করে।"
" বলে দেখুন না, নইলে আশেপাশেই যাব। সবে তো সকাল এগারোটা। এখন বের হলে বিকেলে দেখে চলে আসব।"
" ঠিক আছে, মে মালুম করে আসি দেবে কিনা।"
" আচ্ছা, আমি ততক্ষণে স্নান সেরে নিচ্ছি। আপনার তো স্নান হয়ে গিয়েছে তাই না।"
" হাঁ, ওতো মে শুভা উঠকেই করে নিই, তারপর পুজোকে বাত কিছু খাই।"
" তবে আমি ঝটপট স্নান সেরে নিচ্ছি, এখানে কিছু খেয়ে বেড়িয়ে পড়বো যদি বাইক দেয়। নইলে অন্য কোথাও যাব।"
বলে চঞ্চল স্নানে চলে গেল আর রাঠোর গেল বাইকের খোঁজে।
চঞ্চল এখন শুকনার পথে, পেছনে রাঠোর। হ্যাঁ ভদ্রলোক দোমনা করলেও ভদ্রমহিলা দিতে রাজি করিয়েছেন।তবে ওদের কথা দিতে হয়েছে সন্ধ্যার পূর্বেই ওরা ফিরে আসবে। রাঠোর প্রথমে ভয় পাচ্ছিলো, পরে দেখলো চঞ্চল বেশ ভালো বাইক চালায় চুপ করে গেল।কত কি বলে যাচ্ছে রাঠোর, এতোদিন শিলিগুড়িতে এসেছে, এমন করে ঘুরতে যাওয়া হয়নি। দার্জিলিং মোড়ের কাছে আসতেই বুকের ধুকপুকানিটা কেন জানি বেড়ে যায় চঞ্চলের। কেমন একটা অনুভব হতে থাকে, এতোক্ষণ তো খেয়াকে একটিবার চোখের দেখা দেখার অভিপ্রায়ে এই কাজটা করেছে। চঞ্চল একটু এগিয়ে গিয়ে দিল্লি পাবলিক স্কুলের ওখানে গাড়িটা থামাতে রাঠোর বলল"কি ভাইয়া পৌঁছ গেয়া?"
চঞ্চল কাষ্ঠ হাসি হেসে বললো " না দাদা, এমনি দাঁড়ালাম।"
" তাই বুলেন, হামে তো কই জঙ্গল নেহি দেখ পায়া আশেপাশে।"
চঞ্চল সামনের একটা দোকান থেকে চকলেট কিনতে দেখে রাঠোর হেসে বললো " আপনি বাচ্চাকে তারা চকলেট খান?"
চঞ্চল বললো " নিয়ে নিলাম, সাথে রাখতে দোষ কোথায়। ওদিকে তেমন দোকান নেই।"
এবারে চঞ্চল সোজা শুকনা ফরেস্টের কাছে অর্জুনের বৌয়ের দোকানের কাছে গিয়ে থামলো। পথে আসতে কত প্রশ্ন করছিলো রাঠোর, বড় কথা বলে মানুষটা। কিন্তু চঞ্চল যতটা বুঝতে পেরেছে মানুষটা ভালো, পথে toy train এর রাস্তা দেখে প্রশ্ন করে এতো ছোট ট্রেন লাইনটা কেন? ওটাই যে টয় ট্রেনের রাস্তা এই কথাটা বলাতে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকে রাঠোর। World heritage sight বলে উঠে সে। বেশ লাগছে মানুষটার সঙ্গ।
চঞ্চলকে দেখে অর্জুনের বৌ প্রথমে না চিনলেও পরে পরিচয় দিতে চিনতে পারে, সামান্য কিছু কথা হয়।আরও কিছু বলতো,কিন্তু দোকানে ভীড় দেখে বলতে পারে না কথা।চঞ্চল বাইকটা অর্জুনের বৌয়ের জিম্মায় দিয়ে ফরেস্টে প্রবেশ করে, তার আগে অর্জুন শুনে নিয়েছে কোথায় মিলবে অর্জুনের দেখা।
রাঠোর ওদের কথোপকথন শুনে বললো " ভাইয়া আপ ইধার আচ্ছা সে চিনেন।"
চঞ্চল কিছু না বলে শুধু হাসলো।
বেশীদূর যেতে হলোনা, অর্জুনের দেখা পেয়ে গেল চঞ্চল। চঞ্চলকে দেখে প্রথমে অর্জুন অবাক আর খুশি হলো। তারপর কেমন আছে জিজ্ঞেস করলো। চঞ্চলও কুশল বিনিময় করল। তারপর রাঠোরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো " রাঠোর ভাইয়া আমার একজন দাদা। উনি রাজস্থানের, জঙ্গল তেমন দেখেননি, আজ তুমি দেখিয়ে দাও তো জঙ্গল কতটা সুন্দরী। "
চঞ্চলের কথা শুনে অর্জুন বললো " আপনি থাকবেন তো সাথে?"
" আমি সাথে যাব না তোমাদের, ঘন্টা দুই পরে এখানেই দেখা হবে।"
রাঠোর বললো " আপনি নেহি যাবেন আমার সাথ?"
" আরে চিন্তা করোনা, আমার তো দেখা। একটা কাজ আছে সেটা আমি সেরে নিই।"
অর্জুন কিছু একটা আন্দাজ করে বললো " আপনি চিন্তা করছেন কেন রাঠোর ভাই, উনার কাজ আছে জানি। আপনি আমার সাথে চলেন।"
রাঠোর কিছু বললো না, মুখটা বাংলার পাঁচ করে চলে গেল অর্জুনের সাথে৷
চঞ্চল সোজা খেয়ার বাড়ির দিকে রওনা হলো। বাইকটা নিলো না,কেন কে জানে। বাড়ি যতই এগিয়ে আসলো,ততই ওর পদক্ষেপ মন্থর হতে থাকলো। বাড়ির সামনে এসে বাড়িতে ঢুকতে আর পা এগালোনা। ফিরে চলে যাচ্ছিলো, হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে এসে ওর হাত চেপে ধরলো, দেখলো পিকলু। আজ পর্যন্ত পিকলু ওর কাছে কোনো দিনও আসেনি। আজ ওর হাত ধরতে দেখে অবাক হলো। পিকলুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো চঞ্চল। চঞ্চল চোখ কখন যে ওর অজান্তে ভিজে গিয়েছিল তা চঞ্চল নিজেই জানেনা। পিকলু হঠাৎ ওর চোখ দুখানি মুছিয়ে দিয়ে ইশারায় বললো "কি হয়েছে? "
চঞ্চল কিছু না বলে ওকে বুকে টেনে নিলো। এমন সময় একজনের ডাকে মুখ তুলে দেখে হরকিশোর বাবু, পিকলুকেই খুঁজতে এসে চঞ্চলকে দেখে সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলেন " চঞ্চল তুমি, কেমন আছো। বাইরে কেন? ভেতরে এসো। "
" আমরা ভালো আপনারা?"
" আমরা,আছি আর কি,ওকে ওর মানি খাওয়াচ্ছিলো ,দেখোনা ছুটে বাইরে চলে এসেছে, এখন বুঝেছি তোমাকে দেখেই এসেছে।"
পিকলু তখনও চঞ্চলের হাত ধরে রয়েছে, চঞ্চল ওর হাতে সব চকলেট দিয়ে দিলো।
চঞ্চল বলল " আজ আসি মেসোমশাই, এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই ভাবছি দেখা করে যাই।"
" খুব ভালো করেছ, চলো চলো।"
" আজকে আসি, আমি একা আসিনি,আমার সাথে একজন এসেছে।"
" কই সে?"
" বললো একপাক নাকি ঘুরে নেবে শুকনার জঙ্গলটা।"
" সে তুমি গেলেনা? "
" আমার দেখা, তাছাড়া ভাবলাম দেখা করে যাই। "
হঠাৎ সুবলা দেবীর গলা শোনা গেল, " কি দাদা কার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছ?"
চঞ্চলকে দেখে অদ্ভুত ভাবে বললেন " তুমি?" কেমন একটা শ্লেষ ছিল যেন কথার মধ্যে। তারপর হরকিশোর বাবুর দিকে তাকিয়ে বললো " কি গো বাইরে দাঁড় করিয়ে না রেখে ভেতরে নিয়ে এসো।"
" আজ থাক" বলে চলে যেতে শুরু করলে পিকলু হাত ধরে টানতে শুরু করে। বাধ্য হয়ে চঞ্চলকে বাড়িতে ঢুকতে হয়।
চঞ্চল বসার ঘরে বসতেই সুবলা দেবী বললেন " বিয়ের তো শুনলাম বেশীদিন নেই।"
এই কথাটা শুনে চঞ্চল এতটাই চমকে উঠলো সেটা হরকিশোর বাবুর মতো একটা আত্মভোলা মানুষের চোখ এড়ালো না। তিনি বললেন " কি হলো শরীর খারাপ লাগছে নাকি?"
সুবলা দেবী হেসে বললেন " এখন কি খারাপ লাগতে পারে? খুশীতে থাকবে সবসময়। "
চঞ্চল মাথা নিচু করে নিলো, ওর মনে হতে শুরু করলো চোর চুরি করে ধরা পড়লে যেমন হয় তেমন।
সুবলা দেবী অনুযোগের সুরে বললেন " তুমি আমাদের দিতে পারতে সুখবরটা, তোমার জামাইবাবুর মারফতে দিলে কেন বুঝতে পারলাম না। "
চঞ্চল বুঝতে পারলো দিদি জামাইদাদাকে দিয়ে জানিয়েছে, দিদি হয়তো ভেবেছে খেয়া ওর সাথে সম্পর্ক রয়েছে। দিদি হয়তো বুঝতে পারেনি, সবটা ওর নিজের অনুভূতি।
চঞ্চলকে চুপ থাকতে দেখে হরকিশোর বাবু মনে করেন লজ্জা পেয়েছে চঞ্চল, তাই তিনি বোনকে স্বল্প ধমকের সুরে বলেন, " কি যে বলিস সুবলা, কেউ কি তার নিজের কথা জানাতে পারে লজ্জা লাগে না।"
" তা লাগে বটে,আমারই ভুল। বলছি দাদা স্নানটা সেরে এসো, আমি এখানেই আছি। আর বেলা করলে শরীরটা যে খারাপ করবে।"
হরকিশোর বাবু দোমনা করলেও চঞ্চল যেতে বললো। সুবলা দেবী যেন এই সময়ের প্রতীক্ষা করছিলেন, হরকিশোর বাবু যেতেই তিনি বেশ রূঢ়ভাবেই বললেন " চঞ্চল আমি কি বলেছিলাম আমার খেয়াকে উদ্ধার করো, কিংবা কোনো দিনও তোমার দিকে এগিয়ে দিয়েছি, এমন করেছি বলে তো আমার মনে পড়ছে না। যদি করে থাকি,আমি মন থেকে ক্ষমা চাইছি। বিশ্বাস করো আমরা এমন নই, মানছি একটা দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে আমাদের সাথে। "
চঞ্চল আঁৎকে উঠলো কথাটা শুনে, হয়তো ওর সামনে যমরাজ এলেও এতোটা চমকাতো না। চঞ্চল বললো "মাসিমা আপনি কিসব বলছেন? আপনি আপনাদের কতটা সম্মান করি আপনারা জানেন না।"
" হ্যাঁ তাই তো মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন বুঝেছি আমার বোঝার ভুল ছিল।"
সুবলা দেবী আর কিছু বলতে পারলেন না, উনার গলা আর্দ্র হয়ে এসেছিল।
চঞ্চল হাতজোড় করে বললো "দয়া করে বলবেন আমি কি ভুল করেছি,"
তারপর কি মনে হতে বললো " আমার জামাইদাদা কি বলেছে আপনাদের? বিশ্বাস করেন আমি আপনাদের কোনো বিষয় কিছুই বলিনি, আর খেয়া দেবীর বিষয় আমি যে কোনো দিনও কিছু বলতে পারবোনা, কারণ.. " বলে চুপ করে গেল চঞ্চল।
সুবলা দেবী বললেন " কি কারণ?"
চঞ্চল প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো " আজ কথাটা তোলা থাকুক, কোনো দিনও যদি সময় আসে বলব। আর একটা কথা আমার জামাইদাদা কি বলেছে তা আমাকে বলতে হবে না, আমি আন্দাজ করতে পেরেছি, শুধু এতোটুকুই বিশ্বাস করেন আপনি, আমি এরজন্য দায়ী নই। আমি কিছুই বলিনি। আজ আসি।"
বলে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা বেড়িয়ে গেল। চঞ্চল মনে মনে বললো " এমন করেই, পরিবারের আর বন্ধুদের অহেতুক হস্তক্ষেপে অনেক সম্পর্ক তৈরী হওয়ার আগে শেষ হয়ে যায় আর অনেক স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো তেতো হয়ে যায়।"
বিঃদ্রঃ পরের পর্ব শেষ পর্ব।
।।।

